E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আওয়ামী লীগ এখন গবেষণার বিষয়

২০২৩ জুন ২২ ১৬:২৭:৫০
আওয়ামী লীগ এখন গবেষণার বিষয়

গোপাল নাথ বাবুল


বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের রয়েছে বর্ণাঢ্য ইতিহাস। জন্মলগ্ন থেকেই এ সংগঠন নিপীড়িত বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্ব করে আসছে। বাঙালির যা কিছু অর্জন, সবই হয়েছে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে। যার নেতৃত্বে ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ট বাঙালি ও বাংলাদেশের মহান স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মাওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাতে গড়া এ সংগঠন ইতিহাসের নানা বাঁক পেরিয়ে এবার ৭৪ বছর পূর্ণ করল। তাই আওয়ামীলীগ সাধারণ কোনো সংগঠন নয়। আওয়ামীলীগ মানে নির্যাতীত মানুষের অভয়াশ্রম, আওয়ামীলীগ মানে কৃষক-শ্রমিকসহ খেটে খাওয়া মানুষের কাফেলা। উপমহাদেশের অন্যতম, প্রাচীন, সুবিশাল ও ঐতিহ্যবাহী এ রাজনৈতিক দলটি স্বাধীকার থেকে স্বাধীনতা আন্দোলন, সামরিক স্বৈরশাসন থেকে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতিটি সংগ্রামের নেতৃত্বদানকারী দল।

ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায়, আওয়ামীলীগ গঠনের পিছনে অধিক কারণ ছিল। পাকিস্তান আন্দোলন ও বাস্তবায়নে পূর্ব বাংলার মানুষের অবদান ছিল অপরিসীম। তবে বাঙালি মুসলমান সমাজ পাকিস্তান আন্দোলনে মুসলিমলীগের সৃষ্ট ধর্মান্ধতা ও সাম্প্রদায়িকতার পরিবেশে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার অব্যবহিত পরেই মুসলিমলীগ রাজনৈতিক পরিমন্ডলে ষড়যন্ত্রের ধোঁয়ায় সম্পূর্ণ আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।

১৯৪৭ সালের বিভাগ-পূর্ব বাংলার মুসলিমলীগের হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশেম প্রমুখ নেতারা অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল বিধায় তাঁদের নেতৃত্বেই ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিমলীগ পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। এমতাবস্থায় পাকিস্তানিরা মনে করেছিলেন, তারা যা-ই বলবেন তাই পূর্ব বাংলার জনগণ নতমস্তকে মেনে নেবেন। এমন অতি বিশ্বাসে পাকিস্তানিরা ধর্মীয় কার্ড খেলে বাঙালিদের ধ্বংস করার নীলনকশায় সর্বপ্রথম হামলা চালায় বাঙালির ভাষা-সংস্কৃতির ওপর। কারণ তারা জানত, কোনো জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সর্বপ্রথম তাদের ভাষা ও সংস্কৃতিকে নির্মূল করতে হবে। তারা কৌশলে পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখে।

এদিকে আবার গণতন্ত্রমনা ও প্রগতিশীল মুসলিমলীগাররা কেন্দ্রীয় নেতাদের ষড়যন্ত্রের শিকার হন। ফলে ১৯৪৯ সালের মে মাসের দিকে বাংলার মুসলিমলীগের তরুণরা এক সম্মেলন অনুষ্ঠান করে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মুসলিমলীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানের কাছে এক প্রতিনিধি দল পাঠান। প্রতিনিধি দলটি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিমলীগ নেতৃবৃন্দের ব্যাপারে আপত্তি ও অভিযোগ উত্থাপন করলে কেন্দ্রীয় সভাপতি তাদের কথায় কর্ণপাত না করে আকরাম খাঁ ও নাজিমুদ্দিন প্রমুখকে জোরালোভাবে সমর্থন করেন। এতে বাংলার তরুণ কর্মীরা ক্ষুদ্ধ হন এবং সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশেম নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিমলীগের অংশটি পূর্ব বাংলার স্বার্থ রক্ষায় মুসলিমলীগের বিরুদ্ধে একটি নুতন দলের অভাব অনুভব করেন।

