E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

১৩ জুন নারী উত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস 

নারী উত্যক্তকরণ বন্ধে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে

২০২৩ জুন ১২ ১৭:১৯:০৮
নারী উত্যক্তকরণ বন্ধে পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সচেতনতা গড়ে তুলতে হবে

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


মঙ্গলবার (১৩ জুন) ‘নারী উত্যক্তকরণ প্রতিরোধ দিবস ২০২৩’। আমাদের দেশে ইভটিজিং বা যৌন হয়রানির মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়ে যাওয়ায় তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করা হয়েছে।  ২০১০ সাল থেকে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নারীর স্বাভাবিক চলাচল, জীবনযাপন অবাধ, সমুন্নত করা ও তাদের অধিকার এবং সম্মান বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এ দিবস পালন শুরু করা হয়।

সভ্যতার সূচনালগ্নে পুরুষের পাশাপাশি নারীর অবদান অনস্বীকার্য। নারীর ভূমিকা সমাজ-সভ্যতার অগ্রযাত্রার ইতিহাসে সমান্তরাল। কিন্তু তারপরও নারীরা প্রতিনিয়ত সহিংসতার শিকার হচ্ছে। বিশেষ করে স্কুল ছাত্রীদের প্রতি বখাটেদের উত্যক্তকরণে নেয়া হয়েছিল তাগিদ ও কর্মসূচি। এর পরের বছরও দিবসটি সবার মাঝে আলোড়ন তোলে। কিন্তু চলতি বছর এই বিশেষ এবং প্রয়োজনীয় দিবসটি ঘিরে উল্লেখযোগ্য কোনো কর্মসূচি নেয়া হয়নি।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এ বিষয়ে স্বতন্ত্র আইন প্রণয়ন ও তা প্রয়োগের জন্য সচেষ্ট হয়ে ব্যাপক কর্মসূচি নিয়ে থাকে। প্রাথমিক পর্যায়ে প্রণয়ন করা আইনটি একটি আলাদা আইন হিসেবে দেখানো হলেও পরবর্তীকালে সেটা নারী নির্যাতন আইনের আওতায় অন্তর্ভূক্ত করা হয়।

বিভিন্ন জাতীয় পএিকার রিপোর্ট অনুযায়ী জানাগেছে, ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া সত্ত্বেও ২০২০ সালের চেয়ে ২০২১ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুন। কন্যা শিশু ধর্ষণের সংখ্যা বেড়েছে ৭৪.৪৩ শতাংশ। ২০২০ সালে শিশু ধর্ষণের সংখ্যা ছিল ৬২৬ আর ২০২১ সালে বেড়ে ১ হাজার ১১৭ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে একক ধর্ষণের শিকার ৭২৩ জন, দলবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয় ১৫৫ জন, প্রতিবন্ধী শিশু ১০০ জন এবং অন্যান্য ১৩৯ জন কন্যাশিশু ধর্ষণের শিকার হয়।২০২২ সালে ৫৪২ জন শিশু-কিশোরী ধর্ষণ এবং ৮১ জন সংঘবদ্ধ ধর্ষণের শিকার হয়েছে।

শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে ৩১৬ জন, ৩৭ জনের অস্বাভাবিক মৃত্যু ও ২৮৮ জন শিশু-কিশোরী হত্যার শিকার হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৩১৭ জন শিশু।আর বৈষম্য, যৌন হয়রানি ও নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির সম্মুখীন হয়েছেন এমন ১ হাজার ১৪ জন নারীর সাক্ষাৎকার নেয়া হয়েছে। জরিপে অংশ নেন সারা দেশের বিভিন্ন জেলা ও বিভাগের ১৮ থেকে ৩০ বছর বয়সি নারীরা। দেশের ৬৯.৯২ শতাংশ নারী শারীরিক গঠন নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হচ্ছেন। ৩৭.২৪ শতাংশ নারীকে শরীরের গঠন নিয়ে আত্মীয়রা হেয় করেছে। বন্ধুর কাছে হেয় হয়েছে ২২ শতাংশ। এমনকি পরিবার থেকে এ ধরনের মন্তব্য শুনেছেন বলে জানিয়েছেন ১৪.২৫ শতাংশ।

