E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা

২০২৩ অক্টোবর ২৭ ১৬:৪২:২৭
কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমা

গোপাল নাথ বাবুল


দুর্গতিনাশিনী দেবী দুর্গার আগমনে আনন্দময় হয়ে উঠে এ মর্ত্যলোক। বিজয়া দশমীর দিন চিন্ময়ীর বিদায়ে মর্ত্যবাসী স্বভাবত শোকাহত হয়ে পড়েন। দুর্গোৎসব শেষে প্রথম পূর্ণিমা তিথিতে কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা মর্ত্যবাসীকে সেই শোক ভোলাতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে। তাই নবমীর নিশি যখন দশমীর দিকে গড়ায় তখন বাংলার প্রতিটি হিন্দুর ঘরে ঘরে চুড়ান্ত ব্যস্ততা বেড়ে যায়। মর্ত্যবাসী আবার আনন্দে মেতে ওঠেন শ্রী শ্রী লক্ষ্মীপূজাকে ঘিরে। ব্যাপক উৎসাহ ও উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বিভিন্ন মঠ-মন্দির ছাড়াও প্রতিটি সনাতনীর ঘরে ঘরে উদ্যাপিত হয় এ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। বাংলার ঘরে ঘরে আঁকা হয় চালের গুড়োর আল্পনায় শ্রী শ্রী লক্ষ্মী মায়ের পায়ের চিহ্ন, বিভিন্ন মুদ্রা ও ধানের ছড়ার ছবি। এ আল্পনাগুলো পূজার মাহাত্ম্য যেমন ব্যাখ্যা করে তেমনি পূজার আচারের একটা অংশ হয়ে ওঠে।

নৃসিংহ প্রসাদ ভাদুড়ী লক্ষ্মীপূজার ব্যাপারে বলেছেন, “লক্ষ্মী মানে শ্রী, সুরুচি। লক্ষ্মী সম্পদ আর সৌন্দর্যের দেবী। বৈদিক যুগে মহাশক্তি হিসেবে তাঁকে পুজো করা হত। তবে পরবর্তীকালে ধনশক্তির মূর্তি নারায়ণের সঙ্গে তাঁকে জুড়ে দেওয়া হয়।

নীহার রঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালীর ইতিহাস’ গ্রন্থে লিখেছেন, “আমাদের লক্ষ্মীর পৃথক মূর্তিপূজা খুব সুপ্রচলিত নয়। আমাদের লোকধর্মে লক্ষ্মীর আর একটি পরিচয় আমরা জানি এবং তাঁহার পূজা সমাজে নারীদের মধ্যে বহুল প্রচলিত। এই লক্ষ্মী কৃষি সমাজের মানস-কল্পনার সৃষ্টি; শস্য-প্রাচুর্যের এবং সমৃদ্ধির তিনি দেবী। এই লক্ষ্মীর পূজা ঘটলক্ষ্মী বা ধান্যশীর্ষপূর্ণ চিত্রাঙ্কিত ঘটের পূজা। বাঙালী হিন্দুর ঘরে ঘরে নারীসমাজে সে পূজা আজও অব্যাহত। বস্তুত, দ্বাদশ শতক পর্যন্ত শারদীয়া কোজাগর উৎসবের সঙ্গে লক্ষ্মীদেবীর পূজার কোনও সম্পর্কই ছিল না।”

