E Paper Of Daily Bangla 71
Sikdar Dental Care
Walton New
Mobile Version

আমার আমি এবং আকবর স্যার

২০২৩ অক্টোবর ০৫ ১৮:২৮:৫১
আমার আমি এবং আকবর স্যার

বিশ্বজিৎ বসু


একজন মানুষের আমি হয়ে ওঠার পিছনে যেটুকু অবদান তার সবটুকুই এই প্রকৃতি আর পরিবেশের।এই আকাশ, বাতাস, মাটি, জল, বায়ু, গাছ, পাহাড়, নদি, খাল, বিল, পশু, পাখি, মানুষ সবই এক একজন এই আমির শিক্ষাগুরু। এরকম শত শিক্ষাগুরুর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ শিক্ষাই একজন মানুষকে আমি হয়ে উঠতে সাহায্য করে। আর এই উপলব্ধী হতেই হয়তো কবি সুনির্মল বসু লিখেছেন" বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র"। 

এই শত শিক্ষাগুরুদের মধ্যে অব্শ্যই মানুষের অবদান সবচেয়ে বেশী এবং এই মানুষকুলের মধ্যে সবচেয়ে বেশী অবদান শিক্ষকদের। একারণেই শিক্ষকরা সমাজে মানুষ গড়ার কারিগর হিসাবে স্বীকৃত। সেই হাতে খড়ি কিম্বা তার আগের থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ ডিগ্রি পর্যন্ত রয়েছে শিক্ষকদের একটি লম্বা ক্রম। ক্রমের তালিকাভুক্ত সমস্ত শিক্ষকদের সম্মিলিত শ্রমের পরিমাণের একত্রিত করলে বোঝা যায় তাঁদের ভূমিকা কত ব্যাপক এবং অপরিসীম।তখন এই শ্রমের তুলনায় আমার আমিকে মনে হয় খুব ক্ষুদ্র ।

সমাজ মা বাবার পরেই অবস্থান দিয়েছে শিক্ষকের। সমবেত এত শিক্ষকদের মধ্য আবার কেউ কেউ থাকেন একটু বেশী স্মরণীয় হয়ে। আমার এরকম একজন শিক্ষক-আকবর স্যার। আকবর স্যারের নাম আকবর মৃধা বলেই জেনেছি। তিনি আমার প্রথম শিক্ষক না হলেও প্রথম স্মরণীয় শিক্ষক। যাকে মনে পরে প্রতিনিয়ত। আনুভব করি সত্তায়। অন্যের ক্ষতি না করার যে চেতনা, সেটি আমার সত্তায় তিনি সুচারু রূপে রোপন করে দিয়েছিলেন সেই বাল্যকালে। যা অনুভব করি প্রতি পদক্ষেপে। অল্প বয়সে স্যারকে অনুভব করতাম ফসলের মাঠে ক্ষেতের আইল দিয়ে হাঁটার সময় কিম্বা কোন বাগানে গাছে ফোটা গোলাপের দিকে তাকিয়ে। আর এখন অনুভব করি সত্তায়।

আমার প্রথম পাঠ আমার মায়ের কাছে। সরস্বতী পুজোয় আমার হাতে খড়ি দিয়েছিলেন পঞ্চানন চক্রবর্তী। তিনি ছিলেন আমাদের পুরোহিত। আমি তাঁকে দাদু বলে ডাকতাম। আমার প্রথম গৃহশিক্ষক ছিলেন শ্যামল চক্রবর্তি। তাকে ডাকতাম কাকা। দাদুর হাতেখড়ি দেবার কথা মনে নেই কিন্তু শ্যামল কাকার কাছে লাল মলাটের আদর্শ লিপি নিয়ে খেজুরের পাটিতে বসে পড়ার কথা মনে আছ। আমার প্রথম স্কুল আমাদের গ্রামের কৃষ্ণনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়। এখানেই শুরু হয় আমার প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা। আমরা বলতাম ছোট ওয়ান।

বেড়াবিহীন একটি ভাঙাচোড়া ঘরে বসতো আমাদের সেই ছোট ওয়ানের ক্লাস। কে ক্লাস নিতেন কিছুই মনে করতে পারি না। শুধু মনে পরে ছুটির ঠিক আগে স্কুলের পাশে একটি ঝাকড়া আম গাছের গোড়ায় দাঁড়িয়ে সমবেত স্বরে নামতা পড়তাম। একজন ছাত্র গাছের শিকড়ের উপর দাড়িয়ে পড়াত এক অক্কে এক, দুই অক্কে দুই। আমরা নিচে দাঁড়িয়ে সমবেতভাবে সুরে সুরে পড়তাম এক অক্কে এক, দুই অক্কে দুই। তারপর আমাদের ছুটি হয়ে যেত।