শারীরিক গঠন নিয়ে পথচারীর কাছ থেকে নেতিবাচক কথা শুনেছেন ১১.৮৫ শতাংশ নারী। ওজনের কারণে নেতিবাচক মন্তব্যের শিকার হতে হয় বলে ৩৯.৪৯ শতাংশ নারী মনে করেন।

গায়ের রঙের কারণেও ৩৬.৯৫ শতাংশ নারী এ ধরনের অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যান। এ ছাড়া উচ্চতা, মুখাবয়বের গঠন, কণ্ঠস্বর প্রভৃতি বিষয় নিয়ে নারীরা বিরূপ মন্তব্য শুনে থাকেন।

২৩.৭৭ শতাংশ নারী সম্মতি ছাড়াই পরিবার থেকে বিয়ের চাপের সম্মুখীন হয়েছেন বলে জরিপে উঠে এসেছে। ৬৫.৫৮ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন বলে জরিপে জানা গেছে।

এর মধ্যে ৩৫.৪৯ শতাংশ নারী বিকৃত যৌন ইচ্ছার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত বা কুদৃষ্টির শিকার হয়েছেন। ২৯.৬২ শতাংশ নারীকে আপত্তিকর স্পর্শের ভুক্তভোগী হতে হয়েছে।

আর বিভিন্ন জায়গায় ইভ টিজিংয়ের শিকার হয়েছেন ২২.২৬ শতাংশ। গণপরিবহণে ৪৫.২৭ শতাংশ নারী যৌন হয়রানির শিকার হন বলে জরিপে উঠে এসেছে।

জরিপ অনুযায়ী, অনলাইনে বিড়ম্বনার শিকার হন ৪৩.৮৯ শতাংশ নারী। এর মধ্যে কুরুচিপূর্ণ মেসেজ পাঠিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলা হয়েছে ৬১.১২ শতাংশকে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের আইডি হ্যাকিংয়ের শিকার হয়েছে ১০.৩৪ শতাংশ। ৯.৮৯ শতাংশ ব্যক্তিগত ও সংবেদনশীল ছবি নিয়ে দুর্ভোগ পোহান। আর পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরের ধর্ষণ মামলার মধ্যে ২০১৮ সালে তিন হাজার ৯৪৯টি, ২০১৯ সালে পাঁচ হাজার ৮৭২টি, ২০২০ সালে ছয় হাজার ৫৫৫টি ও ২০২১ সালে ছয় হাজার ৩৪১টি মামলা করা হয়েছে। এদিকে গত পাঁচ বছরে রাজধানী ঢাকায় তিন হাজার ৪২টি ধর্ষণ মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে নারী দুই হাজার ৪৭০ জন এবং শিশু ৫৭২ জন। ২০২২ সালের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ধর্ষণ মামলা হয়েছে ৫২৩টি। এর মধ্যে নারী ৪৩০ জন এবং শিশু ৯৩ জন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) প্রতিবেদন থেকে এসব তথ্য জানা যায়।ডিএমপির তথ্য মতে, গত পাঁচ বছরে শুধু ঢাকা মহানগরীতে নারী ও শিশু নির্যাতন মামলায় সাজাপ্রাপ্ত আসামির সংখ্যা মাত্র ২৪। তাই যৌন হয়রানির অপরাধ দমনের জন্য কার্যকর আইন প্রণয়ন করে প্রকৃত অপরাধীকে শাস্তি দিয়ে দৃষ্টান্ত স্থাপন একেবারে অসম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্রের আইন শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠানগুলি নারীর নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ হয়েছে। এমনকি তাদের মধ্যে কেউ নিজেরাও নির্যাতনকারীর ভূমিকায় আবির্ভূত হয়েছে। পুরুষাধিপত্বের সুবাদে ও নানা পৃষ্ঠপোষকতায় নির্যাতনকারীরা আইনের সহায়তা লাভ করে বেরিয়ে যাচ্ছে। কখনো ত্রুটিপূর্ণ তদন্ত করে অপরাধীদের বেকসুর খালাস দেয়া হচ্ছে। অথবা ঘটনা ভিন্নখাতে প্রবাহের অপচেষ্টায় লিপ্ত হয়ে অত্যাচারীকে বীরদর্পে ঘুরে বেড়াতে আর নির্যাতিত নারীকে অপবাদের দায়ভার বহন করতে বাধ্য করা হচ্ছে। আবার দেখা যাচ্ছে অপরাধের বিরুদ্ধে সোচ্চার নারীকে ‘মন্দনারী’ হিসেবে চিহ্নিত করে অপপ্রচার চালায়। ফলে অধিকাংশ নারী ‘ভালোনারী’র মডেলভুক্ত হয়ে নিপীড়ন, নির্যাতন মেনে নিয়ে নিশ্চুপ থাকছে। নারীর সীমিত মতা এবং দুর্বলতাই তার অধিকার বঞ্চনার জন্য দায়ী।

