E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

১১২তম জন্মদিবসে গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি

উপেক্ষিত এক বিপ্লবীর নাম বীণা দাস

২০২৩ আগস্ট ২৩ ১৬:০৭:২০
উপেক্ষিত এক বিপ্লবীর নাম বীণা দাস

গোপাল নাথ বাবুল


৬ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ সাল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট হলে স্নাতক উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীদের সমাবর্তন উৎসব। উৎসবের প্রধান অতিথি তৎকালিন অবিভক্ত বাংলার রাজ্যপাল ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য স্যার ফ্রান্সিস স্টানলি জ্যাকসন। বৃটেনের হয়ে এক সময়ে দূর্দান্ত ক্রিকেট খেলতেন। ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার পর কনজারভেটিভ পার্টির হয়ে নির্বাচন করে তিনি ১৯১৫ থেকে ১৯২৬ সাল পর্যন্ত বৃটিশ পার্লামেন্টের সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯২৭ সালে তাঁকে গ্রেট বৃটেনের প্রধানমন্ত্রী চার্চিল বাংলার গভর্নর করে ভারতীয় উপমহাদেশে পাঠান। জ্যাকসন বক্তব্য দিতে উঠে বৃটিশ সরকারের পক্ষ থেকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য ৪ লক্ষ টাকা অনুদান ঘোষণা করেন। দর্শকদের তুমুল করতালির মধ্যে চোখের পলকে একজন বিশ-একুশ বছরের ছাত্রী বক্তৃতা মঞ্চের দিকে এগিয়ে গিয়ে রিভলবার থেকে জ্যাকসনকে পর পর ৫টি গুলি ছুঁড়লেন। জ্যাকসন নিজেকে সময়মতো সরিয়ে নেয়ার কারণে ৫টি গুলিই লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো। দ্রুতগতিতে তৎকালিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হাসান সোহরাওয়ার্দী (শহীদ হোসেন সোহরাওয়ার্দীর পিতা) ছাত্রীটির কাছ থেকে রিভলবারটি কেড়ে নেন এবং পুলিশ এসে তাকে গ্রেফতার করে। তৎকালিন বৃটিশ শাসিত ভারতীয় উপমহাদেশের প্রতিটি সংবাদপত্রের শিরোনামে উঠে আসা এবং সশস্ত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের এমন চাঞ্চল্যকর ঘটনার প্রথম দুঃসাহসিক এ নায়িকার নাম বীণা দাস।

বীণা দাসের আদি বাড়ি ছিল চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার সারোয়াতলী গ্রামে। তাঁর দাদার নাম ছিল কৃষ্ণ চন্দ্র দাস। কৃষ্ণদাসের সুপুত্র দর্শনের শিক্ষক বেণীমাধব চট্টগ্রাম সরকারি কলেজসহ ঢাকা, কলকাতা, কটকের বিভিন্ন কলেজে শিক্ষকতা করেন। কৃষ্ণনগরে থাকার সময় নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর প্রিয় শিক্ষক ঋষিতুল্য বেণীবাধব দাসের ঔরসে সরলা দেবীর গর্ভে ১৯১১ সালের ২৪ আগস্টের এক শুভলগ্নে জন্ম নেন বিপ্লবী অগ্নিকন্যা বীণা দাস। বড় বোন কল্যাণী দাসও ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামের আরেক বিপ্লবী ও অগ্নিকন্যা।

