E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দুর্গাপূজা মানে প্রকৃতিরই পূজা

২০২৩ অক্টোবর ১০ ১৬:১৪:১৯
দুর্গাপূজা মানে প্রকৃতিরই পূজা

গোপাল নাথ বাবুল


বর্ষার পরে আকাশে সাদা মেঘের ভেলা ভাসিয়ে আসে ঋতুর রানী শরৎ। শরতের স্নিগ্ধ কোমল সৌরভ প্রকৃতিকে অপরূপ সাজে সাজিয়ে তোলে। মোহনীয় ঋতু শরৎ মানে হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় শারদীয় দুর্গোৎসব। আর দুর্গাপূজার নাম শুনলেই আপামর বাঙালি সনাতনী জাতি কেমন নষ্টালজিক হয়ে পড়ে। এ উৎসব যে বাঙালি সনাতনীদের প্রাণের ও হৃদয়ের উৎসব, তা তো আমাদের সবার জানা। দুর্গাপূজার সময় মন্ডপে মন্ডপে গিয়ে রাত জেগে দুর্গাঠাকুর দেখা, নতুন জামা-কাপড় পড়ে মন্ডপে বসে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, মহাষ্টমীতে মায়ের অঞ্জলি দেওয়া, মায়ের ভোগ প্রসাদ খাওয়া, এ সবের কোনো বিকল্প হয় না বাঙালির জীবনে। স্বভাবতঃ তাই দুর্গাপূজা আসছে ভেবেই মন যেন পবিত্র হয়ে উঠে। কেননা, দুর্গাপূজার মন্ত্রগুলো সাধারণত শ্রী শ্রী চন্ডী থেকে পাঠ করা হয়। ঢাক-ঢোল, খোল-করতাল, সুগন্ধী আগর বাতি এবং ধূপ নিয়ে নয়নাভিরাম আরতি নৃত্য তার সাথে সংস্কৃত মন্ত্রগুলো এক পবিত্র পরিবেশের জন্ম দেয়।

দুর্গাপূজা হলো শক্তির অধিষ্ঠাত্রী পার্বতী দেবীর দুর্গারূপের উপসনার উৎসব। এ পূজা বছরে দু’বার হয়ে থাকে। বসন্ত ঋতুতে (চৈত্র মাসে) বাসন্তী পূজা এবং শরৎ ঋতুতে (আশ্বিন মাসে) শারদীয় দুর্গাপূজা, দু’পূজাই শুক্লপক্ষে অনুষ্ঠিত হয়।

পুরাণ মতে, শ্রী শ্রী দুর্গার আশীর্বাদ থাকায় লঙ্কার রাজা রাবণকে কিছুতেই বধ করা যাচ্ছিল না। কারণ রাবণ ছিলেন মহাশক্তি মহামায়া দেবী দুর্গার বরপুত্র। তাই রাবণ বধে দশরথ নন্দন শ্রী রামচন্দ্র অকাল বোধন করে শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিলেন। দেবী ভাগবত ও কালিকাপুরাণে উল্লেখ আছে, শরৎকালে শ্রী রামচন্দ্র রাবণ বধে দেবী পার্বতীর দূর্গতিনাশিনী রূপের পূজা করেছিলেন দক্ষিণায়নে (শ্রাবণ মাস থেকে পৌষ মাস)। সনাতন ধর্মমতে এ সময় দেবতারা নিদ্রিত থাকেন। তাই দেবী দুর্গাকে জাগানোর জন্য বোধন করতে হয়। এ জন্য শারদীয় দুর্গোৎসবকে ‘অকালবোধন’ও বলা হয়।

