E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

৪৬ বছরের দীর্ঘ পথ চলায় উদীচী

২০১৪ অক্টোবর ২৯ ১৫:০৪:১৪
৪৬ বছরের দীর্ঘ পথ চলায় উদীচী

প্রীতম সাহা : দেশে তখন বিরাজ করছে পাকিস্তানী শাসন। দেশের সিংহভাগ সম্পদ মুষ্টিমেয় স্বার্থান্বেষী মহলের দখলে। ধর্মান্ধতা, কুপমন্ডূকতা গ্রাস করে ফেলেছে গোটা জাতিকে। দেশব্যাপী চলছিল নৈতিকতা বিধ্বংসী কার্যকলাপ।

রবীন্দ্রনাথকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল, নজরুলকে করা হয়েছিল দ্বিখন্ডিত, বাঙালিত্বের চেতনাকে করা হয়েছিল নিষ্পেষিত। তখন পাকিস্তানী শাসন শোষণের বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠছিল বাংলার আপামর সংগ্রামী জনতা। একটি কালজয়ী গণঅভ্যুত্থান উঁকি ঝুঁকি মারছিল। ঠিক সেই সময় দেশের গণসংগীতের অন্যতম পথিকৃৎ ও বিশিষ্ট সাংবাদিক ঔপন্যাসিক সত্যেন সেনের নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী (২৯ অক্টোবর, ১৯৬৮)।

উদীচী শুধুই একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন নয়। উদীচী একটি আন্দোলন। উদীচী কেবল সংস্কৃতি চর্চা করে না, গণমানুষের সংস্কৃতি চর্চার পথও নির্দেশ করে। সংস্কৃতির হাতিয়ার ব্যবহার করে জাতীয় মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে ঢাকা নগরীর উত্তর প্রান্তের নারিন্দায় শিল্পীকর্মী সাইদুল ইসলামের বাসায় সত্যেন সেন, রণেশ দাশগুপ্ত, গোলাম মোহাম্মদ ইদু, কামরুল আহসান খান, মোস্তফা ওয়াহিদ খান প্রমুখের উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত সভায় উদীচী গঠনের সিদ্ধান্ত হয়।

শিল্পী সংগ্রামী সত্যেন সেনের দীর্ঘ চিন্তার ফসল উদীচী। তিনি খুব সচেতনভাবেই উদীচী নামটি নির্বাচন করেছিলেন। উদীচী অর্থ উত্তর দিক বা ধ্রুবতারার দিক। দিক হারা নাবিকেরা যেমন উত্তর দিকে ধ্রুবতারার অবস্থান দেখে তাদের নিজ নিজ গন্তব্য স্থির করেন- তেমনি এদেশের সংস্কৃতি তথা গণমানুষের সংস্কৃতি, সাংস্কৃতিক আন্দোলন সবকিছুই উদীচীকে দেখে তার চলার পথ চিনতে পারবে। এছাড়া বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রিয় আবাসের নাম উদীচী, নামকরণের ক্ষেত্রে এটিও বিবেচিত হলো। উদীচী দেশ ও জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষাসমূহকে উপলব্ধি করবে, এ সম্পর্কে তাদেরকে সচেতন করবে, তাদেরকে এই দুঃখ কষ্টের কারণসমূহ মোকাবেলা করার জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রেরণা যোগাবে এবং আবার তাদেরকে নতুনতর সংগ্রামের জন্য তৈরি করবে সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের মাধ্যমে। উদীচী সমাজ সচেতন, সমাজ পরিবর্তনের নিয়মসমূহ ও কারণসমূহ সম্পর্কে সচেতন। উদীচী কর্মীরা শুধু নিজেরাই সচেতন হওয়া নয়, জনগণকে সচেতন করাকেও কর্তব্য মনে করে। এসব কারণেই উদীচী অপরাপর সাংস্কৃতিক সংগঠন থেকে আলাদা।

উদীচী’র জন্মই হয়েছিল গণসঙ্গীত দিয়ে। সহজভাবে গণমানুষের নিকট যাওয়া যায় একমাত্র গণসঙ্গীতের মাধ্যমেই। তাই এদেশের গণমানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার একাগ্র শক্তি, আদর্শ ও আত্মত্যাগের মহান ঐতিহ্যের গর্বিত বাহক উদীচী’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, এদেশের মেহনতি মানুষের বন্ধু, সাংস্কৃতিক আন্দোলনের প্রাণপুরুষ সত্যেন সেনের সাবলীল উচ্চারণ-

“মানুষের কাছে পেয়েছি যে বাণী
তাই দিয়ে রচি গান
মানুষের লাগি ঢেলে দিয়ে যাব
মানুষের দেয়া প্রাণ।”

