E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

ড. আফসার আহমদ: স্মৃতিতে অম্লান

২০২৩ অক্টোবর ১০ ১৬:৩৭:৫৯
ড. আফসার আহমদ: স্মৃতিতে অম্লান

পীযূষ সিকদার


বুকের ভিতর শিস দেয়া পাখি গান গেয়ে যায়। আমি নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগে পড়ার সুযোগ পেয়েছি। আমার স্যারের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আমার উপর নিপতিত হতে হতে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নাটকে পড়ার সুযোগ পেলাম। কজনইবা নাটকে পড়ার ইচ্ছে মনের ভিতর পুষে রাখে। আমি সেই রকম একজন ছাত্র, যে চলে বইকে না বলে বলে। চলতি পথে দেখা হয় আফসার স্যারের সাথে। তাঁর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এক লহমায় আমি লা হয়ে যাই!

আমার ভিতরে তিন ব্যক্তি সারিবদ্ধ হয়ে মনের অজান্তে দেব-দেবী হয়ে যায়। এক জীবনে সব আশা পূর্ণ হয় না। কর্ম যেখানে শেষ কথা, সেখানে কর্মকে আড্ডায় রূপান্তরিত করি। শেষ পর্যন্ত বড় একটা শূন্য করে দুই হাতে নিয়ে চলি অজানার উদ্দেশ্যে। তাই-তো পথ ফুরায় না। আহা! কতরকমের সম্ভাবনা ছিলো। সেই সম্ভাবনাকে পায়ে দলে ভেবে চলি আকাশসম। চারপাশ থেকে বন্ধুবান্ধব সরতে থাকলো। আমি হলাম একা। তাতে কী, তিন দেব-দেবী আমাকে ছায়া দিলো। আমি বিবর্ণ হতে হতে পৃথিবীর কক্ষপথে হাঁটতে শুরু করলাম। একদিন শুনি পৃথিবীর কক্ষপথ থেকে একজন দেবতা তারা হয়ে খসে পড়েছে। আমার আমি বোধিপ্রাপ্ত হই। চোখের জলে ভাসি। চলে গেছেন আর ফিরবেন না।

কষ্টগুলোকে ব্যবচ্ছেদ করি। ব্যথা বাড়ে। খবর এলো আচার্য সেলিম আল দীন চলে গেছেন। খুঁজতে থাকি স্যার কোথায় গেলেন! এই প্রথম আমার বোধে-মননে নিজেকে আবিষ্কার করি বংশী নদীতে। কষ্টগুলো নানা বর্ণে বিস্ফারিত হলো। আমিও তীর ফলার আগায় নিজেকে আবিষ্কার করি। আস্তে আস্তে শোক ভুলি। শোক কী ভোলা যায়! ৭১-এ হারানো পিতাকে, ফিরে পাই সেলিম স্যারের মধ্যে! সেও চলে গেলো অজানা অথবা জানার মধ্যিখানে! আমি স্যারকে বলি, চলে-তো গেছেন আমার কী দশা হবে? কাকে বলবো স্যার টাকা আসেনি, দুশো টাকা দেবেন। স্যার আমার চোখের দিকে তাকান ভয় ও বেদনার সংমিশ্রণে! পকেট থেকে দুশো টাকা বের করে দিলেন। বললেন, লাগলে বলিস! জি¦ স্যার! আমাকে এক কাপ চা দে-তো। তোর হাতের চা খুবই ভালো। আমি স্যারকে চা বানিয়ে দিলাম। স্যারের মুখাবয়বে দেখলাম অথবা দেখে নিলাম এক ফালি চাঁদ! তাঁকে বললাম, আমার একটি চাকরি দরকার। তিনি কোনো জবাব দিলেন না। তাঁর কপালে ভাদ্রের নদী। কোনো জবাব না পেয়ে আমিও ভাদ্রের নদী হয়ে যাই। আমিও জোয়ার-ভাটা দেখি কপালের বলিরেখায়। কত সময় পার হয়ে যায়, আমি ধীরে ধীরে বোধহীন হতে থাকি।

