E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এক মহান ব্রতের নাম রক্তদান

২০২৩ জুন ১৩ ১৬:১৩:১৯
এক মহান ব্রতের নাম রক্তদান

গোপাল নাথ বাবুল


১৪ জুন বিশ্ব রক্তদাতা দিবস। রক্তের চাহিদা পূরণে স্বেচ্ছায় ও বিনামূল্যে রক্ত দান করে যারা লক্ষ লক্ষ জীবন বাঁচাতে ভূমিকা রাখছেন, তাদের উৎসাহ দিতে এবং নিরাপদ রক্ত নিশ্চিতকরণেই ২০০৪ সাল থেকে বিশ্বব্যাপী দিবসটি পালিত হয়ে আসছে। এবার দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারিত হয়েছে ‘গিভ ব্লাড গিভ প্লাজমা শেয়ার লাইফ শেয়ার অফেন।’

প্রতিবছর আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্ব রক্তদাতা দিবসের বিশ্বব্যাপী অনুষ্ঠান পালনের জন্য একটি আয়োজক দেশ থাকে। এ বছর সে ভূমিকা পালন করছে আলজেরিয়া। প্রতিবারের মতো এবারও উক্ত দিবসে সহযোগীতায় এগিয়ে এসেছে সাড়ে চার লক্ষাধিক সুসংগঠিত ডোনার পুল নিয়ে গঠিত কোয়াণ্টাম ফাউন্ডেশন। আমাদের দেশেও নানা আয়োজনে দিবসটি পালিত হচ্ছে।

সভ্যতার ঊষালগ্ন থেকে মানুষ আপদে-বিপদে একে অন্যের পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে। দুঃস্থ মানবতার পাশে এসে দাঁড়ানো এবং দুঃখী জনের দুঃখ-কষ্ট, যন্ত্রণা ও হাহাকার দুর করে মুখে হাসি ফুটানোই হলো মহৎ হৃদয়ের মানুষের স্বভাবজাত ধর্ম। যে কোনো দানকেই মহৎ কর্ম হিসেবে ধরা হয়। বস্ত্রহীনকে বস্ত্রদান, অন্নহীনকে অন্নদান, গৃহহীনকে গৃহদান, তৃষ্ণাত্বকে পানি দান প্রভৃতি পুণ্যার্জনের ক্ষেত্রকে প্রশস্ত করে। কিন্তু মৃতজনে দেহ প্রাণ-এর চেয়ে বড় কর্ম এবং ধর্ম বোধহয় আর কিছুই নেই। মানব জীবনে সবচেয়ে সহজে এবং নিজ কায়িক কোনো উপকরণ দিয়ে পূণ্যার্জনের নাম রক্তদান। এক কথায় যে ব্যক্তি কোনো একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীকে রক্তদান করে প্রাণদানে সাহায্য করেন, তাকে জীবনদাতা হিসেবে অভিহিত করলেও ভুল হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং রক্তদান হলো শুভ চেতনাসম্পন্ন মানুষের কাছে এক মহান ব্রত।

খাদ্য থেকে রস, রস থেকে রক্ত আমাদের শরীরে সঞ্চারিত হয়। মানুষের শরীরে প্রয়োজনের তুলনায় কিছু বেশি রক্ত সংরক্ষিত থাকে। অর্থাৎ একজন প্রাপ্তবয়স্ক সুস্থ মানুষের শরীরে ৪ থেকে ৬ লিটার পরিমাণ রক্ত থাকে। এ সবটা রক্ত কিন্তু তার দেহে পুরোটা দরকার হয় না। প্রতিবার ৪৫০ মিলিলিটার রক্তদান করা হয়। এতে রক্তদাতার তেমন কোনো ক্ষতি হয় না। রক্তদান করার ১/২ ঘন্টা পরে কাজে যাওয়া যায়। প্রতিদিন মানুষের শরীরে রক্ত তৈরি হচ্ছে। তাছাড়া রক্ত কণিকার আয়ু সর্বাধিক ১২০ দিন। উক্ত সময় পরে এমনিতেই দেহের ভিতর এ রক্ত নষ্ট হয়ে যায়। এ অতিরিক্ত রক্তদানের মধ্য দিয়ে যেমন একটি মানুষ পুনর্জীবন লাভ করে তেমনি যে রক্তদান করে তার শরীরও সুস্থ থাকে। মোট কথা, রক্তদান করে একজন মানুষের প্রাণ বাঁচানোর চেয়ে বড় কোনো মহৎ কাজ আর হতে পারে না।
রক্ত হলো মানুষের শরীরের অত্যাবশ্যক সামগ্রী। মানুষের ধমনিতে রক্তপ্রবাহ অবাধ থাকলে দেহ সুস্থ থাকে। রোগভোগের কারণে অথবা দুর্ঘটনায় পড়ে রক্তক্ষরণ হলে শরীরে রক্তের ঘাটতি দেখা দেয়। তা পূরণ করার জন্য রক্তের প্রয়োজন হয়।