এর পরের বছর চলে যাই মামা বাড়ী। ভর্তি হই বালিয়াকান্দি থানার জামালপুর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে।বাড়ী থেকে মামা বাড়ীতে আসার প্রধান উদ্যোগতা ছিলেন মামা।

মামা তখন হাই স্কুলের ছাত্র। মাসি এ স্কুলের ক্লাস ফাইভের ছাত্র। মাসি আমাকে নিয়ে স্কুলে ভর্তি করে দিল। ভর্তি ফি ছিল এক টাকা। পাকা ভবনের অফিস রুমে টাকা জমা দিয়ে চলে গেলাম ক্লাসে।সেখানে জায়গা পেলাম প্রথম বেঞ্চে।

টিনের ঘরে মাটির মেঝে। গিজ গিজ করছে ছাত্র। দ্বিতীয় দিন স্কুলে গিয়ে দেখি যেখানে গতকাল বসেছিলাম সেখানে অন্য একজন বই রেখে দিয়েছে। আমার জায়গাতে অন্যের বই! আমার সহ্য হলো না। আমি তার বই সরিয়ে রেখে সেখানে আমার বই রেখে বসে পরলাম। কিছুক্ষণ পর সেই ছাত্র এসে হুঙ্কার, আমার বই সরাইছিস ক্যা। শুরু হলো জায়গা দখলের ধাক্কাধাক্কী। বই রেখে মাসিকে ডেকে আনলাম। কিন্তু মাসির বিচারে আমি হেরে গেলাম। যে আগে এসেছে এ জায়গা তার।

ক‘দিন জামালপুর স্কুলে পড়েছিলাম মনে করতে পারি না। এরপর আমাকে পাঠানো হলো নবগঠিত নওপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। দিনটিতে শুরু হলো স্কুলে আনুষ্ঠানিক যাত্রা। লাউজানা গ্রামে হালটের তেমাথায় পাশাপশি কয়েকটি বাড়ির কাছারি ঘর, বারান্দা আর পাড়ার মসজিদের বারান্দায় শুরু হলো স্কুল। মসজিদের সামনে খোলা জায়গায় জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে শুরু হয়েছিল স্কুলের কার্যক্রম। আমরা লাইনে দাঁডিয়ে পতাকাকে স্যালুট জানিয়েছিলাম। প্রথম গান গেয়েছিলাম জাতীয় সংগীত -আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি।

আমাদের ক্লাস বসলো একটি ছনের ঘরের বারান্দায়। চার পাঁচজন ছাত্র। এদের একজনের নাম ছিল দুলি। মনে পরে লাল রংয়ের একটি জামা পরে ঘরের দরজা দিয়ে বের হয়ে এসে আমাদের সাথে খেজুরের পাটিতে বসে পড়া শুরু করেছিল। পরে জেনেছিলাম ওটা ছিল দুলিদের মামাবাড়ী। কয়েকদিন পর দেখি সেই ছেলেটি যার সংগে জামালপুর স্কুলে ফার্স্ট বেঞ্চে বসা নিয়ে মারামারি করেছিলাম। সে আমার দিকে বড় বড় চোখ করে বলেছিল -তুই এখানে। এদিন জানলাম ওর নাম জয়নাল। পরবর্তীতে জয়নাল আমার প্রিয় বন্ধু হয়ে উঠেছিল।

এ স্কুলের শিক্ষক ছিলেন আকবর স্যার। গায়ের রং কালো মিচমিচে। কালো মুখে সাদা দাঁতগুলো ছিল মুক্তার মত। কন্ঠ ছিল ভড়াট। আর চোখ দুটো ছিল দাঁতের চেয়েও উজ্বল। স্কুলের প্রধান শিক্ষক ছিলেন একজন নারী। তিনি স্কুলে আসতেন মাঝে মাঝে। আকবর স্যারই প্রধান শিক্ষকের দায়ীত্ব পালন করতেন। জয়নাল আকবর স্যারের ছোট ভাই।

