E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সূর্যকন্যাকে বাঁচাতে বৃক্ষরোপণ অবশ্যম্ভাবী

২০২৩ জুলাই ১৬ ১৭:১৯:০২
সূর্যকন্যাকে বাঁচাতে বৃক্ষরোপণ অবশ্যম্ভাবী

গোপাল নাথ বাবুল


বর্তমানে দেশের সর্বত্র চলছে তীব্র তাপপ্রবাহ। এর মূল কারণ হলো বৃক্ষনিধন। যত্রতত্র বৃক্ষনিধন করে গড়ে উঠেছে ফ্ল্যাট বাড়ি ও কারখানা। রাস্তার উন্নয়ন প্রকল্পে রাস্তা প্রশস্ত করার জন্য করা হয়েছে প্রচুর বৃক্ষকর্তন। নতুন বৃক্ষরোপণ সেই স্থানে করা হচ্ছে না। করলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা অনেক কম। অথচ মানুষের জীবনে বৃক্ষের গুরুত্ব অপরিসীম।

বৃক্ষ ও প্রাণীকুল একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। অনাদিকাল থেকে উদ্ভিদ ও প্রাণী টিকে থাকার সংগ্রামে একে অপরকে সহায়তা করে আসছে। বিশ্ব প্রকৃতিতে এদের অবস্থান পরস্পরের পরিপূরক। বৃক্ষকে তাই প্রাণী জগতের প্রাণও বলা যেতে পারে। প্রাণীদের বেঁচে থাকার প্রধান ও মূল উপকরণ হলো অক্সিজেন, যা বৃক্ষ থেকেই উৎপন্ন ও নির্গত হয়। প্রত্যেক নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে প্রাণীজগৎ কার্বনডাই অক্সাইড বর্জন করে। এটি এক ধরনের বিষাক্ত পদার্থ, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। বৃক্ষ সেই দুষিত কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে প্রাণীকুলের বেঁচে থাকার মূল উপাদান অক্সিজেন নিঃসরণ করে।

এ পৃথিবীর মানুষ অতীব অধ্যবসায় ও প্রয়াসের দ্বারা মনের মতো করে সাজিয়েছে মমতাময়ী পৃথিবীকে। বিভিন্ন ধরনের আবিষ্কার, যানবাহন, উদ্ভিদ, ফল-ফুল দিয়ে অপরূপা প্রিয়দর্শিনী করে গড়ে তোলা হয়েছে সূর্যকন্যাকে। মানুষের দিবারাত্র চেষ্টায় আজ এ সূর্যকন্যাকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিয়েছে। এভাবে লক্ষ লক্ষ বছরের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠা মনোরম পৃথিবীটাকে আজ মানুষই ধ্বংস করে দিচ্ছে তাদের অজান্তেই। উন্নতির শিখরে পৌঁছতে হাজার হাজার কলকারখানা সৃষ্টি করছে। ফলে যে ভয়ানক কার্বন-ডাই অক্সাইড বেড়ে গিয়ে পৃথিবীর উষ্ণায়ন চরমে পৌঁছেছে।

এতে বায়ুমন্ডল, আবহাওয়া ও ঋতুচক্রের ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে এবং ভবিষ্যতে আরও পরিবর্তন হয়ে পৃথিবীকে ধ্বংস করার পথ তৈরি করছে। যে অরণ্য ও মানুষ তথা জীবজগৎ পাশাপাশি বাস করে একে অন্যের প্রতি সহযোগিতা ও সহায়তার মাধ্যমে এ পৃথিবীতে প্রাণ চিরায়ত ও বায়ুমন্ডল থেকে অক্সিজেন টেনে নিয়ে জীবন যাপনের সুশৃঙ্খল অবস্থান গড়ে ওঠেছে, সেই অরণ্য বিবেকহীনভাবে ধ্বংস করছে এক শ্রেণির মানুষ।

