E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কোন পথে?

২০২৩ জুলাই ১১ ১৭:০০:০০
শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কোন পথে?

গোপাল নাথ বাবুল


শ্রীলঙ্কা ভারত মহাসাগরের দ্বীপরাষ্ট্র। বর্তমান প্রেসিডেন্টের ভাষায় ২ কোটি ২০ লক্ষ জনগোষ্ঠীর এ দেশটি ‘দেউলিয়া’। ২০২২ সালের মে মাসে দেশটি তাদের সার্বভৌম ঋণের কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে পরিণত হয় ঋণখেলাপিতে। ফলে এক গভীর অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ে যায়। ১৯৪৮ সালে স্বাধীনতা লাভের পর থেকে এতটা দুরাবস্থায় আর কখনও পড়েনি দেশটি। অথচ এক সময় অর্থনৈতিকভাবে সম্ভাবনাময় একটি দেশ হিসেবে বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়েছিল দেশটি। 

স্বাধীনতাকামী সংগঠন তামিল টাইগারদের সঙ্গে প্রায় ২৫ বছরের গৃহযুদ্ধের পর ২০০৯ সালে শ্রীলঙ্কা অর্থনৈতিক দিক থেকে একধরনের ‘শান্তির লভ্যাংশ’ পায়। সে সময় শ্রীলঙ্কা বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়। চীন সহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ঋণ দিতে আগ্রহী হয়। অর্থনীতির এ প্রবাহ দেশীয় অর্থনীতির প্রবৃদ্ধিকে বাড়িয়ে তোলে। তবে এর ফলে নানা ধরনের ভারসাম্যহীনতাও সৃষ্টি হয়। রফতানি ২০০০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত সাড়ে ৬ শত কোটি ডলার থেকে বেড়ে প্রায় ২ হাজার কোটি ডলারে গিয়ে পৌঁছে। ওই সময় শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিতে রফতানির অবদান ২৩ শতাংশ থেকে লাফিয়ে ৩৯ শতাংশে গিয়ে ঠেকে।

২০২০ সালে করোনা মহামারির আঘাত হানার আগপর্যন্ত শ্রীলঙ্কার বাণিজ্য-ঘাটতি জিডিপির ৬ শতাংশের বেশি ছিল। শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি এতটা জোরে ধাক্কা খাওয়ার একটি বড় কারণ এ ভারসাম্যহীনতা। আরেকটি বড় কারণ হলো, ঐতিহ্যগতভাবে শ্রীলঙ্কার বড় রফতানি পণ্য হচ্ছে কৃষিপণ্য, যার শুরুটা হয়েছিল দারুচিনি দিয়ে। ষোড়শ শতকে ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো এ দারুচিনিতে আকৃষ্ট হয়েছিল। বর্তমানে সবচেয়ে বড় রফতানি পণ্য হলো চা। কিন্তু ২০১৯ সালে ক্ষমতাসীন হবার পর গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশে অর্গানিক কৃষি চালু করেন। সেজন্য কৃষিক্ষেত্রে রাসায়নিক সার এবং কীটনাশক ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। এর নেতিবাচক প্রভাব পড়েছিল কৃষিক্ষেত্রে। এতে চায়ের উৎপাদন এক-পঞ্চমাংশ এবং চালের উৎপাদন ২০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। তার ওপর করোনা মহামারির কারণে পর্যটন শিল্পেও ধ্বস নামে এবং হাম্বানটোটা বিমান বন্দরসহ গোটাবায়া সরকারের নেওয়া কিছু মেগাপ্রকল্প শ্বেতহস্তিতে পরিণত হয়। তাছাড়া আয়কর এবং ভ্যাট কমানোর ফলে সরকারের রাজস্ব আয় ২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যায়। মুনাফার হার কমানোর চেষ্টায় বিপুল পরিমাণ মুদ্রা ছাপানো শুরু করেন। এতে ঋণের পরিমাণ বাড়তে থাকে। ওই সময় শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক সিনিয়র ডেপুটি গভর্ণর বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছিলেন, ‘ট্যাক্স কমানোর বিষয়টি ছিল একটি বড় ধরনের ভুল।’

