E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শুভ জন্মাষ্টমী : কুল ভেঙ্গে গোকুলে ভাসি

২০২৩ আগস্ট ৩১ ১৮:০৩:৪৬
শুভ জন্মাষ্টমী : কুল ভেঙ্গে গোকুলে ভাসি

পীযূষ সিকদার


আমরা শুধু কুলের গৌরব করি। তাতে শুধু অহংকারই জন্ম নেয়। মীমাংসা টানে না। কেবলি অহংকারে অহংকারে নিপাতিত হই দুঃখে। পাপে। পাপবোধে। বোধের ওপারে বোধহীন হতে হতে কখন যে পশুত্বে রূপান্তিরিত হই টের পাই না। এভাবে কুলের গৌরব করতে করতে আমরা যখন দ্বিধান্বিত ঠিক তখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আসেন ধরায় কুলকে অকুলে ভাসাতে। তাইতো তাঁর লীলা জুড়ে কুল ভাঙ্গার প্রতিধ্বনি শুনি। শুনি এক মহামিলনের মন্ত্র।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কৃষ্ণপক্ষের অষ্টমী তিথিতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বলা যায় মধ্য রাতে দৈবকীর গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন। যেহেতু মধ্যরাতে জন্মগ্রহণ করেন তাই তাঁর জন্ম তিথি দুই দিন পালন করা হয়। শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী এ বছর ৬ সেপ্টেম্বর শুরু এবং শেষ হবে ৭ সেপ্টেম্বর বিকালে। যুগে যুগে এভাবে ভগবান স্বয়ং আসেন মনুষ্যরূপী হয়ে মানুষকে শিক্ষা দেবার অভিপ্রায়ে। বরাবরই আমরা মহামানবকে গ্রহণ করি না। তাঁর থেকে শিক্ষাও নেই না। উপর্যুপরি তাঁকে দূরে ঠেলে দিই। তাইতো আমাদের গ্লানি ঘুচে না। পাপের তাড়নায় অথবা পাপবোধে জড় জীবন লাভ করি। সেই জড় জীবনকে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করার নিমিত্ত ভগবান যুগে যুগে আসেন। তেমনি কুলভাঙার বাঁশি বাজিয়ে রাখাল সেজে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এসেছে পৃথিবীতে এক মমস্পর্শী বার্তা নিয়ে।

শ্রীকৃষ্ণের জন্মাষ্টমী হলো সেই শুভক্ষণ যখন শ্রীকৃষ্ণ এই গ্রহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের জন্ম তিথি ঘিরে সনাতন ধর্মাবলম্বীরা উৎসব পালন করে। এই উৎসবটি অন্ধকার পাক্ষিকের ৪তম দিনে উদ্যাপিত হয় যাকে শ্রীকৃষ্ণের অষ্টমী বলা হয়। এই উৎসবটি ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জয়ন্তী গোকুলাষ্টমী এবং জন্মাষ্টমী নামেও পরিচিত। জন্মাষ্টমী ভগবান শ্রী বিষ্ণর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণের জন্মোৎসব পালন করা হয়। ইংরেজি ক্যালেন্ডার অনুসারে প্রতিবছর আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে জন্মাষ্টমী উৎসব পালন করা হয়।

এই উৎসবটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ বৈষ্ণব ধর্মের জন্য। এই আনন্দ উৎসব ঘিরে চলতে থাকে নাচ-গান। প্রসাদ গ্রহণ। যাতে করে ভক্তরা শ্রীকৃষ্ণের কাছ থেকে মঙ্গলপ্রদীপ জ্বেলে তাঁর কৃপা লাভ করতে পারে। তাঁর কৃপা লাভই ভগবান লাভ। আর ভগবান লাভ করতে পারলে ভক্তদের জন্ম মৃত্যুর ভেদ ঘুচবে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাই কুলভাঙ্গার ব্রত নিয়ে এসেছিলেন। তাইতো রাধাকে বলতে শুনি, ‘কুল রাখি না শ্যাম রাখি?’

