E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

‘সবাই মিলে করি পণ বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’

২০২৩ জুন ০৪ ১৫:৫৮:২৪
‘সবাই মিলে করি পণ বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ’

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


সোমবার ৫০ তম বিশ্ব পরিবেশ দিবস ২০২৩। জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে পরিবেশ সচেতনতার লক্ষ্যে প্রতি বছর বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১০০টিরও বেশি দেশে ৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে পালন করা হয়। ২০২৩ সালের প্রতিপাদ্য বিষয় "সবাই মিলে করি পণ, বন্ধ হবে প্লাস্টিক দূষণ।" ১৯৬৮ সালের ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায় সুইডেন সরকার। চিঠির বিষয়বস্তু ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণ সম্পর্কে তাদের গভীর উদ্বেগের কথা। সে বছরই জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি সাধারণ অধিবেশনের আলোচ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পরের বছর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা এবং সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্যরাষ্ট্রগুলোর সম্মতিতে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে ১৯৭২ সালের ৫ থেকে ১৬ জুন জাতিসংঘ মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি পায়। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ 'বিশ্ব পরিবেশ দিবস' হিসেবে ঘোষণা দেয় ১৯৭৪ সালে।পরিবেশ নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা চলছে যুগ যুগ ধরে আর আমাদের চারপাশের জলবায়ু, গাছপালা, মাটি, অন্যান্য প্রাণী, মানুষ, জৈব ও অজৈব সমস্ত কিছু নিয়েই আমাদের পরিবেশ৷ পৃথিবীর পরিবেশ জীব বিকাশের পক্ষে অনুকূল বলেই এই পৃথিবীতে মানুষের বাস৷ অথচ সৌরজগতের আর কোথাও বা বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোথাও এখন মানুষ জীবের সন্ধান পাচ্ছে না৷ হয়তো বিশ্বব্রহ্মান্ডের কোথাও না কোথাও জীব আছে৷ হয়তো, দূরবর্তী কোনো নক্ষত্রের সংসারে৷ যেমন এ সূর্যের সংসারে পৃথিবী-এমনি কোনো পৃথিবী আছে সেখানে হয়তো মানুষ আছে, কিন্তু এখনো আমাদের বিজ্ঞানীদের জানার বাহিরে৷ তাই এখন আমরা বলতে পারি, এ সুবিশাল বিশ্ব ব্রহ্মান্ডে একমাত্র পৃথিবীর পরিবেশ মনুষ্য বসবাসপোযোগী৷ এর বাইরে মানুষের বাঁচবার বেড়ে ওঠবার কোন স্থান নেই৷

কিন্তু আমাদের অবিমৃশ্যকারিতার জন্যে এই পৃথিবীর পরিবেশ ক্রমশইঃ দূষিত হয়ে যাচ্ছে-মনুষ্যবাসের অনুপযোগী হয়ে যাচ্ছে৷

জল দূষণ,বায়ূদূষণ,মাটি দূষণ, সবকিছুকেই আমরা দূষিত করে চলেছি৷ কারখানার বিষাক্ত বর্জ্যপদার্থ, মানুষের দৈহিক বর্জ্যপদার্থ- মল-মুত্র, পচা-গলা পশুদেহ বা মনুষ্য দেহ- এসবই নিয়মিত জলকে দূষিত করছে৷ পতিত পাবনী গঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার জন্যে এখন ‘মাষ্টার প্ল্যান’ নিতে হচ্ছে৷ কিন্তু কাজ খুব একটা এগুচ্ছে না৷

গাছপালা বায়ুতে অক্সিজেনের জোগান দেয়, বায়ুর ধূলা, ধোঁয়া প্রভৃতি শুষে নেয়, বৃষ্টি ঘটায়৷ কিন্তু মানুষ অতিলোভের বশবর্তী হয়ে বনজঙ্গল দ্রুত ধবংস করছে ও নানান পশুপাখীও ধবংস করছে৷ এই পশুপাখীরাও প্রাকৃতিক ভাবে পরিবেশকে দূষণ মুক্ত রাখতে সাহায্য করে৷ আমাদের রসনাকে পরিতৃপ্ত করতে পশুপাখী মেরে খেয়ে ফেলছি৷ যার ফলে আসলে আমরা নিজেদের সভ্যতার মূলেই কুঠারাঘাত করছি৷

মূলতঃ আমাদের দোষেই বিশ্বের উষ্ণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে৷ বায়ুদূষণ বাড়ছে৷ তার সঙ্গে আমাদের অতিলোভের ফলে খাদ্যে দূষণ , পানীয়ে দূষণ৷ কিছুই প্রায় দূষণমুক্ত নয়৷ ফলে নানান কঠিন কঠিন ব্যাধি জন্ম নিচ্ছে৷

