E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চিহ্নিত শত্রু  নির্মূলে সদিচ্ছাই প্রয়োজন

২০২৩ সেপ্টেম্বর ০৯ ১৭:১৮:০৬
চিহ্নিত শত্রু  নির্মূলে সদিচ্ছাই প্রয়োজন

গোপাল নাথ বাবুল


দেশজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম ডেঙ্গু। প্রাণঘাতি ডেঙ্গুজ্বর ভয়াবহ মাত্রায় ছড়িয়ে পড়েছে। মহামারি ঘোষিত না হলেও এটি এখন মহামারির চেয়ে কম নয়। প্রতিদিনই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণ করছেন। চট্টগ্রামসহ সারাদেশেই এখন ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত ও মৃত্যু উদ্বেগজনক হিসেবে দেখা দিয়েছে এবং আক্রান্ত ও মৃত্যুর সংখ্যা অতীতের সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। চলতি বছর শুধু আগস্টেই মৃত্যুবরণ করেছেন ৩৪২ জন এবং আক্রান্ত হয়েছেন প্রায় ৭১ হাজারেরও বেশি। চলতি মাসে ডেঙ্গু আরও ভয়ানক রূপ নিয়েছে। গত ২ সেপ্টেম্বর ২৩ জন ডেঙ্গু রোগীর মৃত্যু হয়েছে। যা গত ২৩ বছরেই একদিনে সর্বোচ্চ মৃত্যু। 

কেবল বাংলাদেশ নয়, পাশ্ববর্তী ভারত সহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ এখন ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত। মালয়েশিয়া, থাইল্যান্ড, শ্রীলঙ্কাসহ কয়েকটি দেশ ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানায়, এডিসের বিরুদ্ধে রীতিমতো যুদ্ধ শুরু করেছে দক্ষিণ আমেরিকার দেশ পেরু। যুক্তরাষ্ট্রও এর বাইরে নয়। দেশটির ফ্লোরিডা অঙ্গরাজ্যের বেশ কয়েকটি স্থানে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। জানা যায়, পৃথিবীতে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার প্রজাতির মশার মধ্যে এডিস এজিপ্টি খুবই ভয়ঙ্কর। ফলে ডেঙ্গুর প্রচলিত ধরনের সঙ্গে শক সিন্ড্রোম দেখা দেওয়ায় ঝুঁকি ও মৃত্যুহার দৈনিক বাড়ছে। প্রচন্ড জ্বর, গায়ে ব্যথা, চোখের নিচে যন্ত্রণা, বমি বমি ভাব, ফোলা গ্রন্থি, অস্থিসন্ধি, হাড় বা পেশীতে যন্ত্রণা, র‌্যাশ বা ফুসকুড়ি, মাথা ব্যাথা ইত্যাদি উপসর্গ যুক্ত এ ব্যাধি মাত্র ৩-৪ দিনে রোগীকে কাবু করে ফেলে। অবাক ব্যাপার হলো, মাত্র ২.৫ মিলিগ্রাম ওজনের এ ক্ষুদ্র মশাটি তার চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি ওজনের একজন মানুষকে ধরাশায়ী করে ফেলে। বাংলাদেশে গতবছর পর্যন্ত রোগটি শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এবার গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে।

গতকাল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হেল্থ ইমার্জেন্সি অপারেশন সেন্টার ও কন্ট্রোল রুম থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, গত ২৪ ঘণ্টায় ২০ জনের প্রাণ কেড়ে নিয়েছে ডেঙ্গু ভাইরাস এবং ২ হাজার ৬৮৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। চলতি বছরে ৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ডেঙ্গুতে ৬৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং আক্রান্ত হয়েছেন মোট ১ লক্ষ ৪০ হাজার ৭১১ জন। এর মধ্যে ১ লক্ষ ৩০ হাজার ৩০৯ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে সুস্থ হয়ে ছাড়পত্র পেয়েছেন। এখন পর্যন্ত মোট ১০ হাজার ৪০২ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি আছেন। এর আগে ২০২২ সালে ডেঙ্গুতে দেশের ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৮১ জন মারা যান এবং আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ৬২ হাজার ৩৮২ জন। ২০২১ সালে মারা যান ১০৫ জন এবং আক্রান্ত হন ২৮ হাজার ৪২৯ জন।

