E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চরম তাপপ্রবাহে পুড়ছে বিশ্ব, মরছে মানুষ

২০২৩ জুলাই ২৫ ১৬:৩৩:৫৮
চরম তাপপ্রবাহে পুড়ছে বিশ্ব, মরছে মানুষ

গোপাল নাথ বাবুল


বিগত কয়েক বছরে জলবায়ু পরিবর্তন আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ বাড়িয়েছে। বিশ্বব্যাপী কার্বন নির্গমন কমছে না। ফলে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে, জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটছে। আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে তাপমাত্রা। প্রায় এক দশক ধরে বৈশ্বিক উষ্ণতা ঊর্ধ্বমুখী। পৃথিবীর তাপমাত্রা দীর্ঘমেয়াদীভাবে বাড়তে চলেছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনকে দায়ী করেন জলবায়ু বিশেষজ্ঞরা। সুতরাং বিশ্ব-উষ্ণায়নের প্রত্যক্ষ প্রভাব প্রাত্যাহিক মানবজীবনের ওপর সরাসরি পড়তে শুরু করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এ বিষয়টিকে আর হেলাফেলা করে দেখার সুযোগ নেই। 

পরিবেশ-বিশেষজ্ঞ পিটার ডাইন্স কিছুকাল আগে ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, গোটা ভারতীয় উপমহাদেশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে চলতি বছরে এক নজিরবিহীন গ্রীষ্মের প্রকোপ দেখা যেতে পারে। বিশেষ এক পরিভাষা ব্যবহার করে তিনি জানিয়েছিলেন, এ বছরের গ্রীষ্মে, ভারতীয় উপমহাদেশের একেকটি অংশে ওয়েট বাল্ব-টেম্পারেচার বা ডব্লিউবিটির পরিমাণ এতটাই বেড়ে যেতে পারে, যে তার প্রকোপে মানবজীবনের অস্তিত্ব কষ্টকর হয়ে ওঠতে পারে। ওয়েট বাল্ব টেম্পারেচার বা আর্দ্রাবস্থায় তাপমান যন্ত্রের উষ্ণতা ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়ালে বাইরে কাজ করা যায় না। এ মান ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গন্ডি ছাড়ালে বেঁচে থাকাটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।

অর্থাৎ গরমের পরিমাণ সরাসরি হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনাকে আরো বাড়িয়ে তুলবে। এতখানিই গরমে পুড়বে বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশ যে, মানুষের অস্তিত্ব রক্ষাও সেই দহনে কার্যত কঠিন হয়ে পড়বে। বক্তব্যগুলো ভীতিকর মনে হলেও এর বাস্তবতা রয়েছে যা আমরা প্রতিমূহুর্তে অনুভব করছি। মূলত উষ্ণতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আর্দ্রতা বৃদ্ধির কারণেই অস্বস্তির পরিমাণ বাড়ে, বাড়ে হিটস্ট্রোকের সম্ভাবনা, বায়ুর উষ্ণতার কারণে সরাসরি শরীরের ওপরে তার প্রভাব ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে শুরু করে।
বিজ্ঞানও বলছে, ডব্লিউবিটি’র মান ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের গন্ডি ছাড়িয়ে গেলে, বাইরে ছায়ায় বসে থাকা অবস্থায় জলের যথাযথ ব্যবস্থা থাকলেও কয়েক ঘণ্টার বেশি কোনো মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা অসম্ভব হয়ে পড়ে। পিটার ডাইনসের বক্তব্য অনুসারে এ বছরের উপমহাদেশিয় গ্রীষ্মে জায়গায় জায়গায় এ ডব্লিউবিটি বা আর্দ্রাবস্থায় তাপমান যন্ত্রের উষ্ণতার মান সেই ৩৫ ডিগ্রির বিপজ্জনক সীমাকেও ছুঁয়ে ফেলতে পারে। দেশের বর্তমান তাপপ্রবাহের দাপট তারই পূর্বাভাস বলে মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশে ঋতু পরিক্রমায় এখন ঘনঘোর বর্ষা। বৃষ্টির পানিতে ভরপুর থাকার কথা। অথচ আবহাওয়ার উল্টো পরিস্থিতি বিরাজ করছে এখন। দেশের ওপর দিয়ে বয়ে চলছে মৃদু তাপপ্রবাহ। অসহনীয় গরমে অস্বস্তিকর অবস্থা বিরাজ করছে জনজীবনে। আবহাওয়া বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এ বর্ষায় একটানা বৃষ্টি আর মিলছে না। গ্রীষ্মকালের মতো উষ্ণতা অনুভূত হচ্ছে সারাদেশে। অধিদপ্তরের পরিসংখ্যানে গত রবিবার দেশের সর্বোচ্চ ৩৭.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগের অঞ্চলসমূহে ৩২.৮ থেকে ৩৫.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ঘরে ওঠানামা করেছে।
সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে ওঠে এসেছে আরো ভয়ঙ্কর তথ্য। আগামী ৫ বছরে নাকি পৃথিবী কার্যত উনুনে পরিণত হবে। চলতি বছরে ক্রমাগত তাপপ্রবাহ অনেকটা তেমনটাই আভাস দিতে শুরু করেছে।

