E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

নারী দিবসের প্রবক্তা ক্লারা জেটকিনের ১৬৬তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

২০২৩ জুলাই ০৬ ১৫:৩৩:২৭
নারী দিবসের প্রবক্তা ক্লারা জেটকিনের ১৬৬তম জন্মদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি

গোপাল নাথ বাবুল


ভবিষ্যতকে জানতে অতীত জানা প্রয়োজন। কারণ, প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো কালক্রমে ইতিহাসে পরিণত হয়। তাই ইতিহাস কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবায়, তাড়িত করে। আমাদের সমাজের ইতিহাস লেখার দৃষ্টিভঙ্গি মুলত পুরুষতান্ত্রিক। তাই ইতিহাসে অনেক সময় নারীর অবদান লুপ্ত থাকে। কিন্তু সমাজ গঠন বা সমাজ পরিবর্তনে এবং ইতিহাসের নানা বাঁকে নারীরাও রেখেছিলেন গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকা ও অবদান। শ্রেণি সংগ্রামের লড়াইয়ে নারী নেতৃত্বের এক অসাধারণ উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপনকারী এমনই এক মহিয়সী নারীকে আজ স্মরণ করছি। যার নাম কমরেড ক্লারা জেটকিন। ক্লারা জেটকিন ছিলেন জার্মান কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, মার্কসবাদী তাত্ত্বিক এবং ‘নারী অধিকার’ আন্দোলনের বিশিষ্ট নেত্রী।

দক্ষ বেহালা বাদক, স্কুল শিক্ষক ও ধর্মপ্রাণ প্রোটেসস্ট্যান চার্চ সংগঠক গটফ্রেড আইজেনার এবং সুশিক্ষিত প্রগতিশীল নারী জোসেকিন ভেইটালে আইজেনারের কোল আলো করে জার্মানির ছোট গ্রাম সাক্সসনায় ১৮৫৭ সালের ৫ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন ক্লারা জেটকিন। তিন ভাইবোনের মধ্যে ক্লারা ছিলেন সবার বড়। এক সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলে তাঁর বেড়ে ওঠা। একদিকে বাবার সঙ্গীত চর্চার পাশাপাশি মায়ের পুঁথি চর্চা তার মনোজগতে এক উন্নত ক্ষেত্র তৈরি করে। স্কুল কলেজের পড়ার ফাঁকে ফাঁকে তিনি নানা রকম বই পড়তেন। বায়রন, ডিকেন্স, সেক্সপীয়র, শিলার, প্যাটে, হোমারসহ আরও অনেকের লেখা তিনি নিয়মিত পড়তেন।

শৈশবে জেটকিন শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছে নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু করলেও অচিরেই সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন এবং ১৮৭৪ সালে জার্মানির নারী ও শ্রম আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। মাত্র ২১ বছর বয়সেই তিনি জার্মান সোশ্যাল ডেমোক্র্যাট পার্টির সভ্য হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেন। একই সালে তাঁর সঙ্গে বিশেষ যোগাযোগ গড়ে ওঠেছিল জার্মানির নারী আন্দোলন এবং শ্রম-আন্দোলনের সাথে জড়িত সংগঠনগুলোর। নারীদের মাঝে ব্যাপকভাবে কাজ করার লক্ষ্যে ক্লারা ১৮৭৮ সালে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক দলে যোগ দেন। ১৮৭৫ সালে ২টি দল একত্রিত হয়ে এ দলটি গড়ে ওঠে। দল ২টি ছিল ফের্দিনান্দ লাসালে গঠিত সাধারণ জার্মান শ্রমিক সংগঠন এবং আগস্ট বেকেল ও ভিলহেস্ম লাইবনেখত গঠিত জার্মানির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক দল।

