E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আসন্ন জাতীয় নির্বাচন খেলাপি ঋণ আদায়ে বড় সুযোগ

২০২৩ অক্টোবর ১৭ ১৬:১৬:২৫
আসন্ন জাতীয় নির্বাচন খেলাপি ঋণ আদায়ে বড় সুযোগ

চৌধুরী আবদুল হান্নান


একটি মামলার শুনানিকালে ঋণ খেলাপিদের উদ্দেশ্যে আদালত মন্তব্য করেন, “আগে টাকা দিন পরে কথা বলুন, তা না হলে কারাগারে যেতে হবে।”

ব্যাংকের খেলাপি ঋণ আদায়ের জন্য একটি বড় সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে, জাতীয় সংসদ নির্বাচন এমন একটি সুযোগ তৈরি করে দেবে। ব্যাংকাররা তা নিশ্চয়ই কাজে লাগাবেন।

সুযোগ সব সময় আসে না, মাঝে মাঝে আসে। বিচক্ষণ ব্যক্তিরা সুযোগ হাতছাড়া করেন না। ব্যাংকের টাকা আত্মসাত করে ইতোমধ্যে যারা সামাজিকভাবে দাপুটে তারা অনেকেই রাজনৈতিকভাবেও ক্ষমতাবান হতে সংসদ সদস্য হওয়ার দৌড়ে অংশ নিতে বেপরোয়া হবেন, সন্দেহ নেই।

বর্তমানে দেশের ব্যাংক ব্যবস্থা একেবারেই ভাল চলছে না বললে কম বলা হবে বরং দুরবস্থায় নিপতিত বলা যায়। মূল কারণ খেলাপি ঋণের আধিক্য এবং ঋণ খেলাপিদের দৌরাত্ম্য।একদিনে এমন নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়নি, ক্রমান্বয়ে ব্যাংক খাত দুষ্ট চক্রের দখলে চলে গেছে।

খেলাপি ঋণের সঠিক হিসাব কারও কাছে নেই, রোগের ভয়াবহতা যেখানে ধরা যায়নি, চিকিৎসা হবে কীভাবে ?বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক এক রিপোর্টে জানা যায়, গত জুন শেষে দেশের ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণের পরিমান ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকা কিন্ত এ হিসাব অনেকেই সঠিক মনে করেন না, কারণ ব্যাংকগুলো সঠিক তথ্য তাদের কাছে সরবরাহ করে না; খেলাপি ঋণ গোপন করে রাখার প্রবণতা রয়েছে তাদের। তবে ড. মইনুল ইসলাম, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি গবেষণামূলক লেখা থেকে জানা যায় দেশে প্রকৃত খেলাপি ঋণের পরিমান হবে ৪ লাখ কোটি টাকার বেশি।

ঋণ খেলাপিরা ইতোমধ্যে মনে করতে শুরু করেছেন, ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করলে কিছু হয় না এবং তাদের ধরার ক্ষমতাও ব্যাংকের নেই। তাদের দাপট কেবল ব্যাংক পাড়াতেই সীমাবদ্ধ নয়, সমাজেও তারা উচ্চ আসনে আসীন এবং ক্ষমতাশালী, নীতিনির্ধারকও। কারণ তাদের অর্থ আছে, অর্থ কথা বলে, সে অর্থ সাদা হোক বা কালো।

অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এ বিষয়ে কেউ মনোযোগ দিচ্ছে না, আর বাংলাদেশ ব্যাংক তো সাহসই করে না। বর্তমানে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাসহ পুরো ব্যাংক ব্যবস্থা পরাজিত সৈনিক, বিজয়ীর বেশে ঋণ খেলাপিরা।

দেশের অর্থনীতি ধ্বংসকারী, অর্থ পাচারকারীদের লাগাম টানতে কেউ কার্যকরভাবে এগিয়ে আসছে না, সেখানে অসহায় ব্যাংকাররা কী করবেন? তবে ঋণ আদায়ের প্রাথমিক দায়িত্বটা ব্যাংকাররা অস্বীকার করতে পারেন না, কারণ তারাই যাচাই বাছাই করে গ্রাহক নির্বাচন করেছেন।

যেহেতু সকল নিয়ম কানুন পরিপালন করে তারা ঋণ দিয়েছেন, তাই সকল খেলাপি ঋণ আদায়ের একক দায়িত্ব তাদের নয়। তবে নৈতিকতার বিচারে বিতরণকৃত ঋণ সময় মতো আদায়ের জন্য ব্যাংকাররা তৎপর থাকবেন।