এসবের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৭২ সালে সম্মিলিত রাষ্ট্রপুঞ্জের উদ্যোগে ষ্টকহোমে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা সম্মিলিত হয়ে এই সমস্যার থেকে বাঁচবার জন্যে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন৷ পরিবেশ দূষণ বিশ্বের সমস্ত মানুষের কাছে বিপদ ডেকে আনছে৷ তাই একে মোকাবিলা করার জন্যে বিশ্বের সব রাষ্ট্রকে তথা বিশ্বের সমস্ত জনসাধারণকে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে৷ সেই বিশ্ব সম্মেলনে পরিবেশ সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করে তোলবার জন্যে প্রতিবছর ৫ই জুনকে ‘পরিবেশ দিবস’ হিসাবে পালন করতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে৷ ৫ই জুন ‘পরিবেশ দিবস’ হিসাবে পালন করা হয়৷ এই দিনে বিভিন্ন মিটিং, মিছিল, আলাপ-আলোচনা ও কর্মসূচীর মাধ্যমে এই দিবসটি পালন করা হয়৷

পরিবেশকে বিশুদ্ধ করার জন্যে আমাদেরকে সংকল্প নিতে হবে, আর বন, সেই থেকে প্রতি বছর ধবংস নয়, বরং বনসর্জন চাই৷ সেক্ষেত্রে নিতান্ত যদি প্রয়োজনে কোনো একটি গাছ কাটতেই হয়, তাহলে তার পরিবর্তে যেন দশটি গাছ লাগাই৷ এছাড়াও প্রতি বছর ব্যাপকভাবে গাছ লাগানোর পরিকল্পনা নিতে হবে৷ জল পরিবেশের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় উপাদান ৷ বলা হয় জলের অপর নাম জীবন৷ জল পানীয়ের জন্যেও যেমন প্রয়োজন, কৃষিকার্যের জন্যেও জল প্রয়োজন৷ আমাদের পানীয় জলের অভাব মেটাতে ও কৃষিকার্যের জন্যে আমরা সহজে ভূগর্ভ থেকে জল তুলছি৷

এটা ভবিষ্যতের জন্যে অশনি সংকেত হয়ে দেখা দিচ্ছে৷ তাই মাটির নীচের জলভান্ডারে হাত না দিয়ে প্রকৃতি বৃষ্টিরূপে যে বিপুল জনসম্পদ দান করেন, সে জলকে সংরক্ষণ করতে হবে৷১০০ দিনের কাজের মাধ্যমে বা মানুষকে বৃহত্তর আদর্শে উদ্ধু দ্ধ করে নদী, নালা, খাল-বিলকে সংস্কার করে তাদের জলধারণ ক্ষমতা বাড়াতে হবে৷ তাতে বন্যার প্রকোপও হ্রাস পাবে৷ গ্রামে গ্রামে ব্যাপকভাবে জলাশয় বানাতে হবে৷ ‘জল ধরো, জল ভরো’ -এক শ্লোগানটিকে কেবল রাজনৈতিক শ্লোগান না রেখে যথার্থ ভাবে কাজের কাজ করতে হবে৷ বৃষ্টির জলকেই আটকে রেখে সারা বছরের কৃষিকাজে লাগাতে হবে ও তাকে শোধন করে পানীয় জল হিসাবে ব্যবহার করতে হবে৷মোটকথা মানব সভ্যতার রক্ষার স্বার্থে এই পৃথিবীর মনুষ্যবাসোপযোগী পরিবেশকে রক্ষা করতে হবে৷

সবচেয়ে বড় কথা, যে মানুষ এই পরিবেশ রক্ষা করবে- বিশুদ্ধ করবার মহান দায়িত্ব বহন করবে, সে মানুষের মনকে আগে বিশুদ্ধ করবার চিন্তা করতে হবে৷ কেননা ভালমন্দর সবকিছুর সৃষ্টি আগে মানুষের মনে৷

পরিবেশ দূষণের কারণ

দূষিত পরিবেশের প্রভাবে জীব জগতের স্বাভাবিক বৈচিত্র্য নষ্ট হয় এবং ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। এতে মানুষের জীবনধারা ব্যাহত হয়।

