E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

পান্নুর হুঁশিয়ারি ও আমেরিকার দ্বিচারিতা

২০২৩ অক্টোবর ০৬ ১৬:৩২:৪৯
পান্নুর হুঁশিয়ারি ও আমেরিকার দ্বিচারিতা

গোপাল নাথ বাবুল


ভারতের প্রতি খালিস্তানি নেতা গুরপত্তবন্ত সিং পান্নুনের হুঁশিয়ারি-‘আমরা শহীদ নিজ্জর হত্যার বদলা নেব। ৫ অক্টোবর থেকে গুজরাটের আমেদাবাদে নরেন্দ্র মোদী স্টেডিয়ামে ক্রিকেট বিশ্বকাপে এ বদলা নেওয়া হবে। ৫ অক্টোবর বিশ্বকাপ শুরু হবে না, শুরু হবে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ কাপ।’ এ কথা বলার পরে হয়তো তার হুঁশ হয়েছে যে, তিনি আবেগে বড় ভুল শব্দগুলো উচ্চারণ করে ফেলেছেন। এরপরে তিনি আবার তার বক্তব্য সংশোধন করে বলেন, ‘শহীদ নিজ্জরের হত্যার বদলা আমরা নেব। তোমাদের বুলেটের জবাব দেবে আমাদের ব্যালট।’ 

পান্নুন পাঞ্জাবে রাষ্ট্রদ্রোহের ৩টি মামলাসহ ১৬টি ফৌজদারি মামলার আসামি। এ পান্নুনই সম্প্রতি ইন্দো-কানাডিয়ান হিন্দুদের কানাডা ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ার হুমকি দিয়েছিলেন। বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের মধ্যে। পান্নুনের এ হুঁশিয়ারির পরে গুজরাটের নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও বহুগুণ বাড়ানো হয়েছে। তিনি আরও বলেন, ভারত কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকে অপমান করেছে। এসএফজে এর বদলা নেবে। ভারতকে ফল ভোগ করতে হবে। খালিস্তানি একটা অনুষ্ঠানে এক ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ভারতের পতাকাকে ফুটবল বানিয়ে খেলা হচ্ছে এবং ‘খালিস্তান খালিস্তান, জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ’ শ্লোগান দেওয়া হচ্ছে। অথচ এ মানুষগুলো ভারতেই জন্ম নিয়েছে, ভারতের আলো-বাতাসে বড় হয়েছে।

অবাক হওয়ার বিষয় যে, কানাডা প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে ছড়িয়ে দেওয়া এমন উগ্রতাবাদ ও উস্কানি মূলক বক্তব্যের জন্য এ হুমকিদাতাদের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত কানাডা সরকার কোনও প্রকার প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়নি এবং এমন নিন্দনীয় ঘটনার নিন্দাও জানায়নি। এমনকি, এসব চিহ্নিত বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে এমন প্রমাণ দেওয়া সত্ত্বেও ট্রুডো সরকার তাদের একজনকেও প্রত্যপর্ণ করেননি। ভারতের বিরুদ্ধে মুভমেন্টগুলোর বিরুদ্ধে যখন ভারত সরকার কানাডা সরকারকে বারবার অভিযোগ করছিল তখন জাস্টিন ট্রুডো এটাকে ‘ফ্রিডম অব স্পীচ’ এর দোহাই দিয়ে এড়িয়ে যেতেন।

ইন্দিরা গান্ধীকে ২ জন শিখ বডিগার্ড গুলি করে হত্যা করেছিল। একটা ভাইরাল হওয়া ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, ৩রা জুন তা সেলিব্রেট করছে ২ জন খালিস্তানি ইন্দিরা গান্ধীর ছবিতে গুলি করে। প্রশ্ন জাগে, ট্রুডোর ভাষায় এটা কোন ধরণের ‘ফ্রিডম অফ স্পীচ’ হয় কিংবা এ ধরনের অসভ্যতা কোন ধরনের মানবাধিকার, তা মাথায় ঢুকে না। যে ইন্দিরা গান্ধী বারবার ওয়ার্নিং পাওয়া সত্ত্বেও তাঁর সন্তানতুল্য ২ জন শিখ দেহরক্ষীকে ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ব্যবস্থা থেকে সরাননি যাতে তাদের মনোবল ভেঙ্গে না যায় এবং এরা যেন নিজেদের অসহায় মনে না করেন, সে ইন্দিরা গান্ধীকে নিয়ে এরকম জঘন্য সেলিব্রেট কিভাবে জাস্টিন ট্রুডো সমর্থন করে ?