ঋণ নেওয়ার সময় গ্রাহকরা ব্যাংকের পিছনে অনবরত ঘুর ঘুর করতেন আর এখন ফোন ধরেন না। আগে ক্ষণে ক্ষণে ছালাম দিতেন, এখন দেখা হলে ছালাম তো দূরের কথা, মনে হয় চিনেনই না।

খেলাপি গ্রাহকদের লক্ষ কোটি টাকা মুদ্রা বাজারে প্রবেশ করে দ্রব্য মূল্যে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করেছে যার ধাক্কায় আক্রান্ত প্রতিটি নাগরিক। লাগামহীন ঘোড়াকে আটকাতে ব্যাংকারদের ক্ষমতা সামান্যই, তবু চেষ্টা করতে দোষ কি ?

দেশে আইন আছে, খেলাপি ঋণ গ্রহীতারা নির্বাচনে দাঁড়াতে পারেন না; নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতে হলেসে ঋণ পরিশোধ করতে হবে।

প্রতিটি ব্যাংক বা শাখা এ আইনের সর্বোচ্চ সুবিধা গ্রহণ করতে পারে। এখনই যা করতে হবে :

ক) নির্বাচনের আর বেশি দিন বাকি নেই, খেলাপি ঋণ গ্রহীতাদের তালিকা প্রস্তুত করে রাখতে হবে।

খ) ব্যাংকের শাখা পর্যায় থেকে খোঁজ রাখতে হবে ঋণ খেলাপি যারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে তাদের তালিকা নির্বাচন কমিশনে পাঠিয়ে দিতে হবে।

গ) প্রার্থীদের তালিকা চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত ব্যাংকের প্রতিনিধি নির্বাচন কমিশনের সাথে নিবিড় যোগাযোগ রক্ষা করবেন।

ঘ) সার্বিক বিষয়ে তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকে একটি “মনিটরিং সেল” গঠন করা যেতে পারে।

অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেন, “আগামী নির্বাচনে যেন কোনোভাবই ঋণ খেলাপিরা অংশ নিতে না পারে সে বিষয়ে সরকারকে কঠোর থাকতে হবে। কারণ ঋণ খেলাপিরা জনপ্রতিনিধি হতে পারেন না। অনেক সময় নির্বাচনের আগে পুনঃতফশিলের মাধ্যমে ঋণ খেলাপিদের নির্বাচনে অংশ গ্রহণেযোগ্য ঘোষণা করা হয়। সেটি কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।”

যারা নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান কিন্ত তাদের নামে খেলাপি ঋণ রয়েছে, তারা বসে থাকবেন না, নড়েচড়ে বলবেন এবং ব্যাংকমুখী হতে বাধ্য হবেন। প্রভাবশালী ঋণ খেলাপিদের অনেকেই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য বিশেষ সুবিধার আশায় আদালতের দ্বারসহ হবেন, অতীতে যা দেখা গেছে। তবে এমন ক্ষেত্রে ইতিপূর্বে আদালতের কিছু পর্যবেক্ষণ আমাদের আশা জাগিয়ে রেখেছে।

পিপলস লিজিংয়ের একটি মামলার শুনানিকালে ঋণ খেলাপিদের উদ্দেশ্যে আদালত মন্তব্য করেন—“ আগে ব্যাংকের টাকা পরিশোধ করুন, পরে কথা বলুন, তা না হলে কারাগারে যেতে হবে।”

ঋণ খেলাপি ব্যক্তির নির্বাচনে অংশগ্রহণ বিষয়ে কঠোর মনোভাব ব্যক্ত করে হাইকোর্ট একবার বলেছিলেন- “নির্বাচনে অংশ গ্রহণের এতই যখন ইচ্ছা, তা হলে নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই ঋণ পরিশোধ করা উচিৎ ছিল।”

দেশের বানিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় সম্প্রতি ঋণ খেলাপি আর অর্থ পাচারকারীদের প্রতি আদালতের পর্যবেক্ষণে এমন মতামত লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, যেখানে ঋণ খেলাপিদের দৌরাত্ম্যের কাছে সরকারের সকল সংস্থা কোনঠাসা হয়ে পড়েছে, আত্মসমর্পণ করে বসে আছে, সেখানে শেষ ভরসা হিসেবে আদালত জেগে আছে অতন্দ্র প্রহরীর মতো।

সংসদ নির্বাচনের এ সুযোগ কাজে লাগিয়ে খেলাপি ঋণ আদায়ের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা রয়েছে, তবে কতটা সফলতা আসবে তা নির্ভর করবে বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সকল ব্যাংকের সদিচ্ছা ও আন্তরিকতার ওপর।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test