এরইমধ্যে তাপপ্রবাহের জেরে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে মৃত্যুর খবর যেভাবে আসতে শুরু করেছে তা পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলতে শুরু করেছে। গত মধ্য জুনের ৩ দিনে তাপপ্রবাহের জেরে উত্তরপ্রদেশে ৫৪ জন এবং বিহারে ৪৪ জনসহ মোট ৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাজারের কাছাকাছি অসুস্থ হয়ে পড়েছে। যাদের অধিকাংশের বয়স ৬০ বছরের ওপরে। এদের অধিকাংশের মৃত্যু হয়েছে হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক ও ডায়রিয়ায়।

সাধারণত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে এপ্রিল ও মে মাস পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি গরম অনুভূত হয়। মৌসুমী বৃষ্টি শুরুর আগে ওই অঞ্চলে তাপমাত্রা বেশ বাড়ে। কিন্তু এবার তাপমাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা আগে কখনো দেখা যায়নি। জলবায়ু নিয়ে কাজ করা ম্যাক্সিমিলানো হেরেরা আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছেন, থাইল্যান্ডে গত ১৫ এপ্রিল সে দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ ৪৫.৪ ডিগ্রি, লাওসে মে মাসে পরপর দু’দিন ৪৬.৫ ডিগ্রি এবং ভিয়েতনামে ৪৪.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। হেরেরা এ পরিস্থিতিকে ‘অন্তহীন নৃশংসতম দাবদাহ’ বলে বর্ণনা করেছেন।

বিজ্ঞানীদের আন্তর্জাতিক জোট ওয়ার্ল্ড ওয়েদার অ্যাট্রিবিউশনের (ডব্লুডব্লুএ) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় যে তাপপ্রবাহ চলছে, এমনটি ২০০ বছরে একবার দেখা যায়। তবে মনুষ্যসৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তন ছাড়া এমন পরিস্থিতি ‘কার্যত অসম্ভব’। উচ্চমাত্রার আর্দ্রতার কারণে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এ ঝলসানো তাপ আরো বেশি অসহনীয় হয়ে ওঠতে পারে।

ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট মরিয়ম জাকারিয়া জানিয়েছেন, আশপাশে আর্দ্রতা যখন খুব বেশি থাকে, তখন শরীর নিজেকে শীতল করতে ঘাম ছাড়তে থাকে। কিন্তু ঘাম বাষ্পীভূত না হওয়ার কারণে শরীরে ভয়াবহ জলশূন্যতা দেখা দেয়। এটা তীব্র আকার ধারণ করলে হিট স্ট্রোক, এমনকী মৃত্যুও হতে পারে। এ কারণে শুষ্ক তাপমাত্রার চেয়ে আর্দ্রতাপূর্ণ তাপ অনেক বেশি ভয়ঙ্কর। তিনি আরো জানান, বায়ুমন্ডল উষ্ণতর হলে এর আর্দ্রতা ধারণের ক্ষমতা বেড়ে যায়। বৈশ্বিক উষ্ণতা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আর্দ্র তাপমাত্রা ১০ গুণ পর্যন্ত বাড়তে পারে।