কথায় আছে, যে অন্যকে সম্মান দিতে জানে না সে নিজেও সম্মান পাওয়ার যোগ্য নয়। এ বেসিক জ্ঞানটা যার নেই কিংবা এমন নষ্ট মনমানসিকতার অধিকারী জাস্টিন ট্রুডো আবার গলা ফাটিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ আনে ! অথচ ভারত থেকে বারবার অনুরোধ করা সত্ত্বেও ট্রুডো খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেয়নি বা নিচ্ছেন না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা-ট্রুডোর ক্ষমতা নেই যে, খালিস্তানিদের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়ার। কারণ, দেশ চালাচ্ছেন জাস্টিন ট্রুডো কিন্তু ক্ষমতার স্টিয়ারিং ধরে আছেন ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিভ পার্টি’র জাগমিত সিং। মূলত বর্তমানে শিখ সম্প্রদায়ের খালিস্তান আন্দোলনকে ঘিরে ভারত-কানাডার সম্পর্ক অগ্নিগর্ভ হয়ে ওঠেছে। দেখার বিষয়, আগামী ২৫ এর নির্বাচনে খালিস্তানি সন্ত্রাসীদের হাতের পুতুল ট্রুডোকে কানাডাবাসী নির্বাচিত করবেন না কি ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করবেন। তবে বিভিন্ন জরিপে ওঠে আসছে, ট্রুডো কানাডার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পুনরায় নির্বাচিত হওয়ার আশা খুবই ক্ষীন।

আসল ব্যাপার হলো, উত্তর আমেরিকা-ইউরোপের দেশগুলো এশিয়া-আফ্রিকার দেশগুলোকে দেশ বলে মনে করে না এবং এসব দেশের মানুষগুলোকে মানুষ বলেও মনে করে না। একটা অহংবোধ এসব দেশের নেতাদের মধ্যে কাজ করে। বিশ্বকাপ ক্রিকেট একটি ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্ট। এ ইভেন্টকে নিয়ে যদি আজ ভারত কিংবা অন্য কোনও দেশ এমন উগ্র বক্তব্য রাখত যে, ‘বিশ্বকাপ শুরু হবে না, শুরু হবে বিশ্ব সন্ত্রাসবাদ কাপ’, তাহলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ তার ইউরোপীয়ান মিত্ররা এতক্ষণে সারা দুনিয়ায় হৈ চৈ ফেলে দিত। অনেকে আবার এক কাঠি বাড়িয়ে ‘ক্রিকেট বিশ্বকাপকে সন্ত্রাসবাদ কাপ’ বলা দেশটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য ওঠেপড়ে লাগত। আমরা ভুলিনি, কিভাবে মার্কিনিরা তাদের ইউরোপীয়ান মিত্রদের নিয়ে ভূয়া অভিযোগ তুলে ইরাক, লিবিয়া ধ্বংস করে তাদের অধীনস্তদের ক্ষমতায় বসিয়েছে। রাশিয়া না থাকলে এতদিনে সিরিয়াও ইরাক, লিবিয়ার কাতারে চলে যেত।

এদের নিজের দেশের খবর নেই, অথচ এরা পরের দেশের নিন্দা করে দিন গুজরান করেন। যেমন-মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন কোনও দিন নেই, সন্ত্রাসের কারণে দৈনিক মানুষ মরছে না। স্কুলে ঢুকে ব্রাশ ফায়ার করে ছোট ছোট শিশুদের হত্যা করে বুক ফুলিয়ে চলে যায় সন্ত্রাসীরা, দেশটিতে এমন কোনও দিন নেই যেদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন হচ্ছে না। অথচ সে দেশের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে পড়ে আছেন। তিনি বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে দৈনিক উদ্বেগ প্রকাশ করতে একদম ভুল করেন না। তিনি আওয়ামীলীগের পরিবর্তে তাদের আজ্ঞাবাহী কোনও দলকে বাংলাদেশের ক্ষমতায় বসাতে ওঠে পড়ে লেগেছেন।

এর প্রতিবাদে গতকাল শুক্রবার রাজধানী ঢাকায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭৭তম জন্মদিন উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কর্তৃক আয়োজিত এক আলোচনা সভায় আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যোগ্য জবাব দিয়েছেন জো বাইডেনকে। তিনি বলেন, “আগে ডোনাল্ট ট্রাম্পকে সামলান তারপর বাংলাদেশের সঙ্গে লড়তে আসবেন। তিনি আরও বলেন, ‘নিষেধাজ্ঞা ও ভিসানীতি দিয়েও লাভ নেই। কোনও ছাড় দেয়া হবে না। আমাদের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। একাত্তরে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলেন। ভয় করলে দেশ স্বাধীন হত না। আজকেও নিষেধাজ্ঞাকে ভয় করলে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখতে পারব না। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নির্বাচন হবে।” তিনি আরও বলেন, “আমার নির্বাচন আমি করব আপনি বলার কে ? ট্রাম্পকে সামলাতে পারেন না আবার বাংলাদেশকে ধমক দেন ! এমন কোনও দিন নেই যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়না। তাহলে আমাদের ভয় দেখান কেন ? আবার দালাল লাগিয়েছেন মির্জা ফখরুলকে।”

