E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

২০৯তম জন্মদিবস

আধুনিক বাংলা গদ্যের পথিকৃত প্যারীচাঁদ মিত্র

২০২৩ জুলাই ২১ ১৪:৪৪:১৪
আধুনিক বাংলা গদ্যের পথিকৃত প্যারীচাঁদ মিত্র

গোপাল নাথ বাবুল


ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের হাতে বাংলা গদ্যের যে সাধুরূপ গড়ে ওঠেছিল, তা অনুকরণ না করে বাংলা গদ্যের ধারায় এক অভিনব লঘু ভঙ্গির প্রবর্তন করেন যিনি, তাঁর নাম প্যারীচাঁদ মিত্র। বিদ্যাসাগরের ভাষার পদবিন্যাসে যে মন্থরতা ছিল, অসংখ্য উপবাক্য ব্যবহারে গতি শিথিল এবং সংস্কৃতির অতিপ্রাধান্যের ফলে সাধারণ পাঠকের অবোধগম্য সৃষ্ট গাম্ভীর্য ভাষার তিনি কিছুটা সমাধান করে প্রথমবারের মত তাঁর উপন্যাসে বাংলা সাহিত্যের প্রচলিত গদ্যরীতির নিয়ম ভেঙ্গে চলিত ভাষারীতি প্রয়োগ করেন। 

বাংলা সাহিত্যের অন্যতম ঔপন্যাসিক, লেখক, সাংবাদিক, সংস্কৃতিসেবী, ব্যবসায়ী প্যারীচাঁদ মিত্র জন্মগ্রহণ করেন ১৮১৪ সালের ২২ জুলাই। তাঁর পিতার নাম ছিলেন রামনারায়ণ মিত্র। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এবং অন্যতম এ লেখকের পৈত্রিক নিবাস ছিল অধুনা পশ্চিবঙ্গের হুগলী জেলার পাণিসেহালা গ্রামে। তিনি ১৮৮৩ সালের ২৩ নভেম্বর কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। বিশিষ্ট এ মহান ব্যক্তিত্বের ২০৯তম জন্মদিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

প্যারীচাঁদ মিত্র শৈশবে একজন গুরুমহাশয়ের কাছে বাংলা, পরে একজন মুন্সির কাছে ফরাসি শেখেন। ইংরেজি শেখার জন্য ১৮২৭ সালে তিনি হিন্দু কলেজে ভর্তি হন এবং খ্যাতিমান শিক্ষক হেনরি ডিরোজিও’র তত্ত্বাবধানে থেকে শিক্ষা সম্পন্ন করেন।

তিনি মহিলাদের জন্য একটি ‘মাসিক পত্রিকা’ সম্পাদনা করেন, যার সহযোগী ছিলেন রাধানাথ সিকদার। এ পত্রিকার ওপরের পাতায় লেখা ছিল “এই পত্রিকা সাধারণের বিশেষতঃ স্ত্রীলোকদের জন্যে ছাপা হইতেছে, যে ভাষায় আমাদিগের সচরাচর কথাবার্ত্তা হয়, তাহাতেই প্রস্তাব সকল রচনা হইবেক। বিজ্ঞ পন্ডিতেরা পড়িতে চান পড়িবেন, কিন্তু তাঁহাদিগের নিমিত্তে এই পত্রিকা লিখিত হয় নাই।”
কর্মজীবন শুরু করেন ১৮৩৬ সালে কলকাতা পাবলিক লাইব্রেরীর ডেপুটি হিসেবে। বেথুন সোসাইটি ও ব্রিটিশ ইন্ডিয়া সোসাইটির অন্যতম উদ্যোগী ছিলেন। তিনি ১৮৩৮ সালে জ্ঞানান্বেষণ সভার সদস্য এবং পশুক্লেশ নিবারণী সভার সদস্য ছিলেন।

প্যারীচাঁদ মিত্র জাস্টিস অব পিস (১৮৬৩), কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো (১৮৬৪), কিশোর অপরাধীদের সংশোধন কেন্দ্রের পরিদর্শক (১৮৬৪), কলকাতা হাইকোর্টের গ্র্যান্ড জুরী (১৮৬৮-১৮৭০), বঙ্গীয় আইন পরিষদের সদস্য (১৮৬৮-১৮৭০), কলকাতা মিউনিসিপ্যাল বোর্ডের অবৈতনিক ম্যাজিস্ট্রেট প্রভৃতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানসমূহের সম্মানসূচক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। গ্রন্থাকারের প্রতি প্যারীচাঁদ মিত্রের দায়িত্ববোধ সম্পর্কে ‘ইন্ডিয়ান মিরর’ পত্রিকা লিখেছিল, “প্যারীচাঁদ টয়লেড ফ্রম মর্ণিং টু ইভ উইথ লওডেবল জিয়ল এন্ড এনার্জি ইন গেটিং সাবস্ক্রাইপসন্স ফর দি বিল্ডিং।”

তাঁর ইংরেজি ভাষায় রচিত লেখাসমূহ ছাপা হত ইংলিশম্যান, ইন্ডিয়ান ফিল্ড, ক্যালকাটা রিভিউ, হিন্দু প্যাট্রিয়ট, ফ্রেন্ড অব ইন্ডিয়া প্রভৃতি পত্রিকায়।