এছাড়া জাতিসংঘের হিউম্যান ক্লাইমেট হোরাইজনসের প্রক্ষেপণ বলছে, এভাবে একই গতিতে তাপমাত্রা বাড়তে থাকলে থাইল্যান্ড, মায়াম্মার ও কম্বোডিয়ায় দু’দশক পর দাবদাহে প্রতি ১০ লক্ষে যথাক্রমে ৩০, ৩০ ও ৪০ জন এবং চলতি শতাব্দীর শেষ নাগাদ যথাক্রমে ১৩০, ৫২০ ও ২৭০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যু হবে। থাইল্যান্ডের চিয়াং মাই ইউনিভার্সিটির ভূগোলের প্রভাষক এবং ডব্লুডব্লুএ-র লেখক ছায়া ভাদ্দনাফুতি জানান, ‘পেশা, বয়স, স্বাস্থ্যের অবস্থা ও প্রতিবন্ধকতা, স্বাস্থ্যসেবার সহজলভ্যতা, আর্থ-সামাজিক অবস্থা এমনকি লিঙ্গ এসব বিষয় দাবদাহে মানুষকে কম-বেশি অরক্ষিত করে তোলে। ২০১৮ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ৬০ শতাংশের বেশি মানুষ অনানুষ্ঠানিক কাজ করেন। কম্বোডিয়া এবং মায়াম্মারে এ হার ৮০ শতাংশ।

কোপারনিকাস জলবায়ু পরিবর্তন সেবার তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া, লাওস, মালয়েশিয়া ও মায়াম্মার এ ৬টি দেশে এপ্রিলের শুরু এবং মে মাসের শেষের দিকে প্রতিদিন ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস বা এর বেশি তাপমাত্রা অনুভূত হয়েছে। এ মাত্রাকে বিপদসীমার ওপরে গণ্য করা হয়। বিশেষ করে স্বাস্থ্য সমস্যা রয়েছে বা এমন গরমে অভ্যস্ত নয়, এমন রোগীদের ঝুঁকি খুব বেশি।

এদিকে বছরের শুরুতে তীব্র ঠান্ডায় কাঁপা চীনের কিছু এলাকার সর্বনিম্ন হিমাঙ্কের নিচে (মাইনাস) ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার নতুন রেকর্ড করা হয়। অথচ মাত্র ৬ মাসের মধ্যে (১৬ জুলাই) জিনজিয়াংয়ের সানবাও শহরের তাপমাত্রা সর্বোচ্চ তুরপান ডিপ্রেশন এলাকায় ৫২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয়েছে বলে চীনের রাষ্ট্র পরিচালিত সংবাদমাধ্যম জিনজিয়াং ডেইলি জানায়। এটি ২০১৫ সালে অর্থাৎ ৮বছর আগে চীনের আয়দিং এলাকার রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রাকেও ছাড়িয়ে গেছে। মোট কথা, গত এপ্রিল থেকে চীনসহ এশিয়ার দেশগুলো দফায় দফায় রেকর্ডভাঙ্গা তাপপ্রবাহের মুখে পড়েছে। উত্তপ্ত আবহাওয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়েছে চীনের বিদ্যুৎ ও শস্য উৎপাদন।
শুধু দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া নয়, মধ্যপ্রাচ্য, যুক্তরাষ্ট্র এবং শীতল মহাদেশ ইউরোপের অবস্থাও একই। মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ইরাকে কখনো কখনো ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছাড়িয়ে যায়। তাপমাত্রা অনেক বেশি বাড়লে সাধারণ মানুষ বেশিরভাগ ঘরেই থাকেন। গত মে মাসে বিজ্ঞানবিষয়ক জার্নাল নেচার সাস্টেনেবিলিটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ শতাংশের চেয়ে বেড়ে গিয়ে ভয়াবহ একটি পরিস্থিতির সৃষ্টি হতে পারে।

যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইউএস স্টর্মওয়ার্চের কর্মকর্তা জলবায়ু বিশেষজ্ঞ কলিন ম্যাকার্থি এক টুইটবার্তায় জানান, ’১৭ জুলাই দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ইরানের দক্ষিণাঞ্চলীয় প্রদেশ বুশেহেরের আসালুয়েহ জেলার পার্সিয়ান গালফ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর এলাকায় ৬৬.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে। মানুষ-উদ্ভিদ ও অন্যান্য প্রাণীদের জন্য এ পরিমাণ তাপমাত্রা সহ্যের অতীত’।