এ আমেরিকাকে অনেক আগেই চিনেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। তিনি স্বাধীনতার পর এক সভায় বলেছিলেন, “আমি দুনিয়ার বৃটিশ, ফ্রান্স, জার্মানী এমন কি সাংবাদিক এবং তাদের নেতাদেরও ধন্যবাদ জানাই। কিন্তু আমেরিকার সরকারকে আমি ধন্যবাদ দিতে পারিনা। এরা জানে, এদেও কাছে খবর ছিল, বাংলাদেশে কি করে মানুষকে মারা হচ্ছে। গ্রামকে গ্রাম পুড়ে ছারখার করছে। সেই মুহূর্তে আমেরিকার নিক্সন সরকার অস্ত্র দিয়েছে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীকে আমার মা-বোনকে হত্যা করার জন্য। কিন্তু আমেরিকার জনসাধারণের জন্য আমার শুভেচ্ছা বাণী পৌঁছে দিতে চাই, আমেরিকার সাংবাদিকদের কাছে আমার শুভেচ্ছা বাণী পৌঁছে দিতে চাই। কেনেডির কাছে আমার শুভেচ্ছা বাণী পৌঁছে দিতে চাই। সিনেটের কাছে আমি পৌঁছে দিতে চাই শুভেচ্ছা বার্তা। কিন্তু নিক্সন সরকারকে আমি কোনও শুভেচ্ছা জানাতে পারিনা।”

বাপকা বেটি। আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “স্যাংশন ও আন্দোলনের ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। উজান ঠেলেই নৌকা এগিয়ে যাবে।”

বামপন্থীরা বলেন, আমেরিকা যার বন্ধু তার আর শত্রুর প্রয়োজন হয় না। আমরা জানি, ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের মার খেয়ে আমেরিকার পক্ষে যুদ্ধ করা ভিয়েতনামীদের কিভাবে বিপদে ফেলে আমেরিকা পালিয়েছিল। আমরা জানি, আফগানিস্থানের সাধারণ জনগণকে তালিবানদের তোপের মুখে ফেলে কিভাবে আফগানিস্থান থেকে পালিয়েছিল। যতক্ষণ স্বার্থ আছে ততক্ষণ এ দেশটি বন্ধু থাকে। স্বার্থ ফুরালে দেশটি নগদে শত্রু হতে এক সেকেন্ডও সময় নেয় না। দ্বিচারিতায় ভরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নেতারা। খালিস্তানি নেতা হারদীপ সিং নিজ্জর হত্যায় তারা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। কোনও প্রমাণ ছাড়া কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো কর্তৃক অভিযোগ তোলা ভারতকে অনুরোধ জানায় তদন্তে সহযোগীতা করার জন্য, অথচ বালুচিস্তান স্টুডেন্ট অর্গানাইজেশনকে নেতৃত্ব দেওয়া নেত্রী কারিনা বালুচ পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর হাতে খুন হন এবং পাকিস্তানের আইএসআইকে ও খালিস্তানপন্থীদের খুশি করতে ক্ষমতার অপব্যবহার করে জাস্টিন ট্রুডো কারিনা বালুচ হত্যার তদন্ত বন্ধ করে দেন। তখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা নেতারা মুখে কুলুপ এঁটে বসেছিলেন। এ বিষয়ে তারা পাকিস্তানকে তদন্তে সহযোগীতা করার অনুরোধও জানায়নি।

সুতরাং যতদিন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপের সাঙ্গ-পাঙ্গরা দ্বিচারিতা বন্ধ করবে না এবং অন্য দেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা বন্ধ করবে না, ততদিন সারাবিশ্বে অরাজকতা চলতে থাকবে। তাই জাতিপুঞ্জের মত জাতিসংঘও ব্যর্থ হচ্ছে বারবার। কারণ, জাতিসংঘ, বিশ্ব মানবাধিকার সংস্থা সহ আরবলীগের মত সংস্থাগুলো আমেরিকার চামচায় পরিণত হয়েছে। আমেরিকার অঙ্গুলি হেলনে তারা অন্য দেশের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তবে আমাদের একেবারে নিরাশ হওয়ার কোনও কারণ নেই। এশিয়া-আফ্রিকার অনেক দেশ এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপের দেশগুলোর বিরুদ্ধে দেরিতে হলেও রুখে দাঁড়াচ্ছে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৭ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test