E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমার বোন শেখ হাসিনা

২০২৩ সেপ্টেম্বর ২৮ ২৩:১৬:৪৮
আমার বোন শেখ হাসিনা

প্রবীর সিকদার


'শেখের নৌকায় ভোট দিন ভোট দিন, ভোট দিন ভোট দিন শেখের নৌকায় সত্তরের এ শ্লোগানে যখন উত্তাল গ্রামগঞ্জ, তখনও আমার প্রাইমারি স্কুল পেরোনো হয়নি। আমি আর আমার সতীর্থ অধীর তখন স্কুলের অ্যাসেম্বলি ক্লাসে 'পাকিস্তান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান জিন্দাবাদ ...... গানের বদলে 'পাকিস্তান ঝিঙ্গে ভাতে, পাকিস্তান ঝিঙ্গে ভাতে...' গাওয়া শুরু করেছি, স্কুল পালিয়ে নৌকার শ্লোগানেও হারিয়ে গেছি। পেছন ফিরে তাকালে সেই জ্বল জ্বল স্মৃতি মনে হয় গতকালের। তারপর দ্রুত পাল্টেছে দৃশ্যপট। নির্বাচনে নৌকার জয় জয়কার। উৎসবে মুখরিত বাংলা, বাঙালি। দমকা হাওয়ায় আবার হঠাৎ থমকে দাঁড়ানো। এরই মধ্যে একদিন রেডিও কাঁপিয়ে, ফাটিয়ে বঙ্গবন্ধু মুজিব বললেন ... এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম'। আবার উত্তাল দেশ গ্রাম।

ফরিদপুরের কানাইপুর 'সিকদারবাড়ি' আমাদের বাড়ি। আমার স্কুল শিক্ষক বাবা-কাকার বন্ধু, সহকর্মী, ছাত্ররা আসতেন। মিনি রেসকোর্স হতো বাড়িটি। সে আসরে বঙ্গবন্ধুর 'দূত' হিসেবে মাঝে মধ্যেই আসতেন কেএম ওবায়দুর রহমান, ইমামউদ্দিন আহমাদ...। কথা হতো আন্দোলন নিয়ে। ভেতর বাড়ি থেকে গরম গরম চায়ের কাপ পাঠাতেন আমার মা।

একদিন আমাদের বাড়িরই প্রবীন অভিভাবক কনকভূষণ সিকদার আমাদের নিয়ে গড়লেন শিশু দল। প্রতিদিন বিকেলে আমরা গামছা নিয়ে হাজির হতাম বাড়ির বাইরের সবুজ চত্বরে। যার যার গামছার ওপর বসে আমরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম কনকভূষণ সিকদারের নানা নির্দেশনা। তিনি বলতেন, শেখ মুজিব হচ্ছেন। আমাদের 'নারায়ণ', আর ভারতের ইন্দিরা গান্ধী হচ্ছেন আমাদের ‘মা লক্ষ্মী'। এ লক্ষ্মী নারায়ণই আমাদের ভরসা। তিনি তখন যুদ্ধ যুদ্ধ খেলাও শেখাতেন। প্রতিদিনের সে যুদ্ধে জয় হতো জয় বাংলার, পালিয়ে যেত পাকিস্তানিরা।

একদিন ঢাকায় আসল যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ার কথা শুনলাম। সবার চোখে-মুখে ক্ষোভ-আতঙ্ক। সেই সঙ্গে বাঁশের লাঠি নিয়ে প্রতিরোধেরও প্রস্তুতি। আমার এক মামা ঢাকা থেকে পালিয়ে গ্রামে ফিরে বুড়িগঙ্গার জল রক্তে লাল হয়ে ওঠার বীভৎস বর্ণনা দিলেন। সম্ভবত মামার মুখেই শুনেছিলাম, পাক সেনারা আমাদের 'নারায়ণ' শেখ মুজিবকে বন্দি করেছে।

২১ এপ্রিল, ১৯৭১। বাবা এয়ারগানের গুলি ছুড়ে পাকসেনাদের হেলিকপ্টার ধ্বংসের ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। ফরিদপুরে ঢুকে পড়ল পাক সেনারা। অসহায় মানুষ নিরাপত্তার জন্য ছুটলো শহর থেকে গ্রামে, গ্রাম থেকে গ্রামে।

