E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আজ বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস

আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ, প্রবীণদের কষ্টের কোন সীমা নেই 

২০২৩ জুন ১৫ ১৫:৩৭:৪৩
আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ, প্রবীণদের কষ্টের কোন সীমা নেই 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


আজ বৃহস্পতিবার ১৫ জুন ‘বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস ২০২৩’। ২০০২ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) প্রথম প্রবীণ নির্যাতন বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পরবর্তী সময়ে এটিকে বৈশ্বিক সামাজিক সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করা হয় এবং ২০০৬ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইন্টারন্যাশনাল নেটওয়ার্ক ফর প্রিভেনশন অব এল্ডার অ্যাবিউজ (আইএনপিইএ) নামক সংগঠন জাতিসংঘের কাছে ১৫ জুনকে বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস হিসেবে পালনের অনুরোধ জানায়। এরই প্রেক্ষাপটে ২০১১ সালে জাতিসংঘ দিবসটি পালনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে এবং সেই থেকে জাতিসংঘের উদ্যোগে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর এ দিবস পালিত হয়ে আসছে। তবে সব দেশ এখনো সমান গুরুত্ব দিয়ে দিবসটিকে গ্রহণ করতে পারেনি। বাংলাদেশও এই শ্রেণিভুক্ত। সরকারিভাবে দেশে এখনো এ দিবসের কোনো স্বীকৃতি নেই, এটি পালনও করা হয় না। এ কারণে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসের তাৎপর্য এক রকম অজানাই রয়ে গেছে। দিবসটি পালনের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রবীণ নির্যাতন বিষয়ে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করা, সবার মধ্যে এ বিষয়ে সচেতনতা ও জনমত সৃষ্টি করা এবং এই নির্যাতনের বিরুদ্ধে একযোগে সোচ্চার হওয়া।

প্রবীণ নির্যাতন কোনো দেশের একক সমস্যা নয়, বরং এটি একটি বৈশ্বিক সমস্যা। বিশ্বের সব দেশে, সব সমাজেই এর উপস্থিতি রয়েছে বলে জানা যাচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই নির্যাতনের মাত্রা ও ব্যাপ্তি ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বিশ্বের অগণিত প্রবীণের শান্তি, সুখ, মর্যাদা, অধিকারসহ সবকিছু বিপর্যস্ত করে চলেছে, এমনকি এটি অনেক সময় প্রবীণদের মৃত্যুর কারণও হয়ে উঠছে।জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’–এর প্রাথমিক প্রতিবেদন বলছে, দেশে ৬০ বছরের বেশি বয়সী মানুষের সংখ্যা ১ কোটি ৫৩ লাখ ২৬ হাজার ৭১৯। তাঁরা মোট জনসংখ্যার ৯ দশমিক ২৮ শতাংশ। ২০১১ সালের জনশুমারিতে এ হার ছিল ৭ দশমিক ৪৭ শতাংশ। দেশের মানুষের গড় আয়ু বেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা বাড়ছে।

জনশুমারি বলছে, দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কম। অন্যদিকে প্রবীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার বেশি। জাতিসংঘের জনসংখ্যা উন্নয়ন তহবিলের প্রাক্কলন বলছে, ২০২৫–২৬ সালে প্রবীণের সংখ্যা হবে ২ কোটি। ২০৫০ সালে ওই সংখ্যা হবে সাড়ে ৪ কোটি, যা তখনকার জনসংখ্যার ২১ শতাংশ হবে।

ডব্লিউএইচওর মতে, বিশ্বে বর্তমানে প্রতি ৬ জনে ১ জন প্রবীণ নির্যাতনের শিকার, যাঁরা সংখ্যায় ১৪ কোটিরও বেশি। তবে প্রকৃত সংখ্যা যে এর চেয়েও অনেক বেশি, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কারণ, সব সমাজেই প্রবীণ নির্যাতনের বিষয়টি আড়াল করার প্রবণতা রয়েছে; এটি নিয়ে রাখঢাক, লুকোচুরি, নিষেধাজ্ঞা, সর্বত্রই বিরাজমান; এমনকি প্রবীণেরা নিজেরাও পরিবারের মান-মর্যাদা এবং নিজেদের সুরক্ষার কথা চিন্তা করে এ নিয়ে মুখ খুলতে চান না। তাই এর প্রকৃত সত্য কোনো সমাজেই জানা যায় না; জানানোও হয় না। বাংলাদেশের অবস্থা এ ব্যাপারে ভিন্ন কিছু নয়।