এ সময় কলকাতা থেকে একটি মামলা পরিচালনার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় এলে তিনি শওকত আলীকে মুসলিমলীগ ছেড়ে একটি নতুন দল গঠন করার পরামর্শ দেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পরামর্শে শওকত আলী নতুন দল গঠনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। তিনি কর্মী শিবিরের নেতৃবৃন্দকে নুতন দল গঠনে উদ্বুদ্ধ করেন এবং এক সভায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সাধারণ সম্পাদক করে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির কয়েক মাসের তৎপরতার পর ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন পুরানো ঢাকার কে এম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদের বিখ্যাত রোজ গার্ডেনে আতাউর রহমান খানের সভাপতিত্বে বাংলা ও বাঙালির অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক ও কারাগারে থাকা শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ন সম্পাদক করে ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’ গঠন করে।

গণতান্ত্রিক উপায়ে জন্ম নেওয়া এ দলটিই পাকিস্তানের প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করার পরদিনই ঢাকার আরমানিটোলা ময়দানের জনসভায় আন্দোলনের কর্মসূচী গ্রহণ করে। এরপর থেকেই বিরামহীনভাবে দীর্ঘ ৭২ বছর ধরে দলটি আন্দোলন-সংগ্রাম চালিয়ে আসছে, যা এখনও চলমান। কখনও সরকারে, কখনও বিরোধীদলে থেকে অনেক রক্তমাখা পথ পাড়ি দিয়ে দেশ গঠনে অনন্য ভূমিকা পালন করে আসছে দলটি। পাকিস্তানিরা ভাবতেই পারেনি যে, মাত্র ২২ বছর পরে এ দলটির নেতৃত্বেই বঙ্গবন্ধুর হুংকারে ১৯২ বছর পূর্বে পলাশির প্রান্তরে অস্ত যাওয়া লাল সূর্যটির উদয়ের পথ সুগম করে তাদের বাংলা থেকে পিটিয়ে বের করে দিয়ে বাঙালিরা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনবে।

প্রথমদিকে দলটিকে অসম্প্রদায়িক ও ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে গড়ে তোলার পক্ষে অনেকের মত ছিল। দলটির শব্দগুচ্ছে ‘মুসলিম’ শব্দটি অন্তর্ভূক্ত হোক তা অনেকের মত বঙ্গবন্ধুও চাননি, তা পরিস্কার হয় তাঁরই মন্তব্যে; ‘আমি মনে করেছিলাম, পাকিস্তান হয়ে গেছে, সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের দরকার নাই। একটা অসম্প্রদায়িক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হবে, যার একটা শুধু মেনিফেস্টো থাকবে। ভাবলাম, সময় এখনো আসে নাই, তাই যারা বাইরে আছেন, তারা চিন্তা-ভাবনা করেই করেছেন।’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, পৃষ্টা-১২১)।

মূলত ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে, বিকাশমান মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণি ও কৃষক শ্রেণির অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে। ঐতিহ্যগতভাবে পূর্ব বাংলার মানুষ অসম্প্রদায়িক হলেও পাকিস্তান আন্দোলনে সাধারণ ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের মনে যে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় ভাবাবেগের উত্তাল জোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল, তার প্রভাব পাকিস্তান সৃষ্টির পরও কিছু মানুষের মনকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল। ফলে একশ্রেণির সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক নেতা এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ধর্মীয় উম্মাদনা সৃষ্টির প্রয়াস চালান। এ কারণেই নতুন দলকে অসাম্প্রদায়িক রূপ দিতে নেতারা সাহস করেননি। এরপর পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ঔপনিবেশিক শাসনের নতুন জিঞ্জির পরিয়ে দিতে উদ্ধত হয়ে মুখের ভাষা কেড়ে নিতে বাঙালি ছাত্রদের বুকে গুলি চালায়, তখনই ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠার সার্থক সংগ্রামের সূচনা হয়। এরপর এ দলের নেতৃত্বে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে বিজয়ের পর আওয়ামীলীগ সাহসি হয়ে ওঠে। ফলে ১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবরের তৃতীয় কাউন্সিল সভায় দলের নেতারা ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে দল থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেন, যাতে অমুসলিমরাও দলে যোগ দেয়ার সুযোগ পান।