অতীতে বাংলার ফুসফুসে অক্সিজেনের অভাব ছিল না। কিন্তু বহুদিন ধরে প্রশাসনের নাকের ডগায় একদল অসাধু কাঠ ব্যবসায়ী, দুর্নীতিগ্রস্ত বনকর্মী ও কিছু ক্ষমতাবান মানুষের চক্রান্তে সুন্দরবনসহ পার্বত্য এলাকার দুর্লভ ও মহা মূল্যবান যেমন-সেগুন, শাল, গরান, সুন্দরী, গেওয়াসহ বিভিন্ন গাছ কর্তন করে সবুজ ধ্বংস করে আসছে। দেশের সম্পদ এভাবে অবৈধভাবে বৃক্ষ মাফিয়াদের হাতে তুলে দিয়ে অনেকে বনে গেছে কোটি কোটি টাকার মালিক। সে বৃক্ষ মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যে দেশের মূল্যবান বৃক্ষ সমৃদ্ধ বনাঞ্চল প্রায় শেষ হতে বসেছে এবং নিয়মিতভাবে এসব গাছ কাটার ফলে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ অরণ্য সুন্দরবন আজ বিপন্ন।

সরকার, বনবিভাগ এবং সাধারণ মানুষ ব্যাপক বৃক্ষরোপণের ঘোষণা দিয়ে ক্যামরাবন্দি হয়ে বৃক্ষরোপণ করে। কিন্তু পরবর্তীতে এসব চারাগাছ বড় হওয়ার জন্য কোনও রক্ষণাবেক্ষণ থাকে না বলে একসময় চারাগাছগুলো মরে যায় বা নষ্ট হয়ে যায় অথবা গরু-ছাগলে খেয়ে ফেলে। ফলে বাংলাদেশের ফুসফুসে আর আগের মতো অবাধে অফুরন্ত অক্সিজেন জমা হচ্ছে না। তাছাড়া উন্নয়নের নামে বেহিসেবি বৃক্ষকর্তনের কারণে আমাদের সম্মুখীন হতে হচ্ছে অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, খরা, ঘুর্ণিঝড়সহ পরিবেশ দুষণের। ফলে অ্যাজমা, হার্টের সমস্যা, ফুসফুসের রোগ, ব্রঙ্কাইটিসে আক্রান্ত হওয়া সহ নানা রোগ ব্যাধির প্রকোপ বেড়েছে। যা খুবই উদ্বেগজনক।

আর অরণ্য ধ্বংস ও বৃক্ষকর্তনের ফলে পরিবেশের দুষণ সমস্যাও দিন দিন বৃদ্ধি পেয়ে পৃথিবীকে বাসের অযোগ্য করে তুলছে। যেমন-বায়ু হলো প্রাণীজগতের জন্য অত্যাবশ্যকীয় উপাদান, যা ছাড়া কোনও প্রাণী কয়েক মিনিটের বেশি বেঁচে থাকতে পারবে না। একজন স্বাভাবিক মানুষ দিনে ২২ হাজার বার শ্বাস নেয় এবং এ ধরনের শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় যে বায়ু ব্যবহৃত হয়। প্রাকৃতিক বাতাসে ৭৮.০৯ শতাংশ নাইট্রোজেন, ২০.৯৫ শতাংশ অক্সিজেন এবং ০.৯৩ শতাংশ আর্গন মাইক্রো উপাদান হিসেবে থাকে। বাতাসে মাইক্রো উপাদান হলো ০.০৩১৮ শতাংশ কার্বন-ডাই অক্সাইড, ০.০০০১ শতাংশ ক্রিপ্টন এবং ০.০০০৫২ শতাংশ হিলিয়াম। আরও অনেক যৌগ যেমন সালফার-ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, ওজৌন ইত্যাদিও উল্লিখিতগুলোর তুলনায় অনেক কম ঘনত্বে উপস্থিত রয়েছে। এগুলো ছাড়াও জলীয় বাষ্প এবং ধুলিকণা, বিভিন্ন পরিমাণে এবং আকারে বায়ুতে উপস্থিত রয়েছে।

বায়ুদুষণে রাজধানী ঢাকা ১ নম্বরে আছে। ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরের বাতাসে এখন দিন দিন কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এই বায়ুদুষণের কারণগুলো হলো কয়লা ও জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার, ইটভাটা, কল-কারখানার বর্জ্য ও ধোঁয়া, গাড়ির কালো ধোঁয়া, অবৈধ ট্যানারি, নির্মাণ স্থলের দুষণ এবং আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাব। বায়ুদুষণ দিন দিন ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করছে। কারণ, আমরা আইন মানার চেয়ে আইন ভাঙ্গতে বেশি পছন্দ করি। শহরে গাড়ির ব্যবহার যেমন বেড়েছে, তেমনি দৈনন্দিন জীবনে এয়ার কন্ডিশনার, ফ্রিজ, এয়ারকুলার ইত্যাদির ব্যবহারও যথেষ্ট বেড়েছে। এগুলোও বায়ুমন্ডলে দুষণ ছড়ায়। ফলে বায়ুদুষণ মানবজাতির ভবিষ্যৎকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে দাঁড় করিয়েছে। এ বায়ুদুষণ থেকে মানবজাতিকে বাঁচতে হলে বৃক্ষরোপণ প্রয়োজন। কারণ কোনও স্থানে ব্যাপক হারে বৃক্ষরোপণ করলে সে স্থানের বায়ুতে থাকা ধুলি, ধোঁয়া এবং অন্যান্য দুষক পদার্থগুলোর পরিমাণ কমতে থাকে।