জন্মের পর থেকে বীণা পরিবারের সবার স্নেহমমতা ও আদরের মধ্যে বড় হতে থাকেন। কিন্তু বাইরের জগতের সাথে পরিচিত হয়ে অনুভব করলেন অসীম বেদনাদায়ক মানবজীবন। ভারতবাসির দুঃখ-দূর্গতি ও পরাধীনতার গ্লানি তাঁর মনকে বিষিয়ে তোলে। মাতৃভূমির শৃঙ্খল ভাঙ্গার আকুল আহ্বান এবং আদর্শনিষ্ঠ বীণার মনকে স্বাধীনতা সংগ্রামের পথে ধাবিত করে। বাবার প্রিয় ছাত্র সুভাষ চন্দ্র বসু তাঁদের ঘরে নিত্য আসা-যাওয়া করতেন। সুভাষ বসুর রাজনৈতিক বিশ্বাস, বৃটিশ বিরোধী নীতি তাঁকে আগাগোড়া প্রভাবিত করেছিল। বড় বোন কল্যাণীসহ বীণা পিতার কাছ থেকে সমাজ বিপ্লবীদের জীবনী ও তাঁর বড় মামা অধ্যাপক বিনয়েন্দ্রনাথ সেনের মহৎ চরিত্র কথা শুনে শুনে বিপ্লবী রাজনীতির দিকে আকৃষ্ট হন। বীণা উদার চিন্তাভাবনা, দৃঢ় সংকল্প, দেশপ্রেম, আদর্শবাদ সবই তাঁর পরিবার থেকে লাভ করেছিলেন।

ছোটবেলা থেকে শান্ত প্রকৃতির এবং কবি ও দার্শনিক মনের অধিকারী বীণা সময়ের উত্তাল হাওয়ায় পরিণত হন অগ্নিকন্যায়। এছাড়াও কলকাতা ছাত্রী সংঘের একজন নিষ্ঠাবান সংগঠক উচ্চ শিক্ষিতা হওয়া সত্ত্বেও বড়বোন কল্যাণী দাসকে কারাগারে তৃতীয় শ্রেণির বন্দির মর্যাদা দেয়ার পরেও দিদির এমন আত্মত্যাগ ও চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞায় শাণিত করে বীণা দাসকে। অনুপ্রাণিত করে বৃটিশ শাসন-শোষণ থেকে দেশকে মুক্ত করার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে। রাজনীতিতে প্রথমদিকে কংগ্রেসের হয়ে গান্ধীজির অহিংস আন্দোলনে আত্মনিয়োগ করলেও বৃটিশদের কর্মকান্ডে ক্রমশ জমে উঠা প্রচন্ড ক্ষোভের কারণে গান্ধীজির অহিংস আন্দোলন থেকে সরে এসে বৈপ্লবিক পন্থা বেছে নেন তিনি।

বেথুন এবং ডায়শেষন কলেজ থেকে ১৯৩১ সালে স্নাতক অর্জনের পর বাংলার গভর্নরকে হত্যা করার মতো এমন দুঃসাহসিক সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বীণা দাস তাঁর বড় বোন কল্যাণী দাসের বান্ধবী ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য কমলা দাশগুপ্তের সহযোগীতা কামনা করেন। প্রথমে অনীহা প্রকাশ করলেও ‘যুগান্তর’ দলের সদস্য না হওয়া সত্তে¦ও বীনার দৃঢ় প্রতিজ্ঞা ও সংকল্পে মুগ্ধ হয়ে কমলা দাসগুপ্ত এ প্রস্তাবে সম্মতি দেন এবং তাঁর সহযোদ্ধা সুধীর দত্তের কাছ থেকে ২৮০ টাকায় একটি চোরা রিভলবার এনে দেন ও স্থানাভাবে টার্গেট প্র্যাকটিস করার সুযোগ না পেলেও বীনাকে কমলা রিভলবার চালানোর কৌশল শিখিয়ে দেন। মাত্র এতটুকু অভিজ্ঞতা নিয়ে বীণা এমন দুঃসাহসিক কাজটি করেন। মূলতঃ এ কারণেই টার্গেট মিস্ হয় এবং জ্যাকসনকে হত্যা করতে ব্যর্থ হন তিনি।