গণঅভ্যূত্থানের প্রাক-পর্বে উদীচী’র গান হলো মিছিলের সাহসী যৌবনের প্রণোদনা। ঐ বছরই ঢাকার মঞ্চে প্রথম নাটক করল উদীচী। নাম ‘আলো আসছে’। ঊনসত্তরে ছাত্রনেতা আসাদ শহীদ হলেন। আসাদের শার্ট শামসুর রাহমানের কবিতায় হলো পতাকা আর আসাদের জীবনদানকে গান ও নাটকে প্রেরণা হিসেবে গ্রহণ করল উদীচী। সত্তরের জলোচ্ছ্বাস ও নির্বাচন, দু-স্থানেই উদীচী রাখল গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। উদীচী কবি কাজী নজরুল ইসলামের মতো “মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী আর হাতে রণতূর্য” নিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করল। স্টেনগানের গুলির মতোই বেজে উঠলো উদীচী’র কণ্ঠ। স্বাধীনতা উত্তরকালে সাম্যবাদী সমাজ বিনির্মাণে উদীচী গণমানুষকে জাগ্রত করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করল। জেলায় জেলায় শাখা প্রশাখায় বিস্তৃত উদীচী সংস্কৃতির অবিনাশী শক্তি নিয়ে যখন কর্মকান্ড পরিচালনা করছে তখন এল চুয়াত্তরের সাম্রাজ্যবাদ সৃষ্ট কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ। উদীচী দুর্ভিক্ষ পীড়িত বিপন্ন মানুষের পাশে গিয়ে দাঁড়াল। এল পঁচাত্তরের পনেরোই আগস্ট। সপরিবারে নিহত হলেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্যক্তি মুজিবের সাথে নিহত হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অর্জনসমূহ। জেলখানায় নির্মমভাবে হত্যা করা হলো জাতীয় চার নেতাকে। আহত হলো পবিত্র সংবিধান। পরিকল্পিতভাবে ইতিহাসের চাকাকে ঘুরিয়ে দেওয়া হলো। রাজনীতি ও সংস্কৃতি চর্চা নিষিদ্ধ হলো সেনা শাসক জিয়াউর রহমানের নষ্ট চিন্তার আদেশে। পিছনে গমন করা বাংলাদেশ সেনা শাসকদের পরিপূর্ণ পরিচর্যায় এবং বিশ্বদানব সাম্রাজ্যবাদের সহযোগিতায় প্রসব করল সাম্প্রদায়িকতা। রাজনীতি থেকে শুরু করে বাঙালির অসাম্প্রদায়িক মনোজগৎ পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে বিস্তৃত করা হলো এই সদ্যজাত সাম্প্রদায়িকতা। এর মধ্যে সুস্থতা যখন নির্বাসিত, বঙ্গবন্ধু যখন নিষিদ্ধ, তখন উদীচী ১৯৭৬ সালের ১৬ ডিসেম্বর মাহমুদ সেলিম রচিত ‘ইতিহাস কথা কও’ সাহসী গীতিআলেক্ষ্যে উপস্থিত করল বাঙালির মহাকাব্য ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ। ১৯৭৭ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রমনায় ছয় ফুট দীর্ঘ মাইকের স্ট্যান্ডকে মঞ্চে দাঁড় করিয়ে অনুষ্ঠান করল উদীচী। সেদিন বঙ্গবন্ধুর প্রতীকী উপস্থাপনায় রমনায় সমবেত সকলে নতুন করে দ্রোহে উৎসাহিত হলো।

১৯৭৮ সালে যখন সেনা সরকার যাত্রাকে নিষিদ্ধ করল, মন্দিরে প্রতিমা ভাঙল মৌলবাদীরা, তখন উদীচী সিদ্ধান্ত নিয়ে মাঠে নামল। ঘোষণা দিল দ্বিতীয় যুদ্ধের। এবারের যুদ্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও সা¤্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। যুদ্ধ স্বাধীনতা বিরোধীদের বিরুদ্ধে। মাঠে ময়দানে, কলে-কারখানায়, প্রান্তবর্তী জনগোষ্ঠীর অনাদৃত প্রাঙ্গণে উদীচী’র গান, নাটক, কবিতা পরিবেশিত হলো। সেখানে ধর্মাশ্রয়ী রাজনীতির বিরুদ্ধে উদীচী’র বীণায় ধ্বনিত হলো রুদ্রের বীণা।