পরিবেশের অপরিহার্য বিভিন্ন উপাদান যেমন – বায়ু, পানি ও শব্দ দূষণের ফলে পরিবেশ সংকট দেখা দেয়। পরিবেশ সংকটে মানব জীবন বিপুল বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে এবং জীব জগতের স্বাভাবিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরিবেশ দূষণের ফলে মানুষের শারীরিক, মানসিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সৃষ্টি হয়।
পরিবেশের উপাদানগুলো দূষণের ফলে নানা রোগ ব্যাধি ছড়ায়। পানি দূষণের ফলে কলেরা, ডায়রিয়া, আমাশয়, টাইফয়েড, চুলকানি ইত্যাদি রোগ হয়। শব্দ দূষণের ফলে হৃদরোগ, মাথাব্যথা, মানসিক সমস্যা ও কানের অসুখ হয়। বায়ু দূষণের ফলে ফুসফুসের অসুখসহ নানা জটিল রোগ দেখা দেয়। এছাড়া মাটি দূষণের ফলে রোগ উৎপাদক বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া বা অনুজীব ছড়ায়। এছাড়া জমির উর্বরতা শক্তি কমে গিয়ে উৎপাদন ব্যাহত হয়। এতে খাদ্য ও অর্থ সংকট দেখা দেয়।

পরিবেশ দূষণের অনেক কারণের মধ্যে নগরায়ন, শিল্পায়ন, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, যান্ত্রিক সভ্যতার বিকাশ, গাছপালা কর্তন, সার ওষুধ কীটনাশকসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার, যেখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ও পশুপাখির মৃতদেহ ফেলা, কলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, গাড়ি কারখানা ও ইটভাটার কালো ধোঁয়া, কার্বন ডাই অক্সাইডের বৃদ্ধি, বনভূমি কমে যাওয়া, নলকুপ স্থাপন, ভূমির অপর্যাপ্ততা, ভূমি ক্ষয়, অপরিকল্পিত চুলা ও জ্বালানি ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্যপরিবেশ দূষণ জনস্বাস্থ্যের হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। গোটা মানবজাতিকে পরিবেশ সংকট বিপন্ন করতে পারে।

পরিবেশ দূষণ রোধ করা অত্যন্ত জরুরি। পরিবেশ দূষণ প্রতিকার করার জন্য যেসব পদক্ষেপ নেয়া একান্ত প্রয়োজন সেগুলো হচ্ছে গণমাধ্যমে বিপন্ন পরিবেশের ভয়াবহতা সম্পর্কে বেশি বেশি প্রচার প্রচারণা চালাতে হবে, গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, কীটনাশকের ব্যবহার কমাতে হবে, বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে, পশুপাখির মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে, ময়লা আবর্জনা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলতে হবে, প্রাকৃতিক বিভিন্ন উপাদান ও সম্পদের সংরক্ষণ, সঠিক ব্যবহার ও ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিতে হবে, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জ্বালানি হিসেবে কাঠ কয়লা তেল ব্যবহার বন্ধ করতে হবে, জনবসতিপূর্ণ স্থানে ইটভাটা বন্ধ করতে হবে ও ইটভাটা অবশ্যই পরিবেশ বান্ধব হতে হবে, পরিবেশের পরিচ্ছন্নতা ও ভারসাম্য রক্ষা করতে হবে।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্য

স্বাস্থ্যই সব সুখের মূল। বাক্যটির যথার্থ প্রচলন রয়েছে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমান অনুযায়ী, পৃথিবীর প্রায় ২৫ শতাংশ মৃত্যুর কারণ পরিবেশগত। বর্তমান সময়ে পরিবেশদূষণের ফলে মানুষ নানা ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছে। এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। এই দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য দরকার দক্ষ মানব সম্পদ। এই পরিপ্রেক্ষিতে বারডেমের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সেসের ডিপার্টমেন্ট অব অকুপেশনাল অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল হেলথ চালু করেছে এনভায়রনমেন্টাল হেলথ অ্যান্ড সেফটি বা পরিবেশ স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিষয়ে স্নাতক। এই বিষয়ের পাঠ্যসূচিতে পরিবেশদূষণ কী কারণে হয়, বিষাক্ত উপাদান কীভাবে আমাদের পরিবেশের সঙ্গে মিশে স্বাস্থ্যের ক্ষতি করে, কীভাবে এই দূষণের প্রভাবগুলো শনাক্ত, প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা যায়—এসব ব্যাপারে সম্যক জ্ঞান দেওয়া হয়। দুর্যোগ মোকাবিলা পদ্ধতিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে পড়ানো হয়।

জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের পাশাপাশি জীববৈচিত্র্য রক্ষা, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, নগর স্বাস্থ্য ও পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, মাটিদূষণ আরও অন্যান্য বিষয় এর পাঠ্যতালিকাভুক্ত। তবে স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখার জন্য যা যা থাকা দরকার তা আছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন অনেক। বিশেষজ্ঞদের মতে, স্বাস্থ্যটা ঠিক রাখার জন্য অনেকগুলো বিষয়ের মধ্যে প্রথমেই যে বিষয়টা প্রয়োজন তা হলো স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ। তবেই বাক্যটার যথার্থতা খুঁজে পাওয়া যাবে। সুন্দর পরিবেশ ভালো থাকার মূলমন্ত্র, যা প্রতিটি নাগরিকের জন্য খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে প্রতিটি নাগরিকের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার নিরাপত্তা বহন করে। কিন্তু আমরা কি সেই পরিবেশ পাচ্ছি? আমাদের চারপাশ বিবেচনা করলে বিষয়টা আজ প্রশ্নের সম্মুখীন। শহর এবং গ্রাম দুই স্থানেই এই প্রশ্ন সমভাবে প্রযোজ্য। জীবনের তাগিদে মানুষ আজ শহরমুখী। সংজ্ঞা যেন এমন স্বল্পপরিসরে অধিক মানুষের বসবাস যেখানে তার নাম শহর। সেখানে নাগরিক সুবিধা চাই থাকুক আর নাই থাকুক। সেটা দেখার বিষয় নয়। একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই পেলেই হলো। সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পাওয়াটা তাদের কাছে এতটা জরুরি বিষয় নয়। আর যেখানে মানুষ খেয়ে-পরে বাঁচার জন্য দৌড়াচ্ছে, সেখানে স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ পাওয়াটা সত্যিই হাস্যকর। তবু কি এর প্রয়োজন নেই? হ্যাঁ অবশ্যই আছে, দেহকে সুস্থ রাখতে হলে বা রাখতে চাইলে এই পরিবেশ ছাড়া বিকল্প কোনো রাস্তা নেই। তবে পরিসংখ্যাটা আমাদের নেতিবাচক সংবাদই বহন করে। কেননা চাকরি সুবাদের হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, শহরের দিকে ধাবিত হওয়া মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে। পরিবেশ দুষণের কারণে কিছু ক্ষতি প্রত্যক্ষভাবে হচ্ছে। যেমন কীটনাশক মেশানো লিচু খেয়ে শিশু মারা গেল বা বিষাক্ত মাছ খেয়ে কেউ অসুস্থ হলেন। আবার কিছু ক্ষতি হচ্ছে দীর্ঘমেয়াদি। যেমন রাসায়নিক বা কীটনাশক মেশানো বা বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারো কিডনি নষ্ট হয়ে গেলো। বা দীর্ঘদিন দূষিত বায়ুতে থেকে ফুসফুসের সংক্রমণে আক্রান্ত হলেন।

শিশুদের বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ব্যাহত এবং স্নায়ুর ক্ষতি

বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দূষণের শিকার দরিদ্র নারী, শিশুরা ব্যাপকভাবে ক্ষতির শিকার হচ্ছে। কারণ তাদের বেশিরভাগই দূষিত এলাকায় বসবাস করেন, যেখানে সীসা দূষণেরও ঝুঁকি রয়েছে এর ফলে শিশুদের বুদ্ধিমত্তা বিকাশে এবং স্নায়ুবিক ক্ষতি হতে পারে।

গর্ভবতী মহিলাদের শারীরিক ক্ষতি, বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন

দূষণের কারণে বাংলাদেশের বছরে ৬৫০ কোটি ডলার ক্ষতি হয় যা মোট জাতীয় উৎপাদন বা জিডিপির প্রায় সাড়ে তিন শতাংশ দূষিত এলাকায় বসবাসের ফলে গর্ভবতী মহিলাদের গর্ভপাত ও মৃত শিশু প্রসবের ঝুঁকি অনেক বেড়ে যেতে পারে। এসব এলাকার দূষিত বায়ু এবং পানির কারণে তার নিজের এবং গর্ভের শিশুর স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

* বায়ু দূষণে চোখ, শ্বাসতন্ত্রের ক্ষতি মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান লরেন্স বের্কলি ন্যাশনাল ল্যাবরেটরি বলছে, রাসায়নিক মিশ্রণ আছে, এমন দুষিত বায়ুর সংস্পর্শে থাকলে চোখ, নাক বা গলার সংক্রমণ বা ক্ষতির কারণ হতে পারে। সেই সঙ্গে ফুসফুসের নানা জটিলতা, যেমন ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া, মাথাব্যথা, অ্যাজমা এবং নানাবিধ অ্যালার্জির সমস্যা দেখা দিতে পারে। বায়ু দূষণের সঙ্গে ডায়াবেটিসের সম্পর্ক দেখতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা।

ক্যান্সার ও হৃদরোগ

দীর্ঘদিন বায়ু দূষণের মধ্যে থাকলে বা এরকম পরিবেশে কাজ করলে ফুসফুসের ক্যান্সার এবং হৃদরোগের দেখা দিতে পারে। এমনকি সেটা মস্তিষ্ক, লিভার বা কিডনির দীর্ঘমেয়াদি সমস্যাও তৈরি করতে পারে।

