E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শোকাবহ আগস্ট ও বঙ্গবন্ধু

২০২৩ আগস্ট ০১ ১৭:২৯:১৪
শোকাবহ আগস্ট ও বঙ্গবন্ধু

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


বছর ঘুরে আবার ফিরে এসেছে আগস্ট মাস। আগস্ট বাংলা ও বাঙালির শোকের মাস। বিশ্বরাজনীতির ইতিহাসে বহু জনপ্রিয় নেতার জন্ম হয়েছে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, জনপ্রিয়তায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বেশ শীর্ষের দিকে রয়েছেন। আমার একথা বলার পেছনের যুক্তিগুলো হচ্ছে সত্তরের নির্বাচনে পূর্ব বাংলার শতকরা ৯০ ভাগের বেশি ভোটার বঙ্গবন্ধুর নৌকায় ভোট দিয়েছেন। একাত্তরের ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ বিরোধীদলীয় নেতা শেখ মুজিবের নির্দেশে এ দেশ পরিচালিত হয়েছে। অথচ দেশে তখন সামরিক সরকার ক্ষমতায় বহাল ছিল। ২/৪ জন ছাড়া এদেশের প্রায় সবাই মুজিবের নেতৃত্বে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ হয়। শত্রুর কারাগারে বন্দি থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধের ৯ মাসে তার নামেই স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে এবং তার নামেই মুক্তিযোদ্ধারা হাসতে হাসতে জীবনদান করেছেন।

১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট ভোরে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। ঘাতক মেজর ডালিম ভোর ৬টার দিকে বেতার ঘোষণায় জানায়, শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এবং খোন্দকার মোশতাক আহমদের নেতৃত্বে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে। সকাল প্রায় ৮টায় খোন্দকার মোশতাক বেতারে প্রদত্ত ভাষণে বলেন- “তার উপর রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে।” জাতির পিতা ও তার পরিবারের সদস্যদের লাশ ধানমন্ডির বাড়িতে পড়ে থাকা অবস্থাতেই হত্যাকাণ্ডের মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য কয়েকজন বাদে প্রায় সবাই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলকারী মোশতাক মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে যোগদান করে। রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মাত্র ৩-৪ ঘণ্টার মধ্যে সশস্ত্র বাহিনীর তিন প্রধান এবং বিডিআর, পুলিশ, রক্ষী বাহিনী প্রধানরা পৃথকভাবে বেতারে খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

ঘাতকচক্র রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারের সদস্যবর্গ, বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি ও মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত এবং তার পরিবারের কয়েকজন সদস্য এবং বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে প্রভাবশালী যুবনেতা শেখ ফজলুল হক মণিকে সস্ত্রীক হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বিশাল দল, লাখো নেতাকর্মী, সরকার, সশস্ত্র বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর সবাই ছিলেন। সবাই থাকা সত্ত্বেও বিশ্ব ইতিহাসের এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো প্রতিবাদ হয়নি।

ক্ষমতা দখলকারী খোন্দকার মোশতাক বঙ্গবন্ধুর প্রায় চার দশকের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে বিশ্বাসঘাতকতা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু তাকে মাফ করে দিয়ে মন্ত্রিসভায় স্থান করে দেন। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে ঘাতক মোশতাক কত সুবিধা নিয়েছে, তার একটি উদাহরণ এখানে দেয়া হলো। বিখ্যাত ব্যাংকার খায়রুল কবীর ছিলেন খোন্দকার মোশতাকের হোস্টেল-মেট। তিনি বঙ্গবন্ধুরও ঘনিষ্ঠজনদের একজন। লন্ডনপ্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিনের ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব : মুক্তিযুদ্ধের পর’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ১৫২) খায়রুল কবীর স্মৃতিচারণে বলেছেন-

“খোন্দকার মোশতাকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর একটা দুর্বলতা ছিল। প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে বঙ্গবন্ধু খায়রুল কবীরকে টেলিফোন করে বলেছিলেন, ‘ মোশতাকের কিছু টাকা দরকার’; বিশ হাজার টাকা তাকে ধার দিবেন।’ যথাসময়ে মোশতাক কবীর সাহেবের সঙ্গে দেখা করেন।

কবীর সাহেব তাকে বলেন, ‘তুমি নিজে না এসে বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে টেলিফোন করিয়েছ কেন?’ মোশতাক বলেন, ‘টাকা না হলে আমার বউ এর চিকিৎসা হবে না।’ তার স্ত্রীকে ক্যান্সারের চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়েছিল। খায়রুল কবীর বলেন, ‘তাকে ১৫ হাজার টাকা দিয়েছি। ব্যাংকের টাকা দেইনি। কারণ সে ব্যাংকের টাকা ফেরৎ দিবে না।”

হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘদিনের বন্ধু, সহকর্মী ও মন্ত্রীদের মধ্যে কয়েকজন ছাড়া প্রায় সবাই ঘাতক সরকারের মন্ত্রী হন। সেনাবাহিনী প্রধান কে এম সফিউল্লাহ ও উপপ্রধান জিয়াউর রহমান দু’জনকেই বঙ্গবন্ধু স্বল্প সময়ের মধ্যে কয়েকটি প্রমোশন দিয়ে মেজর থেকে মেজর জেনারেল বানিয়ে সেনাপ্রধান ও উপপ্রধানের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সেনাপ্রধান সফিউল্লাহর বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে অদ্যাবধি কোনো সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়া না গেলেও হত্যাকাণ্ডের পর কোনো প্রতিরোধ গড়ে তুলতে সক্ষম হননি। অবশ্য তিনি গত সাড়ে চার দশকে বিভিন্নভাবে বলার চেষ্টা করেছেন- তার পদস্থ সহকর্মীদের মধ্যে কেউ কেউ বঙ্গবন্ধু হত্যায় জড়িত ছিলেন আবার কেউবা প্রতিরোধের ব্যাপারে তাকে সহযোগিতা করেনি। তাছাড়া বঙ্গবন্ধু হত্যার ১০ দিনের মাথায় সফিউল্লাহকে সরিয়েও দেয়া হয়।

এটা এখন প্রমাণিত সত্য যে, সে সময়ের সেনাবাহিনীর উপপ্রধান জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন। খুনিদের সঙ্গে সহযোগিতার পুরস্কার হিসেবে ১৫ আগস্টের ৯ দিন পরই জিয়াকে সেনাপ্রধান করা হয়। এর পর জেনারেল জিয়া রাষ্ট্রপতিসহ সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সবচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছেন এই জিয়াউর রহমান। সেনাবাহিনীর তৃতীয় ক্ষমতাধর ব্যক্তি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের ভূমিকাও স্বচ্ছ ছিল না। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কয়েক ঘণ্টা পর ঘাতক চক্রকে এই খালেদ মোশাররফ ট্যাঙ্কের গোলা সরবরাহ করেন।

উল্লেখ্য, গোলা-বারুদ ছাড়াই খালি ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘাতকরা ১৫ আগস্টের নির্মম ট্র্যাজেডি ঘটায়। সেনাবাহিনীর একটি ক্ষুদ্র অংশ বঙ্গবন্ধু সরকারকে উৎখাত করলেও তিন বাহিনীপ্রধান অর্থাৎ সমগ্র সেনাবাহিনী, শেষ পর্যন্ত ঘাতক চক্রকে সমর্থন করে।

বঙ্গবন্ধু হত্যায় স্বাধীনতাবিরোধী চক্র খুবই উল্লসিত হয়। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে প্রবীণ জননেতা মওলানা ভাসানী সর্বাগ্রে ঘাতক মোশতাক সরকারকে সমর্থন দেন। তথাকথিত রাষ্ট্রপতির নিকট প্রেরিত তারবার্তায় নতুন সরকারের প্রতি অভিনন্দন ও তার পূর্ণ সমর্থনের কথা জানান। মওলানা এই পরিবর্তনকে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ বলে উল্লেখ করে দেশ হতে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও অবিচার দূর করার আহ্বান জানান। (ইত্তেফাক, ১৭.৮.১৯৭৫)

১৫ আগস্ট হত্যার পর বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন মূল দল বাকশাল এবং অঙ্গ সংগঠনগুলোর নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ মন্ত্রী, কেউ গ্রেপ্তার, কেউ আত্মগোপন করলেন। প্রতিরোধের ডাক খুব একটা আসেনি- এটা বলাই সংগত হবে। জানা যায়, গ্রেপ্তার সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী, এএইচএম কামারুজ্জামান, জিল্লুর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ প্রমুখ খুনিদের পক্ষ থেকে আহবান সত্ত্বেও অবৈধ সরকারকে সমর্থন করতে অস্বীকার করেন। তোফায়েল আহমদকে শারীরিকভাবে নির্যাতনও করা হয়।

বঙ্গবন্ধু সরকারের পদত্যাগকারী অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের বাসায় ১৫ আগস্ট সকালেই ঘাতক মেজর ডালিম গিয়ে তাকে গৃহবন্দি করে আসে। তবে মোশতাক জানতেন, তাজউদ্দীন কোনোদিন মোশতাককে মেনে নিবেন না। আসলেই তাই। সৈয়দ নজরুল ইসলামও মোশতাকের উপরাষ্ট্রপতি হওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। ১৫ আগস্ট সকালে ঘুম থেকে জাগিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত (বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্রপতি হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পান) মনসুর আলীকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি আক্রান্ত হওয়ার খবর দেয়া হয়।