পরে ১৮৯০ সালে জার্মানির সমাজতান্ত্রিক শ্রমিক দলের আধুনিক সংস্করণ তৈরি হয়েছিল। যার নতুন নামকরণ হয়েছিল জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল। ১৮৭৮ সালে বিসমার্ক জার্মানিতে সমাজতন্ত্র-বিরোধী জরুরি আইন এবং সমাজতান্ত্রিক কাজকর্মের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে জেটকিন ১৮৮২ সালে জুরিখ চলে যান। পরে সেখান থেকে প্যারিসে নির্বাসনে যান। প্যারিসে থাকাকালীন তিনি সমাজতন্ত্রকে আন্তর্জাতিকভাবে ছড়িয়ে দিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। রাশিয়া থেকে পালিয়ে আসা মার্কস বিপ্লবী বন্ধু ওসিপের সঙ্গে জেটকিনের বিয়ে হয়। তাঁদের ছিল ২ সন্তান। প্রথম সন্তান ম্যাক্সিম জেটকিন জন্ম নেয় ১৮৮৩ সালে এবং দ্বিতীয় সন্তান কোনস্টাইনটেন জন্ম নেয় ১৮৮৫ সালে।

১৮৮৯ সালে দীর্ঘদিন যক্ষ্মা রোগে আক্রান্ত স্বামী ওসিপ মারা যান। এ সময় স্বামীর মৃত্যুশোক উপেক্ষা করে তিনি ১৮৯০ সালে নতুন নামে গঠিত ‘সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মান’ দলের কাজে এগিয়ে আসেন। এ সময়ে সহযোদ্ধা হিসেবে পাওয়া ব্যক্তিত্বদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন-রোজা লুক্সেমবার্গ। ক্লারা ও রোজার মিলিত কর্মকান্ড নারী আন্দোলন ও শ্রমজীবী জনতার মুক্তি আন্দোলনকে আরও বেগবান, সুদুর প্রসারী ও সমগ্র দুনিয়াব্যাপী ছড়িয়ে দিতে সক্ষম হন। এছাড়া প্যারিসে অবস্থানকালে তিনি বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব কার্ল মার্কসের কন্যা লরা ও তাঁর স্বামী পল গ্রাফার নামে আরও ২ মহান ব্যক্তিত্বকে কাছে পান।

১৮৯১ সালে তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় ‘ইকুয়ালিটি’ বা ‘সমতা’ নামে নারীদের একটি পত্রিকা। এর মাধ্যমেই ক্লারা শুধু জার্মান নয়, সারাবিশ্বের নারীদের মধ্যে সংগ্রামী চেতনা জাগানোর পাশাপাশি ন্যায্য অধিকারের জন্য লড়াই করতে উদ্বুদ্ধ করেন। তাঁর দ্বিতীয় পুত্র কোনস্টাইনটেন সমতা পত্রিকা প্রকাশনায় মাকে সহযোগিতা করেন। ১৮৯১ থেকে ১৯১৭ সাল পর্যন্ত তিনি এ পত্রিকার সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।

সহজে সবার সঙ্গে মিশতে পারা এবং যেকোনো বিষয়কে গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারা ক্লারা জেটকিন ছিলেন জীবনের চড়াই-উতরাই পেছনে ফেলে সমতার আদর্শে নিবেদিতপ্রাণ। বিপ্লবী হওয়ার কারণে ব্যক্তিগত জীবনে অনেক অভাব-অভিযোগ, রোগ-ব্যাধি, বাধা-বিপত্তির মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। কিন্তু থামিয়ে দেননি নারীদের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম। একদিকে সংসার অন্যদিকে দেশ ও জাতির মুক্তির আন্দোলন। উভয়ক্ষেত্রে তাঁর দায়িত্ববোধ সমান্তরালভাবে চালিয়ে গেছেন।