পানি দূষণের প্রভাব অনেক দীর্ঘস্থায়ী

যুক্তরাজ্যের ওয়াটার পলুউশন গাইড, যারা পানির মাধ্যমে দূষণের মাত্রা কমাতে কাজ করছে, তারা বলছে, পানি দূষণে সাময়িক প্রভাবের তুলনায় দীর্ঘস্থায়ী প্রভাব অনেক বেশি পড়ে। বিশেষ করে শিল্প কলকারখানার বজ্য মানব দেহের জন্য অনেক বেশি ক্ষতিকর। এসব পানি ব্যবহার চর্মরোগ, টাইফয়েড, জন্ডিস বা হেপাটাইটিসের মতো রোগ হতে পারে।

খাদ্যচক্রের মাধ্যমে ক্ষতি

বিজ্ঞানীরা বলছেন, দুষিত পানি বা নদীর ভেতর যেমন মাছ বা প্রাণী থাকে, যেসব ভেজষ উৎপন্ন হয়, দূষণ সেসব প্রাণীর ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। খাদ্যচক্রের মাধ্যমে এসব ক্ষতিকর পদার্থ আবার মানব দেহের শরীরে চলে আসে। ফলে সরাসরি দূষিত পানির কাছাকাছি না থাকলেও, সেসব দুষিত পদার্থ এসব মাছের মাধ্যমে মানব দেহে আসে, যার ফলে ক্রুটি পূর্ণ জন্ম বা ক্যান্সার হতে পারে। এমনকি খাদ্য চক্রের মাধ্যমে মানব শরীরে ঢুকছে সীসা, প্লাস্টিকসহ নানা ক্ষতিকর পদার্থ।

* শব্দ দূষ ণের কারণে হাইপার টেনশন, খাবার থেকে শুরু করে ওষুধ, প্রসাধনীসহ প্রতিটি পণ্য সংরক্ষণে ব্যবহার হয় প্লাস্টিক, যা খাদ্যচক্রের মাধ্যমে আবার মানব শরীরে প্রবেশ করছে
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অফ নয়েজ কন্ট্রোল বলছে, পথের শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে। এমনকি অতিরিক্ত শব্দের পরিবেশে থাকলে শিশুর জন্মগত ক্রুটির তৈরি হতে পারে। শব্দ দূষণের কারণে ব্লাড প্রেশার, শ্বাসের সমস্যা এমনকি হজমের সমস্যার তৈরি হতে পারে।

খাদ্য দূষ ণে কার্যকারিতা হারাচ্ছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ

খাদ্য দূষণের কারণে অন্ত্রের নানা রোগ, লিভার, কিডনি বা পাকস্থলী কার্যকারিতা হারাচ্ছে। গ্যাস্ট্রিক আলসারসহ নানা সমস্যার তৈরি হচ্ছে। কখনো কখনো এসব কারণে ক্যান্সারেরও তৈরি হচ্ছে। শিশুরা ছোটবেলা থেকে এ ধরণের দুষিত খাবার খেলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে বা বৃদ্ধি ব্যাহত হচ্ছে।

রক্ষা পাওয়ার কি উপায়?

পরিবেশ দূষণ এড়ানোর জন্য শুধু সরকার বা কর্তৃপক্ষের দিকে তাকিয়ে থাকলেই চলবে না। নিজেরা আগে পরিবেশ রক্ষার ব্যাপারে সচেতন হতে হবে।''শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে শব্দের কারণে একজনের হাইপার টেনশন, আলসার, হৃদরোগ, মাথাব্যথা বা স্নায়ুর সমস্যা হতে পারে ''আইনের প্রয়োগ তো করতেই হবে, সেই সঙ্গে বায়ু দূষণ যাতে না হয়, পানি বা শব্দ দূষণ না হয়, সে ব্যাপারে আমাদের নিজেদের সতর্ক হতে থাকতে হবে।

> বিশ্ব পরিবেশ দিবসের প্রতিপাদ্য'র বিষয় নিয়ে নিম্নে আলোকপাত করা হয়েছে। প্লাস্টিকদূষণ বিশ্বব্যাপী এক জটিল সমস্যা; যা পরিবেশ, জীববৈচিত্র্য, অর্থনীতি ও মানবস্বাস্থ্যের জন্য এক বিরাট হুমকি। পরিবেশকে বিপন্নকারী পৃথিবীর শতকরা ৫১ ভাগ প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে শুধু এশিয়া মহাদেশের দেশগুলোয়। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, বাংলাদেশে প্রতিদিন প্রায় তিন হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশে যোগ হচ্ছে, যা সব ধরনের বর্জ্যের শতকরা ৮ ভাগ। বাংলাদেশ বিজ্ঞান একাডেমি ও এশিয়ান বিজ্ঞান একাডেমিগুলোর দুদিনব্যাপী আন্তর্জাতিক ওয়েবিনারে প্লাস্টিকদূষণ মোকাবেলায় যেসব সুপারিশ গৃহীত হয় তা হচ্ছে:

১) বিশ্বব্যাপী ও আঞ্চলিক পর্যায়ে প্লাস্টিকদূষণ ব্যবস্থাপনা প্রণীত আইন ও নীতিমালাকে হালনাগাদ করতে হবে; ২) বাংলাদেশে প্লাস্টিকদূষণ ব্যবস্থাপনায় প্রণীত আইনের কঠোর বাস্তবায়ন করতে হবে; ৩) পরিবেশ সুরক্ষা নীতি ও প্লাস্টিকদূষণ নীতিমালাকে সমন্বয় করে আধুনিক জ্ঞানের ভিত্তিতে তা হালনাগাদ করতে হবে; ৪) প্লাস্টিকের দ্রব্যকে বারবার ব্যবহার ও পুনর্চক্রায়ণকে (রিসাইক্লিং) উৎসাহিত করতে হবে; ৫) যদিও আমাদের জীবনে প্লাস্টিকের দ্রব্যের ভূমিকা স্বীকার্য, তবে তা ব্যবহারে সতর্কতা এবং পরিমিতি আবশ্যক; ৬) পরিবেশে সহজে পচনশীল (বায়োডিগ্রেডেবল) প্লাস্টিকের ব্যবহারকে উৎসাহিতকরণ এবং পাটের তৈরি সোনালি ব্যাগ ও অন্যান্য পাটজাত দ্রব্যকে প্লাস্টিকের বিকল্প হিসেবে ব্যবহারে প্রণোদনা প্রদান করতে হবে; ৭) বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করে পলিথিন ও প্লাস্টিকের অন্যান্য দ্রব্যের ব্যবহার সীমিতকরণ এবং পরিবেশ ও মানবস্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

চলুন প্লাস্টিক এড়ানোর কয়েকটি উপায়

বেলুন: বেলুন পচনশীল না।এগুলো প্রানীদেহের ক্ষতি এবং মাটির সাথে মিশে খাদ্য গুনাগুণ নষ্ট করে ফেলে।কিন্তু শিশুদের কাছে বেলুন খুবই আকর্ষনীয় একটি বস্তু।তাছাড়া জন্মদিন বা কোনো অনুষ্ঠানে বেলুন না হলে যেনো চলেই না।কিন্তু বেলুনের পরিবর্তে কাগজের তৈরী পম্পম ব্যবহার করা যায়।পম্পম দিয়ে ঘর সাজালে তা যেমন ঘরের সৌন্দর্য্য রক্ষা করবে তেমনি পরিবেশ বান্ধবও হবে।

ঝুড়ি: আবর্জনা যত্রতত্র না ফেলে ঝুড়ি ব্যবহার করতে হবে।তা নাহলে এই ময়লাগুলোকে নদীর ধারে নিয়ে গিয়ে স্তূপাকারে জমা করা হয়।যা নদীর পানি,মাছ সবকিছুকে নষ্ট করে দেয়। ঢাকার খাল-বিলের দিকে তাকালে দেখা যায় বর্জ্যের ভিড়ে কীভাবে এসব প্রাকৃতিক সম্পদ নষ্ট হওয়ার পথে!

নদীতে ময়লা ফেলা থেকে বিরত থাকা: নদী,পুকুরে,খালে ইচ্চেমতো ময়লা ফেলা থেকে নিজেকে বিরত রাখতে হবে।কারণ এগুলো পানি দূষণ করে এবং মাছগুলো মরে যায়। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বের অর্ধেক জায়গাতেই সমুদ্রের বাসকারী কচ্ছপেরা মারা যায় এইসব প্লাস্টিক,বর্জ্যের কারণে।

ক্লাব কর্মসুচি: স্কুলগুলোতে এই পরিবেশ বান্ধব বিভিন্ন ক্লাব খোলা যেতে পারে। যেখানে পরিবেশ রক্ষা সপ্তাহ, মিটিং, মেলার মতো কর্মসূচি থাকবে।এতে করে শিশুদের মাঝে সচেতনতা বাড়বে,তারা দায়িত্বশীল এবং যত্নবান হবে পরিবেশ যত্নে।

এলাকাভিত্তিক কর্মসূচি: নিজ নিজ এলাকায় এ ধরনের উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। প্রতিবাড়ি থেকে প্লাস্টিক দ্রব্য অপসারণ,প্লাস্টিকের বদলে পরিবেশ বান্ধব অন্যকিছু ব্যবহারে পরামর্শ প্রদান,খতিকারক দিকগুলো তুলে ধরা এভাবে জনসচেতনতা তৈরী করা যেতে পারে।

