E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জগন্নাথদেবের রথযাত্রার তাৎপর্য 

২০২৩ জুন ২০ ১৬:১৯:২৫
জগন্নাথদেবের রথযাত্রার তাৎপর্য 

মানিক লাল ঘোষ



“রথযাত্রা, লোকারণ্য, মহা ধুমধাম,
ভক্তেরা লুটায়ে পথে করিছে প্রণাম।
পথ ভাবে আমি দেব রথ ভাবে আমি,
মূর্তি ভাবে আমি দেব—হাসে অন্তর্যামী।”

রথযাত্রা নিয় কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিখ্যাত পংক্তিমালার তাৎপর্য আমাদের অনেকের অজানা।

রথযাত্রার ইতিহাস কি/, কিভাবে এলো এই রথ? , কার হাত ধরে শুরু হলো এই অপূর্ব যজ্ঞ! এ নিয়ে নানান জনের নানান মত ও তথ্য রয়েছে।

কঠোপনিষদে উল্লেখ আছে

“আত্মানং রথিনং বিদ্ধি শরীরং রথমেব তু।

বুদ্ধিং তু সারথিং বিদ্ধি মন: প্রগ্রহমেব চ।। (১/৩/৩)

এর অর্থ হচ্ছে –

“এই দেহই রথ আর আত্মা দেহরূপ রথের রথী। আর ঈশ্বর থাকেন অন্তরে। তার মানে দাঁড়ায় ঈশ্বর আমাদের অন্তরে থাকেন। তাঁর কোন রূপ নেই। তিনি সর্বত্র বিরাজিত”।শাস্ত্র মতে তাই মানুষের দেহ হচ্ছে রথ এবং ঈশ্বর হচ্ছেন তার সারথি। পরমেশ্বর ভগবান শ্রী জগন্নাথকে দর্শন করলে এই জড় জগতের জন্ম মৃত্যুর আবদ্ধতা ও মায়া মমতা থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব। এই বিশ্বাসকে ধারন করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা রথযাত্রা উৎসব উদযাপন করে আসছে। রথযাত্রা আজ সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে অন্যতম ধর্মীয় উৎসব এবং বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিনত হয়েছে।

প্রতি বছর আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয় তিথিতে আয়োজন কর হয়েছে উৎসবের। এ উৎসবের কেন্দ্রস্থল হচ্ছে ওড়িষ্যা বা ওড়শা রাজ্যের পুরিতে অবস্থিত জগন্নাথ দেবের প্রধান মন্দিরে। এ উৎসব ভারত, বাংলাদেশ ছাড়াও বিশ্বের অনেক দেশে পালিত হয়ে আসছে।

রথযাত্রা হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের (হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের) দেবতা জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার তিনটি সুসজ্জিত মূর্তি রথে চেপে পুরির জগন্নাথদেবের মন্দির থেকে মাসির বাড়িতে গুন্ডিচা যাত্রাকে বোঝায়।
পুরীতে এই রথযাত্রা দেখতে সারা পৃথিবী থেকে লাখ লাখ মানুষের সমাগম ঘটে। জগন্নাথ, বলরাম ও শুভদ্রার গুন্ডিচা মন্দিরে যা জগন্নাথদেবের মাসির বাড়ি হিসেবে খ্যাত সেখানে যাওয়াকে কেন্দ্র করে। রথযাত্রা শুরু হয়। সাত দিন মাসির বাড়ি থেকে পোঙা পিঠা খেয়ে আবার বাড়ির পথে ফিরে আসা যা উল্টো রথ নামে পরিচিত এবং এর মাধ্যমে এ উৎসবের সমাপ্তি ঘটে।

কি ভাবে, কবে থেকে, জগন্নাথদেবের রথযাত্রার প্রচলন তা নিয়ে তা জানতে হলে আমাদের কে ফিরে যেতে হবে মালবদেশ যা বর্তমানে উড়িষ্যা নামে পরিচিত সে রাজ্যের রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। কেননা রথযাত্রার সূচনা হয়েছিলো এই রাজার হাত ধরেই।

পদ্মপুরাণ এর বর্ণনানুযায়ী ও তথ্য মতে এই রাজার হাত ধরেই রথযাত্রার প্রচলন । তখন সত্যযুগ, মালবদেশ এর রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন ছিলেন শ্রী বিষ্ণু ভক্ত। তিনি গড়ে তুলেছিলেন জগন্নাথধাম তথা শ্রীক্ষেত্র নামের এক পবিত্র মন্দির। এই মন্দিরে ছিলো না কোনো বিগ্রহ।একদিন এক সন্যাসীর আগমন ঘটে রাজপ্রাসাদে। রাজার সেবা যত্নে তুষ্ট হয়ে তাকে বললেন নীলমাধব (ভগবান বিষ্ণুর আরেক রুপ) এর গুপ্তভাবে শবরদের মাধ্যমে পূজিত হবার কথা। নীল পর্বতের ধারেই ছিলো শবরদের বসবাস। সন্যাসীর কথা শুনে নীলমাধবের দর্শণের জন্য ব্যাকূল হয়ে গেলেন রাজা। তখন সে ডেকে পাঠালেন তার পুরোহিতের ভাই বিদ্যাপতিকে এবং শবরদের দেশে গিয়ে খুঁজে আনতে বললেন নীলমাধবের মূর্তীকে ।