এ দলের নেতৃত্বেই ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু প্রণয়ন করেন বাঙালির মুক্তির সনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা এবং ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে তাঁরই নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে স্বাধীনতা লাভের পথ সুগম করে। পাকিস্তান আন্দোলন থেকে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার আন্দোলন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু অসম্প্রদায়িক মূল্যবোধ দ্বারা পরিচালিত হন এবং তাঁরই নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ একটি জাতীয়তাবাদী চরিত্র গ্রহণ করে নিজেদের মর্যাদার লড়াই শুরু করে। এরই পরিক্রমায় ১৯৭১-এ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।

স্বাধীনতার পরেও বঙ্গবন্ধু ধর্মনিরপেক্ষতাকে সর্বোচ্চ স্থান দেন। এ আদর্শ রক্ষায় তিনি জীবন দিয়েছেন, তবু বিচ্যুত হননি। ১৯৭২ সালের ৪ অক্টোবর খসড়া সংবিধানের ওপর আলোচনার জন্য আয়োজিত সম্মেলনে তিনি উদাত্ত কন্ঠে ঘোষণা করেন, ‘ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্ম-কর্ম করার স্ব-স্ব অধিকার অব্যাহত থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মচর্চা বন্ধ করতে চাই না এবং তা করবও না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা রাষ্ট্রের কারও নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম-কর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে, কেউ তাদের বাধা দিতে পারবে না। আমাদের আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়েছে।’

বর্তমানে এ দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, গণতন্ত্রের মানসকন্যা, ৪ বারের সফল প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ আরো বেশি সুসংগঠিত ও শক্তিশালী। বিশ্বসভায় দেশ আজ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত এবং পদ্মাসেতুর মত বিস্ময় আজ দৃশ্যমান হয়েছে।

আওয়ামীলীগ এখন আর হেলাফেলার কোনো সংগঠন নয়। আওয়ামীলীগকে নিয়ে এখন অনেকেই গবেষণা করছেন। রচনা করেছেন পিএইচডি অভিসন্দর্ভ। ভারতের শ্যামলী ঘোষ দিল্লীর জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ‘দি ইস্ট পাকিস্তান আওয়ামীলীগ, ১৯৫৮-১৯৭১’ শীর্ষক অভিসন্দর্ভ রচনা করেছেন এবং তাঁর এ অভিসন্দর্ভটি পরে ‘দি আওয়ামীলীগ, ১৯৪৯-১৯৭১’ নামে গ্রন্থাগারে প্রকাশিত হয়। তাছাড়া, কেন্দ্রীয় আওয়ামীলীগের সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য নূহ-উল আলম লেলিনের রচনা, গ্রন্থনা ও সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ইতিহাস ও বাঙালির ঐতিহাসিক দলিল ‘বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ, সংক্ষিপ্ত ইতিহাস ও নির্বাচিত দলিল (প্রথম খন্ড ও দ্বিতীয় খন্ড)।’

পরিশেষে বলব, মুক্তিযুদ্ধের পর ধ্বংসস্তুপ থেকে একটি দেশকে পুনর্গঠন করে মাত্র নয় মাসের মধ্যে একটি সংবিধান উপহার দিয়ে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামীলীগ অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও শোষনমুক্ত-উন্নত বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ভিত্তিভূমিটাই নির্মাণ করে দিয়েছে। তারই পরিক্রমায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে দেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ একটি উন্নত দেশে পরিণত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ জেগে থাকবে। এ প্রত্যাশা নিয়ে কৃতজ্ঞতায় স্মরণ করছি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এবং যাঁরা নিরবচ্ছিন্ন দীর্ঘ নেতৃত্ব দিয়ে, মৃত্যুভয়কে ছিন্ন করে আওয়ামীলীগকে এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন, তাঁদের মধ্যে যারা মৃত্যুবরণ করেছেন, তাদের জানাই বিনম্র্র শ্রদ্ধাঞ্জলি এবং বর্তমান দলের প্রধান ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি জানাই সশ্রদ্ধ প্রণাম।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test