দেশে ধর্মীয় ও সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে প্রবীণ মা-বাবাকে সর্বোচ্চ স্থান দেওয়ার রীতি চালু থাকায় প্রবীণ নির্যাতন নিয়ে সমাজে তেমন কোনো উদ্বেগ বা আলোচনা নেই, এমনকি এসব নির্যাতনের অস্তিত্বের কথাও অনেকে স্বীকার করতে চান না। তবে গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমের কল্যাণে সাম্প্রতিক কালে এ ভুল কিছুটা ভাঙতে শুরু করেছে। কয়েক বছর ধরেই বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে এ নির্যাতনসংক্রান্ত ঘটনা বেরিয়ে আসছে। করোনাকালে এ নির্মমতা, নিষ্ঠুরতার আরও নগ্ন রূপ আমরা দেখতে পেয়েছি। গণমাধ্যমে জেনেছি, এ সময়ে নির্যাতন ও অপমান সইতে না পেরে কোনো কোনো প্রবীণ আত্মহত্যার পথও বেছে নিয়েছেন।

প্রবীণ মা-বাবার প্রতি সন্তানদের এ নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা সমাজে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়েরই একটি বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন আমাদের দেশেও মানুষ ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং ভোগবিলাসী হয়ে উঠছে; যে কারণে সন্তানেরা এখন মা-বাবাকে আর পরিবারের অংশ বা পারিবারিক দায়িত্বের অংশ বলে ভাবতে পারে না বা ভাবতে চায় না।
প্রবীণ নির্যাতন বিষয়ে দেশে তেমন কোনো তথ্য নেই। এ কারণে চলমান এ সমস্যার বিষয়ে নিশ্চিতভাবে কিছু জানা যায় না। তারপরও ছোটখাটো যেসব গবেষণা রয়েছে, তা থেকে যেটুকু জানতে পারি, দেশের অধিকাংশ প্রবীণই পরিবারে কোনো না কোনোভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন যার মধ্যে শারীরিক, মানসিক, আর্থিক, আবেগজনিত, ভয়ভীতি প্রদর্শন, অবহেলা, বঞ্চনা, অসম্মান, দুর্ব্যবহার, রূঢ় আচরণ ইত্যাদি রয়েছে। কোনো কোনো গবেষণা বলছে, দরিদ্র পরিবারে আর্থিক ও শারীরিক নির্যাতন বেশি হয় এবং অপেক্ষাকৃত ধনী ও মধ্যবিত্ত পরিবারে মানসিক নির্যাতন বেশি হয়।

তবে প্রায় সবাই একমত, ধনী-দরিদ্রনির্বিশেষে সব পরিবারেই প্রবীণেরা যথেষ্ট অবজ্ঞা, অবহেলা, অসম্মান ও দুর্ব্যবহারের স্বীকার হচ্ছেন। তাঁদের প্রয়োজন, চাহিদা—কোনো কিছুই পরিবারে তেমন কোনো গুরুত্ব পায় না। এ কারণে দৈনন্দিন থাকা-খাওয়া, চিকিৎসাসেবা, ব্যক্তিগত সেবা—সবকিছু নিয়েই তাঁদের অনেক ভোগান্তি পোহাতে হয়। শুধু তা-ই নয়, আয়রোজগারবিহীন এবং সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন হওয়ায় প্রবীণদের অনেক পরিবারেই বোঝা মনে করা হয়। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ও পত্রপত্রিকা থেকেও আমরা দেখতে পাই, আজকাল সন্তান ও নিকটজনেরা কখনো কখনো প্রবীণদের শারীরিক ও মানসিক অক্ষমতাকে জিম্মি করে তাদের অর্থ-সম্পদও করায়ত্ত করে নিচ্ছে। এ কারণে আর্থিকভাবে সক্ষম প্রবীণেরাও কখনো কখনো নিজস্ব সহায়-সম্পদের ওপর নির্ভর করে স্বাধীন ও মর্যাদাপূর্ণ জীবন যাপন করতে পারছেন না।

মোটকথা, প্রবীণ নির্যাতন দেশে পরিচিত বা আলোচিত বিষয় না হলেও এর অস্তিত্ব রয়েছে এবং বেরিয়ে আসা ঘটনা বলছে, এটি সমাজের কোনো বিশেষ শ্রেণির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; ধনী-গরিব, শিক্ষিত-অশিক্ষিত—সব শ্রেণিই কমবেশি এ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সবচেয়ে দুঃখজনক সত্য হলো, এসব নির্যাতনের প্রায় শতভাগই সংঘটিত হয় পরিবারে সন্তানদের দ্বারা, যাদের ওপর প্রবীণ বয়সে মানুষ সবচেয়ে বেশি আস্থা ও ভরসা রাখতে চান। প্রবীণ মা-বাবার প্রতি সন্তানদের এ নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতা সমাজে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয়েরই একটি বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এখন আমাদের দেশেও মানুষ ক্রমান্বয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক, স্বার্থপর এবং ভোগবিলাসী হয়ে উঠছে; যে কারণে সন্তানেরা এখন মা-বাবাকে আর পরিবারের অংশ বা পারিবারিক দায়িত্বের অংশ বলে ভাবতে পারে না বা ভাবতে চায় না।