৮ মে, ১৯৭১। আমাদের সিকদার বাড়িতে রাইফেল উচিয়ে ঢুকে পড়ল রাজাকার আর বিহারিদের একটি দল। বাবা-কাকারই এক ছাত্র লাল মিয়া সেই দলের নেতা। ওরা আমার বাবা ও দাদুসহ কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেল। সিকদার বাড়িতেই রাজাকারদের হাতে আটকা পড়ে আমার দুই কাকা, মামাসহ আমাদের পুরো পরিবার এবং আমাদের বাড়িতে আশ্রয় নেয়া আরও কয়েকটি পরিবার। লাল মিয়ার সঙ্গে আমার দুই কাকার রফা হলো; ওরা আমাদের সবাইকে খুন করবে। সে অনুযায়ী খুনের প্রস্তুতিও চলল। কারো কণ্ঠে কোনো বাঁচার আকুতি নেই। রাইফেল উঁচিয়ে লাইনে দাঁড় করানো হলো। সম্ভবত রাইফেলের গুলির নিশানায় রাখতে আমি ও আমার ছোট ভাই-বোনকে উঁচু করে তুলে ধরা হয়েছিল। ঘাতকের রাইফেল তৈরি। আমরা সবাই যখন চোখ বন্ধ করে একটি শব্দের জন্য অপেক্ষা করছিলাম তখন এক 'মহানুভব' রাজাকারের আবির্ভাব হলো। তিনি 'বাচ্চা-কাচ্চা' আর 'মাইয়্যা মানুষ' না মারার নির্দেশ দিলেন। মুহূর্তে আমাকে এবং আমার ভাই বোন, মা-ঠাকুরমাসহ সব নারী-শিশুকে লাইন থেকে সরিয়ে একটি বারান্দায় বসিয়ে রাখা হলো। আমাদের ঘিরে রাখল বেয়নেট সংযুক্ত কয়েকটি রাইফেল। আমাদের চোখের সামনে বেয়নেট ঘুরিয়ে রাজাকার-বিহারিরা বলল 'কোনো শালা কাঁদতে পারবি না। আমরা আর কাঁদতেও পারলাম না। আমাদের চোখের সামনে ওরা আমার দুই কাকা-মামাসহ ১৩ জনকে রামদা-চাকু দিয়ে কুপিয়ে, লোহার রড দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করল। ওইদিন আমাদের এলাকায় আরো অন্তত ২০ জনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল; যাদের অনেকেই আমার আত্মীয়।

তারপর আর কাঁদা হয়নি। তখন শুধুই বেঁচে থাকার যুদ্ধ। খাদ্য আর নিরাপত্তার খোঁজে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় আমরা গ্রাম থেকে গ্রামে ঘুরেছি। পাকি রাজাকারদের ধাওয়ার মুখে পাড়ি দিয়েছি মাঠের পর মাঠ। কুকুর-শকুনে খাওয়া অজস্র লাশ দেখেছি । খোলা মাঠে প্রসব বেদনাকাতর এক মাকে সন্তান প্রসব ও মুহূর্তে সেই রক্তমাখা সন্তান নিয়ে ওই মাকেই দৌঁড়ে পালাতে দেখেছি। কিন্তু কখনোই খোজ নিতে পারিনি। আমার বাবা আর দাদু কোথায় কেমন আছেন। আর জানাও হয়নি রাজাকাররা তাদের কোথায় কী অবস্থায় হত্যা করেছে। শুধু নিরন্তর খোঁজ রেখেছি আমাদের সেই 'নারায়ণ' শেখ মুজিবের। কোথাও একটি রেডিওর খোঁজ পেলেই ছুটে গেছি সেখানে। শত শত শঙ্কিত ও কৌতূহলী মানুষের ভিড়ে জানার চেষ্টা করেছি- বঙ্গবন্ধু কোথায় আছেন? কেমন আছেন? বেঁচে আছেন তো? এভাবে কখন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবই আমার হারানো পিতা হয়ে উঠেছেন তা টেরই পাইনি। বাবাকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। বড়জোর ওরা বাবাকে মেরে ফেলবে। তাতে কী! বঙ্গবন্ধু মুজিব জীবিত থাকলেই হলো। তিনিই তো সবার ভরসাস্থল, আমারও পিতা। আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পাব। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসবেন। তখন আমি পিতাও পাব।