পরিবেশের এমন বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে বৃক্ষরোপণের কোনও বিকল্প নেই। বৃক্ষ আমাদের ফুল দেয়, ফল দেয়, ছায়া দেয়, জ্বালানি কাঠ দেয়। গৃহস্থালীর মূল্যবান আসবাবপত্রসহ যানবাহন নির্মাণ ও বড় বড় কলকারখানাতে কাঠের যোগান দেয়। বিভিন্ন প্রকার চিকিৎসা ও ওষুধ তৈরিতেও গাছ আমাদের কাজে লাগে। বৃক্ষ প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করে। বৃষ্টির পরিমাণ বৃদ্ধিতে সহায়তা করে। মাটির আর্দ্রতা রক্ষা করে। বায়ুমন্ডলের তাপমাত্রা হ্রাস করে। বায়ুদুষণ ও শব্দদুষণ রোধে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখে। সর্বোপরি বৃক্ষ আমাদের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ুর পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে দেশকে রক্ষা করতে আরও ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। পরিবেশের দুষণ নিয়ন্ত্রণসহ আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার স্বার্থে অধিক পরিমাণে বৃক্ষরোপণ করা প্রয়োজন। জলবায়ু সঙ্কট ও উষ্ণায়ন মোকাবিলায় বিশ্বজুড়ে কোটি কোটি গাছ রোপণ করার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন উদ্ভিদ বিজ্ঞানীরা। জলবায়ু পরিবর্তন রুখতে গাছ লাগানোর কর্মসূচী সবচেয়ে ভালো ও কম ব্যয়বহুল উপায় বলে মনে করছেন তাঁরা। গাছ লাগানোর মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ দুই-তৃতীয়াংশ কমানো সম্ভব হবে।

উদ্ভিদ বিজ্ঞানীদের মতে, সরল পাতাযুক্ত গাছ যেমন-আম, কদম্ব, দেবদারু, শাল, পিপুল, পাকুর, অশ্বত্থ, সেগুন প্রভৃতি গাছের বায়ুতে ভাসমান ধুলিকণাকে অপসারিত করার ক্ষমতা তুলনামূলকভাবে বেশি থাকে। তাই রাস্তার দু’পাশসহ যেসব স্থানে ধুলিকণা বেশি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেসব স্থানে সরলপাতাযুক্ত গাছ রোপণ করা উচিত এবং জাতীয় সড়কগুলোসহ দেশের প্রতিটি রাস্তার দু’পাশে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ করা হলে প্রচুর পরিমাণে বিশুদ্ধ অক্সিজেন, পাখিদের আশ্রয় ও সর্বোপরি পথচারীরা সুনিবিড় ছায়া পাওয়া যাবে।

সুতরাং দুষণ কমাতে বৃক্ষের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য। উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করতে হবে। আমাদের পবিত্র সংবিধানের ১৮(ক) অনুচ্ছেদে স্পষ্টভাবে বলা আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ, প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবে। সংবিধানের এ অঙ্গীকার রক্ষার্থে বৃক্ষনিধন নিয়ন্ত্রণ করে আমরা যদি প্রত্যেকে অন্তত একটি করে গাছ লাগাই এবং তার পরিচর্যা করি, তবে কোটি কোটি গাছে ভরে যাবে বাংলাদেশ। তাই আসুন, গাছ লাগাই, দেশ বাঁচাই। এটাই হোক আমাদের অঙ্গীকার। তা নাহলে অদুর ভবিষ্যতে অসহায় ব্রেক ভাঙ্গা গাড়ির মতো সর্বনাশের অতল খাদের দিকে এগিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনও উপায় থাকবে না।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test