চোখ যতই বন্ধ করে রাখি না কেন, প্রলয় তাতে বন্ধ হবে না। তাই প্রবীণ নির্যাতন থেকে মুখ ঘুরিয়ে না রেখে এর দিকে দৃষ্টি দিতে হবে। আমরা সবাই জানি, ভবিষ্যতে দেশে প্রবীণের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাবে। দেশে বর্তমানে ৮ শতাংশের মতো লোক প্রবীণ, যাঁরা সংখ্যায় প্রায় দেড় কোটি। জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ বলছে, ২০৩৫ সালের দিকে প্রবীণের অনুপাত বেড়ে হবে ১২ শতাংশের কাছাকাছি এবং ২০৫০ সালে ২০ শতাংশেরও বেশি, যখন প্রবীণের মোট সংখ্যা দাঁড়াতে পারে প্রায় ৪ দশমিক ৫ কোটির মতো। শুধু সংখ্যা বৃদ্ধি নয়, দেশে গড় আয়ু বৃদ্ধির কারণে প্রবীণেরা বার্ধক্য নিয়ে ভবিষ্যতে দীর্ঘ সময় বেঁচেও থাকবেন, ফলে অতি প্রবীণের সংখ্যা (৮০ বছরের ঊর্ধ্বে) যাঁদের প্রায় সবাই কোনো না কোনো রোগব্যাধি বা বার্ধক্যজনিত শারীরিক-মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকেন এবং দৈনন্দিন জীবনযাপনে প্রায়ই অন্যের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন, তাঁদের সংখ্যা প্রবীণদের চেয়ে দ্রুত হারে বৃদ্ধি পাবে।

জনসংখ্যা প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে মোট প্রবীণের সংখ্যা বাড়বে তিন গুণের মতো আর অতি প্রবীণের (৮০ বছরের ঊর্ধ্বে) সংখ্যা বাড়বে ৪ দশমিক ৫ গুণের মতো। জনমিতির এই প্রেক্ষাপট এবং আর্থসামাজিক পরিবর্তনের কারণে ভবিষ্যতে প্রবীণ নির্যাতনের যে আরও বিস্তার ঘটবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই এবং সেটি হতে দিলে সমাজের অনেক ভারসাম্যই ভেঙে পড়তে পারে, এমনকি আমাদের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও এটি বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তাই প্রবীণ নির্যাতন বিষয়ে মুখ খোলা, সমাজে সচেতনতা সৃষ্টি করা, এর প্রতিরোধ-প্রতিকারের বিষয়ে মনোযোগ দেওয়া এবং প্রবীণদের সুরক্ষার বিষয়ে পদক্ষেপ নেওয়া এখন খুবই জরুরি। আর এসব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার একটাই উপায়- কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় প্রবীণদের আনন্দের সঙ্গে বসবাস করার জন্য ‘আনন্দ কেন্দ্র’ গড়ে তুলতে হবে, যেখানে স্বেচ্ছায় প্রবীণরা থাকতে চাইবেন। উপজেলা শহরের কাছাকাছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির ওপর এই ‘আনন্দ কেন্দ্র’ গড়ে তুলতে হবে। সেখানে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, ভালো নার্সিং ব্যবস্থা, ভালো মানের খাবার, বিনোদনের ব্যবস্থা, প্রার্থনার জন্য মসজিদ-মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি।

পরিশেষে বলতে চাই, জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা-২০১৩, পিতামাতার ভরণপোষণ আইন-২০১৩, রাষ্ট্রপতি কতৃক সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা সরাকারের নেয়া গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। সরকার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ৫৭ লাখ প্রবীণকে বয়স্ক ভাতার আওতায় নিয়ে এসেছে। সার্বজনীন পেনশন চালু করার পরিকল্পনা সরকারের বিবেচনায় আছে।তাই প্রবীণ নির্যাতন প্রতিরোধ সচেতনতার জন্য রাষ্ট্র, পরিবার ও সমাজ—সবার দায়িত্ব রয়েছে, তবে প্রবীণদের দেখভাল করার প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে পরিবারের। তাই প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিতের বিষয়টি পরিবার থেকেই শুরু করতে হবে। এজন্য সন্তানদের সেই মূল্যবোধ দিয়ে গড়ে তুলতে হবে এবং প্রতিকারের লক্ষ্যে গবেষণা, শিক্ষা কার্যক্রমে বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত এবং আইন প্রণয়ন করে তা গণমাধ্যমে তুলে নীতিনির্ধারকদের প্রভাবিত করতে হবে। বর্তমানে এটিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ জনস্বাস্থ্য এবং সামাজিক সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করার সময় এসেছে।প্রবীণের ন্যায় বিচারপ্রাপ্তির অধিকার বাস্তবায়নে সংশ্লিষ্ট সবার কার্যকর ভূমিকা পালন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test