তাছাড়া এ সময় খাদ্য ও জ্বালানি আমদানির জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার সঙ্কট দেখা দেয়। অর্থনীতির এমন শোচনীয় অবস্থায় শ্রীলঙ্কার রাজনীতি চরম সঙ্কটে পড়ে। শুরু হয় জনবিক্ষোভ। ব্যাপক জনবিক্ষোভ সামাল দিতে না পেরে জুলাইয়ে প্রেসিডেন্ট গোটাবায়া রাজাপাকসে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান। ক্ষমতায় আসেন রনিল বিক্রমসিংঘে। তিনি বুঝতে পারেন যে, শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির উত্তরণ ঘটাতে হলে সঙ্কটের উৎসে যে ভারসাম্যহীনতা, তা কমাতে হবে। তাঁর কাছে আরও পরিষ্কার হয় যে, ভবিষ্যতে রফতানি বাড়ানোর জন্য কৃষিপণ্য উৎপাদন বৃদ্ধিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে না। মূলত দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বিক্রমসিংঘে সরকার বিভিন্নভাবে শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক সঙ্কট থেকে মুক্তি দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এবং পরিকল্পনার অংশ হিসেবে তিনি দেশকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচাতে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) দ্বারস্থ হন। গত বছরের আগেও আইএমএফের সঙ্গে ১৬ দফা চুক্তিবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত প্রতিশ্রুতিগুলো পূরণ করতে ব্যর্থ হয় শ্রীলঙ্কা।

গত বছর রনিল বিক্রমসিংঘে শ্রীলঙ্কার স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে এক সভায় মিলিত হয়ে বলেন, ‘আমাদের বড়ধরনের প্রতিযোগীতামূলক রফতানিমুখী অর্থনীতির দিকে যেতে হবে। এছাড়া কোনও গত্যন্তর নেই। ২ কোটি ২০ লক্ষ মানুষের দেশ এটি। আমাদের দেশের বাইরে বাজার দেখতে হবে।’
মূল কথা, রফতানি বাড়াতে হবে। চায়ের বাইরে শ্রীলঙ্কার রফতানি পণ্যের মধ্যে আছে পোশাকশিল্প। কিন্তু ওই শিল্পের কাঁচামাল ও জ্বালানির জন্য শ্রীলঙ্কাকে পুরোপুরি বাইরের মুখাপেক্ষী হয়ে থাকতে হয়। তাহলে শ্রীলঙ্কার এমন কি আছে যা রফতানি করে অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে বের হয়ে আসতে পারে ? মালয়েশিয়া বা ভিয়েতনামের মতো ইলেক্ট্রনিক সামগ্রীর উৎপাদন শ্রীলঙ্কায় হয় না, যা দেশের জন্য বড় ধরনের সুবিধা এনে দিতে পারে। এক্ষেত্রে দ্বীপরাষ্ট্রটির জন্য একটি সম্ভাবনাময় জায়গা হয়তো হতে পারে সমুদ্রবন্দর সেবা।

এ ব্যাপারে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর নন্দলাল বীরাসিংহে বলেন, ভারত মহাসাগরের সমুদ্রপথের কেন্দ্রে অবস্থান করায় শ্রীলঙ্কার ভৌগোলিক অবস্থান তাদের দেশকে একটি বড় ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে গড়ে ওঠার সুযোগ করে দিয়েছে। রফতানির আয় বাড়াতে সমুদ্রবন্দর ও লজিস্টিক্স সেবা খাত আমাদের জন্য সম্ভাবনার জায়গা। ধারণা করা হয়, বিশ্বে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের এক-তৃতীয়াংশ এবং জ্বালানি তেল পরিবহনের দুই-তৃতীয়াংশই ভারত মহাসাগর দিয়ে চলাচল করে। কিন্তু জাতীয় পরিকল্পনার অভাবে এর সুযোগ নিতে পারছে না শ্রীলঙ্কা।

গত বছর অর্থনৈতিক সঙ্কটের সময় মার্কিন ডলারের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার মুদ্রার মূল্যমান অর্ধেকে নেমে যায়। এতে রফতানি বাড়বে বলে আশা করা হয়েছিল। কারণ মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার শেষ পর্যন্ত রফতানি বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক পরিচালক এবং থিঙ্কট্যাঙ্ক রোশান পেরেরা বলেন, ‘অতীতে আমরা দেশের মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের চলকগুলোর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে অবমূল্যায়িত হতে দিইনি, যা শেষমেষ আদতে রফতানিকে নিরুৎসাহিত করেছে।’