ফরিদপুর শত্রুমুক্ত হয় ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। তখন আমরা বোয়ালমারীর প্রত্যন্ত একটি গ্রামে। পিঁপড়ের সারির মতো মানুষ ছুটছে ফরিদপুর শহরের দিকে। আমিও যোগ দিয়েছিলাম ওই সারিতে। উল্লাসমুখর ক্লান্তিহীন পায়ে হেঁটে চলার ওই দীর্ঘ পথে আমার তখন একটাই আকাঙ্ক্ষা, ফরিদপুর শহরে ঢুকলেই বুঝি বঙ্গবন্ধু মুজিব, আমার পিতা মুজিবের দেখা পেয়ে যাব। কিন্তু শহরে ঢুকে সে আশা পূরণ হয়নি। যখন আরো পরিষ্কার করে জেনেছি বঙ্গবন্ধু মুজিব পাকিস্তানের কারাগারেই বন্দি রয়েছেন তখন বিমর্ষ হয়েছি, শঙ্কিত হয়েছি; আমার এ পিতাটিকেও কী ওরা খুন করবে।

একদিন খবর পেলাম বঙ্গবন্ধু দেশে ফিরছেন। আমার সে কী উত্তেজনা! আমি এবার আমার পিতা মুজিবকে দেখতে ঢাকাতেই যাব। কিন্তু টাকা আর উপযুক্ত সঙ্গী সংগ্রহ করতে না পারায় আমার সে আকাঙ্ক্ষা পূরণ হয়নি। ১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরলেন। পরদিন খবরের কাগজে বঙ্গবন্ধুর কান্নায় ভেঙে পড়া ছবি দেখে আমিও কেঁদেছিলাম। তারপর একদিন আমাদের বাড়িতে হাজির হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর লেখা দু'খানা চিঠি । স্বামী হারানো বোনকে সান্ত্বনা দিয়ে আমার মাকে চিঠি লিখেছেন বঙ্গবন্ধু। আরেকখানা লিখেছেন সন্তানহারা মাকে সান্ত্বনা দিয়ে আমার ঠাকুরমাকে। সেদিন ওই চিঠি পেয়ে আমার মা-ঠাকুরমা প্রচণ্ড কেঁদেছিলেন। আমি আনন্দে কেঁদেছিলাম একাত্তরের হারানো পিতার অস্তিত্ব অনুভব করে।

২২ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। স্বাধীন দেশে নিজের জেল ফরিদপুরে প্রথম এসেছিলেন বঙ্গবন্ধু। তাকে দেখার অদম্য ইচ্ছার বাস্তবায়ন আমি সেদিন করেছিলাম। সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ ময়দানের জনসভা মঞ্চে সেদিন এক আবেগঘন বক্তৃতা দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। ওই জনসভা চত্বরে আমি আমার সুরদিদির কোলে বসে বঙ্গবন্ধুকে প্রথম দেখেছিলাম। সেদিন সুরদিদিও কেঁদেছিলেন, একাত্তরে হারানো পিতার ছায়া বঙ্গবন্ধুর মধ্যে খুঁজে পেয়ে আমিও কেঁদেছিলাম। সেই প্রথম সেই শেষ দেখা বঙ্গবন্ধুকে।

১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। আমি তখন ঢাকার নারিন্দায় মামার বাসায় থেকে গেন্ডারিয়া হাইস্কুলে পড়ি। মামার বাসায় রেডিও কিংবা টেলিভিশন ছিল না। খুব সকালে বাসা থেকে এক সের চাল কেনার জন্য আমাকে দোকানে পাঠানো হয়েছিল। রাস্তায় বেরুতেই কেমন যেন উত্তাপ-আতঙ্ক অনুভব করলাম। রাস্তায় জটলা। নানা কথা চলছে। নারিন্দা পুলিশ ফাঁড়ির সামনের এক মুদি দোকান থেকে এক সের চাল কেনা শেষে দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম রাস্তায় এত জটলা কেন? দোকানি আমাকে চিনতেন। আর এ জন্যই হয়তো প্রচণ্ড বিদ্রুপের ভঙ্গিতে বললেন, তোমগো বাজান খতম অইছে।' আমি কোনো অর্থ না বুঝলে দোকানি একটু পরিষ্কার বাংলায় আমাকে জানালেন, সপরিবারে 'শেখ মজিবর খুন হওয়ার সংবাদটি। এ খবর পেয়ে আমি ভয়ে আঁতকে উঠলাম। সেই সঙ্গে কেঁদেও ফেললাম। দ্রুত বাসায় ঢুকে সবাইকে খবরটি জানালাম। সেদিন বাসায় সকাল ও দুপুরে রান্না হয়নি। সেই এক সের চাল সিদ্ধ হয়েছিল রাতে। একাত্তরে পিতা হারিয়েছি। সেটি আজও আমার কাছে একটি নিখোঁজ সংবাদ।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট আমি প্রথমবারের মতো পিতার মৃত্যু সংবাদে বিপর্যস্ত হলাম। সেই থেকে বঙ্গবন্ধু মুজিবের একখানা ছবি আমি আগলে রাখি; মুজিব আমার পিতা, আমার দেবতা। পরে খবরের কাগজ থেকেই জেনেছি, দেশে না থাকায় বেঁচে গেছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা আমার দু'টি বোন। তার পরের ইতিহাস সবার জানা। জগদ্দল পাথরের মতো আমাদের বুকের ওপর চেপে বসল স্বৈরশাসক নিষিদ্ধ হলেন মুজিব, মুক্তিযুদ্ধ। জেলখানায় জাতীয় ৪ নেতাকে হত্যার মাধ্যমে দেশে নিশ্চিত করা হলো পাকিস্তানি ভাবধারার অপরাজনীতি।