রাজার আদেশ মেনে বিদ্যাপতি গেলেন শবররাজ বিশ্ববসুর নিকট। সেখানে একবার জঙ্গলের মাঝে বিদ্যাপতি পথ ভুলে যায় ।তখন তাকে উদ্ধার করেন বিশ্ববসুর কন্যা ললিতা। ঘটনা ক্রমে বিদ্যাপতি ললিতার প্রেমে পড়ে গেল । এরপর রাজা দুজনের বিয়ে দিয়ে দিলেন। কিন্তু বিদ্যাপতির মাথার মধ্যে তখনো নীলমাধবের দর্শনের চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছিলো। সে অনেক অনুনয় বিনয়ের মাধ্যমে ললিতাকে রাজি করালো নীলমাধবের দর্শন করানোর জন্য ।কিন্তু ললিতার শর্ত ছিলো যে তিনি বিদ্যাপতিকে চোখ বেধে নিয়ে যাবেন। বিদ্যাপতি গেলেন চোখ বেধে কিন্তু সাথে করে নিয়ে গেলেন যব এর দানা ।

যাবার পথে ললিতার অগোচরে তিনি সেই দানা পথে ফেলতে ফেলতে ফেলেন চিহ্ন হিসেবে। নীল পর্বতে গিয়ে নীলমাধবের দর্শন পেয়ে বিদ্যাপতি ধন্য হলেন। এর পরে তিনি খবর পাঠালেন রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের কাছে। রাজা তার রথ, সৈ্ন্য নিয়ে এলেন নীলমাধবকে নিয়ে যেতে।কিন্তু শ্রীহরির লীলা বোঝা বড় দায়। রাজা পৌছে গিয়ে দেখলেন যে মন্দিরে নীলমাধবের বিগ্রহ নেই। যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন মত রয়েছে কোথায় বলা হয় নীল মাধবে নীজে থেকেই লীন হয়ে যান, আবার কেউ বলে থাকেন যে শবরেরা নীলমাধবের বিগ্রহ লুকিয়ে রেখে দেয়।এতদূরে এসেও নীলমাধবের দেখা না পেয়ে ইন্দ্রদ্যুম্ন হতাশ হয়ে পরেন এবং সিদ্ধান্ত নেন এ জীবন সে রাখবে না। ঠিক এই সময় আকাশ থেকে দৈববাণী শোনা যায়-

“সমুদ্রের জলে ভেসে আসবে দারুব্রহ্ম কাষ্ঠ, সেই কাষ্ঠখণ্ড থেকেই তৈরি হবে বিগ্রহ” (অর্থাৎ নীলমাধবের বিগ্রহ)।

এরপর রাজা চলে আসলেন তার নিজ রাজ্যে। হঠাৎ এক রাত্রে রাজা সপ্নে দেখলেন, ভগবান শ্রী হরি তাকে বলছেন –

“ আমি সমুদ্রে ভাসতে ভাসতে তোমার নিকট আসছি। পুরীর বাঙ্কিমুহান নামক স্থানে তুমি আমাকে দারুব্রহ্ম রূপে পাবে।”

রাজা সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে সেই স্থানে গিয়ে দেখতে পেলেন এক খন্ড কাঠের টুকরা। হাতি সৈণ্য এনেও সেই কাঠ নড়ানো গেলো না। তখন শ্রী হরির স্বপ্নাদেশে খবর পাঠানো হলো শবররাজ বিশ্ববসুকে। তিনি আসার পর বিদ্যাপতি , রাজা ও বিশ্ববসু এই তিনজনে মিলে সেই কাঠের টুকরা নিয়ে এলেন রাজার প্রাসাদে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো সে কাঠ খোদাই করার মত ক্ষমতা কারোর ই ছিলো না ঐ রাজ্যে। হাতুরি বা খোদাই করতে গেলেও তা সম্ভব হলো না। ভেঙ্গে যাচ্ছে বারবার।রাজা আবার চিন্তায় পরে গেলেন। ঠিক তখনি তার কাছে এলেন অনন্ত মহারাণা নামের এক ছুতোর। অনেকের মতে শ্রীহরি নিজেই এসেছিলেন ছুতোর হয়ে আবার মতান্তরে অনেকে বলে থাকেন বিশ্বকর্মা এসেছিলেন ভগবান এর আদেশে।