দৃঢ়চিত্তে বীণা দাস গভর্নরের উপর হামলার সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে নির্ভীক চিত্তে জবানবন্দিতে বলেন, ‘আই হ্যাভ নো সর্ট অব পার্সোনাল ফিলিংস এগেইনস্ট স্যার স্টানলি জ্যাকসন, দি ম্যান এন্ড লেডি জ্যাকসন, দি উমেন। বাট দি গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল রিপ্রেজেন্টস্ দি সিস্টেম অব রিপ্রেসান হুইচ হ্যাজ কিপ্ট এনস্ল্যাভড্ ৩০০ মিলিয়নস অব মাই কাউনট্রিম্যান এন্ড কান্ট্রিউমেন।’
বীণা দাস কতটুকু দেশপ্রেমিক ও নির্ভীক চিত্তের অধিকারী ছিলেন তা তাঁর শিক্ষিকার প্রশ্নের উত্তর দিয়ে জানিয়ে দেন। কান্নারত অবস্থায় তাঁর শিক্ষিকা সিস্টার ডরোথি বলেন, ‘ও বীনা, আই লাভ ইউ সো মাচ। হাউ কুড ইউ ডু দিজ ?’ বীণা দাসের তাৎক্ষণিক উত্তর, ‘ ও সিস্টার, আই লাভ ইউ নো লেস। বাট, আই লাভ মাই কান্ট্রি মোর।’ রিভলবারের উৎস জানতে বিরতিহীন চেষ্টা করেও বীণার মুখ খুলতে পারেনি বৃটিশ পুলিশ। এরপর এক তরফা বিচারে আদালত বীণাকে ৯ বছরের কারাদন্ড দেয় এবং ৭ বছর কারাভোগের পর গান্ধীজির আপ্রাণ চেষ্টায় ১৯৩৯ সালে মুক্তিলাভ করেন।

কারাগার থেকে মুক্তি লাভের পর বীণা দাস কমলা দাশগুপ্ত সম্পাদিত ‘মন্দিরা’ পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করে তিনি দেশাত্মবোধক চিন্তাধারার বাহক ও সাহিত্যিক হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৪২ সালে ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু হলে কংগ্রেসের হয়ে হাজেরা পার্কে তাঁর ডাকা সভাকে বৃটিশ সরকার বেআইনি ঘোষণা করে এবং তাঁর এক সহকর্মীকে এক বৃটিশ সার্জেন্ট ব্যাটন দিয়ে প্রহার শুরু করলে তীব্র প্রতিবাদ করে আবারও গ্রেফতার হয়ে ৩ বছর কারাভোগ করেন। ১৯৪৫ কারামুক্তির পর কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচন করে রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে নিবেদিত তাঁর স্বামী যতীশ ভৌমিকের মৃত্যুর পর রাজনীতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে তিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে যান।

১৯৮৬ সালের ২৬ ডিসেম্বরে হরিদ্বার গঙ্গার ঘাটে এক বয়স্ক মহিলার দেহ উদ্ধার করা হয়। খবরটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর অজ্ঞাতনামা সে নারীর পরিচয় জানা যায়। সে অজ্ঞাতনামা দেহটি ছিল ইংরেজদের ত্রাস বিপ্লবী বীণা দাসের। কখন যে সবার অলক্ষ্যে হরিদ্বার চলে যান, তা কেউ বলতে পারেন না। এক প্রকার নীরবে-নিভৃতে তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন।

আজ দুঃখের সাথে বলতে হচ্ছে, প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার ও কল্পনা দত্তকে আমাদের নতুন প্রজন্ম কিছুটা জানলেও বীণা দাসকে আমাদের নতুন প্রজন্মের কাছে সেভাবে তুলে ধরতে পারিনি। প্রজন্মের কাছে এক প্রকার উপেক্ষিতই রয়ে গেছেন বীণা দাস। এটা আমাদের ব্যর্থতা। আজ এ জন্যই আমাদের সন্তানেরা বৃটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনের বিপ্লবী প্রীতিলতা, কল্পনা দত্ত ও বীণা দাসের মতো দেশপ্রেমিক অগ্নিকন্যাদের আদর্শ ও মডেল মনে করে না। তারা আদর্শ ও মডেল মনে করে মাইকেল জ্যাকসন, শাহরুখ খান, অক্ষয় কুমার ও হৃত্বিক রোশনদের। ফলে সমাজের অবস্থাও যা হওয়ার কথা, তাই হচ্ছে।

সুতরাং ২৪ আগস্ট কুয়াশার আড়ালে হারিয়ে যাওয়া এক নক্ষত্রের জন্মদিবসে জানাই শুভেচ্ছাসহ বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test