এর ভিতরে এলো ২৬শে মার্চ। স্বাধীনতা দিবস। লাউজানা সেই মসজিদের সামনে থেকে শুরু হলো স্বাধীনতা দিবসের র্যাচলি। আকবর স্যার আমার হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দিয়েছিলেন।

মামা বাড়িতে থাকালীন সময়ে আমি একটু এক্সট্রা ভালবাসা পেতাম। এর পিছনে কারণ ছিল আমার প্রয়াত দাদু। আমার মায়ের বাবা-শান্তিু ঘোষ।দাদু আমৃত্যু ছিলেন গাজনা ইউনিয়নের মেম্বার। একবার তিনি তৎকালীন চেয়ারম্যানের সংগে কোন কারণে মতবিরোধ হওয়ায় চেয়ারম্যানকে চ্যালেঞ্জ দিয়েছিলেন "আমি চেয়ারম্যান নির্বাচন করলে তুমি জিততে পারবে না" পরের নির্বাচনে চ্যালেঞ্জ দিয়ে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন। বিজয়ের পর তিনি সিও অফিসে গিয়ে পদত্যাগ পত্র জমা দেন। বলেন আমি আজিমদ্দিকে দেখাতে চেয়েছিলাম আমি চেয়ারম্যান হতে চাইলে হতে পারি কিন্তু আমি চেয়ারম্যানি করতে চাই না। মেম্বারেই সন্তুষ্ট। কিন্তু আইন অনুযায়ী নূন্যতম তিন মাস দায়ীত্ব পালন করে পদত্যাগ করেন। আজিমদ্দী সাহেবকে আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেন। চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে এভাবে পদত্যাগ করার ঘটনা খুবই বিরল। কিন্তু দুঃখজনক সত্য হলো এর কয়েক বছর পর সেই আজিমদ্দী গংদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে দাদু খুন হয়ে যান। আমার হাতে জাতীয় পতাকা তুলে দেয়ার পিছনে দাদুর প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা কাজ করেছিল বলে মনে হয়েছিল।

স্যার যখন পতাকাটা আমার হাতে পতাকা তুলে দিয়েছিলেন সে মূহুর্তের আনন্দ আর গর্বের অনুভূতিটুকু এখনও চোখ বুজে অনুভব করি। লম্বা একিট তল্লা বাঁশের মাথায় বড় একটা পতাকা বহন করতে আমার একটু কষ্টই হচ্ছিল। কিছুদুর যাবার পর স্যার আমার হাত থেকে পতাকা নিয়ে তুলে দিলেন আরেক ছাত্রের কাছে।

কিছুদিন পর স্কুলের জায়গা নির্ধারিত হলো। যাওয়া আসার পথে সেই জায়গাটি বড় আপন মনে হতো। স্কুল থেকে কিছুদুরে একটি বাড়ি থেকে পুরানো টিনের ঘর কিনে বানানো হলো স্কুল ঘর। যেদিন সে ঘরখানা ভাঙা হয় সেদিন দেখতে গিয়েছিলাম। ঐ বাড়ির তিনজন তখন স্কুলের ছাত্র। তিনজন সহোদর ভাই বোন। দুজনের নাম মনে পরে, লিলি আর বাবুল। বাবুল ছিল এ স্কুলে আমাদের সহপাঠি।

স্কুল ঘর তৈরির পর মুল ক্যাম্পসে শুরু হলো ক্লাস। নতুন নতুন ছাত্র আসা শুরু হলো। সালেহা, জয়নাল, মঈন, বাশার, দুলি, পল্টু, জোবেদা, চায়না, শেফালী, মতি, লিয়াকত। লিয়াকত ছিল বয়সে অনেক বড়। উচু লম্বা এবং স্বাস্থ্যবান। ওর বড় ভাই ছিল ভ্যুটে। সে আরও বড়, ক্লাস ফাইভে পড়তো। কিন্তু পরিপূর্ণ যুবক।

নতুন স্কুলে যাওয়া যেন অন্য এক আনন্দ। মঈন, চায়না, শেফালি, আমি এক এলাকায় হওয়াতে একসংগে দল বেঁধে হেটে স্কুলে যেতাম।দল বেধে হৈহৈ করে খেতের আইল ধরে, হালটে পথে রেল ক্রিসং পার হয়ে যেতাম স্কুলে।