তাছাড়া প্রাচীন বাংলা সাহিত্যে লক্ষ্মীপূজার উল্লেখ দেখে বোঝা যায়, সেকালে এ পূজার জনপ্রিয়তা কতটা ছিল। লক্ষ্মী চঞ্চলা। তবে ক্রোধী দেবী নন। তাই যেকোনও গৃহস্থই লক্ষ্মীর ঝাঁপি করে লক্ষ্মীর পিঁড়ি পাতেন গৃহকোণে। উপাচারও সামান্য। প্রতি বৃহস্পতিবারে (লক্ষ্মীবার) সামান্য ফুল-বাতাসা আর ধোয়া পিঁড়িতে চাল পিটুলির আল্পনা। সেটাই একটু বড় আকারের এ কোজাগরীর রাতে অনুষ্ঠিত হয়।
শাস্ত্রমতে, তিনি ধন-সম্পদের দেবী। তাই ধন-সম্পদের আশায় এদিন হিন্দু নর-নারীরা উপবাস ব্রত পালন করে ফুল, ফল, মিষ্টি নৈবদ্য দিয়ে আরাধনা করেন লক্ষ্মী মায়ের। শুধু ধন-সম্পদ নয়, তিনি খ্যাতি, জ্ঞান, সাহস, শক্তি, জয়, সু-সন্তান, বীরত্ব, বিভিন্ন রত্নরাজি, শস্য, সুখ, বুদ্ধি, সৌন্দর্য, উচ্চভাবনা, নৈতিকতা, সু-স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন দান করেন তাঁর ভক্তদের। এককথায় একনিষ্টভাবে ও মন দিয়ে মা লক্ষ্মীর আরাধনা করলে মহাশক্তি স্বরূপিনী সকলের সব রকম মঙ্গল ও কল্যাণ বিধান করেন এবং মা লক্ষ্মী সন্তুষ্ট হলে মানুষ সুন্দর ও চরিত্রবান হয়। তাই বর্তমানে সমাজের অসংখ্য অনাচার ও অবিচারের মধ্যেও সমাধানের পথ খুঁজে ফেরা প্রতিনিয়ত সংসারের নানা সমস্যায় জর্জরিত মানুষগুলোর সমাধানের দিশা হতে পারে মা লক্ষ্মীর পূজা। লক্ষ্মীপূজার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো মা লক্ষ্মীর পাঁচালী পাঠ।

মা লক্ষ্মী শ্রী শ্রী বিষ্ণুর সহধর্মিণী। তাই শ্রী শ্রী বিষ্ণু যখনই সাধুদের রক্ষা ও অসুরদের বিনাশের জন্য পৃথিবীতে আবির্ভূত হন, তখনই ভিন্ন ভিন্ন নামে মা লক্ষ্মীও তাঁর সঙ্গী হন। তিনি কখনো বিষ্ণুশক্তি লক্ষ্মী আবার কখনো কমলা বা গজলক্ষ্মী অথবা মহালক্ষ্মী। আবার রূপবৈচিত্রে দেখা যায়, তিনি কখনো দ্বিভুজা আবার কখনো চতুর্ভুজা। তবে সবত্রই তিনি পদ্মাসনা ও পদ্মহস্তা। যা আধ্যাত্মিক পবিত্রতা ও অনাশক্তির প্রতীক। প্রভাতের সূর্যের তেজের মতো তাঁর জ্যোতি। মা লক্ষ্মীর হাতের প্রহরণ অশুভ শক্তিকে বিনাশ করার জন্য শুভ শক্তির প্রতীক। আশ্বিন মাসের পূর্ণিমা তিথিতেই এ কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা বা কোজাগরী পূর্ণিমা উদ্যাপিত হয়।

শব্দগতভাবে ‘কোজাগর’ থেকেই এসেছে কোজাগরী শব্দটি। কোজাগরী শব্দের অর্থ হলো ‘কো জাগতি’ অথ্যাৎ ‘কে জেগে আছো’। সনাতনী ধর্মালম্বীদের বিশ্বাসমতে, দেবী লক্ষ্মী কোজাগরী পূর্ণিমার রাতে মর্ত্যলোকে আবির্ভূত হন। তাই এ পূর্ণিমায় সারারাত জেগে থেকে পূজা, স্তব ও দ্বাদশ নাম জপ করলে মা লক্ষ্মীর আশীর্বাদ পাওয়া যায়। এ রাতে মা লক্ষ্মী মর্ত্যলোকের প্রত্যেকের ঘরে ঘরে গিয়ে ‘কে জেগে আছো’ ডাক দিয়ে ভক্তদের মনোবাঞ্চা পূরণ করেন। তাই ব্রতকারীরা সারারাত জেগে থাকেন মা লক্ষ্মীর ডাকের আশায়।

