E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

৯৮তম জন্মদিবসে শ্রদ্ধাঞ্জলি

নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর ইলা মিত্র

২০২৩ অক্টোবর ২০ ১৬:১২:২০
নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের কন্ঠস্বর ইলা মিত্র

গোপাল নাথ বাবুল


কারাগারে রাজবন্দীদের হত্যার কথা জানি (১৯৭৫ এর ৩ নভেম্বর জাতীয় চার নেতা হত্যা)। কিন্তু কারাগারে রাজবন্দীকে ধর্ষনের কথা কী আপনারা শুনেছেন, যা পাকিস্তানের অসভ্য মুসলিমলীগ সরকার করেছিল ? আজ সে বৃটিশ ও পাকিস্তান সরকারের আতঙ্ক সংগ্রামী এবং বিপ্লবী ইলা মিত্রের কথা বলব।

ইলা মিত্র এক সংগ্রামী নাম। এক বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধির নাম। এক মানবতাবাদী নারীর নাম। অত্যাচারী বৃটিশ সরকারের শোষণের বিরুদ্ধে এ বাংলায় শত শত বিপ্লবী বারবার গর্জে উঠেছেন এবং প্রতিরোধ গড়ে তোলে হাসতে হাসতে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন। ইলা মিত্র তাদের মধ্যে একজন হলেও ছিল অনেকটা ভিন্ন। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ পরিবারে জন্ম নিয়ে এবং জমিদার পত্নী হয়েও সকল সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যকে বিসর্জন দিয়ে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত লড়ে গেছেন সাধারণ মানুষের জন্য, ভোগ করেছেন অমানুষিক নির্যাতন। নীরবে সহ্য করে গেছেন শত অত্যাচার এবং গণতন্ত্রকামী মানুষের মুক্তির জন্য আজীবন সংগ্রাম করে মানুষকে আলোর পথ দেখিয়েছেন। এ সংগ্রামী নারী ইতিহাসে আলাদা আবেদন রাখেন এ কারণে, সাধারণ মানুষের জন্য শোষক শ্রেণির এতো শারীরিক অত্যাচার আর কোনো বিপ্লবী সহ্য করেছেন কিনা, জানা নেই।

অথচ ইলা মিত্রের স্বপ্ন ছিল সফল বিপ্লবের মাধ্যমে বৈষম্য পীড়িত সমাজকে পাল্টে দিয়ে সারাবিশ্বের শোষণের অবসান ঘটাবেন। স্বপ্ন ছিল নতুন সমাজ গড়বেন। স্বপ্ন ছিল আলোকিত মানুষ গড়বেন। এক কথায় তিনি ছিলেন সারাবিশ্বের বঞ্চিত ও নিপীড়িতদের মুক্তিই ছিল যাঁর ধ্যান-জ্ঞান, বাঙালির গর্বের ধন ও কিংবদন্তি, সংগ্রামী, মানবতাবাদী, বঞ্চিত মানুষের প্রতিনিধি, জোতদার, বৃটিশ ও পাকিস্তানি মুসলিমলীগ সরকারের ত্রাস, ঐতিহাসিক তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী নাচোলের রাণীমা খ্যাত ইলা মিত্র। ১৮ অক্টোবর এ মহিয়সী বিপ্লবীর ৯৮তম শুভ জন্মদিনে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি।

ঝিনাইদহের বাগুটিয়া গ্রামের বৃটিশ সরকারের অধীন বাংলার অ্যাকাউন্টেণ্ট জেনারেল নগেন্দ্রনাথ সেন ও মনোরমা সেনের তিন ছেলে তিন মেয়ের মধ্যে সবার বড় ইলা সেন জন্ম নেন কলকাতায় ১৯২৫ সালের অক্টোবরের এ শুভ দিনে। বেথুন স্কুল ও বেথুন কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে বিএ ডিগ্রি অর্জন করেন এবং ১৯৫৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্য ও সংস্কৃতি বিষয়ে স্নাকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। গান-অভিনয়, খেলাধুলাসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডেও জড়িত ছিলেন। ১৯৩৫ থেকে ১৯৩৮ সাল পর্যন্ত ছিলেন রাজ্য জুনিয়র অ্যাথলেটিক চ্যাম্পিয়ন। বাঙালি মেয়েদের মধ্যে তিনিই প্রথম ১৯৪০ সালে জাপানে অনুষ্ঠিত অলিম্পিকের জন্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। যদিও সেবার দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অলিম্পিক বাতিল করা হয়।