চলতি বছর মৃতদের মধ্যে ১৮ থেকে ৪০ বছর বয়সি রোগী বেশি। এদের মধ্যে শিশুরাও রয়েছে। সরকারের অক্লান্ত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না। বলা যায়, সারাবছর মশার চাষ করে এখন মৃত্যুর ফসল তুলছে বাংলাদেশ। দেশজুড়ে ডেঙ্গুজ্বরে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। সাথে বাড়ছে মৃত্যুও। দিন যতই যাচ্ছে ডেঙ্গু নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ততই বাড়ছে। সেপ্টেম্বর-নভেম্বরে আরও ভয়াবহ পরিস্থিতির আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

বিশেষত বিশেষজ্ঞদের উদ্বেগ ছিল, করোনা ও ডেঙ্গুর যৌথ আক্রমণ নিয়ে। কেননা, দুর্বল শরীরের ওপর যে কোনো সংক্রামক আক্রমণ মারাত্মক হতে পারে, যা প্রমাণিত সত্য। সে কারণে ডেঙ্গুর প্রভাব তীব্র ও ব্যাপক হওয়ায় দেখা দিচ্ছে সময়োপযোগী চিকিৎসার অভাব এবং রোগীদের চরম বিপন্ন অবস্থা। ফলে প্রতিদিন মৃত্যুর মিছিলে যোগ হচ্ছে নতুন নতুন ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগী। এজন্য ডেঙ্গুকে অঙ্কুরেই বিনাশ করার পরামর্শ দিয়েছিলেন বিশেষজ্ঞরা। মশার লার্ভা সময় থাকতে ধ্বংস করলে ডেঙ্গু ছড়াবার সম্ভাবনা কমে যায়। কিন্তু যথারীতি সে সুপরামর্শ উপেক্ষিত হয়েছে। চলতি বছরের মে’র প্রথম থেকেই ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা গিয়েছিল যা আগস্ট থেকে দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়ে। প্রতিদিন নতুন নতুন সংক্রমণের খবর হচ্ছিল। কিন্তু দুঃখের বিষয় যে, কোভিডের মতো বিপর্যয় দেখা দেওয়ার পরেও চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আরও সুরক্ষিত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। বরং আগের চেয়ে আরও অবনতি পরিলক্ষিত হয়েছে। পথে-ঘাটে স্তুপিকৃত আবর্জনা, নিকাশির অবস্থা তথৈবচ, প্লাস্টিক বা থার্মোকল ব্যবহারের রাশ টানা হয়নি। ফলে বৃষ্টির পর নেমে না যাওয়া পানি জমে অবস্থা আরও শোচনীয় হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের অবস্থা আরও খারাপ। কারণ, দৈনিক নিয়ম করে দু’বার জোয়ার-ভাটার পানি জমে অপরিণত খালসহ নালা-নর্দমায়। তার ওপর রয়েছে পরিত্যক্ত বা নির্মাণাধীন বিল্ডিংগুলো। ফলে এগুলো হয়ে ওঠেছে মশার আতুঁড়ঘর।

এ কথা ঠিক যে, জন্মলগ্ন থেকেই দেশের নগরীগুলো মশার মোকাবিলা করে আসছে। তারপরও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কর্তা ব্যক্তিরা চিকিৎসা ব্যবস্থাকে আপদকালীন চিকিৎসার সঙ্গে এক করে ফেলেন। সঙ্কট দেখা দিলে হৈচৈ ফেলে দেন, তারপর যথা পূর্বং। ফলে ফলাফল দাঁড়ায় যে লাউ সে কধু।
গত বুধবার বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসুস এক অনলাইন সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব রেকর্ডের সবচেয়ে ভয়াবহ আবার ধারণ করেছে। প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকে গত এপ্রিলে বিশ্বের অষ্টম জনবহুল এই দেশটিতে ১ লাখ ৩৫ হাজারেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুরোগে আক্রান্ত হয়েছে। প্রাদুর্ভাবের পরে মৃত্যু রেকর্ড করা হয়েছে ৬৫০ জনের। তিনি আরও বলেন, শুধু গত আগস্ট মাসেই বাংলাদেশে ডেঙ্গুতে ৩০০ জনেরও বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। ডেঙ্গুর এই প্রাদুর্ভাব স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর ব্যাপক চাপ সৃষ্টি করছে। রাজধানী ঢাকায় সংক্রমণ কমতে শুরু করলেও দেশের অন্যান্য অংশে তা বাড়ছে।

