E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক দিবস

২০২৩ জুন ২৬ ১৫:২০:২৯
আন্তর্জাতিক অলিম্পিক দিবস

গোপাল নাথ বাবুল


প্রতিবছরের ন্যায় এ বছরও ২৩ জুন পালিত হলো আন্তর্জাতিক অলিম্পিক দিবস। ১৮৯৬ সালের এ দিনে প্রথমবারের মতো শুরু হয় আধুনিক অলিম্পিক গেমস। ফ্রান্সের প্যারিসে অনুষ্ঠিত এ ক্রীড়া উৎসব সময়ের হাত ধরে বিশ্বের সবচেয়ে সমৃদ্ধ ক্রীড়া উৎসবে পরিণত হয়েছে। এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ উপলক্ষ যা অলিম্পিক গেমসের চেতনা এবং খেলাধুলার বিশ্বব্যাপী প্রভাব উদযাপন করে। দিবসটি শুধুমাত্র আধুনিক অলিম্পিক মুভমেন্টের প্রতিষ্ঠার স্মরণে নয় বরং জাতির মধ্যে ঐক্য, বন্ধুত্ব, চেতনা, শ্রেষ্ঠত্ব ও শান্তি বৃদ্ধিতে খেলাধুলার শক্তির স্মারক হিসেবে কাজ করে এবং সম্মানের অলিম্পিক মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়ায়, যা ব্যক্তিদের ক্রীড়াঙ্গনের চেতনাকে আলিঙ্গন করতে অনুপ্রাণিত করে। এটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে ও খেলাধুলায় অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করে। দিনটি সব বয়সের এবং সামর্থ্যরে মানুষকে খেলাধুলা ও শারীরিক ক্রিয়াকলাপে নিয়োজিত করতে উৎসাহিত করে। নিয়মিত ব্যায়াম এবং ফিটনেসের গুরুত্বের ওপর জোর দিয়ে একটি সক্রিয় এবং স্বাস্থ্যকর জীবনধারা গ্রহণ করতে ব্যক্তিদের অনুপ্রাণিত করাই এর লক্ষ্য। মোট কথা, আন্তর্জাতিক অলিম্পিক দিবস বিশ্বব্যাপী অলিম্পিক মুভমেন্টের প্রচারে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। 

খৃষ্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে চতুর্থ শতাব্দী পর্যন্ত গ্রিসের অলিম্পিয়াতে অনুষ্ঠিত হওয়া আদি অলিম্পিক গেমসের অনুপ্রেরণায় সৃষ্টি হয়েছে বর্তমান নব্য অলিম্পিকের। খ্রিষ্টের জন্মের ৭৭৬ বছর পূর্ব থেকে ৩৯৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ১২০০ বছর প্রাচীন গ্রিসের এলিসের অলিম্পিক ভিলেজে অলিম্পাস পাহাড়ের পাদদেশে দেবতা জিউসের উদ্দেশ্যে ৪ বছর পর পর অনুষ্ঠিত হতো অলিম্পিক গেমস্। তারপর গ্রিসের শাসক থিওডোসিয়াস পৌত্তলিকতার দোষ দিয়ে অলিম্পিক গেমস বন্ধ করে দেন। তার প্রায় ১৫০০ বছর পর ১৮৯৬ সালে ফরাসি শিক্ষাবিদ ব্যারন পিয়েরে ডি কুব্যার্তা প্রাচীন গ্রিসের সে ঐতিহ্যকে পুনর্জাগরিত করে আধুনিক অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠানের ব্যাপারে সচেষ্ট হন। কুব্যার্তার সক্রিয় প্রচেষ্টায় ১৮৯৪ সালে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি। এ কমিটির প্রথম সভাপতি হিসেবে ছিলেন দিমেত্রিওস ভাইকেলাস। আর ১৮৯৬ সালে গ্রিসের রাজধানী এথেন্সে বসে আধুনিককালের প্রথম গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস, যা ওই সালের ৬ থেকে ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত চলে। আধুনিককালের বৃহত্তম খেলাধুলার আসর অলিম্পিক গেমস প্রতি ৪ বছর পর পর অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ১৮৯৬ সাল থেকে। দিন দিন জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাওয়া অলিম্পিক গেমসে বর্তমানে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ অংশ নিচ্ছে।

১৯২০ সালে এণ্টোয়ের্পে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে প্রথম অলিম্পিক পতাকা ওড়ানো হয়। পতাকটির নকশা ১৯১৩/১৪ সালে পিয়েরে ডি কুব্যার্তা তৈরি করেন। পতাকার ৬টি রং অর্থাৎ সাদা জমিনের ওপর ৫টি রঙিন বৃত্ত। বৃত্তগুলোর রঙ পর্যায়ক্রমে নীল, হলুদ, কালো, সবুজ ও লাল দ্বারা বোঝানো হয়েছে ৫টি প্রধান ভৌগলিক এলাকা। এলাকাগুলো হলো-এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা, আমেরিকা এবং অষ্ট্রেলিয়া। বৃত্তগুলো একে অপরের সঙ্গে জুড়ে থাকার অর্থ হলো-অলিম্পিক গেমস পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলোকে মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ করার মাধ্যম হিসেবে কাজ করবে।