স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধের চেতনার চাকাটি সচল করতেই একাশিতে বীরের বেশে দেশে ফিরলেন আমার বোন শেখ হাসিনা। আমার মতো করেই দেশের কোটি কোটি মানুষ আবার ফিরে পেল জীবনী শক্তি। শুরু হলো স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন। নব্বইয়ে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে বিজয় অর্জন ও তারই ধারাবাহিকতায় দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র পুনঃপ্রবর্তনে শেখ হাসিনা হলেন কাণ্ডারি। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে দীর্ঘ ২১ বছর পর দেশে প্রকৃত অর্থে মুক্তচিন্তার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যাত্রা শুরু হয়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে কাঁপিয়ে পড়েন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা । শত প্রতিকূলতাও তাকে দমাতে পারেনি।

শেখ হাসিনার সরকারের শেষদিকে ২০০১ সালের ২০ এপ্রিল হত্যার উদ্দেশ্যে আমার ওপর নৃশংস হামলা হয়। আমি তখন দৈনিক জনকণ্ঠের ফরিদপুর প্রতিনিধি। জনকণ্ঠে রাজাকারদের একাত্তরের ইতিবৃত্ত নিয়ে লেখার জের ধরেই আমার ওপর হামলা হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত সহমর্মিতা, তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার ও জনকণ্ঠসহ অসংখ্য সংগঠন-মানুষের আন্তরিক সহযোগিতা-সহমর্মিতায় দেশ-বিদেশের উন্নত চিকিৎসায় আমি আবার ফিরে পেয়েছি আমার সংবাদকর্মীর জীবন। যদিও আমাকে হারাতে হয়েছে একটি পা; খর্ব হয়েছে একটি হাতের স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা। শেখ হাসিনার ব্যক্তিগত আগ্রহ ও পরামর্শে সে বছর আগস্ট-সেপ্টেম্বরে দু'দফায় আমি সিঙ্গাপুরে চিকিৎসা নিয়েছি। সেখানে ডা. কমল বোসের তত্ত্বাবধানে আমার অচল হাতে অস্ত্রোপচার হয়। সে সময়েই গ্রহণ করি একটি কৃত্রিম পা। সিঙ্গাপুরে অপারেশন থিয়েটারে অস্ত্রোপচার শেষে জ্ঞান ফেরার পর ডা. কমল বোস যখন আমাকে জানালেন, তোমার প্রধানমন্ত্রী (অবশ্য তখন তিনি আর প্রধানমন্ত্রী নন) শেখ হাসিনা তোমার খোজ নিয়েছেন, তখন আর আমার আনন্দের শেষ নেই। আমি শুধু আবেগে বলেছিলাম, শেখ হাসিনা কি শুধুই প্রধানমন্ত্রী। তিনি তো আমার বোন।

৮ আগস্ট, ২০০১। সিঙ্গাপুর থেকে ঢাকায় ফিরেই আমি ছুটে গিয়েছিলাম গণভবনে আমার মমতাময়ী বোন শেখ হাসিনাকে দেখতে। সঙ্গে আমার স্ত্রী অনিতা ও পুত্র সুপ্রিয়ও ছিল। সেদিন গণভবনে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি সমাবেশ ছিল। সমাবেশের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান খানিকটা পিছিয়ে দিয়ে তিনি আমাকে, আমার পরিবারকে দীর্ঘ সময় দিয়েছিলেন। সে কী গভীর মমতা। সেই প্রথম আমার শেখ হাসিনা দর্শন, বড় বোন হাসিনার মুখোমুখি হওয়া। নানা আলাপচারিতায় আমি আমার বোনের কাছে অনুযোগ করেছিলাম, বিদেশে আমার হাত ও পায়ের চিকিৎসার জন্য যে টাকা ব্যয় হয়েছে তা যদি আমি ব্যাংকে জমা করে রাখতে পারতাম তা হলে আমার জীবনটি অনেক বেশি সহজ হতো। ব্যাংকের লাভের টাকা দিয়েই আমি আমার পরিবার নিয়ে বেশ ভালভাবেই জীবন কাটাতে পারতাম। সে ক্ষেত্রে হাত- পা না থাকলে কি আসে যায়। আমার একথায় সেদিন। শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত হয়ে যথার্থ বড় বোনের মতোই আমার পিঠে হাত রেখে বলেছিলেন, 'তোর দুষ্টুমিটা যায়নি তাহলে। তোর কত টাকা লাগবে? টাকার দরকার হলে তুই আমার কাছে চলে আসিস। সেদিন আমার ও আমার পরিবারের মনোবল সুদৃঢ় করতে শেখ হাসিনা যে মহান আচরণ করেছিলেন তা আমি ও আমার পরিবার গভীর । কৃতজ্ঞতায় চিরদিন স্মরণ করব।