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বহু নাম। বহু রূপ। বহু সাজ। বহু কলংক। কলংকই তাঁর প্রেম ধর্মের প্রধান আধার। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যমুনার তীরে বাঁশি বাজায়। রাধা বিমনা হয়। ঘর ছাড়ে। এ যেন কুল ভাঙ্গার এক মহামন্ত্র।

শুভ জন্মাষ্টমী যা ‘কৃষ্ণ জন্মাষ্টমী’ নামেও পরিচিত। ভগবান বিষ্ণুর অষ্টম অবতার শ্রীকৃষ্ণ।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিখিয়েছে আমরা যেন অহংকারী না হই। আমরা যখন হাটি ডান পান আগে যায়। তাতে ডানপায়ের কোন অহংকার নেই। বাম পা যে পিছনে পড়ে রইলো তাতে তার কোন হীনমন্নতা নেই। একটু পরেই বাম পা একধাপ এগিয়ে যাবে। অতএব হে মানুষ কী এমন অহংকার তোমার! অহংকারকে পয়ে পিষে সামনের দিকে এগুনোর লীলাই তাঁর লীলাযজ্ঞে পাই। লোভ তো নয়ই। কাম থেকে অনেক দূরে। মোহতো মানুষকে ভুল ঠিকানায় নিয়ে যায়। শ্রীকৃষ্ণ তাই তাঁর লীলার সমস্তটা জুড়ে আনন্দের মধ্য থেকে জীবকে শিক্ষা দিয়ে গেছেন।

তারপরও কী জীব শ্রীকৃষ্ণের বাণীকে অথবা তাঁর লীলাকে মেনে নিয়েছে! আমরা তো সবসময় অবিশ্বাসী। বিশ্বাসী না হতে পারলে আমরা শ্রীকৃষ্ণের লীলাকে অনুধাবন করতে পারবো না। কেবলি আমরা মিথ্যা সেজে বসে থাকবো। ভগবান তাঁর জীবনটা ভর জীবকে যে শিক্ষা দিয়ে গেলেন জীব কী সেই শিক্ষাটা গ্রহণ করেছেন? না গ্রহণ করেনি। গ্রহণ করলে পৃথিবীজুড়ে এতো হানাহানি, মারামারি, যুদ্ধবিগ্রহ থাকতো না। একমাত্র শ্রীকৃষ্ণের প্রেম ধর্মই পারে জাতিতে জাতিতে গোত্রে গোত্রে বর্ণে বর্ণে দ্বিধাবিভক্ত না হয়ে একে অন্যের সাথে যুক্ত হবার এক মহামন্ত্রই আমাদের এক হবার শিক্ষা দিতে পারে।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রেমের ধর্মকেই মেনে নিয়েছেন হৃদয়জুড়ে। প্রেমহীনতা কোনো ধর্ম হতে পারে না। তাই প্রেমই তাঁর সমস্ত তনুমন প্রাণ।

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কংসের কারাগারে দৈবকীর গর্ভের জন্মেছিলেন। পালন হয়েছিলেন মা যশোদার ঘরে। দ্বারকার রাজা কংস দৈববানী পায় তাকে বধ করবে দৈবকীর গর্ভের সন্তান। অর্থাৎ ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। কত ঘটনা অনুঘটনার মধ্য দিয়ে শ্রীকৃষ্ণ কংসকে বধ করে। শ্রীকৃষ্ণ আমাদের শিখিয়ে গেছেন যেমন প্রেম তেমনি শিক্ষা দিয়ে দিয়ে গেছেন কেমন করে শাসন করতে হয়। প্রজাদের সাথে কিরূপ ব্যবহার করবে তাও পলে পলে আমাদের শিখিয়ে গেছেন।