রক্তাক্ত পতাকা, ক্ষত-বিক্ষত সংবিধান, বিবর্ণ মুক্তিযুদ্ধের অর্জন, বিপন্ন মূল্যবোধ, ভোগবাদের প্রলোভন, পুঁজিবাদের দানবীয় উত্থান, সামরিক স্বৈরাচার, নষ্ট রাজনীতি, সাম্প্রদায়িকতা সব মিলিয়ে আশির দশকের বাংলাদেশ যেন অচেনা প্রান্তর। উদীচী আরো ধ্বংসের আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হলো। মানবিক মূল্যবোধের সর্বোদয় জাগৃতি ও বিকাশে শিল্পীর দায়িত্ব থেকে গৃহীত হলো উদীচী’র বিচিত্র কর্মসূচী। উর্দি শাসনের বিরুদ্ধে উন্মাতাল বাংলাদেশের শত সহ¯্র বিক্ষোভে উদীচী সম্পৃক্ত হলো সর্বাত্মক শক্তিতে। বিশ্ব বেহায়ার খপ্পর থেকে মুক্ত হয়ে জাতি পেল প্রত্যাশিত ’৯১ এর গণতন্ত্র। অথচ মুক্তির মহিমা থেকে বঞ্চিত থাকলো মানুষেরা। বরং নানামাত্রিক সহযোগিতায় সাম্প্রদায়িকতা স্থান পেল রাষ্ট্রের নীতিমালায়। চর্চিত হলো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ফলে মৌলবাদী চিন্তাচেতনা বিকশিত হলো সর্বত্র। মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত বাংলাদেশ স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর করতলগত হলো।

স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর পরই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে শুরু হয় যুদ্ধাপরাধ বিরোধী অভিযাত্রা। তিনি একাত্তরের ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে গোটা জাতিকে সংঘটিত করার চেষ্টা করেন। উদীচী সে আন্দোলনেরও সামনে থেকে গতি সঞ্চার করেছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে তৈরি মঞ্চগুলোতে উদীচী’র শিল্পীকর্মীদের পরিবেশিত গান, নাটক ছিল আন্দোলনকারীদের প্রেরণার উৎস। ইতিহাস বিকৃতকারীদের দোসর রাজাকার, যারা লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত লাল-সবুজ পতাকাবাহী গাড়িতে চড়ে জাতিকে কলঙ্কিত করেছে, স্বাধীনতার প্রায় চার দশক পরে হলেও তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো এ সকল আন্দোলনেরই ফসল। বিচারের শেষে রায় নিয়েও যখন টালবাহানা শুরু হয়, তখন দেশের সচেতন তরুণ প্রজন্মের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ আন্দোলন সৃষ্টি করে শাহবাগের ‘গণজাগরণ মঞ্চ’, যেটির প্রতিষ্ঠা ও বিকাশে উদীচী’র নেতৃবৃন্দ ছিলেন প্রাণভোমরা। পরে সেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে দেশের আনাচে-কানাচে যাতে প্রাণসঞ্চার করেন উদীচী’র সকল স্তরের কর্মীরা।

কোন জাতিকে ধ্বংস করতে হলে সর্বাগ্রে বিলীন করতে হয় তার সংস্কৃতিকে। আর এ মর্মবাণী উপলব্ধি করেই প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকারের শক্তি বারবার আঘাত হেনেছে উদীচী’র উপর। স্তব্ধ করে দিতে চেয়েছে প্রগতির চাকা। তারা ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশোরে দ্বাদশ জাতীয় সম্মেলনে বোমা মেরে কেড়ে নিয়েছে ১০ জন শিল্পী কর্মীকে, ২০০৫ সালে আত্মঘাতী বোমা হামলা করে হত্যা করে নেত্রকোণা উদীচী’র হায়দার ও শেলীসহ মোট ৭ জনকে, আহত হয় আরো অনেকে । এখনো বিভিন্ন জায়গায় চলছে নানামুখী হামলা, অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া, চোখ রাঙানি। কিন্তু ধর্মান্ধ মৌলবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি যতই চক্রান্ত করুক, যত রক্তই ঝরাক না কেন উদীচী’র ধমনী কখনো রক্তশূন্য হবে না। বরং আরো দ্বিগুণ শক্তি নিয়ে প্রতিবাদী হয়ে উঠবে দেশীয় দু:শাসন আর সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে।

আজ বিচ্যুতিহীন সংগ্রামী শিল্পীকর্মীর সমাবেশ উদীচী। উদীচী সকল অন্যায়-অবিচার, কুপম-ূকতা, ধর্মান্ধতা ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে এবং প্রগতির পক্ষে লড়াইয়ে সবার আগে সোচ্চার হয়েছে। এই অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিকামী, স্বেচ্ছাসেবী জাতীয় গণ-সাংস্কৃতিক সংগঠনটিকে তার এই ঋদ্ধ, সাহসী ও বলিষ্ঠ পথ চলার স্বীকৃত স্বরূপ ২০১৩ সালে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা ‘একুশে পদক’- এ ভূষিত করা হয়। এই অর্জন শোষিত-নিপীড়িত-বঞ্চিতের, এই অর্জন গণমানুষের। ৪৬ বছরের গৌরবোজ্জ্বল সিঁড়ি বেয়ে মুক্তির নিশানায় এগিয়ে যাবে উদীচী। উদীচীর জন্মের প্রত্যয় শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ আমরাই করবো এবং বাংলাদেশকে অসাম্প্রদায়িকই রাখবো- এই হোক আমাদের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর অঙ্গীকার।

জয় উদীচী। জয় হোক কৃষক শ্রমিক মেহনতি জনতার।

লেখক : সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠী
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সংসদ

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test