রক্তদান নিয়ে অনেকের মনে ভয়-ভীতি কাজ করে। অথচ রক্তদানে শরীরের কোনো ক্ষতি হয় না। শরীর শুকিয়ে যায় না বা শক্তি নিঃশ্বেষ হয়ে যায় না। বরং রক্তদানে শরীরের নানাবিধ উপকার হয়। যেমন-গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে, নিয়মিত রক্তদানের ফলে হার্ট অ্যাটাক, হৃদরোগ ও ক্যান্সারের ঝুঁকি কমে, অস্থিমজ্জার রক্তকণিকা উৎপাদন ব্যবস্থা আরো সক্রিয় হয়, শরীরের অন্তঃস্থলে বোন ম্যারো এবং লোহিত রক্তকণিকা তৈরির হার বাড়ে, হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, দেহে কোলেস্টরেলের মাত্রা কমে, রক্তচাপ বা ব্লাডপ্রেশার অনেকটা নিয়ন্ত্রিত হয়। রক্তদান করলে ক্যালোরি বার্ণ হয় অর্থাৎ প্রতি ৪৫০ মিলি রক্তে প্রায় ৬৫০ কিলোরি বার্ণ করতে পারে। শুধু তাই নয়, কোনো প্রকার খরচ ব্যতীত রক্তদাতার মিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা এবং রক্ত পরীক্ষা হয়ে যায়। ফলে রক্তদাতার শরীরে হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, সিফিলিস, ম্যালেরিয়া, এইচআইভি বা এইডস্ জাতীয় রোগগুলো নীরবে বাসা বাঁধছে কিনা তা জানা যায়। নিয়মিত রক্তদান শরীরের ওজন কমানোর ক্ষেত্রেও বিশেষ ভূমিকা রাখে। তাছাড়া, রক্তদানের ফলে মানুষে মানুষে বন্ধন দৃঢ় হয়ে ওঠে। রক্তদান ধনী-গরীবের বৈষম্য, সাদা-কালোর ভেদাভেদ এবং বিভিন্ন ধর্মীয় ব্যবধান ঘুচিয়ে মানুষকে একই মনুষ্যত্বের সারিতে এনে দাঁড় করায় এবং একজন মানুষের রক্তে অপর কোনো মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর জীবন ফিরে পায়।

তবে সবাই রক্তদান করতে পারে না। রক্তদাতার বয়স ১৮ বছর থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত হতে পারে। ওজন হতে হবে ৪৮ কেজির বেশি। রক্তদাতার হিমোগ্লোবিন পুরুষের ক্ষেত্রে ১২.৫ গ্রাম/ডিএল এবং নারীদের ক্ষেত্রে ১১ গ্রাম/ ডিএল এর কম হতে পারবে না। শ্বাস-প্রশ্বাস জনিত রোগ না থাকলে এবং কোনো রোগে অ্যান্টিবায়োটিক সেবন না করলে রক্ত দিতে পারেন। রক্ত দেওয়ার পর লোহিত রক্ত কণিকার মাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে যেতে কমপক্ষে এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে বলে মনে করা হয়। রক্ত দেওয়ার সময় শরীর থেকে রক্তের পাশাপাশি ২৫০ থেকে ৩০০ মিলিগ্রাম আয়রন কমে যায়। তাই তার ক্ষয় পূরণে আয়রন ও প্রোটিনযুক্ত খাবার বেশি করে খাওয়া উচিত।

পরিশেষে বলা যায়, রক্তদান মানব জাতির জন্য এক মহান সেবাকর্ম। এক ব্যাগ রক্তই একজন মৃত্যুপথযাত্রী রোগীর জীবন বাঁচাতে পারে। তাই সকলের উচিত, সকলের প্রয়োজনে পাশে দাঁড়ানো। কেননা, পরার্থে যারা জীবন উৎসর্গ করে, তারা মহৎ। রক্তদানও এক মহৎ কর্ম। রক্তদানের ভিতর দিয়ে আমাদের ভিতর এক অসাধারণ মানব ঐক্য গড়ে ওঠে। মনুষ্যত্বের এ যুগে রক্তদানের এ মহান ব্রতকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। এজন্য আমাদের সকলকে রক্তদানে এগিয়ে আসতে হবে এবং এ ব্যাপারে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। স্লোগান হোক- রক্তদান জীবনদান/রক্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচান।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test