অন্যদিকে একদিন কার্তিকের গাঙ যখন কানায় কানায় ভর্তি খবর পেলাম, আফসার স্যার নেই! তখন নিজেকে আবিষ্কার করি পাবনার মানসিক হাসপাতালে। অনেক সময় কেটেছে পাবনার মেন্টাল হাসপাতালে। আমি সমাজচ্যুত হলাম। একদিকে আফসার স্যারকে হারালাম অন্যদিকে মানসিক বাস চলছে। মানসিক বাস শেষে বাড়ি ফেরা। কোথাও উপরে উঠার সিঁড়ি পেলাম না। একা একা কাঁদি। গান গাই। এইটুকুন মনে ছিলো স্যারের বাড়ি উত্তর জামশা, মানিকগঞ্জ। পালালাম বাড়ি থেকে। গভীর রাতে একা চলে গেলাম আফসার স্যারের কবরে। কবর জিয়ারত করলাম। এই ধর্মীয় কৃত্যকলায় চোখের জলে স্যারকে বললাম, এই-তো আপনার ব্যাটা! কানে বাজতে থাকে নানা রকমের শব্দ। একসময় নিজেও ভয় পেয়ে গেলাম। কে-যেনো স্যারের কবরে ফুল দিয়ে গেছে। স্যারকে বললাম, কিছ্ইু তো নেই আমার সাথে। কী দেবো আপনাকে! চোখের জল ছাড়া! শো-শো করে শব্দ হচ্ছে। ঝি ঝি পোকা ডাকছে। একটা কী যেন হাওয়ার মতো করে আমার মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল। ভয় পেলাম না। স্যারের কবর থেকে একমুঠো মাটি নিয়ে পকেটে ভরে স্যারকে নমস্কার করে বিদায় নিলাম। অটোওয়ালা কয়, আপনার ভয়-ডর কিছু নাই! আমি চুপ। অটোতে উঠলাম। অটো-ড্রাইভার আবার বললো, আপনার কী ভয়-ডর বলে কিছু নাই! আমি চুপ। গাড়ী উত্তর জামশা ছাড়লো। পেছনে পড়ে রইল সুদূর অতীত। এই দিকে প্রতিদিনই প্রায় চুরি-ডাকাতি হয়। সত্যিই আপনি আশ্চর্য মানুষ। সেই থেকে চলে আমার ভাবনা তিন মোহনায়। মোহনায় ভেসে ভেসে অকূলে ভাসি।

আমার কষ্ট হচ্ছে। বেদনার রং কী নীল? তাই-তো আকাশ কাঁদে। আমিও কেঁদে-কুটে এক হই। পীর বাবা বলেন, কোনো চিন্তা করিস না, আমি আছি ব্যাটা। তারপরেই শূন্যে মিলালো। শূন্যের কী আয়তন আছে? সেই থেকে আমি শূন্য-সন্তান।

একটু দখিনা বাতাস দেখেই মনটা উদাস হয়ে যায়! স্যার আপনাকে ফ্রেমে বন্দী করেছি। আমি যে বন্দী জীবন কাটাই। ক্ষণে ক্ষণে ফ্রেম থেকে বেরিয়ে এসে ঘরময় হাঁটতে থাকেন। স্যার, বাতাসের সাথে আপনিও কী আসেন? স্যার এখনো আপনি আমার চেয়ারে বসেন! লেখেন! নইলে একই হাতের লেখা কেনো! শুধু মেলে না আমার ‘ল’ ও আপনার ‘ল’। আবার আপনাকে দেখি ফ্রেমে ফ্রেমে। চলমান ¯্রােতের বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমি। আপনি উজানে বৈঠা মারেন। আমি নৌকার বিপরীতে বসে গান গাই। আপনি শুনতে পান!