স্কুলে প্রধান শিক্ষিকা আর আকবর স্যার ছাড়া আরও দুজন শিক্ষক ছিলেন স্কুলে। এর একজন ছিল আমাদের সহপাঠী সালেহার দুলাভাই। আরেকজন আকবর স্যারের চাচাত ভাই। তাঁদের নাম মনে নেই। স্বেচ্ছাসেবক শিক্ষক হিসাবে মাঝে মাঝে ক্লাস নিতেন মোতালেব নামে একজন। মামা বাড়ীর সাথে পারিবারিক সম্পর্ক থাকায় তাকে মামা বলে ডাকতাম। আকবর স্যারের যে ভাই শিক্ষক ছিলেন কথায় কথায় বেত দিয়ে ছাত্রদের পেটাতেন। তারপর বলতেন তোদের কেন পিটায় জানিস! আমি যখন ছাত্র ছিলাম তখন স্যারের হাতে প্রচুর মার খেতাম, তখন প্রতিজ্ঞা করেছিলাম আমি কোনদিন টিচার হলে ছাত্রদের পেটাব। তাই তোদের পেটায়।আকবর স্যার কখনও বেত নিয়ে ক্লাসে ঢুকতেন না। শাসনের জন্য মোটা গলা আর চোখের চাহনিই ছিল যতেষ্ট।

ক্লাস ওয়ান থেকে টুতে যখন উঠলাম, আমার রোল হলো তিন। প্রথম সালেহা, দ্বিতীয় জয়নাল, তৃতীয় আমি। আমি প্রাইভেট পড়া শুরু করলাম আকবর স্যারের কাছে। পড়তে যেতাম স্যারের বাড়ি ডাঙ্গাতি মোহন গ্রামে। স্যার যে ঘরে পড়াতেন সে ঘরে আরো ছাত্রদের দুখানা পাশাপাশি খাটের উপর বসতাম। স্যার বসতেন একটি চেয়ারে। পাশে ছিল একটি টেবিল। ঘরের পাশে ছিল বেশ কয়েকটি গোলাপ গাছ। জানালা দিয়ে গোলাপ গাছ দেখ যেত। বলা যায় এটা ছিল আমার প্রথম দেখা বাগানে ফোটা গোলাপ। তখন থেকেই স্বপ্ন দেখতাম একদিন বাগানে গোলাপ গাছ লাগাব।

আমাদের স্কুলে যাওয়া আসার পথে পরতো ফসলি জমি। আষাঢ় মাসে সেখানে আউশ ধানের চাষ হতো। তার মাঝে সাথী ফসল হিসাবে ছিল কাউন। কাউনের ছড়াগুলো দেখতে ঠিক কাঠ বিড়ালীর লেজের মত। মজার ব্যাপার হলো একটি কাউনের ছড়ার সংগে আরেকটা কাউনের ছড়া রাখলে পরস্পর পরস্পর দুটিকে চৌম্বকীয় এক আকর্ষণে জড়িয়ে ধরে ।টেনে তাকে আলাদা করতে হয়।

একদিন আমি আর মঈন দুজনে সেই ক্ষেতের পাশ দিয়ে স্কুলে যাবার সময় কয়েকটি করে কাউনের ছড়া ছিড়ে একটার সাথে আরেকটা লাগিয়ে তোড়ার মত বানালাম। তারপর দুজনে দুটি তোড়া নিয়ে উপস্থিত হলাম ক্লাসে। ভেবেছিলাম স্যার আমাদের ফুলের তোড়া দেখে খুশি হবেন। কিন্তু ঘটনা হলো উল্টো। আকবর স্যার ক্লাসে এলেন। তাঁর চোখে পড়ল কাউনের তোড়া। মুহুর্তের মধ্যে স্যারে চোখ লাল হয়ে গলে। কাউকে পাঠলেন বেত আনতে অফিস রুমে। তারপর জেরা, ওটা কার ক্ষেত থেকে এনেছ। বললাম ইসাব মামাদের ক্ষেত থেকে। কেন তুলেছ? কোন উত্তর দিতে পারলাম না। বুঝলাম অন্যায় করে ফেলেছি।