মনসুর আলী বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধার এবং বিমান থেকে গোলা নিক্ষেপের মাধ্যমে ঘাতকদের বেতার ভবন উড়িয়ে দিতে মন্ত্রীর মতোই নির্দেশ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ১৭ আগস্ট আত্মগোপনের স্থান থেকে এম মনসুর আলীকে বঙ্গভবনে মোশতাকের কাছে নেয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার মোশতাকের প্রস্তাব ঘৃণার সঙ্গে মনসুর আলী শুধু প্রত্যাখ্যানই করেননি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্যে তিনি মোশতাককে অভিযুক্ত করেন বলেও জানা যায়। এই প্রসঙ্গে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তার ‘ জেল হত্যাকাণ্ড’ গ্রন্থে (পৃষ্ঠা ২৪-২৫) লিখেছেন-

“কে এম ওবায়দুর রহমান এম মনসুর আলীকে মোশতাকের কাছে নিয়ে গেলেন। মোশতাক তাকে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব করলে তার জবাব না দিয়ে মনসুর আলী ঘৃণার সঙ্গে মোশতাকের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলেন। মোশতাক তাঁকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি দেখছেন অমন করে? মনসুর আলী বললেন, ‘দেখছি তোমাকে- আর ভাবছি বঙ্গবন্ধুকে। মোশতাক তুমি শেখ মুজিবকে হত্যা করলে- করতে পারলে, আবেক-উদ্বেগ-কান্নায়-ঘৃণায় বুজে এলো তার কণ্ঠ।”

মোশতাক বুঝলেন, মনসুর আলীকে পক্ষে পাওয়া যাবে না। এভাবে সৈয়দ নজরুল, মনসুর আলী ও তাজউদ্দীনদের মতো বঙ্গবন্ধুর কিছু নেতাকর্মীও যদি সে সময় ঘাতক সরকারকে ঘৃণা করে প্রতিরোধের ডাক দিতেন, তাহলে বাংলার ইতিহাস আজ অন্যভাবে লেখা হতো।

যেই রক্ষীবাহিনীর জন্যে বঙ্গবন্ধু সরকারের প্রতি সেনাবাহিনীর অনেকের ক্ষোভ ছিল, সেই রক্ষীবাহিনী বঙ্গবন্ধু হত্যার পর একটি গুলিও ছোড়েনি। এখানে উল্লেখ্য, ১৫ আগস্ট সকালে সশস্ত্র ডালিমচক্র সেনাপ্রধানকে বেতার ভবনে নিয়ে যেতে এলে সেনাপ্রধান প্রতিরোধের আশায় ৪৬ ব্রিগেডে যান। সেখানে গিয়ে দেখলেন, জনৈক ক্যাপ্টেন হাফিজুল্লা বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি পদতলে পিষ্ট করছে আর জোয়ানরা সরকার পতনে উল্লাস করছে।

হয়তো কেউ বলবেন, বঙ্গবন্ধুর লাশ বত্রিশ নম্বরে- রাস্তায় সশস্ত্র আর্মি, ট্যাঙ্ক নিয়ে ঘাতকের মহড়া, এর মধ্যে কীভাবে প্রতিরোধের ডাক দেয়া সম্ভব। তবে এটাও ঠিক রাজধানী ছাড়া সারা বাংলাদেশে কিন্তু আর্মি বা ট্যাঙ্কের মহড়া ছিল না। তাছাড়া বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আর্মির হত্যাকারী ওই ক্ষুদ্র অংশ ভয়ে ভয়ে ছিল। ওরা ঊর্ধ্বতনদের বলছিল- ‘আমরা দেশের স্বার্থেই এই পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা পরিস্থিতি সামলান।’ উপ-প্রধান জিয়াউর রহমানসহ পাকিস্তান প্রত্যাগত প্রায় সকল সেনা কর্মকর্তা ঘাতক চক্রের প্রতি সমর্থন, আর সিজিএস খালেদ মোশাররফসহ আরও অনেকের ‘যা হবার হয়ে গেছে’ এই মনোভাব- সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী পদে বঙ্গবন্ধু সরকারের মন্ত্রীরাই শপথ নেয়ায় জনগণ যেমন বিভ্রান্ত হয়, তেমনি খুনি চক্রও সময় পেয়ে যায়।

