E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

এমন মন্তব্য সুবিচারের প্রতি অন্তরায়

২০২৩ অক্টোবর ১৬ ১৬:৩৪:৩১
এমন মন্তব্য সুবিচারের প্রতি অন্তরায়

গোপাল নাথ বাবুল


ঘটনা-১ : ‘দেশটা জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছেন।’ ‘আসামিদের আইনজীবীদের আগে বলতে দিন। আপনি এখন লাফ দিয়ে উঠছেন কেন ?’ 

উপরোক্ত বাক্যগুলো রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা, ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. রেজাউল করিমকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন হাইকোর্টের বিচারপতি মো. এমদাদুল হক আজাদ। অসাংবিধানিক বক্তব্যের মাধ্যমে শপথ ভঙ্গের অভিযোগ এনে ওই বিচারপতির বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতির কাছে অভিযোগ দায়ের করেন রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। বিচার বিভাগ নিয়ে বহু চক্রান্ত রয়েছে উল্লেখ করে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে অ্যাটর্নি জেনারেল প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, তিনি (হাইকোর্টের বিচারপতি) কাকে লাভবান করতে এমন মন্তব্য করেছেন?

একজন আইনজীবীর প্রতি একজন বিচারকের এমন বক্তব্য তাঁর আচরণ, মনমানসিকতা, চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এবং তিনি কোন ঘরানার বিচারপতি, তা জনসমক্ষে স্পষ্ট করেছেন, যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।

সুপ্রিম কোর্টের এক তথ্যমতে, বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলে ২০০৪ সালের ২৫ আগস্ট অস্থায়ী বিচারপতি হিসেবে হাইকোর্টে নিয়োগ পাওয়ার পর মো. এমদাদুল হক আজাদ ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট বিচারপতি হিসেবে স্থায়ী হন। সে হিসেবে আগামী ১৫ অক্টোবর অবসরে যাওয়ার তারিখ উক্ত বিচারপতির। অবসরে যাওয়ার আগে এ বিচারপতির এমন বক্তব্য গত কয়েকদিন ধরে আদালত অঙ্গনসহ ‘টক অব দ্যা কান্ট্রি’তে পরিণত হয়েছে। আমরা আগেও দেখেছি, কিছু কিছু বিচারপতি এ সুযোগটাকে কাজে লাগান।

যে দু’জন মানবাধিকার কর্মীকে জামিন দিতে গিয়ে বিচারপতি মো. এমদাদুল হক আজাদ রাষ্ট্রের একজন আইন কর্মকর্তাকে উদ্দেশ্য করে এমন মন্তব্য করেছেন, তাদেরকেও দেশের জনগণ ভালভাবেই চিনেন যে, তারা কাদের মানবাধিকার রক্ষা করেন। ২০১৩ সালে রাজধানীর মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশে অভিযান নিয়ে তথ্য বিকৃতির অভিযোগে মামলাটি করা হয়েছিল। মামলার বিবরণে জানা যায়, আসামি আদিলুর ও এলান ৬১ জনের মৃত্যুর বানোয়াট, উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও মিথ্যা তথ্য দিয়ে প্রতিবেদন তৈরি ও প্রচার করে জনমনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে আইনশৃঙ্খলা বিঘেœর অপচেষ্টা চালিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সরকার ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি দেশে-বিদেশে চরমভাবে ক্ষণœ করেন।

এ মামলায় গত ১৪ সেপ্টেম্বর ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এ এম জুলফিকার হায়াত তাদের ২ বছরের কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানার আদেশ দেন, অনাদায়ে আরও ১ মাসের কারাদন্ডের আদেশ দেন। উক্ত আদেশের বিরুদ্ধে গত ২৫ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট শাখায় আপিল ও জামিন চেয়ে তারা আবেদন করলে গত ১০ অক্টোবর জামিনের শুনানিতে বিচারপতি আজাদ এমন মন্তব্য করে বসেন। তিনি মন্তব্য করেই ক্ষান্ত হননি, মানবাধিকার কর্মকর্তাদের জামিন দেন এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানাও স্থগিত করেন।

ঘটনা-২: ২০১৩ সালের ১৭ ডিসেম্বর এক রায়ে বিদেশে অর্থপাচার সংক্রান্ত মামলায় সাবেক প্রধামন্ত্রী ও তৎকালীন বিএনপি’র চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়ার বড় ছেলে বর্তমানে লন্ডনে পলাতক তারেক রহমানকে বেকসুর খালাস দেন ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩ এর বিচারক মোতাহার হোসেন। তিনিও অবসরের আগেরদিন এ কর্মটি করেছিলেন। কেন তিনি এ কর্মটি করেছিলেন, তা পরে ফাঁস হয়ে যায়। কারণ তিনিও তারেক রহমানের পথের পথিক ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়া এবং বিদেশে অবৈধ উপায়ে অর্থ পাচারের অভিযোগ উঠে। তাঁর ছেলে লন্ডনে থেকে লেখাপড়া করেন। তিনি লন্ডনে বাড়ি কিনেছেন। স্বল্প সময়ের ব্যবধানে রাজধানীর ধানমন্ডিতে ২টা অ্যাপার্টমেন্টের মালিক হয়েছেন। গ্রামের বাড়ি নাটোরেও নামে-বেনামে প্রায় ৫০ বিঘা কৃষি-অকৃষি জমি কিনেছেন বলে অভিযোগ উঠে। এসব অভিযোগের সত্যতা যাচাই-এ দুদক উদ্যোগ নিলে ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি তিনি মালয়েশিয়ায় পালিয়ে যান।