স্যার আমাদের দুজনকে হাই বেঞ্চের উপর উঠতে বললেন। তারপর বললেন নিল ডাউন করো। ফ্লোর ছিল মাটির। সেখান থেকে তুলে আনলেন ছোট চারটি টুকরো ইট। দুটি আমার দুই হাটুর নিচে, দুটি মঈনের হাটুর নিচে।কষ্টে আমাদের চোখে জল বেরিয়ে এলো। ইতিমধ্যে বেত চলে এসেছে।বেত হাতে নিয়ে বললেন হাত পাত। ডান হাত এগিয়ে দিলাম। একটি হাতে একটি বেতের বাড়ি, বাম হাত এগিয়ে দিলাম। আরেকটি বাড়ি। দুজনের হাতে বেতের বাড়ি দিয়ে বললেন নামো। আর কোনদিন কারও জমি থেকে ফসল ছিড়বে না। এরপর থেকে এখনও কোন ক্ষেতের পাশ দিয়ে যায় সেদিনের কথা মনে পড়ে। মনে পরে আকবর স্যারকে।

একটি রাজনৈতিক পট পরিবর্তন তূণমুল পর্যায়েও তার ব্যাপক প্রভাব পড়ে । ১৯৭৫ সালের পরও সেটা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর দাদুর খুনি গংদের আস্ফালন আবার শুরু হয়। আমার মামা দেশ ত্যাগ করে চলে যায় ভারতে। আমি নওপাড়া স্কুলের পড়াশুনার পাঠ চুকিয়ে চলে আসি বাড়িতে। ভর্তি হই কৃষ্ণনগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। এদিকে নবগঠিত প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোর সরকারীকরণ বন্ধ হয়ে যায়। শিক্ষকরা বিভিন্ন চাকুরি নিয়ে চলে যান। কিছুদিন পর বন্ধ হয়ে যায় নওপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়। যার বাড়ীর ঘর ভেঙে এনে স্কুলঘর তৈরি হয়েছিল শুনেছিলাম সে এখানে বাড়ী করেছে।

কলেজে ভর্তি হবার পর আকবর স্যারকে হৃদয়ে অনুভব করতে লাগলাম। খোঁজ নিয়ে জানলাম স্যার রেলে চাকরি নিয়েছেন। শুনেছিলাম স্যারের বাবা ছিলেন রেলের কর্মচারি, পোষ্য কোটায় স্যারের চাকরি হয়েছে রেলে। তখন স্যারেকে কল্পনা করতাম একজন স্টেশন মাস্টার হিসাবে। স্বপ্ন দেখা শুরু করলাম কোন এক স্টেশনে হয়তো স্যারের সংগে দেখা হবে। স্যার আমার কুশলাদি জিজ্ঞাসা করবেন। আমার পড়াশুনার খোঁজ খবর নিবেন। আমার অবস্থান জেনে খুশি হবেন। অনেকদির পর জানতে পেরেছিলাম স্যার রেলের খালাসী পদে চাকরি করেন। খবরটা শোনার পর এক ধরণের কষ্টে বুকটা ভাড়ী হয়ে উঠেছিল।

ছুটিতে যখন মামা বাড়ি যেতাম খুব ইচ্ছা করতো স্যারের সংগে একবার দেখা করার। কিন্তু তাকে পেতাম না। কালুখালি ভাটিয়াপাড়া লাইন বন্ধ থাকার কারণে স্যারের পোস্টিং ছিল দুরে কোথা্য। নব্বই দশকের শেষের দিকে বা ২০০১ বা দুই সালের দিকে জানতে পারলাম স্যার বাড়িতে। জামালপুর বাজারে একটি চায়ের দোকানে বসেন। বন্ধু কাশেম বললো চল স্যারের সাথে দেখা করবি। কাশেম ছিল আমার এক ক্লাস নিচে, কিন্তু আমাদের ছিল চরম বন্ধুত্ব। কাশেম সাথে করে নিয়ে গেল সেই চায়ের দোকানে। দেখিয়ে দিল আকবর স্যারকে।

স্যারের দিকে তাকিয়ে মনে হলো আমার দেখা স্যারের চোখে মুখের সেই জ্যোতি হারিয়ে গেছে। পরিশ্রমী এক শ্রমিক যার মুখের হাড়গুলো স্পষ্ট। গায়ের কালো রংয়ের উপর আরো কয়েক পর্ত কালো রঙের প্রলেপ পড়েছে। যেন সত্যজিৎ রায়ের হীরক রাজার দেশে সিনেমার হীরক খনির কোন শ্রমিক শ্রমিক জীবন্ত বসে আছে আমার সামনে।