ইভটিজিং সঠিক নামকরণ নয়

ইভটিজিং শব্দটি যৌন হয়রানির অমার্জিত ভাষা যা বাইবেলে বর্ণিত প্রথম নারী চরিত্রকে নির্দেশ করে। এখানে ইভের রমনীয় প্রকৃতিকে মুখ্য করে তোলা হয়। ইভকে প্রলুব্ধ করার গুন সম্পন্ন বলে ধরা হয় এবং অন্যদিকে তাকে উত্যক্ত করার জন্য তাকেই দায়ী করা হয়। নারী একাধারে ভিকটিম এবং ভিকটিম হওয়ার কারণ। আর নারীর প্রতি পুরুষের আক্রমনাত্মক প্রতিক্রিয়া অপরাধ না হয়ে স্বাভাবিক বলে গণ্য হয়। ভিকটিম হওয়ার ফলে নারী হয়ে যায় অচ্ছুতের ন্যায়। কারণ তার প্রতি সংঘটিত পাপের জন্য সেই হয় পাপী।

আবার অনেকে মনে করেন ইভটিজিং শব্দটি পাবলিক স্পেসে নারীর প্রতি যৌন হয়রানির শ্রুতিমধুর অভিব্যক্তি। আসলে একে ‘ক্ষতিকারক পরিহাস’ বলে এর আড়ালে পুরুষের যৌন অত্যাচারকে আড়াল করা হয়। যেমন এসিড ছুড়ে নারীর মুখ ঝলসে দেয়ার মত ঘটনার কারণ হিসেবে বলা হয় ‘প্রেমের প্রস্তাবে রাজী হয় নাই’। যৌন নির্যাতন করার কারণ হিসেবে বলা হয় ‘মেয়েটি রাতের বেলা একা একা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিল’। আরও বলা হয় ‘মেয়েটি বেশি অহংকারী’, ‘ছেলেটি একটু রাগী’, ‘মেয়েটি সিনেমা হলের ভীড়ের মধ্যে গিয়েছিল’। কিংবা বলা হয় ‘আজকাল ডিস দেখে দেখে ছেলেমেয়েদের মেজাজ বদল হয়ে যাচ্ছে’ অথবা ‘আজকাল আইন শৃঙ্খলা নাই’। ইভটিজিং বলে যেমন নারীকে দায়ী করা হচ্ছে তেমনি ধর্ষণ শব্দটি না বলে ‘সম্ভ্রমহানি’, ইজ্জতহানি’, ‘শ্লীলতাহানি’, ‘লাঞ্ছিত’ এ সকল শব্দ ব্যবহার করে পুরুষের অপরাধের জন্য নারীকে দোষী করা হচ্ছে। কারণ নারী সম্ভ্রম ও ইজ্জত হারিয়ে অপরাধী হয়ে যান। এভাবে ভিন্ন শব্দের ব্যবহার নিপীড়নকেই প্রশ্রয় দেয় এবং নারীর নিরাপত্তা অনিশ্চিত করে তোলে।