উল্লেখ্য, দুদকের তৎকালীন সহকারি পরিচালক মো. ইব্রাহীম ২০০৯ সালের ২৯ অক্টোবর রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট থানায় মানি লন্ডারিং আইনে মামলাটি করেছিলেন। যার মামলা নম্বর ছিল-৮। তাতে অভিযোগ করা হয়, তারেক রহমান ও তাঁর বন্ধু মামুন ২০০৩ থেকে ২০০৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন পথে মোট ২০ কোটি ৪১ লাখ ২৫ হাজার টাকা অবৈধভাবে সিঙ্গাপুরে পাচার করেছেন।
ঘটনা-৩ঃ নওগাঁ জেলার দায়রা জজ কোর্টের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ হিসেবে কর্মরত একজন বিচারপতি (নাম উহ্য রাখলাম)। গত বছরের দিকে টি-টুয়েন্টি ক্রিকেট বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ইংল্যান্ডের কাছে ভারতের হারকে কেন্দ্র করে এহতেশামুল ইমরান নামের এক ব্যক্তি খুশির ইমোজি ব্যবহার করে ভারতকে বিদ্রুপ করে ‘ইন্ডিয়া বুলছে ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি! দশ উইকেটে হার’ লিখে ২০২২ সালের ১০ নভেম্বরে ফেসবুকে একটি পোস্ট দেন। এ পোস্টে ওই বিচারপতি মন্তব্য করেন, ‘খুব শান্তি পেলাম, মা..উন রা হারলে খুব ভালো লাগে।’

এসব খবর কোনও পত্রিকায় স্থান পায়নি। ইদানীং অনেক ঘটনা কোনও প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া প্রকাশ করেনা। হয়তো সরকারের নীরব নিষেধাজ্ঞা আছে। বিশেষ করে দেশের বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত হিন্দু নির্যাতনের ঘটনাগুলো কোনও মিডিয়ায় প্রকাশ হয় না। সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করা ওই বিচারক ২৪তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে এর আগে কুড়িগ্রামের জুডিশিয়াল মেজিস্ট্রেট কোর্টে চীফ মেজিস্ট্রেটের দায়িত্বে ছিলেন।

সংবিধান অনুযায়ী একজন বিচারক হলেন জাতির বিবেক, সংবিধানের রক্ষক এবং অভিভাবক। একজন বিচারকের দায়িত্ব ও কর্তব্য হচ্ছে, তিনি সবসময় বিচারকাজে নিরপেক্ষ থাকবেন। সেভাবে তিনি শপথ গ্রহণ করেছেন। তাই তিনি এমন মন্তব্য করে শপথ ভঙ্গ করেছেন। যাদের আমরা বিবেকবান মনে করি, সেসব শিক্ষিত জনরাই এসব ঘৃণাসূচক শব্দ ব্যবহার করেন, তাও আবার একটা দায়িত্বশীল পদে বসে। তার মুখে এমন বিদ্বেষপূর্ণ মক্তব্য শোভা পায় কিনা, তা বিবেচনার বিষয়।
যে কেউ যে কোনো দেশের বিরুদ্ধে ফেসবুকে এমন আবেগী পোস্ট দিতেই পারেন। কারণ, খেলায় এমন হয়ে থাকে। কিন্তু একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি এমন সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করতে পারেন কিনা, সেটাই বড় প্রশ্ন। প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে এসব সাম্প্রদায়িকমনা ব্যক্তিদের ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা বারবার সতর্ক করলেও সরকার এ বিষয়ে সজাগ নয়। ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে আজ মৌলবাদীদের বাড়বাড়ন্ত।

উইকিপিডিয়া ঘেঁটে দেখা যায়, আরবীতে ‘মালাউন’ শব্দের আভিধানিক অর্থ হচ্ছে ‘অভিশপÍ’ বা ‘সৃষ্টিকর্তার করুণা বঞ্চিত’। ভারতের সংখ্যাগুরু জনগণ হচ্ছে হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাই তিনি হিন্দুদের অভিশপ্ত হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এখন আমার প্রশ্ন-এমন একজন সাম্প্রদায়িক বিচারকের কাছ থেকে অমুসলিমরা সুবিচার আশা করতে পারেন কিনা ? কারণ, তার দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্লেষণ ক্ষমতাই তো নিরপেক্ষ নয়। তার মন্তব্য থেকে বোঝা যায়, তিনি আগাগোড়া একজন সাম্প্রদায়িকমনা ব্যক্তি। তার ধর্মীয় উম্মাদনার মাধ্যমে তিনি যে তার কর্মক্ষেত্রে মানুষকে বিভ্রান্ত বা বিচার কার্যে প্রভাবিত অথবা বিচারপ্রার্থীদের তিনি ন্যায় বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত করবেন না, তার নিশ্চয়তা কে দেবে ?