একজন ড. অধ্যাপক আফসার আহমদ একাই আকাশের দিকে মুখ তুলে কতকিছু বলে যান। শিল্পের নানান বাঁকে আলো ফেলেন। তখন জন্ম-মৃত্যু কিছু থাকে না। জন্মই মৃত্যু, মৃত্যুই জন্ম। তবুও আমরা মেনে নিতে পারি না। চোখে এতো জল এলো কোথেকে! চোখ ভর্তি হিমানি। স্যার আসেন, ফিরে আসেন। আমার এই সুবিস্তৃত বারান্দায়। আবার কলম ধরেন। আমি আপনার সারথি হই। আচ্ছা এই যে লিখি জন্ম ১৯৫৯ এর ৩০ সেপ্টেম্বর, প্রয়াণ ২০২১, ৯ অক্টোবর। মৃত্যু দিয়ে আপনি ছেদ টানলেন জীবনের। জন্ম-মৃত্যুর খেলায় আপনি-তো চিরঞ্জীব।

উপরে কে যেনো টানে। তাই-তো আফসার স্যার উপর থেকে কথা পাড়তেন। স্যার আপনার লেখায় আমাকে টানেনি। এটা বললে ভুল হবে। আপনার লেখায় মহাকাব্যিক দ্যোতনা আছে। কিন্তু আপনি যখন আমাদের পড়াতেন, আমি আপনার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতাম। কী অসাধারণ আপনার বলার নান্দনিকতা!

আমার কপালের বলিরেখা বেড়ে যাচ্ছে। আমারও বয়স হচ্ছে। এই-তো স্যার আমিও আসছি। চোখে যে ভরাট গাঙ। বলিরেখায় বলে দেয়, সীমানা প্রাচীর। এই প্রাচীর কবে ভাঙবে! একটু চেয়ে দেখেন, আপনার বলিরেখায় আর আমার বলিরেখায় কী অদ্ভুত মিল! স্যার ফিরে আসেন। এই অমাবশ্যায় অথবা পূর্ণিমায়। আমরা যে আপনার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনি!। কবে ফিরবেন! আবার কবে ব্যাটা বলে ডাক দিবেন। আমার চোখের দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা হাসি দিয়ে বলেন, ফিরবো! খুব তাড়াতাড়ি! জল-পাথর একাকার!

মা, তেমন কথা বলেন না। মা আপনাকে সাদা শাড়ি আর শিউলি পাতার নকশা করা শাড়িতে বেশ মানায়। শুধু আমারই কোনো শ্রী নেই। পূর্ণতা পেলাম না শিল্পের ঘাটে। শিল্প শিল্প করে কাটিয়ে দিলাম বৈশাখ থেকে চৈত্র। শিল্প ধরা দিলো না। কাগজ-কলমে অহেতুক লিখে চলি এ-গাঙ থেকে ও-গাঙে। উপর থেকে পেড়ে খবরের পাতা খুলি। আমার জন্য কেউ অপেক্ষা করে নাই। স্যার আবার আমাকে ফার্স্ট ইয়ারে ভর্তি নেবেন? আমি তাল পাতার বাঁশি বানিয়ে আপনাকে শুনাতেম! আবার বাঁশি বাজবে! এ-তো খেলতে খেলতে খেলাঘর বানিয়েছি! আমি তো তিন-মোহনায় ঘর বেধেছি। কপালে ভরাট গাঙ। হয়েছি হিমানি পর্বত। জলধারা আমাকে ছুঁতে পারে না। কারণ, আমিই তো হয়ে গেছি জলধারা। স্যার, জানা নেই চোখের জল কেমনে শুকায়! পথ বাতলে দেন এই ভরা আশ্বিন অথবা কার্তিকে।

লেখক : শিক্ষক ও নাট্যকার।

পাঠকের মতামত:

১১ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test