যে সব অপরাধমূলক কাজ ইভটিজিং এর অন্তর্ভুক্ত তা হলো- লম্পট চাহনি, টিটকারী, ব্যঙ্গবিদ্রুপ, ধূর্ততার সঙ্গে নারীর প্রতি অঙ্গভঙ্গী করা, শিষ বাজানো, উস্কানিমূলক তালি বাজানো, গায়ে ধাক্কা দেয়া, সম্মতির বিরুদ্ধে নারীর অঙ্গ স্পর্শ করা বা আঘাত করা, উদ্দেশ্যমূলকভাবে যৌন আবেদনময়ী গাণ গাওয়া, অশ্লীল মন্তব্য করা, হুমকি প্রদান, যৌন অর্থবাহী ছবি অথবা বিডিও দেখানো, নাম ধরে ডাকা, মুঠোফোনে বার বার মিসকল দেয়া, প্রেম ও যৌন সম্পর্ক স্থাপনে চাপ প্রয়োগ করা, প্রতারণা, ভয় প্রদর্শন করে কোন কিছু করতে বাধ্য করা, শিক্ষা, কর্মজীবন ব্যহত করা, অশ্লীল মেসেজ পাঠানো ইত্যাদি। দেখা যায় যে নারীদের দলবেধে পুরুষরা তাদের প্রতি কুৎসিত আচরণ করে, হাসাহাসি, ঠাট্টা মশকরা করে, ধাক্কা দেয়, চিমটি কাটে, জাপটে ধরে কিংবা কাপড় ধরে টানে। আসা যাওয়ার পথে উপর্যপুরি এসব শারিরীক ও মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি গবেষণায় জানা যায় যে বাংলাদেশে ১০-১৮ বছর বয়সী নারীদের ৯০% নিয়মিত ইভটিজিং এর শিকার হন। আক্রমনকারী ধনী, দরিদ্র, শিক্ষিত, অশিক্ষিত, রিক্সাচালক, অফিসের কর্তাব্যক্তি সহকর্মী যে কেউ হতে পারেন। গবেষণায় জানা যায় যে আক্রমনকারীদের ৩২% ছাত্র, ৩৫% অসামাজিক ব্যক্তিবর্গ ও ২৭% মধ্যসয়সী পুরুষ।

ইভটিজিংকে হালকা করে দেখার জন্য বলা হয় যে ‘এসব বখাটে ছেলেদের কাণ্ড’। আরও বলা হয় যে ‘ছেলেরা এসব করে মেয়েদের আকর্ষণ করার জন্য’, ‘মেয়েদের সাজসজ্জা পোশাক উগ্র হওয়ায় ছেলেরা উত্তেজিত হয়’। যাহোক ইভটিজিং পুরুষের জন্য তামাশা হলেও নারীর জন্য যন্ত্রণার কারণ। বলা হয় পুরুষরা নানাবিধ হতাশা থেকে আক্রমনাত্মক হয়ে উঠেন এবং নারীকে উপলে পরিণত করেন। অনেকে এটিকে পুরুষের জীবন চক্রের অংশ বলে মনে করেন- পৌরুষ অর্জনের মাধ্যম।

অন্যদিকে ইভটিজিং এর ফলে আক্রান্ত নারীর উপর জীবন ও কর্ম বিনাশী প্রতিক্রিয়া পড়ে বলে জানা যায়। তা হচ্ছে-

১. কর্মের পরিধি কমে যাওয়া, স্কুলে ফলাফল খারাপ করা, অনুপস্থিত থাকা;

২. চাকরী হারানো, আয় রোজগার কমে যাওয়া;

৩. স্কুলে ছেড়ে চলে যাওয়া, শিা পরিকল্পনা পরিবর্তন করা;

৪. নারীর ব্যক্তিগত জীবন অন্যদের নজরদারির বিষয়ে পরিণত হয়- যখন মানুষজন নারীর পোশাক, সাজ সজ্জা, জীবন যাপন সব কিছু পরীক্ষা করে;

৫. মানুষজনের গালগপ্পের বিষয়ে পরিণত হয়ে আপমানিত হওয়া;

৬. নারীর যৌন অস্তিত্ব মুখ্য হয়ে উঠে- অন্যান্য গুন গৌণ হয়ে যায়;

৭. চরিত্রহনন হয় এবং সম্মান ও মর্যাদা হারায়;

৮. যে পরিবেশে ইভটিজিং এর হয়রানি ঘটে, সে পরিবেশের উপর নারীর আস্থা হারায় এবং ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে;

৯. মানুষের উপর বিশ্বাস হারায়;

১০. ব্যক্তিগত সম্পর্কের সৃষ্টি হয়- এতে বিবাহ বিচ্ছেদ, বন্ধুত্বে ফাটল ও সহকর্মীদের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়;

১১. অন্যরা যেমন ভিকটিমের কাছ থেকে দূরে চলে যায় তেমনি ভিকটিমও নিজেকে গুটিয়ে নেয় একাকীত্বের মাঝে
১২. স্বাস্থ্যগত সমস্যা দেখা দেয়, যেমন- হতাশা, দুশ্চিন্তা, আকারণে ভয় পাওয়া, ঘুম না হওয়া;