অনেকে হয়তো বলবেন, তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনে ফেসবুকে এমন মন্তব্য করেছেন। তিনি তো আদালতে বসে এমন মন্তব্য করেন নি। তাদের কাছে আমার প্রশ্ন-তিনি তার ব্যক্তিগত জীবনে যে মনমানসিকতা লালন করেন, তা তার কর্মজীবনে বাস্তবায়ন করবেন না, তার কোনো নিশ্চয়তা কেউ দিতে পারবেন ? তার ব্যক্তিগত জীবনের আচার-ব্যবহার কী তার মনমানসিকতার পরিচায়ক নয় ? এমন সাম্প্রদায়িক মনমানসিকতা সম্পন্ন বিচারকের কাছে অমুসলিমরা কি সুবিচারের আশা বা ভরসা করতে পারেন ?

সুতরাং এ সকল বিচারকবৃন্দের মনমানসিকতা সংবিধানের মূল চেতনার পরিপন্থী। আর জনগণের সাংবিধানিক অধিকার রক্ষা করা এমন বিচারক দ্বারা কোনোদিন সম্ভব নয়। কারণ তিনি পক্ষপাতদুষ্ট। তার পক্ষে গণতান্ত্রিক আদালতের বিচারকের আসন মানায় না। তাই এমন সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি বিচারকের মতো দায়িত্বশীল পদে বসার অধিকার হারিয়েছেন। কারণ, অন্য ধর্মাবলম্বীরা তার কাছ থেকে কোনো সুবিচার আশা করতে পারেন না।

দেশের উচ্চ ও নিম্ন আদালতে এমন বিচারকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। এ ব্যাপারে সরকারের নজর দেওয়া উচিত। কারণ বিচার বিভাগ সরকারের একটি প্রধান অঙ্গ। বিচার বিভাগ যদি দুর্বল হয় তাহলে সে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়, গণতন্ত্র দুর্বল হয় এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় ব্যাঘাত ঘটে।

আরও চিন্তার বিষয় হল যে, আমাদের বিচারলয়ে এবং প্রশাসনে এখন দেদারছে সাম্প্রদায়িকতার চর্চা হয়। এক বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়- হিন্দু নির্যাতনের কারণে হওয়া মামলাগুলো নাকি আদালত সহজে ধরতে চায় না। এছাড়া বেশ কয়েকবছর ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু কিছু মৌলবাদী অমুসলিমদের গালাগালি করলেও এজন্য কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়েছে বলে জানা নেই। আর এসবের প্রতিবাদ করতে গিয়ে অনেক অমুসলিম জেল খাটছে এবং মামলায় হয়রানি হচ্ছে। যেমন-সুনামগঞ্জের শাল্লার ঝুমন দাস আপন মন্দিরের গেইটে মসজিদের দানবাক্স লাগানোর প্রতিবাদ করে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে জেল খেটেছেন এবং এমন প্রতিবাদ করে ফেসবুকে আর কোনোদিন পোস্ট দেবেন না, এমন মুচলেকা দিয়ে তিনি জামিন পান। অথচ মন্দিরের গেইটে দানবাক্স লাগিয়ে যারা সাম্প্রদায়িক ঘটনার জন্ম দিয়েছেন, সে মসজিদ কমিটির লোকদের আইনের আওতায় আনা হয়নি। এভাবে চলছে গত ১২/১৩ বছর ধরে। বর্তমান বাংলাদেশের প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাপটি মেরে বসে আছেন সাম্প্রদায়িক মৌলবাদীরা।

তাই রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে যারা আছেন, তাদের কাছে বিনীত অনুরোধ-বিচারকসহ প্রশাসনের দায়িত্বশীল পদে নিয়োগ দেওয়ার সময় একজন চাকরিপ্রার্থী মানবিক পরীক্ষায় পাশ করছেন কিনা, সে দিকটি দেখার এবং বঙ্গবন্ধুর অসম্প্রদায়িক বাংলাদেশ সৃষ্টির পথে বাধা সৃষ্টিকারী সাম্প্রদায়িক মনোভাবাপন্ন এ বিচারকদের বিচারকার্য থেকে বিরত রাখা এবং সম্ভব হলে আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি। কারণ, অসহায় মানুষের শেষ ভরসাস্থল হল আদালত। এছাড়াও একজন বিচারকের এমন মন্তব্য সুবিচারের অন্তরায়।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test