১৯০৭ সালে দলের নারী বিষয়ক বিভাগ ‘নারী কার্যালয়’-এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং অনেক বাঁধা-বিপত্তি অতিক্রম করে ১৯০৭ সালে আয়োজন করেন প্রথম আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারী সম্মেলন। কোপেনহেগেন শহরে ১৯১০ সালে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক কর্মজীবী নারী সম্মেলনে ১৭টি দেশের শতাধিক নারী-প্রতিনিধি যোগদান করেন। উক্ত সম্মেলনে তিনি ৮ মার্চকে আন্তর্জাতিক নারী দিবস করার প্রস্তাব পেশ করেন। কংগ্রেস এ প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং ১৯১১ সাল থেকে ৮ মার্চ নারী দিবস পালিত হয়ে আসছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় কোনও আন্দোলন করা যাবে না বলে যে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয় তিনি তার প্রতিবাদ করেন। ১৯১৫ সালে আন্তর্জাতিক সমাজতান্ত্রিক নারীদের নিয়ে যুদ্ধবিরোধী আন্দোলন সংগঠিত করেন। ১৯১৬ সালে স্পার্টাকাসপন্থী লীগের তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। ১৯১৭ সালে জার্মানির সমাজ গণতান্ত্রিক দল ভেঙ্গে ‘ইনডেপেন্ডেট সোস্যাল ডেমোক্রেটিক পার্টি অব জার্মানি’ (ইউএসপিডি) গঠিত হলে এটিরও তিনি সহ-প্রতিষ্ঠাতা হন। ১৯১৯ সালের ‘কমিউনিস্ট পার্টি অব জার্মানি’ (কেপিডি) গঠিত হলে তিনি এর সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। তিনি ১৯২০ থেকে ১৯৩৩ সালে তাঁর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত রাইখস্টাগে এ দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনি জার্মানির কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় অফিসের সদস্য, ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত তিনি দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য, ১৯২১ থেকে ১৯৩৩ সাল পর্যন্ত তিনি কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা কমিন্টার্নের এগজিকিউটিভ কমিটির সদস্য পদে ছিলেন। ১৯২০ সালে তিনি কমরেড লেনিনের সাক্ষাৎকার নেন। এডলফ হিটলার ক্ষমতায় এসে কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করলে তিনি ১৯৩৩ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নে চলে যান। সেখানে ১৯৩৩ সালের ২০ জুন তিনি মৃত্যুবরণ করেন। মস্কোর ক্রেমলিনে তাঁকে সমাহিত করা হয়। নারীমুক্তি আন্দোলনের এ পথিকৃৎকে সম্মান জানিয়ে ১৯৩৮ সালের ৮ মার্চ তাঁকে ‘অর্ডার অব লেনিন’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়।

পরিশেষে বলা যায়, নারী মুক্তির জন্য তিনি আজীবন লড়াই করে গেছেন। এক ভাষণে তিনি বলেন, ‘মনে রেখো বোনেরা, ফ্যাসিবাদ চায় তোমাদের শুধু দাসী ও সন্তান উৎপাদনের যন্ত্র বানাতে। সেই নারীযোদ্ধাদের কথা ভুলে যেয়ো না, যারা ফ্যাসিবাদীদের হাতে প্রাণ দিয়েছে এবং কারাবরণ করেছে। যে সময়ে ক্লারা জেটকিন জোর গলায় এ বাক্যগুলো উচ্চারণ করেছিলেন, সে সময় সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে ছিল নারীরা। ছিল না তাদের শিক্ষার অধিকারও। এমনকি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত হয়নি তাদের ভোটাধিকার। এ রকম প্রতিকূল পরিবেশে জার্মানিতে বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়ে এ সাহসী বাক্য উচ্চারণ ও একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে এমন প্রতিবাদ জানানোর জন্য জার্মান ফ্যাসিস্ট বাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারও হতে হয় তাঁকে।

নারীদের যে সমাজ ও সভ্যতা নির্মাণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রয়েছে সেটিকেই তুলে ধরে তা প্রতিষ্ঠা করার মধ্য দিয়ে একটি সমাজতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থার স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি। আর সে লক্ষ্যে পৃথিবীর সকল মেহনতি মানুষের মুক্তির সঙ্গে নারীর মুক্তিও যে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত সেই বার্তা ও সংগ্রামকে ছড়িয়ে দিতে আজীবন লড়াই করেছেন সুদৃঢ়ভাবে। কারণ ক্লারা জেটকিন মনে করতেন, সেই সময়ের ফেমিনিজম শ্রেণি চরিত্রের দিক থেকে শ্রমিক নারীর বিপরীতে মধ্যবিত্ত ও উচ্চবিত্ত নারীদের স্বার্থ রক্ষাই ছিল রাষ্ট্রের নীতি। এখনও ফেমিনিজম বা নারীবাদ শহুরে মধ্যবিত্তদের গন্ডি, তাদের চাওয়া-পাওয়া এবং নারীর অধিকারের প্রশ্নে তাদের নিজ শ্রেণির ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মধ্যেই রয়ে গেছে, যা সাধারণ নারী বিশেষ করে শ্রমিক নারীর জীবন ও জগতের যেমন প্রতিনিধিত্ব করে না, তেমনি তাদের স্বার্থের সঙ্গেও অধিকাংশ সময় সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test