আগামী কয়েক দশকে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়লে মধ্যপ্রাচ্যের কী অবস্থা হতে পারে, গত এপ্রিলে এমন একটি সমীক্ষা প্রকাশ করেছে বিজ্ঞানবিষয়ক সাময়িকী ল্যানসেট। এতে বলা হয়েছে, তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে মধ্যপ্রাচ্যে মৃত্যুহার অনেক বাড়বে। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে তাপপ্রবাহজনিত রোগে ভূগে প্রতি এক হাজারে দু’জনের মৃত্যু হয়। এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ১২৩ জনে। তাপপ্রবাহ বাড়তে থাকলে চলতি শতক শেষে শুধু ইরাকে মারা যেতে পারেন ১ লক্ষ ৩৮ হাজারের মতো মানুষ। সমীক্ষায় আরো বলা হয়েছে, চলতি শতকে বিশ্বের কোনো কোনো অঞ্চলের তাপমাত্রা ২ থেকে ৯ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে তাপপ্রবাহের কারণে মৃত্যুর ৮০ শতাংশই ঘটতে পারে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে। ২০৫০ সাল নাগাদ মধ্যপ্রাচ্যের ৭০ শতাংশের মতো মানুষ বড় বড় শহরে বসবাস শুরু করবেন। ফলে শহরাঞ্চলে তাপমাত্রা বাড়বে, সঙ্গে মৃত্যুও বাড়বে।

এ বিষয়ে সতর্ক করে জাতিসংঘের চিফ্ হিট অফিসার অ্যালেনি মিরিভিলি জানান, আবহাওয়াজনিত বিপর্যয়গুলোর মধ্যে চরম তাপমাত্রা সবচেয়ে বিপদের কারণ হয়ে ওঠছে। কিন্তু বিশ্বজুড়ে এ বিষয়ে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না। বড় বিপর্যয় এড়াতে হলে প্রতিটি দেশের সরকারের উচিত, চরম তাপপ্রবাহ সম্পর্কে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানো। এজন্য প্রস্তুতি নেওয়া এবং নিজেদের রক্ষার কৌশল নির্ণয়ের পরিকল্পনা প্রণয়ন করা।

পৃথিবীর ইতিহাসে গড় বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১৭.০১ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছুঁয়ে রেকর্ড গড়েছে। এর আগে ২০১৬ সালে ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছিল। জলবায়ু বিজ্ঞানী ফ্রিডেরিক অটো বলেছেন, এটি উদযাপন করার মতো কোনো রেকর্ড নয়। তাপমাত্রার এ রেকর্ড মানুষ ও ইকোসিস্টেমের জন্য ‘মৃত্যুদন্ড’। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্রে তীব্র তাপপ্রবাহ হচ্ছে। চীনে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে, উত্তর আফ্রিকায় ৫০ ডিগ্রি এবং অ্যান্টার্কটিকার আর্জেন্টিনা দ্বীপপুঞ্জে ৮.৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা রেকর্ড হয়েছে। জুলাই মাস বিশ্বে একাধিক রেকর্ড ভেঙ্গেছে। জুলাই মাসকে বিজ্ঞানীরা শতাব্দীর উষ্ণতম মাস হিসেবে অভিহিত করেছেন। নাসার আবহাওয়া বিশেষজ্ঞ গ্যাভিন শিমিডট বলেন, গরম বৃদ্ধির কারণ হিসেবে শুধু এল নিনোকে দায়ী করলে চলবে না। আমরাও লাগাতারভাবে গ্রিন হাউস গ্যাস তৈরি করে চলছি।

মেক্সিকোর স্বাস্থ্য দপ্তর জানিয়েছে, গত জুনের শেষ ২ সপ্তাহে তীব্র তাপপ্রবাহে সে দেশে প্রায় ১০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। বেশির ভাগই মারা গিয়েছে হিট স্ট্রোকে। তাপমাত্রা ৫০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি পৌঁছেছে।