উপহার: শিশুদের সর্বশ্রেষ্ঠ উপহার খেলনা। কিন্তু এই প্লাস্টিকের তৈরী খেলনা গুলোই যে আমাদের জন্য হুমকি!তাই এমন খেলনা দেয়া যেতে পারে যাতে শিশু খুশিও থাকে আবার পরিবেশ বান্ধবও হয়। যেমন,কোনো কুপন, কার্ড, ঘরে তৈরী কোনো উপহার দেয়া যেতে পারে।

আমাদের মাটি, পানি, বায়ু প্রতিনিয়ত প্লাস্টিক দ্বারা দূষিত হচ্ছে। এছাড়া প্লাস্টিক স্টিরিন নামক ক্ষতিকর পদার্থ নির্গত করে, যা মানবদেহে তৈরি করতে পারে ক্যান্সারের মতো মরণব্যাধি। মোটকথা, প্লাস্টিক পদার্থটি কোনোভাবেই পরিবেশ ও মানবজীবনের জন্য উপকারী নয়। বরং এর ব্যবহারে পরিবেশ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তাতে মাশুল দিতে হবে আমাদেরই।

পরিবেশ বিপর্যয় আইন সমূহ

বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ বিধিমালা-১৯৯৭ (সংশোধনীসহ), পরিবেশ আদালত আইন-২০১০, বাংলাদেশ জীববৈচিত্র্য আইন-২০১৭, পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ব্যবস্থাপনা বিধিমালা-২০১৬, শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা-২০০৬, চিকিৎসা বর্জ্য (ব্যবস্থাপনা ও প্রক্রিয়াজাতকরণ) বিধিমালা-২০০৮, ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩ (সংশোধনীসহ), জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০, মোটরযান আইন-১৯৪০, ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০০৫, পণ্যে পাটজাত পণ্যের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন-২০১০, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন-২০১৩ ইত্যাদি আইন থাকলেও আইনের যথাযথ প্রয়োগ হয় না! পরিবেশ আইনের প্রয়োগ হলে জনসাধারণের মধ্যে যেমন সচেতনতা তৈরি হবে, তেমনি পরিবেশও রক্ষা পাবে।

পরিবেশ আদালত আইনটি বাস্তবসম্মত ও কার্যকর না হওয়ার ফলে পরিবেশ সুরক্ষা করা সম্ভব হচ্ছে না! পরিবেশ আইন-২০১০ অনুসারে দেশের প্রতিটি জেলায় একটি আদালত গঠনের বিধান থাকলেও ৩টি পরিবেশ আদালত (ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট) ও ঢাকায় একটি পরিবেশ আপিল আদালত কার্যকর রয়েছে। ফলে বিভিন্ন জেলার পরিবেশ দূষণের মামলা পরিচালনায় বাদী-বিবাদী উভয়েরই সমস্যা হচ্ছে।

প্রত্যেকটি জেলায় পরিবেশ আদালত না থাকার কারণে ক্ষতিগ্রস্তরা পরিবেশ দূষণ-সংক্রান্ত মামলা দায়ের করতে পারছেন না। আবার পরিবেশ আদালতের সংখ্যা কম থাকায় মামলা নিষ্পত্তি করতে অনেক সময় লেগে যাচ্ছে। দুঃখের বিষয়, বিদ্যমান পরিবেশ আদালত আইনের আওতায় সাধারণ মানুষ দূষণ সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে সরাসরি মামলা করতে পারেন না! তারা শুধু ক্ষতিপূরণের মামলা করতে পারেন। তথ্য মতে, বাংলাদেশে পরিবেশ আদালতগুলোয় বছরে গড়ে মাত্র ৮০টির মতো মামলা দায়ের করা হয়! প্রশ্ন হলো, দেশের অন্য আদালতগুলো যেখানে মামলার ভারে ন্যূব্জ, সেখানে পরিবেশ আদালতে এত কম মামলা দায়ের করা হয় কেন? প্রতিদিন গণমাধ্যমে পরিবেশ দূষণ, অবক্ষয় ও বিপর্যয়ের কথা শোনা গেলেও মানুষ কেন পরিবেশ আদালতের দ্বারস্থ হয় না? এর প্রধান কারণ হলো পরিবেশ আইন সম্পর্কে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতা এখনো সেভাবে গড়ে না ওঠা।