যে কারণে ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তাৎক্ষণিক প্রতিবাদ হয়নি তা হচ্ছে: ১. বঙ্গবন্ধুর মতো নেতাকে হত্যা করা হয়েছে- এ কথা প্রথমে অনেকেই বিশ্বাস করতে পারেনি; ২. আবার হত্যাকাণ্ডের ভয়াবহতায় বড় বড় নেতাসহ কেউ কেউ হতভম্ব ও কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন; ৩. হত্যাকাণ্ডের পর পর বঙ্গবন্ধুর সহকর্মীরাই খুনি সরকারের রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রী হিসেবে শপথ নেয়। তাছাড়া সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীপ্রধান, রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত প্রধান, পুলিশ বাহিনীসহ সকল প্রধানদের খুনি সরকারের প্রতি আনুগত্য ও সমর্থনের ঘোষণা বেতার-টিভিতে প্রচারিত হওয়ায় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী ও জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। ঢাকার রাস্তার মোড়ে মোড়ে ট্যাঙ্ক মোতায়েন, কারফিউ জারি ও সঙ্গীন উঁচিয়ে সেনা টহলে মানুষ আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। যেসব নেতারা খুনিদের সমর্থন করেননি তাদেরকে গৃহবন্দি করা হয়। এসব কারণেই খুনিচক্র তাৎক্ষণিকভাবে প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়নি।

মোশতাক-ফারুক-রশীদ-ডালিম চক্র বঙ্গবন্ধু পরিবারকে হত্যা করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ১৫ আগস্টের শহীদদের প্রতিও তারা অবমাননা করেছে। বঙ্গবন্ধুর মরদেহ ১৫ আগস্ট সারা দিন, ১৫ আগস্ট দিবাগত রাত শেষে ১৬ আগস্ট বিকেলে গ্রামের বাড়ি টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যাওয়া হয়। আর্মির যে কজন বঙ্গবন্ধুর মরদেহ টুঙ্গিপাড়া নিয়ে যায় তারা দাফন-কাফন অর্থাৎ ইসলামি নিয়ম-কানুন পালন না করেই লাশ কবরস্থ করতে চেষ্টা চালায়। কিন্তু স্থানীয় মৌলবির চাপের মুখে কফিন খুলে বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখানো হয় এবং খুব দ্রুত ১০/১৫ জনের উপস্থিতিতে জানাজা দিয়ে লাশ দাফন করা হয়। আর্মির উদ্যত আচরণের কারণে স্থানীয় লোকজন বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখাতো দূরের কথা- তারা আশেপাশের গ্রাম ছেড়ে দূরে চলে যায়। বঙ্গবন্ধু ছাড়া অন্যদের লাশ বনানী গোরস্তানে ১৫ আগস্ট দিবাগত শেষ রাতে জানাজা-গোসল ছাড়াই কবরস্থ করা হয়।

আরেকটি আশ্চর্যজনক ব্যাপার হলো বঙ্গবন্ধুর আর্মি, পুলিশ, বিডিআর, প্রায় তিনশ’ জন সংসদ সদস্য, সহকর্মী যারা সেদিন রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী হলেন- তাদের অন্তত একজনও শেষবারের মতো বঙ্গবন্ধুর মুখ দেখার সাহস করেননি। অথচ এই বঙ্গবন্ধুর কারণেই বাংলাদেশ হলো- ক্যাপ্টেনরা জেনারেল হলো- অনেক অখ্যাত লোক খ্যাত হলো, মন্ত্রী-রাষ্ট্রপতি হলো।

হত্যা-ষড়যন্ত্রে জড়িত জিয়াউর রহমান, খালেদ মোশাররফ, তাহের, মঞ্জুরসহ আরও অনেকের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। মাহবুব আলম চাষী- দেশের বাইরে দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছে। প্রায় দুই যুগ চোরের মতো গৃহবন্দি এবং দুর্নীতির দায়ে কয়েক বছর জেল খেটে ১৯৯৬-এর মার্চে বিশ্বাসঘাতক মোশতাকের মৃত্যু হয়েছে। ৩৫ বছর পরে হলেও ২০১০-এর ২৮ জানুয়ারি রাতে বঙ্গবন্ধুর ৫ ঘাতকের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে।

এতসব কিছুর পরেও যতদিন মানুষের হৃদয়ে স্পন্দন থাকবে, বিশ্বের বুকে বাংলাদেশ ও বাঙালি থাকবে- হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা, ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নাম ততদিন শ্রদ্ধাভরে উচ্চারিত হবে।

লন্ডনের দি টাইমস পত্রিকার একটি উদ্ধৃতি দিয়ে এই লেখার ইতি টানতে চাই। “সবকিছু সত্ত্বেও শেখ মুজিব স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এ জন্য যে, তাকে ছাড়া বাংলাদেশ কখনো বাস্তবে পরিণত হতো না।”

লেখক : সহকারী পরিচালক (অর্থ ও বাজেট), অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test