এবার মুক্ত পরিবেশে সরকারি কোনো কড়াকড়ি নেই। তাই উদ্যোক্তা, মন্ডপ শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পীসহ পুরোহিতরা যে যার মতো করে কাজে লেগে পড়েছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় উৎসব দুর্গোৎসব মানে আনন্দ। কারণ মানুষের জীবনে আনন্দ-উদ্দীপনার গুরুত্ব রয়েছে। যে কোনো উৎসবের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য হলো দৈনন্দিন জীবনের একঘেয়েমি কাটিয়ে জীবনযাপনের নতুন রসদ খুঁজে নেওয়া। দুর্গাপূজা নিছক কোনো পূজা নয়। দুর্গাপূজা মানে প্রকৃতির পূজা। প্রকৃতিকে খুশি রাখতে পারলে ধরণী খুশি থাকে। প্রকৃতির ওপর জুলুম করলে প্রকৃতিও ছাড়ে না। প্রতিশোধ নিয়ে প্রকৃতি শোধে-মূলে উসুল করে নেয়, যা আমরা করোনাকালে দেখেছি। লকডাউনের সময় প্রকৃতি অপূর্ব সাজে সজ্জিত হয়েছিল। প্রতিটা বৃক্ষে নতুন পাতা গজিয়ে মানবজাতিকে জানান দিয়েছিল, প্রকৃতি মানবসমাজের কাছে সেটাই আশা করে। এজন্যই হয়তো আদিম সমাজে মানুষ প্রকৃতিকে পূজা করতেন। সুতরাং আমরা প্রকৃতির অংশ। প্রকৃতিকে রক্ষা করা মানে নিজেদের রক্ষা করা। প্রকৃতি পৃথিবীর আশীর্বাদ। এ পৃথিবীতে বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন প্রকৃতি।

চারদিন ধরে মায়ের পূজার উপকরণের দিকে তাকালে চোখে পড়ে দুর্গাপূজা মানে প্রকৃতির হাজার উপাদানের সংযোজন। যেখানে ব্যবহৃত প্রায় প্রতিটি উপাদানই প্রকৃতি থেকে নেওয়া। প্রতিমা তৈরি হয় বাঁশ, খড়, মাটি দিয়ে। তাই দেবী দুর্গা মাটির প্রতিমাতেই মমতাময়ী হিসেবে ধরা দেন বলেই চিন্ময়ীকে মৃন্ময়ী রূপেই চিনি। যে মাটি প্রকৃতির লীলাক্ষেত্র, মানবকুলের বেঁচে থাকার আশ্রয়। সেই মাটির সাজেই আনন্দময়ী আনন্দ বিলান বাঙালির ঘরে ঘরে।