সাধারণত দেখা যায়, পরিবেশ বিপর্যয় ও দূষণকারী ব্যক্তি ধনী, প্রভাবশালী ও ক্ষমতাধর হয়ে থাকেন। অন্যদিকে ক্ষতিগ্রস্ত বা ভুক্তভোগী ব্যক্তি দরিদ্র তথা সাধারণ হওয়ায় অনেক সময় মামলা দায়ের করতে উৎসাহিত হন না। আবার ন্যায়বিচার নিয়েও অনেক সময় সন্দিহান থাকেন! দেখা যায়, মামলা চালনা করার খরচও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির থাকে না! এসব কারণে প্রশ্ন উঠতে পারে, পরিবেশ আদালত কতটুকু জনবান্ধব? আবার পরিবেশ আদালতে অভিযোগকারীকেই সব সাক্ষ্য-প্রমাণ হাজির করতে হয়, যা অভিযোগকারীর জন্য কঠিন কাজ বটে! পরিবেশ আদালতে আবার পরিবেশ-সংক্রান্ত অন্যান্য সব (বন রক্ষা, পানি দূষণ, জীববৈচিত্র্য রক্ষা ইত্যাদি) মামলাও দায়ের করা যায় না। শুধু ইট প্রস্তুত ও ভাটা স্থাপন (নিয়ন্ত্রণ) আইন-২০১৩-এর অপরাধসমূহের বিচার ও ক্ষতিপূরণের দাবি করা যায়। তাই এখন সময়ের প্রয়োজনে পরিবেশ আদালতে পরিবেশগত অধিকার সুরক্ষায় জনসাধারণের আশা-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে পরিবেশ আইন সংশোধন করে সব ধরনের মামলা করার এখতিয়ার ও সবার জন্য উন্মুক্ত করে দিতে হবে। পাশাপাশি পরিবেশ-সংক্রান্ত বিভিন্ন আইন ও বিধিমালার বিষয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এর ফলে নিজেদের আশপাশের পরিবেশ রক্ষার্থে জনসাধারণ সরাসরি ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে।

পরিশেষে বলতে চাই,পরিবেশদূষণের কারণগুলো চিহ্নিত করে তা দূর করার উদ্যোগ নিতে হবে। সরকার, প্রশাসন ও জনগণকে সম্মিলিতভাবে পরিবেশদূষণ রোধে কাজ করতে হবে। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধি যাতে না হয়, সেভাবে সবাইকে অগ্রসর হতে হবে। পরিবেশ ধ্বংস করে এমন দ্রব্য যেমন—পলিথিনের ব্যবহার কমানোর কৌশল গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয় যাতে না হয়, সেদিকে কঠোর দৃষ্টি রাখতে হবে। শিল্প-কারখানা তৈরির সময় পরিবেশ দূষণ হবে কি না তা ভাবতে হবে।

জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। পানিসম্পদ রক্ষার জন্য নদ-নদীর পানিকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। বেশি বেশি গাছ লাগাতে হবে। আমাদের বিশাল সমুদ্রের পরিবেশ নষ্ট হয়ে মৎস্য সম্পদের ক্ষতি যাতে না হয়, তার জন্য কর্মপন্থা এখনই গ্রহণ করতে হবে। পুকুর, বিল, হাওর, হ্রদ ও দিঘির পানির বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নিতে হবে। পাহাড়-পর্বতের ক্ষয়রোধে উদ্যোগ নিতে হবে। জীববৈচিত্র্য বৃদ্ধি করতে হবে।আর আমাদের দেশে পরিবেশ-বিষয়ক আইন আছে। কিন্তু আইনের প্রয়োগ নেই। এ ছাড়া আমরা নিজেরাই পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন নই।

শুধু আইন করে দূষণরোধ করা সম্ভব হবে না। পরিবেশদূষণ রোধ করতে হলে নিজেদেরও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতন হতে হবে। আমরা যদি পাহাড় না কাটি, আমরা যদি যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা না ফেলি, তাহলে পরিবেশ অনেকটা রক্ষা হবে।আর পরিবেশ বিপর্যয় ও মারাত্মক বায়ুদূষণের কারণে সারা দেশে প্রতিনিয়ত অ্যাজমা (হাঁপানি), ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি রোগ (সিওপিডি), ফুসফুসের ক্যানসারসহ মারাত্মক সংক্রামক রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। এসবের মূলে মানুষের কর্মকাণ্ডই প্রধানত দায়ী। যথেচ্ছ বৃক্ষ নিধন, অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, যানবাহনের কালোধোঁয়া, জোরালো শব্দের হর্ন, আবাসিক এলাকায় শিল্প কারখানা ও ইটভাটার অবস্থান, ইত্যাদি পরিবেশকে দূষিত করছে।তাই বিশ্বকে বসবাসযোগ্য করার লক্ষ্যে দূষণমুক্ত বিশ্ব গড়ার অঙ্গিকার নিয়ে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক, পরিবেশ ও স্বাস্থ্য সম্পাদক, সবুজ আন্দোলন কেন্দ্রীয় কার্য নির্বাহী পরিষদ।

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test