১৩. দুঃস্বপ্ন দেখা, লজ্জা পাওয়া, ও অপরাধী ভাবা, মনোযোগ কমে যাওয়া, নেশা করার প্রবণতা, উচ্চ রক্তচাপ, খাদ্যাভাস বদল, ওজন বেড়ে যাওয়া বা কমে যাওয়া, আত্মহত্যার প্রবণতা ইত্যাদি।

আমাদের করণীয়

১. প্রথমে স্বীকার করতে হবে যে যৌন হয়রানি ও নিপীড়ন নারীর মন ও শরীরের উপর কুৎসিত বিভৎস ও বর্বর আক্রমন। এটি মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধ। যৌন নিপীড়নকে আড়াল করে নির্যাতিত নারীকে অপরাধী বানানোর চেষ্টা বন্ধ করতে হবে।

২. নারী নির্যাতনের কারণ যে সমাজ কাঠামোতে নিহিত তা বুঝতে হবে। সমাজে নারীর চলাফেরা, স্বাধীনতা, কর্মকাণ্ড সবকিছু পুরুষ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত গওয়া সঠিক বলে ধরে নেয়া হয়। পুরুষাধিপত্যের কারণে পুরুষরা নারীদের বশ্যতা স্বীকার করার জন্য হুমকি দেন এবং বল প্রয়োগ করেন। কখন অধীনস্ত হিসেবে নারী লাঞ্ছিত হয়? যখন পুরুষ ও নারীর মধ্যে বিরাজ করে অসম মতা সম্পর্ক। নারীদের প্রান্তিকতা দূর করতে হবে।

৩. সমাজে যৌনতা লজ্জাকর বিবেচিত হওয়ায় আক্রান্ত নারীকেই সকলে দোষারোপ করে। ফলে নারী যৌন নিপীড়নের অভিযোগ উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকে। যে কথাটি বলতে মানা যে অপরাধের কথাটি নারীকে বলতে শিখতে হবে।

৪. ইভটিজিং এর মত যৌন হয়রানি করা যত সহজ, তা কোর্টে প্রমাণ করা ততটাই কঠিন। নিপীড়কগণ অনেক নিপুনতার সঙ্গে এই অপরাধ সংঘটিত করে যাতে একে অপরাধ বলে ভ্রম হয়। তবুও নারীবাদী গবেষকগণ একে ‘ষরঃঃষব ৎধঢ়ব’ বা প্রায় ধর্ষণ বলে মনে করেন। এ ধরনের অপরাধের বিচার করার জন্য বিশেষ আইন প্রণয়ন করা জরুরী।

৫. বাংলাদেশে ইভটিজিং এর মত অপবাদের জন্য উপযুক্ত আইন নেই। নতুন আইনী কাঠামোও বিধান কার্যকর করা আবশ্যক। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অডিন্যান্স ১৯৭৬ এর ৭৬ নং অধ্যাদেশ এবং পেনাল কোড ১৮৬০ এর ৫০৯ অধ্যাদেশে মর্যাদাহানি করার জন্য সংঘটিত যে কোন কাজ, আচরণ অথবা মৌখিক উচ্চারণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ। পূর্বের নারী ও শিশু নির্যাতন আইন ২০০০ এর ১০(২) অধ্যাদেশে এ ধরনের অপরাধের বিচারের বিষয় ছিল। কিন্তু ২০০৩ সালে এটি বাতিল করা হয় এই মর্মে যে আইনটির অপপ্রয়োগের আশংকা আছে। নতুন আইনের ৯ নং অধ্যাদেশে বলা হয়েছে যে যদি কারো ইচ্ছাকৃত অসম্মানজনক কাজ, যৌন হয়রানি, কিংবা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের ফলে কোন নারী আত্মহত্যা করেন তাহলে অপরাধীকে সর্বোচ্চ ১০ বৎসর ও সর্বনিম্ন ৫ বৎসর কারাদণ্ড প্রদান করা হবে। কিন্তু ইভটিজিংকে এই ধরনের অপরাধ ভুক্ত করা হবে কিনা তা নিয়ে বিতর্ক আছে। যদিও এই আইনে অপরাধীকে শাস্তি দেবার বিধান আছে তথাপি উল্লেখ্য যে তা কেবল নারী আত্মহত্যা করলেই সম্ভব। মৃত্যুবরণ না করলে একজন ভিকটিম আইনের আশ্রয় থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। যেহেতু অপরাধী আইনের ফাঁক গলিয়ে বের হয়ে যায় এবং ইইনের যথাযথ প্রয়োগ নেই সে কারণে নির্যাতিত নারী অভিযোগ করার ব্যাপারে উৎসাহ হারান।