বরফের দেশ ইউরোপের কথা শুনলে আগে মনে পড়ে শীতের গরম পোষাকের কথা। সে ইউরোপেও এ বছর বেনজির গরম পড়ছে। চলতি বছরের জুন মাসে ইংল্যান্ডে রেকর্ড গরম পড়েছে। এতো উষ্ণ জুন মাস এর আগে বৃটেনবাসী দেখেননি। রীতিমতো গরমে হাঁসফাঁস করেছে বৃটেনের জনগণ। পাখা কেনার জন্য লাইন ধরেছে সুপার মার্কেটে। ইংল্যান্ডের আবহাওয়া দপ্তর জানিয়েছে, জুন মাসে গড় তাপমাত্রা ছিল ১৫.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস। যা গত ১৩৯ বছরে সর্বোচ্চ। ১৮৮৪ সালের জুন মাসে এমনই গরম অনুভত হয়েছিল। উত্তর ইউরোপের পরিবেশবান্ধব খ্যাত নরওয়ে, সুইডেন, ডেনমার্ক, ফিনল্যান্ডের মতো দেশও ছাড় পাচ্ছে না তাপপ্রবাহের বিপর্যয় থেকে। কয়েকবছর ধরে স্ক্যান্ডিনেভিয়ার এ দেশগুলোর শীতকাল (সেপ্টেম্বর থেকে মে) ছোট হয়ে গ্রীষ্মকাল শুরু হয়ে যাচ্ছে আগেভাগে এপ্রিল-মে থেকেই।

গ্রীষ্মকালে ইউরোপের দক্ষিণাঞ্চলীয় অপেক্ষাকৃত উষ্ণ দেশ হিসেবে পরিচিত স্পেন, ইতালি, পতুর্গাল ও গ্রিসে এ তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার অকল্পনীয়। অন্যদিকে বরফাঞ্চল বলে খ্যাত স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশগুলোতে উষ্ণতা বৃদ্ধির হার আশঙ্কাজনকভাবে বেশি। হাড় কাঁপানো শীতের দেশ সুইডেনে শীতকালের তাপমাত্রা মাইনাস ২৫ থেকে ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াসও হয়ে থাকে। ইউরোপের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৮.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস রেকর্ড করা হয় ২০২১ সালের আগস্টে। এ তাপমাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন আবহাওয়াবিদরা। ইতালিতে রোম, ফ্লোরেন্স ও বোলোগনাসহ ১৬টি শহরে তাপপ্রবাহের রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। ইউরোপীয়ান স্পেস এজেন্সী (ইএসএ) জানিয়েছে, জার্মানি, ফ্রান্স, ইতালি, স্পেন ও পোল্যান্ডসহ ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে তাপমাত্রা বেড়েই চলেছে। গত ১৪ ও ১৫ জুলাই গ্রিসে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে পৌঁছায়।

ক্রোয়েশিয়ায় তীব্র দাবদাহে দাবানল দেখা দিয়েছে। স্পেনের দক্ষিণাঞ্চল, ইতালির দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে ও সম্ভবত গ্রিসের তাপমাত্রা ৪৭ ডিগ্রি সেলসিয়াসে গিয়ে দাঁড়াতে পারে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্লোরিডা থেকে টেক্সাস ও ক্যালিফোর্নিয়ার পাশাপাশি উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় ওয়াশিংটন অঙ্গরাজ্য পর্যন্ত এলাকার প্রায় ২ কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ ৪৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার কবলে পড়তে পারেন বলে সতর্কতা জারি করেছে গত ১৪ জুলাই। জুনের শুরুর দিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমোসফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (এনওএএ) বিজ্ঞানীরা বলেছেন, পূর্বাভাস অনুযায়ী ‘এল নিনো’ জলবায়ু পরিস্থিতি শুরু হয়ে গেছে। এতে আবহাওয়া ও তাপমাত্রা চরম রূপ ধারণ করতে পারে।

সম্প্রতি ২০২২ সালের তাপপ্রবাহ নিয়ে পেশ করা ওয়ার্ল্ড মেটিওরোলজিক্যাল অর্গানাইজেশনের (ডব্লুএমও) এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, কার্বন ডাই-অক্সাইড, মিথেন এবং নাইট্রাস অক্সাইড-এ তিন গ্রিন হাইসের পরিমাণ ক্রমশ বেড়েই চলেছে। ফলে সব মহাদেশে বন্যা, খরা, আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাসহ তাপপ্রবাহ বেড়েছে।