অলিম্পিকের বিশ্বাস এবং মূলমন্ত্র হলো-ক্ষিপ্রতা, উচ্চতা এবং শক্তি, যা ১৯২১ সালে পিয়েরে ডি কুব্যার্তা প্রচলন করেন। ১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিকে বিশপ তালবোটের দেওয়া বক্তৃতার অংশ হলো-অলিম্পিক গেমসের মূল বিশ্বাস, ‘জীবন যুদ্ধে জয়ী হওয়ার চেয়ে যুদ্ধ করে টিকে থাকা যেমন বেশি গুরুত্বপূর্ণ, একইভাবে অলিম্পিক গেমসে জয় পরাজয়ের চেয়ে অংশগ্রহণই বেশি গুরুত্বপূর্ণ।’
১৯০৮ সালের লন্ডন অলিম্পিক গেমসে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের প্রচলন শুরু হয়। আধুনিক অলিম্পিকের জনক কুব্যার্তা অলিম্পিক শপথ রচনা করেন।

অলিম্পিক গেমসের উদ্বোধন দিনে একজন ক্রীড়াবিদ সমস্ত ক্রীড়াবিদের পক্ষ থেকে এ শপথ বাক্য পাঠ করে থাকেন। ১৯২০ সালের অলিম্পিকে বেলজিয়ামের অসিচালনা ক্রীড়াবিদ ভিক্টর বোইন প্রথম শপথ বাক্য পাঠ করেন। এরপর অলিম্পিক পতাকা উত্তোলন, আবহ সঙ্গীত, আয়োজক দেশের পতাকা উত্তোলন এবং সে দেশের কৃষ্টি ও সভ্যতা ফুটিয়ে তুলে নাচ, গান এবং শারীরিক কলা কৌশল প্রদর্শন করেন সে দেশের শিল্পীরা। এরপর একে একে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো প্যারেড করেন। সবশেষে প্রবেশ করেন আয়োজক দেশের ক্রীড়াবিদরা। তারপর স্টেডিয়ামে অলিম্পিক মশাল স্থাপনের মধ্য দিয়ে উদ্বোধন অনুষ্ঠান শেষ হয়।

আধুনিক অলিম্পিক গেমসে অলিম্পিক মশালের প্রচলন শুরু হয় ১৯২৮ সালের আমস্টারডাম অলিম্পিকে। গ্রিসের অলিম্পিয়াতে প্রাচীন গ্রিসের পোশাক পরিহিত গ্রিক রমণীরা আতস কাচের ওপর সূর্য রশ্মি ফেলে এ মশাল জ্বালাতেন। এ মশাল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ ঘুরে এসে শেষ হয় অলিম্পিক স্টেডিয়ামে। ১৯৩৬ সালে বার্লিন অলিম্পিকে প্রথম প্রচলন করা হয় অলিম্পিক মশালের পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ প্রদক্ষিণ করা। গেমস সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে নিভিয়ে ফেলা হয় অলিম্পিক মশাল। পতাকা উত্তোলনের সময় যে আবহ সঙ্গীত বাজানো হয়, স্পাইরোস সামারাস সে সঙ্গীতের সুরকার এবং রচয়িতা হলেন কস্টিস পালামাস। ১৮৯৯ সালের অলিম্পিক থেকে এ সঙ্গীত বাজানো শুরু হলেও ১৯৫৭ সালে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি অফিসিয়ালভাবে অনুমোদন দেয়।

১৯৪৭ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটির (আইওসি) ৪১তম অধিবেশনে কমিটির সদস্য ডক্টর গ্রাস আন্তর্জাতিক গেমসে সচেতনতা বাড়াতে এবং অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য অলিম্পিক দিবস উদযাপনের ধারণাটি প্রস্তাব করেছিলেন। ১৯৪৮ সালে সেন্ট মরিৎজে ৪২তম আইওসি অধিবেশনে ২৩ জুন অলিম্পিক দিবস হিসেবে আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হয়। কারণ এ তারিখটি ১৮৯৪ সালে প্যারিসের সোর্বোনে আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি প্রতিষ্ঠার জন্য চিহ্নিত হয়েছিল। সিগফ্রিড এডস্ট্রমের নেতৃত্বে ১৯৪৮ সালের ২৩ জুন প্রথম আন্তর্জাতিক অলিম্পিক দিবস পালিত হয়। তারপর থেকে এ দিবসটি অলিম্পিক মুভমেন্ট ও এর মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে প্রতিবছর পালিত হয়ে আসছে।

আন্তর্জাতিক অলিম্পিক দিবসের অনেক তাৎপর্য রয়েছে। কারণ এটি একাধিক উদ্দেশ্যে কাজ করে এবং গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে। এ বছরের অলিম্পিক দিবসের থিম হলো ‘লেট’স্ মুভ’, যার লক্ষ্য সারাবিশ্বের মানুষকে প্রতিদিনের শারীরিক কার্যকলাপের জন্য সময় বের করতে অনুপ্রাণিত করা। এ দিনটি উদযাপনের লক্ষ্যই হলো জনমানসে ক্রীড়ার প্রচার ও ক্রীড়াকে জীবনের অত্যাবশ্যক অঙ্গ হিসেবে যুক্ত করার বার্তা দেওয়া। পাশাপাশি এ দিবসের অন্যতম লক্ষ্য হলো, যত বেশি সম্ভব মানুষকে অলিম্পিককে অংশগ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা। ক্রীড়ার প্রচার, প্রসার ও নিত্যদিনের জীবনের সঙ্গে এর গুরুত্ব বোঝাতে এ বিশেষ দিনটি মোট ১৫০টি দেশে পালিত হয়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test