৬ . শিক্ষাঙ্গনে ও কর্মস্থলে যৌন হয়রানি বন্ধের লক্ষ্যে হাইকোর্ট যে প্রতিমালা প্রণয়ণ করেছে তাতে অভিযোগ কেন্দ্র স্থাপনের বিধান আছে। এই কেন্দ্রের সদস্যদের অভিজ্ঞ, আইন সম্পর্কে ধারণা সম্পন্ন ও নারীর প্রশ্নে সংবেদনশীল হওয়া আবশ্যক। কেন্দ্রটিকে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর ভেতর ক্রিয়াশীল মতার রাজনীতির উর্ধ্বে স্থাপন করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় আইনী সংস্কার করা জরুরী।

৭. লক্ষ্যনীয় যে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী যৌন হয়রানি ও অপরাধ বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান সম্পন্ন না হওয়ায় তারা প্রচলিত পুরুষতান্ত্রিক মতাদর্শ দ্বারা প্রভাবিত হন। অনেক সময় পুলিশও নারী নির্যাতন করেন। জেণ্ডার ট্রেনিং এর মাধ্যমে তাদেরকে দক্ষ করে তোলা প্রয়োজন। অপরাধের অভিযোগ জানানোর জন্য পুলিশ কেন্দ্রে হট লাইন থাকতে পারে। সিভিলিয়ান পোশাকে বিভিন্ন স্থানে নারী ও পুরুষ পুলিশ মোতায়েন করে ইভটিজিং বন্ধের উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

৮. পুরুষাধিপত্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে নারী প্রতিনিয়ত বেঁচে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত হন। নারীর প্রতিরোধের ধরন তাদের প্রতিদিনের লড়াই। যৌন হয়রানি ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা আবশ্যক। এবং তা এখনই শুরু করতে হবে। এখনই আওয়াজ তুলতে হবে। নারীর জন্য রুখে দাড়ানো ব্যতীত বিকল্প কিছু নেই।

ইভটিজিং সমস্যাকে যেকোন ভাবে দমন করতে হবে। এর কারণে একটি মেয়ে মানসিক ও শারীরিক ভাবে তির স্বীকার হবার পাশাপাশি তার পরিবারকেও এ নিয়ে বিপদে পড়তে হয়। ইভটিজিং বিষয়ে সবাইকে সচেতন হতে হবে। এটা প্রতিরোধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে কাজ করতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, নারী একজন মানুষ। তাদের সম্মান করতে হবে একজন মানুষ হিসেবেই। সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে তাদের প্রাপ্য সম্মান দিতে হবে। বন্ধ করতে হবে হয়রানি উত্যক্তকরণ। এ লক্ষ্যে সরকার যে আইন প্রণোয়ন করেছে সে আইন যথাযথ ভাবে প্রয়োগ করতে হবে। বখাটেদের এমন শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে যাতে তা দেখে অন্য বখাটেরাও শুধরে যায়। যাতে কেউ নারীকে অসম্মান করতে সাহস না পায়। সরকারের প্রনীত আইন থেকেও যেটি সব থেকে বড় ভূমিকা পালন করবে নারীদের হয়রানি প্রতিরোধে সেটি হলো সচেতনতা।

নারীর প্রতি হয়রানি বন্ধ করতে সর্বস্তরে সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। নারীকে তার অধিকার তার সম্মান রক্ষায় সচেতন হতে হবে, সাহসী হতে হবে। ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে রাখলে চলবে না। মনে রাখতে হবে যে, তারও দিনশেষে পুরুষের পাশাপাশি সমান ভাবে কাজ করে বেঁচে থাকার অধিকার আছে। অধিকার আছে একজন স্বাধীন রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে কাজ করে স্বাধীনভাবে বেঁচে থাকার। মনে রাখবেন একজন নারী আপনার মা, বোন, এবং আপনার সহধর্মিণী। তাই আসুন আমরা নারীদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test