গ্যাব্রিয়েসুস জানান, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রাদুর্ভাবের সময় নজরদারি, ল্যাবের সক্ষমতা, ক্লিনিক্যাল ম্যানেজমেন্ট, মশা নিয়ন্ত্রণ, যোগাযোগ এবং সম্প্রদায় সংযোগের কাজে বাংলাদেশ সরকার এবং কর্তৃপক্ষগুলোকে সহায়তা করছে। তিনি আরও বলেন, আমরা চিকিৎসদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি এবং মাঠপর্যায়ে বিশেষজ্ঞদের মোতায়েন করেছি। আমরা ডেঙ্গু পরীক্ষা এবং রোগীদের সেবাযতেœর জন্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রও সরবরাহ করেছি।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ডেঙ্গু এবং মশাবাহিত ভাইরাস যেমন-চিকুনগুনিয়া, হলুদ জ্বর, জিকার কারণে সৃষ্ট অন্যান্য রোগ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। সংস্থাটির অ্যালার্ট অ্যান্ড রেসপন্স ডিরেক্টর আব্দি মাহামুদ সম্মেলনে বলেন, জলবায়ু সংকট এবং আবহাওয়ার অস্বাভাবিক অবস্থা এল নিনোর কারণে বাংলাদেশ ডেঙ্গুর এমন ভয়াবহ কবলে পড়েছে। এছাড়া জলবায়ু সংকটের প্রভাব কী রকম ভয়াবহ হতে পারে, বাংলাদেশে ডেঙ্গুর মহামারী সেটি দেখিয়েছে। এ বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ বছরের বিভিন্ন কারণের সংমিশ্রণ বাংলাদেশ ও দক্ষিণ আমেরিকাসহ বেশ কয়েকটি অঞ্চলে মারাত্মক ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব বাড়িয়ে তুলেছে। আফ্রিকার দেশগুলোতেও সম্প্রতি প্রাদুর্ভাবের খবর পাওয়া গেছে। তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, এটি বিশ্ববাসীর জন্য একটি সতর্কবার্তা। আর এই সংকট মোকাবিলায় বিশ্বের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন।

অন্য এক বিজ্ঞাপ্তিতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গ্রীষ্মমন্ডলীয় রোগের ইউনিট প্রধান রমন ভেলাউধন বলেছেন, ‘বিশ্বের অর্ধেক জনসংখ্যা মশাবাহিত ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। ডেঙ্গু আনুমানিক বিশ্বের ১২৯টি দেশকে প্রভাবিত করবে। ‘হু’ ২০০০-২০২২ সালের মধ্যে ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে আটগুণ বৃদ্ধি রেকর্ড করেছে।’

এদিকে এডিস মশা নিধন প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী গতকাল বিকেলে সচিবালয়ে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘মশা মারার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের একার না। আমরা জনগণকে সম্পৃক্ত করে এই কাজটা করি এবং করছি। মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উদ্যোগ আর আন্তরিকতার কোনও ঘাটতি নেই। জনগণের অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে মশা নিধন কার্যক্রমের সফলতা অর্জন করা যেতে পারে।’

কিন্তু কীটতত্ত্ববিদরা অভিযোগ করেছেন, মশা নিয়ন্ত্রণের নামে তামাশা চলছে। দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি মহামারি পর্যায়ে পৌঁছেছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে স্থানীয় সরকার ও সিটি কর্পোরেশন ব্যর্থ হয়েছে। পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দেওয়া ডেঙ্গুরোগীদের পরিসংখ্যানও খন্ডিত বলে তারা উল্লেখ করেন।
গত শনিবার রাজধানীর সিরডাপ মিলনায়তনে ‘বাংলাদেশ ভেক্টর ম্যানেজমেন্ট গ্রুপ’ আয়োজিত ‘কেন এই ডেঙ্গু মহামারি ? পরিত্রাণ কোন পথে ?’ শীর্ষক এক সম্মেলনে ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অভিযোগ করেন কীটতত্ত্ববিদরা। উক্ত সম্মেলনে বক্তারা বলেন, মশাকে আমরা গুরুত্ব দিচ্ছি না- যে কারণে মশাবাহিত রোগ বাড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে মশা নিধনে সিটি কর্পোরেশন ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় যেসব কার্যক্রম পরিচালনা করছে, সেগুলোর বাস্তব কোনও কার্যকারিতা ও বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মশা নিধনে পানিতে হাঁস, ব্যাঙ ছাড়ার যে কৌশল নেওয়া হয়েছে তা খুবই হাস্যকর।

কীটতত্ত্ববিদ অধ্যাপক আবু ফয়েজ মো. আসলাম বলেন, আমাদের এমন কিছু লোক থাকতে হবে, যারা সব সময় এই বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করবে। কারণ মশা প্রতিনিয়ত তার ধরন পাল্টাচ্ছে। আমরা যে ওষুধগুলো ব্যবহার করছি, সেগুলো নতুন ধরনেও কার্যকর হচ্ছে কিনা-সেটা গবেষণা করতে হবে।