১৯৫০ সালের ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানি পুলিশ ইলা মিত্রকে গ্রেফতার করার পর হত্যাকান্ডের নির্দেশদাতা হিসেবে স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য এমন কোনো পন্থা নেই, যা প্রয়োগ করেনি। যেমন- অনবরত লাঠি দ্বারা পিটানো, দু‘লাঠির মধ্যে পা দু‘টো ধরে ক্রমাগত চাপ সৃষ্টি করা, রুমাল দিয়ে মুখ বেঁধে চুল টেনে উপড়ে ফেলা, লাঠি দ্বারা মাথায় আঘাত করে নাক-মুখ দিয়ে অনবরত রক্ত বের করা, কিল-ঘুষিসহ তলপেটে বুটের লাথি মারা, হাঁটুতে লম্বা পেরেক ঢুকিয়ে দেয়া, সারাদিন উলঙ্গ করে রাখা, যৌনাঙ্গ দিয়ে গরম ডিম ঢুকিয়ে দেয়া, পরিশেষে স্বীকারোক্তি আদায়ের নামে ধর্ষণ করা। প্রায় ১০দিন ধরে চলে এ নারকীয় অত্যাচার মাত্র মাস খানেক আগে সন্তান জন্ম দেওয়া ইলা মিত্রের উপর। যাবজ্জীবন কারাদন্ড ভোগ করা ইলা মিত্রকে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রণ্ট সরকার ক্ষমতায় এসে মুক্তি দিলে চিকিৎসার জন্য তিনি কলকাতা চলে যান।

ইলা মিত্রের অপরাধ ছিল, নিপীড়িত ও বঞ্চিত কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া। তেভাগা মানে তিন ভাগের একভাগ ফসল জোতদার বা জমিদারকে দিয়ে বাকি দু’ভাগ ফসল কৃষকদের জন্য নিশ্চিত করা। এটাই ছিল আন্দোলন। উল্লেখ্য যে, পলাশীর যুদ্ধের আগ পর্যন্ত জমির মালিকানা ছিল কৃষকদের হাতে এবং ফসলের একভাগ বা তারও কম খাজনা দিতেন রাজকোষে। কিন্তু ইংরেজ আমলে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রথা চালুর পর জমির মালিকানা চলে যায় জমিদারদের হাতে। তার উপর আবার মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে জোতদারদের উৎপাত, হাটে ‘তোলা’ ও ‘লেখাই’ এসব দিয়ে কৃষকদের হাতে আর ফসলের অবশিষ্ট কিছু থাকতো না। জমি চাষের তদারকি করা ও খাজনা আদায় করা এ জোতদারেরা কৃষকদের দাসের মতো ব্যবহার করতো। মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে অর্থের মাধ্যমে খাজনা পরিশোধ করতে গিয়ে সর্বশান্ত হয়ে এ সময়ের সমৃদ্ধ বাংলার কৃষক সমাজ আধিয়ার আর ক্ষেত-মজুরে পরিণত হন এবং এর ফলে জমিদার-জোতদারদের বিরুদ্ধে কৃষকদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হতে থাকে। ১৯৩৬ সালে ‘সর্বভারতীয় কৃষক সমিতি’ গঠনের মাধ্যমে বাংলার কৃষক সমাজ ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। ছেচল্লিশের দাঙ্গা ও সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ, জেলায় জেলায় ভ্রাতৃঘাতি দাঙ্গাকে মন থেকে পরিহার করে হিন্দু-মুসলিম ইলা মিত্রের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