স্যারকে দেখে একটা সালাম দিলাম। -আদাব স্যার! কেমন আছেন।

স্বভাবতই স্যার আমাকে চিনতে পারলেন না। স্যার নামে তাকে কেউ সম্বোধন করবে এটা হয়তো তার কল্পনাতেও ছিল না। যারা বসে ছিল তাদের কেউ একটু জায়গা তৈরি করে আমাকে বসতে বললো। আমি বিনয়ের সাথে বললাম ঠিক আছে। স্যার আমাকে প্রশ্ন করলেন – কে আপনি। আপনাকেতো চিনলাম না।

স্যার যখন আমাকে আপনি বলে সম্বোধন করলেন আমি ভীষণ অস্বস্তি অনুভব করেছিলাম। স্যারকে বললাম, আমাকে আপনি বলবেন না। আমি আপনার ছাত্র ছিলাম। নওপাড়া প্রাইমারি স্কুলে। জয়নাল আর আমি একসাথে পড়তাম।

স্যার আর একটি কথাও বললেল না। জানিনা কোন দুঃখ কষ্ট স্যারের বুকে হু হু করে উঠেছিল কিনা। নাকি তিনি আমার বুকের ভীতরের আবেগটা বুঝতে পারলেন না। তিনি উঠে গেলেন। কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেলেন। আমার সাথে কোন কথাও বললেন না।

কেউ কেউ বললেন চা খেতে। অপ্রস্তুত আমি চা খেতে পারলাম না। বেরিয়ে এলাম সেখান থেকে। স্যারকে বলতে পারলাম না আপনার সেই শিক্ষা আমার পথ চলার পাথেয় হয়ে আছে।

কিছুদিন বন্ধ থাকার পর স্কুলটি আবার চালু হয়। ২০০৭ সালে মামা বাড়ী বেড়াতে গেছি। গিয়ে শুনি আজ স্কুলের স্পোটর্স চলছে। এ স্কুলে প্রথম জাতীয় পতাকা হাতে নিয়েছি। এই স্কুলে প্রথম স্পোর্ট্সডে তে খেলাধুলায় অংশগ্রহণ করেছি।এই স্কুলে প্রথম কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করছি।খুব যেতে ইচ্ছা করলো। সস্ত্রীক গিয়েছিলাম স্কুলে। সব কিছুই, নতুন জায়গা, নতুন ঘর, নতুন শিক্ষক।গিয়ে দেখি মোতালেব মামা। খেলাধুলা পরিচালনা করছেন। তিনি তখন এই স্কুল কমিটির পরিচালনা কমিটির সদস্য।

ক‘বছর পর ২০১১ সালের দিকে দেশে গিয়ে মধুখালি থেকে ভ্যান রিকসায় উঠেছি। ছিপছিপে গড়ন, মুখে চাপদাড়ী, পঞ্চাশোর্ধ ভ্যান চালককের চোখেমুখে একটি ব্যক্তিত্বের ছাপ। আলাপচাড়িতার এক পর্য়ায়ে জানতে চাইলাম -আপনার বাড়ী কোন গ্রামে। তিনি জানালেন জামালপুর বলের ফিল্ডের পিছনে। আমি বললাম, ডাঙ্গাতমোন। তিনি আমার ভুল সংশোধন করে দিয়ে বললেন নামটা ডাঙাতি মোহন। ভুল নাম বলাকে তিনি মেনে নিতে পারেন নাই। আমি বললাম ডাঙ্গাতমোন আমার এক স্যার ছিল, নাম আকবর মৃধা। তার ভাই জয়নাল ছিল আমার সহপাঠী। তিনি আবারও সংশোধন করে বললেন-ডাঙ্গাতি মোহন। আমি যখন সঠিক ভাবে উচ্চারণ করে বললাম হ্যাঁ-ডাঙাতি মোহন, তখন তিনি জানালেন আকবর মৃধা মারা গেছেন।

স্যারের সংগে আর কোনদিন দেখা হবে না। ভ্যান চালকের দেয়া স্যারের মৃত্যুর খবর মিথ্যা হলেও আর কোনদিন দেখা হবে কিনা জানিনা। স্যার কোনদিন জানানো না আমার আমি হয়ে ওঠার পিছনে তাঁর অবদান কত বড়।

লেখক : অস্ট্রেলিয়া প্রবাসী।

পাঠকের মতামত:

২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test