গবেষণায় আরো জানা যায়, ১৮৫০-১৯০০ সাল থেকে বর্তমানে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১.১৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ফলে ২০২২ সালের ৩০ মে থেকে ৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত তীব্র গরমে ইউরোপ মহাদেশে ৬১৬৭২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে ইতালিতে ১৮ হাজার, স্পেনে ১১ হাজার এবং জার্মানিতে ৮ হাজার মানুষ প্রাণ হারান। এ মহাদেশের ১০টি দেশেই মারা যাওয়ার তালিকায় মহিলারাই বেশি। জার্মানির স্বাস্থ্যমন্ত্রী কার্ল লাউটারবাখ জানিয়েছেন, তীব্র গরমে নানা অসুখে ভূগে জার্মানিতে প্রতিবছর ৫ থেকে ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এ মৃত্যু ঠেকাতে তিনি শিগগিরই একটি ‘হিট প্রটেকশন প্ল্যান’ তৈরির পরিকল্পনা করছেন।

নেচার মেডিসিন জার্নালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গেল গ্রীষ্মে ২০২১ সালের তুলনায় ২০২২ সালে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ফ্রান্সে ২.৪৩ ডিগ্রি, সুইজারল্যান্ডে ২.৩০ ডিগ্রি, ইতালিতে ২.২৮ ডিগ্রি এবং হাঙ্গেরিতে ২.১৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করে বলা হয়েছে, উচ্চ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ না নেওয়া হলে ২০৩০ সালের মধ্যে ইউরোপে গ্রীষ্মকালে গড়ে ৬৮ হাজার, ২০৪০ সালের মধ্যে ৯৪ হাজার এবং ২০৫০ সালের মধ্যে ১ লক্ষ ২০ হাজার মানুষের মৃত্যু হবে।

সম্প্রতি ইউরোপীয় ইউনিয়নের জলবায়ু পর্যবেক্ষণ সংস্থা ‘কোপার্নিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিস’-এর ডেপুটি ডিরেক্টর সামান্থা বার্গেস জানান, ১৯৫০ সাল থেকে পাওয়া তাপমাত্রা সংক্রান্ত তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত জুন মাসে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা অন্তত ০.৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। গরমের ফলে জলাভূমিও শুকিয়ে যাচ্ছে। পানীয় জল কিংবা কৃষির জন্য জল তুলতে তুলতে পৃথিবীর আবর্তনের অক্ষ বদলে যাচ্ছে।

সম্প্রতি ‘জিওফিজিক্যাল রিসার্চ লেটারস্’ জার্নালে প্রকাশিত এক গবেষণায় জানানো হয়েছে, ১৯৯৩ সাল থেকে ২০১০ সালের মধ্যে প্রায় ২১৫০ গিগাটন ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়া হয়েছে। এক গিগাটনের অর্থ ১০০ কোটি মেট্রিক টন বা ১ লক্ষ কোটি কেজি। বিজ্ঞানীদের দাবি, এ পরিমাণ ভূগর্ভস্থ জল তুলে নেওয়ার জেরে পৃথিবীর অক্ষ প্রতিবছর পূর্বের দিকে ৪.৩৬ সেন্টিমিটার সরে যাচ্ছে। এর ফলে গোটা পৃথিবী প্রলয়ের সম্মুখীন হতে পারে। অক্ষ পরিবর্তন হলে হিমশীতল উত্তরমেরুর আবহাওয়া বিষুবরেখায় চলে আসাটা আশ্চর্যের নয়। সেই সঙ্গে ভয়ঙ্কর সুনামির জেরে ডুবে যেতে পারে এশিয়া ও আফ্রিকার মতো মহাদেশ। গবেষকরা জানাচ্ছেন, পৃথিবীর অক্ষের যে পরিমাণ স্থানবদল ঘটেছে, তাতে প্রাকৃতিক বিপর্যয় অবশ্যাম্ভাবী।

সুতরাং পরিস্থিতি আমাদের হাতের নাগালের বাইরে চলে গিয়েছে। আবহাওয়ার যে পরিবর্তন ইতিমধ্যেই ঘটে গিয়েছে, তা অপরিবর্তনীয়। এত কিছুর পরেও এ বিষয়ে কোনো হেলদোল নেই। তাতে বোঝা যায়, আমরা দিন দিন ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test