১৯৪৭ এ দেশ ভাগ হলে পাকিস্তানের মুসলিমলীগ সরকার কমিউনিস্ট পার্টিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে দমননীতি শুরু করেন। হিন্দু নেতা-কর্মীরা প্রায় এ সময় ভারতে চলে যায় কিন্তু ইলা মিত্র ও তাঁর স্বামী রমেন মিত্র নাচোলের চন্ডীপুর গ্রামে আত্মগোপন করেন এবং তেভাগা আন্দোলন অব্যাহত রাখেন। ১৯৪৬ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন ইলা মিত্র। এ আন্দোলনে পুরো কৃষক সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়লেও সামনের সারিতে ছিল সাঁওতালেরা। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি পুলিশ ও কৃষকদের মধ্যে সংঘর্ষ হলে ৭ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার প্রায় ২০০০ সৈন্য প্রেরণ করেন। সেনারা ঐ গ্রামগুলো চারদিক থেকে ঘিরে ব্যাপক মারধর শুরু করার পর গুলি করে শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যা করে এবং ১২টি গ্রামের কয়েক শত ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। এদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন সাঁওতাল অধিবাসী। ইলা মিত্র সাঁওতালদের পোষাক পড়ে পালাতে গিয়ে দূর্ভাগ্যবশতঃ ভাষাগত কারণে রোহনপুর রেলস্টেশনে পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। তারপর শুরু হয় সীমাহীন অকথ্য নির্যাতন।

মূলতঃ তিনি স্নাতক সম্মানের ছাত্রী থাকা অবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৪৩ সালে কলকাতা মহিলা সমিতির সদস্য হয়ে পরবর্তীতে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টিতে সমস্যপদ লাভ করেন। ১৯৪৫ সালে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও চাঁপাইনবাবগঞ্জের রামচন্দ্রপুরের জমিদার নন্দন রমেন মিত্রের সাথে বিয়ের পর ইলা মিত্র কলকাতা থেকে শ্বশুরবাড়ি রামচন্দ্রপুর হাটে চলে আসেন। এরপর এলাকাবাসির দাবির মুখে এলাকার মেয়েদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেন এবং রমেন মিত্র ও ইলা মিত্র দু’জনই জমিদার পুত্র ও জমিদার পুত্রবধু হওয়ার পরও জমিদারির সুখ ও মোহ ত্যাগ করে জমিদার ও জোতদারের বিরুদ্ধে কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়ান। ১৯৪৬ সালে নোয়াখালীর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বিরোধী জনমত গঠন করে ইলা মিত্র অসীম সাহসের পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালে তিনি আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনে অত্যন্ত সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সারাজীবন বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করে চির নমস্য ও জনমানুষের হৃদয়ের মণিকোটায় স্থান নেওয়া এ মহিয়সী ও কিংবদন্তি নেত্রী ৭৭ বছর বয়সে ২০০২ সালের ১৩ অক্টোবর কলকাতায় পৃথিবীকে চিরবিদায় জানান।

পরিশেষে বলবো, তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী ইলা মিত্র স্মরণে নাচোল উপজেলার কেন্দুয়ায় কেন্দুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে একটি স্মৃতিস্তম্ভ রয়েছে। এছাড়া এ বিপ্লবী নারীকে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য আর কিছুই নেই। অথচ বর্তমান প্রজন্মের কাছে ইলা মিত্রের সংগ্রামী জীবনের বিভিন্ন দিক তুলে ধরা উচিত এবং হাজী কিয়ামউদ্দিন ও আমিনুল ইসলামরা ইলা মিত্রের পৈতৃক বাড়ি ও শত শত বিঘা সম্পত্তি দখল করে বসে আছে। এদের হাত থেকে এ বাড়ি ও সম্পত্তিগুলো দখলমুক্ত করে রক্ষণাবেক্ষণ ও দর্শনীয় করে কৃষক বিদ্রোহের ইতিহাস রক্ষার্থে সরকারের হস্তক্ষেপ কামনা করছি। (তথ্যসূত্রঃ ইলা মিত্র, নাচোলের তেভাগা আন্দোলনের নেত্রী, লেখক: মালেকা বেগম।)

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

১২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test