তারা আরও অভিযোগ করেন যে, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইডলাইন অনুযায়ী মশা নিধন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে না এবং গাইড লাইন প্রয়োগে দুই সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা সম্পূর্ণ অজ্ঞ। দুই সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বশীল বিভাগীয় প্রধানদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কীভাবে এডিস মশার বিস্তার রোধ করা হয়, জানতে চাওয়া হলে তার কোনও সদত্তর তারা দিতে পারেননি। এডিস মশা নিধনে ওষুধের সঠিক মাত্রা নির্ধারণ ও তার প্রয়োগ সঠিকভাবে না করা এবং মনিটরিংয়ের দুর্বলতার কারণে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব আজ ভয়ঙ্কর রূপ নিয়েছে। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, পাশ্ববর্তী ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা সিটিতে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গাইড লাইন মেনে ওষুধ প্রয়োগ করে তারা ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। কিন্তু বাংলাদেশে এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে তার উল্টো চিত্র দেখা যায়। তারা বলেন, শস্যের পোকামাকড় নিধনের প্রক্রিয়া আর মশা নিধনের ওষুধ প্রয়োগের প্রক্রিয়া এক নয়। এর মধ্যে অনেক পার্থক্য রয়েছে।

এতে বোঝা যায়, কীটতত্ত্ববিদদের এড়িয়ে সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা, সঠিক মাত্রায় ব্যবহার করা হয় না ওষুধ। ফলে মশার শক্তি বাড়ছে দ্বিগুণ। সিটি কর্পোরেশনের কর্তারা জানেনই না কীভাবে ওষুধ ব্যবহার হচ্ছে।

উল্লেখ্য, ১৭৭৯ সালে ডেঙ্গুর প্রথম নাম শোনা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে ডেঙ্গু একটি বৈশ্বিক রোগে পরিণত হয়। এশিয়া, দক্ষিণ আমেরিকা ও অন্যান্য মহাদেশের ১১০টির অধিক দেশে ডেঙ্গু রোগটি দেখা দেয়। বাংলাদেশ সরকার ২০০০ সালে সরকারিভাবে ডেঙ্গুকে রোগ হিসেবে ঘোষণা করে। সে বছর ৯৩ জন লোক মারা যায় এবং ৫ হাজারেরও বেশি লোক এ ভাইরাসে সংক্রমিত হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে, বর্তমানে লার্ভার ৪টা স্টেজই পাওয়া যাচ্ছে এবং আগের তুলনায় বেশি পাওয়া যাচ্ছে।

একসময় বর্ষাকালকে ডেঙ্গুরোগের মৌসুম বলা হলেও জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণতার কারণে এখন সারাবছর ডেঙ্গুর মৌসুম হয়ে ওঠেছে। আগে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দিনে কামড়াত, এখন রাতেও কামড়ায়। আগে স্বচ্ছ পানিতে এডিসের লার্ভা পাওয়া যেত, এখন ময়লাযুক্ত পানিতেও লার্ভা পাওয়া যাচ্ছে। এটা এখন বারোমাসি রোগের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। বসতবাড়ি থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত, কলকারখানা সকল স্থানে মশার বিচরণক্ষেত্র বানিয়ে ফেলেছে। সব জেলাতেই এখন এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ গত দুই দশক থেকে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, রোগীব্যবস্থাপনা এবং এডিস মশা নির্মূলে সরকার কাজ করছে। কিন্তু মশা নিয়ন্ত্রণে দুর্বলতা এবং রোগী ব্যবস্থাপনার ঘাটতির কারণে রোগটিকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছে না।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ মুহূর্তে ৫টি ডেঙ্গু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে। এর মধ্যে ২টি প্রায় শেষ পর্যায়ে। তবে ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে ডেঙ্গু প্রতিরোধে এডিস মশার নিয়ন্ত্রণ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই। সুতরাং ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সরকারের পাশাপাশি জনগণকে সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। বাড়ি আঙ্গিনা ও চারপাশে, অফিস-আদালত, কলকারখানাসহ সকল প্রতিষ্ঠান পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পানি যাতে কোথাও না জমে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত মশার উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করে মশকনিধনে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ সহ চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। অন্যথায় ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে কাক্সিক্ষত ফল আসবে না। তাই আসুন, আমরা দায়িত্বশীল হই, রোগটি মোকাবেলায় সতর্ক ও সচেতন হই। তবেই মুক্তি পাওয়া যাবে এ ভয়ঙ্কর রোগটি থেকে। কারণ সদিচ্ছা থাকলে চিহ্নিত শত্রুকে সহজেই নির্মূল করা যায়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test