দুর্গাপূজার প্রধান অঙ্গ হলো নবপত্রিকা। দুর্গাপূজার সাথে কলাবউ এর যোগ অবিচ্ছেদ্য। নবপত্রিকা মানে নয় প্রকার শস্য। পূজায় যে নয় ধরণের শস্য বা উদ্ভিদের ব্যবহার করা হয়, এর প্রত্যেকটির ঔষধি ও খাদ্যগুণ অপরিসীম। এ নয় ধরণের শস্য বা উদ্ভিদের মধ্যে রয়েছে কলাগাছ, হলুদ, বেল, ডালিম, অশোক, ধান, গম, যব, মানকচু ইত্যাদি। কথিত আছে, মহামায়া দুর্গা প্রকৃতিতে এসব শস্য হয়ে মানুষের ক্ষুধা দূর করেন। পূজার তাত্ত্বিক বিশ্লেষণের বাইরে দেখলে বোঝা যায়, এসব উপাদান ব্যবহারে প্রকৃতিকেই পূজা করা হচ্ছে। সে অর্থে নবপত্রিকাকে কেন্দ্র করে নিখিল বিশ্ব প্রকৃতিকে গুরুত্ব দেওয়ার বার্তাই যেন ঘোষিত হয় এবং প্রকৃতির অঢেল রত্নসম্ভারকে বাঁচিয়ে রাখার এক অভিন্ন প্রয়াস তা স্পষ্ট। তাছাড়া মহাসপ্তমীর দিন দেবীর মহাস্নানে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন স্থানের জল। গঙ্গার জল থেকে শুরু করে সমুদ্রের জল, বৃষ্টির জল, ঝর্ণার জল, পুষ্প জল, শিশির জল, শঙ্খজল, নারিকেলের জল, পষ্ণগব্য, মধু, দুধ, তিলের তেলসহ আরও নানা রকমের প্রকৃতি থেকে সংগ্রহ করা দ্রব্যাদি। মহাস্নানে দেখা যায় নানা মাটির ব্যবহার। যেমন-বরাহদন্ত মৃত্তিকা, সাগর মৃত্তিকা, নদী মৃত্তিকা, রাজদ্বারের মৃত্তিকা, চৌমাথার মৃত্তিকা, সব তীর্থের মৃত্তিকাসহ বেশ্যাদ্বারের মৃত্তিকা। এখানে মৃত্তিকা যে সমাজের অঙ্গ তা স্পষ্টরূপেই প্রকাশিত। এর মাধ্যমে মায়ের পূজায় চাষা-ভূষা, মুচি-মেথরসহ সমাজের সব স্তরের মানুষ এবং জীব-জগতের অংশগ্রহণের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত মহিলারা পান, দূর্বা, সিঁদুর, আলতা, শিলা, ধান, কলার ছড়া ইত্যাদির সঙ্গে সজ্জিত কুলো নিয়ে পূজা মন্ডপে যান। উপকরণ থেকে পূজা, সবক্ষেত্রে প্রকৃতিরই বিচরণ। যে প্রকৃতির কাছে আমরা মাথা নত করি তিনিই যেন মায়ের রূপে ‘আশ্বিনের শারদ প্রাতে’ বিচরণ করেন বাঙালির বাস্তব ও মনন ভূমিতে। সবুজ ধান, সবুজ ফসল, বিন্দু বিন্দু কুয়াশা, রাতের গভীরতায় ঝিঁঝিঁ পোকার ডাকসহ পরিবেশ যেন প্রকৃতি বন্দনায় মুখর হয়ে ওঠে। কেননা, মায়ের আগমন বার্তা যদি প্রকৃতির রূপ-রস-গন্ধে দোলায়িত করতে হয়, তাহলে বাঁচাতে হবে প্রকৃতির সৃষ্টিশীলতাকে। সুতরাং দুর্গাপূজা মানে প্রকৃতিরই পূজা। প্রকৃতি বাঁচলেই জীবজগৎ বাঁচবে। থাকবে নিরাপদ। পৃথিবীর নিরাপত্তার জন্য এটাই হলো গুরুত্বপূর্ণ বার্তা।

তামার পাত্র, কাঁসা, পেতল ব্যবহারের যে ঐতিহ্য রয়েছে, এর পেছনে রয়েছে বিজ্ঞান। বিশেষ করে তামার পাত্র ব্যবহার, তামার বাসনে খাবার ও তামার গ্লাসে পানি পান করে আজকে অনেকে উপকার পাচ্ছেন বলে স্বীকার করেছেন। তামার কোশার জলে আচমনের উপকারিতা প্রমাণিত। পূজার আবহ তৈরির পেছনে প্রকৃতিজাত দ্রব্যাদি ও ধুপধুনো যে ভূমিকা রাখে, এর একটা ইতিবাচক দিক রয়েছে। ধুপধুনো বিভিন্ন ক্ষতিকারক জীবানু ধ্বংস করে, যা প্রমাণিত হয়েছে অনেকবার। সার্বিকভাবে পূজা যেহেতু সুন্দরের আরাধনা, তাই দুর্গাপূজার মৌসুমে সকলেরই আনন্দে অবগাহন করে প্রকৃতিকে শ্রদ্ধা জানানোর একটা অবকাশও রয়েছে।

পরিশেষে দেবী দুর্গার কাছে আমাদের প্রার্থনা- বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত বর্তমান যুদ্ধাবস্থার অবসান ঘটিয়ে পৃথিবী যেন স্থিতিশীল অবস্থায় ফিরে আসে এবং সারাবিশ্বময় উৎপাতে মেতে ওঠা ডেঙ্গু পরিস্থিতি যেন স্থিত হয়। বসুমতী এবং তার প্রিয় সন্তানগুলো যেন সুখে ও শান্তিতে থাকে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test