প্যারীচাঁদ মিত্রই বাংলা সাহিত্যের প্রথম ঔপন্যাসিক। তাঁর ছদ্মনাম টেকচাঁদ ঠাকুর। তাঁর শ্রেষ্ঠ ও বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাস ‘আলালের ঘরের দুলাল’ ১৮৫৮ সালে প্রথম গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে নগরজীবনের উচ্ছৃঙ্খলতা ও অধঃপতিত সমাজের চিত্র প্যারীচাঁদ মিত্র এ উপন্যাসে ফুটিয়ে তুলেছেন। জমিদার রামবাবুর পুত্র মতিলাল কীভাবে অতিরিক্ত আদরে এবং সঙ্গদোষে খারাপ হয়ে যায়, আবার দুঃখ-দুর্দশার মধ্য দিয়ে কীভাবে মতিলালের স্বভাব পরিবর্তন হয় এবং সৎ ও ধর্মনিষ্ঠ হয়, তা এ উপন্যাসের প্রতিপাদ্য বিষয়। মনস্তত্ত্ব বিশ্লেষণের অভাবে গ্রন্থটি উপন্যাস হয়ে ওঠতে না পারলেও সেই সময়কার কলকাতার নগরজীবনের কথা উপন্যাসে ধরা পড়েছে। প্যারীচাঁদ মিত্র সেই সময়ের সমাজ জীবনের বাস্তব চিত্র তুলে ধরতে গিয়ে গুরুগম্ভীর সংস্কৃত ভাষার পরিবর্তে আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করেছেন। কলকাতায় ব্যবহৃত চলতি ভাষার ব্যবহার ‘আলালের ঘরের দুলাল’কে আরও বেশি বাস্তবের কাছাকাছি এনে দিয়েছে।

এ উপন্যাসের একটি আদর্শবান, ন্যায়নিষ্ঠ ও সৎচরিত্রের নাম-রামলাল। সে মতিলালের ভাই। আর খল চরিত্রের নাম-ঠকচাচা, যার প্রকৃত নাম উপন্যাসে উল্লেখ ছিল মোকাজান মিয়া। এ উপন্যাসটি ‘দি স্পয়ল্ড চাইল্ড’ নামে ইংরেজি ভাষায়ও অনুবাদ করা হয়। উক্ত উপন্যাসে যে কথ্য ভাষা ব্যবহার করা হয়েছে, তা পরবর্তীতে ‘আলালী ভাষা’ নামে পরিচিতি লাভ করে।

তাঁর রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থের নাম-‘মদ খাওয়া বড় দায়, জাত থাকার কি উপায়’। উক্ত গ্রন্থটি একটি ব্যঙ্গাত্মক গদ্য রচনা। এ গ্রন্থে তৎকালীন গোঁড়া শ্রেণির ব্যক্তিদের চিত্রঙ্কন করা হয়েছে। প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘রামারঞ্জিকা’ গ্রন্থটি প্রকাশিত হয় ১৮৬০ সালে। এ গ্রন্থটিতে সংলাপময় কুড়িটি অধ্যায় রয়েছে।
১৮৬৫ সালে প্রকাশিত তাঁর ‘যৎকিঞ্চিৎ’ গ্রন্থটি একটি ঈশ্বর তথ্যমূলক দার্শনিক প্রবন্ধ গ্রন্থ। তিনি বাংলা সাহিত্যে চলিত ভাষার প্রবর্তন করলেও প্রবন্ধগুলি সাধু ভাষায় লিখেন।

তাঁর রচিত ‘গীতাঙ্কুর’ ১৮৬১, ‘কৃষিপাঠ’ ১৮৬১, ‘ডেভিড হেয়ারের জীবনচরিত’ ১৮৭৮, ‘অভেদী’ ১৮৭১ ও ‘আধ্যাত্মিকা’ ১৮৮০ সালে প্রকাশিত হয়। ‘অভেদী’ এবং ‘আধ্যাত্মিকা’ গ্রন্থ দু’টোতে মানবতার স্বরূপ ও ঈশ্বর মহিমার কথা ব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং ‘কৃষিপাঠ’ গ্রন্থে সিপাহী বিদ্রোহেরও আগে ১৮৫৪-৫৫ সালে তিনি ‘ফুলকপি জন্মানোর প্রণালী, কলকাতার বাগানে উত্তর হিন্দুস্থানীয় তরমুজ ইত্যাদি চাষ করার ধারা, কানপুর অঞ্চলে স্ট্রবেরির চাষ করার ধারা, খেজুর গাছ রোপণ এবং তার রস হতে ইউরোপীয় ধারানুসারে চিনি প্রস্তুতকরণ’ নিয়ে লিখেছিলেন।

‘দি জমিদার এন্ড রায়তস্’ প্রবন্ধে তিনি সমালোচনা করেন চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের। তাঁর ইংরেজি গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ‘এ বায়োগ্রাফিক্যাল স্কেচ অব ডেবিড হেয়ার’ (১৮৭৭), ‘দি স্পিরিচুয়্যাল স্ট্রাই লিভস্’ (১৮৭৯), ‘স্ট্রাই টোথ অব স্পিরিচুয়্যালিজম’ (১৮৭৯), ‘লাইফ অব দেওয়ান রামকমল সেন’ (১৮৮০), এবং লাইফ অব কোলেস্ ওরথি গ্র্যান্ট’ (১৮৮১)। এছাড়া, ১৮৮১ সালে প্রকাশিত ‘বামাতোষিণী’ গ্রন্থটিতে নারীশিক্ষা সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। পরিশেষে জেমস্ লং সাহেন’র ভাষায় ‘বাংলার চার্লস ডিকেন্স’ এবং বিশিষ্ট এ লেখকের জন্মদিবসে আবারও গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test