২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারির বই মেলায় আমার প্রথম বই "বর্ণমালায় বাংলাদেশ' বের হয়। বইটির প্রকাশক আগামী প্রকাশনী। বইটি শেখ হাসিনাকে উৎসর্গ করা। সম্ভবত তারিখটি ছিল ১৭ ফেব্রুয়ারি। আমি তখন জনকণ্ঠের স্টাফ রিপোর্টার হিসেবে ফরিদপুরে কর্মরত। সকালের দিকে খবর পেয়েছি বই মেলায় আমার বই বেরিয়েছে। তখনও বইটি আমি দেখিনি। দুপুরের দিকে আমার ফরিদপুরের বাসার টেলিফোন বেজে উঠল। আমিই রিসিভ করলাম। অপরপ্রান্ত থেকে জানতে চাইলেন, এটি কি প্রবীর সিকদারের নম্বর? আপনি কি প্রবীর সিকদার? আমি 'হ্যাঁ' বলতেই উত্তর এলো আপা কথা বলবেন। তারপর যে কণ্ঠস্বর ভেসে এলো তা আমার বোন শেখ হাসিনার। প্রথমেই আমার, আমার পরিবারের খোঁজ-খবর নিলেন। তার নামে বই উৎসর্গ করার জন্য ধন্যবাদও দিলেন। কথা বললেন আমার স্ত্রীর সঙ্গেও। আমার নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেন। পরামর্শ দিলেন সতর্ক থাকতে। যে কোনো প্রয়োজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথাও বললেন। সেদিন শেখ হাসিনার সঙ্গে টেলিফোন আলাপচারিতা শেষে আমি এবং আমার স্ত্রী প্রচন্ড বিস্ময়-আবেগে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েছিলাম; শেখ হাসিনা নিজে টেলিফোন করে আমাদের খোঁজ নিলেন।

সে বছরেরই ২১ আগস্ট। শেখ হাসিনার ওপর নৃশংস বোমা হামলার ঘটনা ঘটল। আমি তখনও ফরিদপুরে। খবরটি পেয়েই মুষড়ে পড়েছিলাম। শেখ হাসিনা নিরাপদে আছেন, সুস্থ আছেন- এটি জেনেই আমি লন্ডনে ফোন করেছিলাম মাসুদা ভাট্টির কাছে। আমি কান্নায় ভেঙে পড়ে মাসুদা ভাট্টিকে বলেছিলাম, 'শেখ হাসিনা আমাদের শেষ ভরসাস্থল । তাকে হারালে আমরা কোথায় দাঁড়াবো। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ তো তাকেই শেখ করতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ বিনির্মাণে শেখ হাসিনাই কাণ্ডারি। আমরা তাকে হারাতে চাই না, আর বিপন্ন করতে চাই না আমাদের অস্তিত্বকে।'

আমি বিশ্বাস করি, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা যেমন স্বাধীন বাংলাদেশ পেয়েছি, তেমনি আমার বোন শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক গণতান্ত্রিক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পাবেই পাবে। দেশের জনগণই শেখ হাসিনার নিত্য সহচর। কোনো বোমা-বুলেট, মামলা কিংবা ষড়যন্ত্র শেখ হাসিনাকে আর কক্ষচ্যুত করতে পারবে না।

ঢাকা ১২ এপ্রিল, ২০০৭

লেখক : সম্পাদক, বাংলা ৭১ ও উত্তরাধিকার ৭১ নিউজ।

(এই লেখা সম্বলিত একটি বই 'আমার বোন শেখ হাসিনা' প্রকাশ পেয়েছিল ২০০৮ সালের বই মেলায়।)

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test