এতো কিছুর পরও আমরা প্রেম ধর্মকে মানি না। আমরা প্রেমকে মিলিয়ে ফেলি যৌনতার সাথে। যৌনতা আর প্রেম এক জনয়। প্রেম মহিমান্বিত এক সম্পর্কের নাম। আমরা শুধু গোজামিল দিতে শিখেছি। ধর্ম ধর্ম করে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ করি। তাতে কী ধর্ম হয়! হয় না! ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দেখানো পথই সুপথ। সে পথের নাম প্রেম। প্রেমকে দূরে রেখে শুধু ধুলায় গড়াগড়ি খেলে ধর্ম হয় না। ধর্ম এমন এক আলোর নাম যে পথে গেলেimpritual আলোর সন্ধান পাওয়া যায়। আমি আমি করতে করতে তাতে কেবল অহংকার বাড়ে কাজের কাজ কিছু হয় না। ভেতরে যদি আলো জ্বালতে হয় তাহলে অহংকার নামক অদৃশ্য জিনিষটি একেবারে নিঃশেষ করে দিতে হবে। মোহ সেতো আরেক অন্ধকারের নাম। কামতো দূরের বিষয়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বুঝতে হলে তাঁর লীলা বুঝতে হবে। আর তাঁর লীলা বুঝতে হলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন দর্শন বুঝতে হবে। গোকুলে যার জন্ম সেতো কুলের গর্ব করতে পারেন না। তাইতো কুলভাঙার গান তাঁর কর্মেল সর্বজনীয়তায় উঠে এসেছে। যেনবা ভেদ ভুলে অভেদাত্মার জয় গান তাঁর সমস্ত জীবনজুড়ে। সুন্দরই তাঁর কাছে কৃত্য। সুন্দরই আরাধ্য। সেই আরাধ্য কে? ভাগবান শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর কাছে কোনো কিছুর অভাব নেই। চাও। পাবে। অহংকারী হইও না। গৌরব করো না। কী এমন গৌরব তোমার। তোমার তো কিছু নেই। সবই ভগবানের শ্রীপদ্মে নিবেদন করে নৈবেদ্য সাজাও। দেখবে তোমার নেই বলতে কিছু নেই। সব আছে।

যুগ যুগ ধরে যুগে যুগে অনেক মহামানব এসেছে। আমরা তাদের মেনে নেইনি। কারণ আমরা এতটাই নিরক্ষর যে তাদের লীলাধর্ম বুঝিনি। বুঝিনি বলেই আজ আমাদের এই কলিকালে আমরা মরণাহত। বিষে বিষে কেবলি কালসাপ দংশায়। আমাদের পথ জানা নেই। পথের শেষটাও আমরা বুঝতে পারিনে। কোথায় আমরা যেতে চাই তাও আমরা জানি না। শুধু হরি হরি বলে ধুলায় লুটাই। ধুলায় লুটোপুটি খেয়ে কী হবে? যদি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের জীবন দর্শন আমরা না বুঝি। জাতি হিসেবে আমরা খুব হীনমন্য। শেষ অবধি হীনমন্যতাই আমাদের না বুঝে অহংকারী করে গড়ে তোলে।

কত মহামানবই তো এসেছে যুগে যুগে। তাদের জীবন আচরণ ও জীবন দর্শন আমরা বুঝিনি। আর বুঝিনি বলেই আমরা কেবলি অন্ধকারে হামাগুড়ি খাচ্ছি। শ্রীকৃষ্ণ কোথাও কোন জাতির কথা বলেননি। বলেছেন মানুষের কথা। মানুষই তাঁর সমস্ত হৃদয়জুড়ে। মানবমুক্তির লাগি তাঁর যত চলন। আমরা বুঝিনি। আমরা কোন মহামানবকেই বুঝতে পারিনি। তাঁদের লীলা বুঝতে পারিনি। তাঁদের কথার প্রতিকীচলন আমরা বুঝতে পারিনি। কথা পীঠে অনেক কথা বলে ফেললাম। আজ ভাগবান শ্রীকৃষ্ণের জন্মতিথি অথবা জন্মাষ্টমী। আসুন আমরা কুল ভেঙে গোকুলে ভাসি। হিংসা ভুলে প্রেমের বেদমন্ত্র শুনি।

৬ সেপ্টেম্বর দুপুর ৩টা ৩৮ মিনিটে অষ্টমী তিথির সূচনা হবে। শেষ হবে ৭ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৪টা ১৫ মিনিটে। শ্রীকৃষ্ণ মাঝরাতে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বলে তাঁর জন্মতিথি জন্মাষ্টমী দুই দিন পালিত হয়। ঘরে ঘরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের স্তব গান করতে করতে আবার আমরা ভূমিষ্ট হবো অহিংস ধর্ম নিয়ে কুল থেকে গোকুলে। যেখানে হিংসা দ্বেষ থাকবে না। মানুষে মানুষে অভেদ মন্ত্র শুনতে পাবো আগামীর পথে। ভেদে নয় অভেদই মুক্তি। সেই মুক্তির গান গেয়ে যাবে মানুষে মানুষে অভেদাত্মা হয়ে। আমরা তো পথ দেখতে চাই ভাগবান সেই পথ দেখানোর জন্য অভয় বাণী দিয়ে যাচ্ছেন সময় থেকে সময়ে। কুল থেকে গোকুলে।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test