শ্রীলঙ্কার আরেকটি সংস্কারের দিক তুলে ধরেছে বিশ্বব্যাংক। সেটা হলো, আমদানি শুল্ক কমানো। বেশি শুল্কের কারণে আমদানি পণ্যের দাম অনেক বেশি হয়ে যায়। ভোক্তা পণ্যে আমদানি শুল্ক আরোপের দিক থেকে শ্রীলঙ্কা বিশ্বের সবচেয়ে রক্ষণশীল অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত। রফতানির ক্ষেত্রে এসব বাধা দুর করার উদ্যোগ বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে পারে এবং দেশের শিল্পকে আরও দক্ষ করার পাশাপাশি রফতানিও বাড়াতে পারে।

এখন শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির বড় প্রশ্ন হলো, আদৌ কি শ্রীলঙ্কায় প্রয়োজনীয় সংস্কার হয়েছে ? দেশ কি উন্নতির দিকে সত্যিই যাচ্ছে ? দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করেছিল, ২০২৩ এর জুলাই থেকেই তাদের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করবে। কিন্তু গত ৬ জুলাই কলম্বোর নিজ কার্যালয়ে সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ৬৩ বছর বয়সি নন্দলাল বীরাসিংহে জানিয়েছেন, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের চক্র থেকে দেশকে উদ্ধারের শেষ সুযোগ চলছে। এখনই ব্যবস্থা না নেওয়া গেলে দেশকে বাঁচানোর আর কোনও সুযোগ থাকবে না। শ্রীলঙ্কাকে বাঁচানোর এটাই শেষ সুযোগ। বীরাসিংহে মনে করেন, তিনি যে পরিকল্পনাগুলো সাজিয়েছেন, সেগুলো শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর শেষ সুযোগ।

তিনি আরও জানান, অর্থনৈতিক বিপর্যয় নিয়ে কয়েকবছর আগেই শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর থাকাকালীন সময়ে তিনি শ্রীলঙ্কাকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তখন তাঁর সতর্কবার্তাগুলো কেউ আমলে নেননি। এ অবস্থায় আগাম অবসর নিয়ে তিনি বিদেশে পাড়ি জমান। তবে গতবছর শ্রীলঙ্কার চরম অর্থনৈতিক দুর্দশার মধ্যে পড়ার পর দেশকে বিপর্যয় থেকে উদ্ধারের জন্য আবারও তাঁকে দেশে ফিরিয়ে এনে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।

নন্দলাল সংবাদ সংস্থাকে জানান, ‘আমি দেখলাম, যেভাবে নীতিগুলো বাস্তবায়ন করা হচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি খারাপ হবে। সে-সময় আমি যে ধরনের পরিস্থিতি হওয়ার কথা বলেছিলাম তেমনটাই ঘটেছে। এবার আর কোনও অজুহাত দেওয়া যাবে না। দ্বিতীয় কোনও সুযোগও আর আসবে না, যা করার আমাদের এখনই করতে হবে। এক্ষেত্রে আমি মনে করি, সঙ্কটই একটি সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে।’
বীরাসিংহে মনে করেন, শ্রীলঙ্কা যদি বর্তমান আইএমএফের সঙ্গে লেগে থাকে তবে ২ থেকে ৪ বছরের মধ্যে এর অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। যদি অন্য কোনও কর্মসূচীর দিকে ঝুঁকে পড়ে, তা হলে সেটা খুব কঠিন হবে এবং চুড়ান্ত পরিণতি ঘটবে।

তিনি সাক্ষাৎকারে আরও জানান, ‘আমি সিনিয়র ডেপুটি গভর্নর থাকাকালে সবসময়ই আমার উদ্বেগগুলো জানাতাম। কিন্তু রাজাপাকসে প্রশাসন এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অন্য কর্মকর্তারা আমার আপত্তিগুলোকে গুরুত্ব দিতেন না। পরিস্থিতির কারণে তখন আমার মনে হয়েছিল, আগাম অবসর নেওয়া ছাড়া আমার আর কোনও উপায় নেই।’

তাহলে শ্রীলঙ্কার অর্থনীতি কোন পথে ? অর্থনৈতিক দুর্দশা থেকে কি শ্রীলঙ্কার মুক্তি মিলবে না ? এমন অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে অর্থনীতিবিদদের মনে। তবে ইতিবাচক দিক হচ্ছে, গত বছরের ধাক্কা এ ধরনের কষ্টদায়ক সংস্কার কর্মসূচী এগিয়ে নেওয়ার পক্ষে একটি উৎসাহ সৃষ্টি করেছে এবং শ্রীলঙ্কাকে অন্তত লড়াই করার একটি সুযোগ করে দিয়েছে, যার মাধ্যমে দেশটি তার ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে অর্থনৈতিক সঙ্কট মোকাবিলা করে সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যাবে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test