সে বলল সে এই কাঠ খোদাই করে গড়ে দিবেন নীল মাধবের বিগ্রহ। কিন্তু তার একটি শর্ত হলো ২১ দিনের মধ্যে কেউ এই মন্দিরে প্রবেশ করবে না যতক্ষন পর্যন্ত তার খোদাই এর কাজ শেষ হয়। রাজা রাজি হলে গেলেন।দরজায় পাহাড়া বসল। কিন্তু বিপত্তি বাধালো ইন্দ্রদ্যুম্নের রানী গুণ্ডীচা। তার আর অপেক্ষা মানছিলো না , কাজ শেষ হবার আগেই ১৪ দিনের মাথায় তিনি মন্দিরে প্রবেশ করলেন। মন্দিরে ঢুকে তিনি দেখতে পেলেন এক অদ্ভূত দৃশ্য। সেখানে নেই কোন ছুতোর, অসম্পূর্ণ অবস্থায় জগন্নাথ, বলভদ্র ও সুভদ্রা দেবীর মূর্তি দেখে রানী ভিরমি খেলেন। একি মূর্তি! নীল নবঘন শ্যামল শ্রীবিষ্ণুর এমন গোলাকৃতি নয়ন, হস্ত পদ হীন, কালো মেঘের মতো গাত্র বর্ণ দেখে রানীর মাথা ঘুরতে লাগলো।

রাজা শুনে ছুটে এলেন । রানীর উপরে ক্ষিপ্ত হলেন এবং এও বললেন শর্ত ভঙ্গের কারনে কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই ছুতোর চলে গেছেন।

বিমর্ষ হয়ে পরলেন রাজা। কিন্তু ভক্তের কষ্ট ভগবান সইবেন কেন। সে রাত্রেই রাজাকে আবার সপ্নে দেখা দিলেন। তাকে বললেন তিনি এই রুপেই পূজিত হবেন। তার নিজস্ব কোনো আকার বা আকৃ্তি নেই। ভক্তেরা যে রুপ কল্পনা করে তার আরাধনা করেন তিনি তার কাছে ঠিক তেমন ই। তিনি রাজা ইন্দ্রদ্যুম্ন কে বললেন এই অসম্পুর্ন অবস্থায় ই তিনি পূজো গ্রহণ করবেন এবং তাকে পুরুষোত্তম ধামে স্থাপণ করা হয় যেন এবং সেখানেই তিনি পূজো গ্রহন করবেন।

আর এভাবেই প্রতিষ্ঠা হয় জগন্নাথ দেব এর। জগণ্ণাথ দেব এর এই রুপ নিয়ে কৃষ্ণ যজুর্বেদিয় শ্বেতাশ্বতর উপনিষদের তৃতীয় অধ্যায়ে বলা হয়েছে-

‘‘অপাণিপাদো জাবানো গ্রহীতা

পশ্যত্যচক্ষুঃ স শৃণোত্যকর্নঃ ।

স বেত্তি বেদ্যং ন চ তস্যাস্তি বেত্তা

তমাহুরগ্র্যং পুরুষং মহান্তম্’’ ।।

অর্থাৎ, তার লৌকিক হস্ত নাই, অথচ তিনি সকল দ্রব্য গ্রহণ করেন। তার পদ নাই, অথচ সর্বত্রই চলেন। তার চোখ নাই, অথচ সবই দেখেন। কান নাই, কিন্তু সবই শোনেন। তাকে জানা কঠিন, তিনি জগতের আদিপুরুষ। এই বামনদেবই বিশ্বাত্মা, তার রূপ নেই, আকার নেই। উপনিষদের এই বর্ণনার প্রতীক রূপই হলো পুরীর জগন্নাথদেব। তার পুরো বিগ্রহ তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কারণ তার রূপ তৈরিতে মানুষ অক্ষম। শুধু প্রতীককে দেখানো হয়েছে মাত্র।

জগন্নাথ মন্দিরে প্রান প্রতিষ্ঠা করেছিলেন প্রজাপতি ব্রহ্মা। রথ যাত্রার ইতিহাস সম্পর্কে এইটাই গল্প।

জগন্নাথের প্রধান উত্‍‌সব হল রথযাত্রা। পুরাণ অনুসারে বলা হয়- আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে জগন্নাথ-সুভদ্রা-বলরাম রথে চড়ে রাজা ইন্দ্রদ্যুম্নের পত্নী গুণ্ডিচার বাড়ি যেটাকে বলা হয় জগন্নাথের ‘মাসির বাড়ি’ এবং সাত দিন পরে সেখান থেকে আবার নিজের মন্দিরে ফিরে আসেন। রথে চড়ে ওই গমন ও প্রত্যাগমনকে (সোজা)রথ ও (উল্টো)রথ বলা হয়।

পুরির জগন্নাথদেবের রথযাত্রা অনুসরণে বাংলায় রথযাত্রার সূচনা হয়। চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচল থেকে এই ধারাটি বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। চৈতন্য ভক্ত বৈষ্ণবরা বাংলায় পুরির আদলে রথযাত্রার প্রচলন করেন। রথযাত্রার মাহাত্ম্য সম্পর্কে শাস্ত্রে আছে- ‘রথস্থ বামনং দৃষ্টা পূনর্জম্ন ন বিদ্যতে।’ অর্থাৎ রথের ওপর অধিষ্ঠিত বামন জগন্নাথ দেবকে দর্শন করলে তার পুনর্জম্ন হয় না। তাই জগন্নাথ দেবের রথযাত্রায় রথের রশি টানাকে পুণ্যের কাজ হিসেবে গণ্য করে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা। (তথ্য সূত্র: পদ্মপুরাণ)

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট, বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test