বছরের এ পূজা ছাড়াও প্রতি বৃহস্পতিবার বাংলার হিন্দুদের ঘরে ঘরে মা লক্ষ্মীর পূজা করা হয়। কারণ, বৃহস্পতি মা লক্ষ্মীর প্রতীক, শুভ গ্রহ। তাই বৃহস্পতিবারে মা লক্ষ্মীর পূজা করলে সকল দুঃখ মোচন হয়। আর যদি কোনো বৃহস্পতিবার পূর্ণিমা তিথির মধ্যে পড়ে, তাহলে সেদিন কোনো রমণী উপবাস ব্রত পালন করে মা লক্ষ্মীর পূজা করলে ধন-সম্পদে গৃহ পূর্ণ হয় এবং সকল সমস্যার সমাধান হয়।
প্রচলিত আছে, এক দোলপূর্ণিমার রাতে ব্রহ্মার মানসপুত্র নারদমুনি বৈকুণ্ঠে লক্ষ্মী ও নারায়ণের কাছে গিয়ে মর্ত্যরে অধিবাসীদের নানা দুঃখ-বেদনার কথা জানালেন। নারদমুনি বললেন, মা, মর্ত্যবাসী নানা দুর্গতিতে ভূগছে, অন্নাভাবে ক্ষুধার জ্বালা সহ্য করতে না পেরে অনেকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে, কেউ কেউ আবার ক্ষুধার জ্বালা মিঠানোর জন্য প্রাণাধিক সন্তানদেরও বিক্রি করছে। বল মা, কোন পাপের ফলে মর্ত্যলোকে এমন দূর্ভিক্ষ নেমে এল ?

উত্তরে মা লক্ষ্মী মানুষের নিজেদের কু-কর্মের ফলকেই এসব দুঃখের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, দিনে ও সন্ধ্যাকালে নিদ্রা, অনাচার, ক্রোধ, অহংকার, আলসেমি, ঝগড়া-বিবাদ ও মিথ্যায় ভরে গেছে এ সংসার। নারীগণের উচ্চ হাসি, উচ্চ ভাষা, নারীর ভূষণ লজ্জা ও দয়া-মায়া বিসর্জন, যেখানে সেখানে গমন, সন্ধ্যা এবং ভোরের কাজগুলো তারা ঠিকমতো করে না। অপরদিকে পুরুষেরাও অবহেলা ও সারাদিন ঝগড়া-বিবাদে সময় কাটায়, হিংসা-বিদ্বেষে পরিপূর্ণ হয়ে গেছে তাদের হৃদয়, রসনাতৃপ্তির জন্য তারা অখাদ্য-কুখাদ্য খায়। এসব কারণেই ধরাধামে চলছে দুর্ভিক্ষ।

তবু নারদের অনুরোধে মা লক্ষ্মী মত্যবাসীদের দুঃখ-কষ্ট লাঘবে সম্মত হলেন এবং সুন্দর বাক্য প্রয়োগে নারদমুনিকে বিদায় জানিয়ে মা লক্ষ্মী পাশে উপবিষ্ট শ্রী শ্রী বিষ্ণুকে জিগ্যেস করলেন, এ অবস্থায় আমার করণীয় কী ? উত্তরে বিষ্ণু মর্ত্যলোকে গিয়ে লক্ষ্মীব্রত প্রচারের পরামর্শ দিলেন।

অবশেষে মা লক্ষ্মী মর্ত্যলোকে এসে দেখলেন, এক বৃদ্ধা আত্মহননের জন্য প্রস্তুত। মা লক্ষ্মী বৃদ্ধার কাছে তাঁর আত্মহত্যার কারণ জানতে চাইলে বৃদ্ধা জানান, তিনি অবন্তীনগরের ধনেশ্বর নামক এক ধনী বণিকের স্ত্রী। স্বামী মারা যাওয়ার পর তাঁর ছেলেরা বিষয়-সম্পত্তি ও অন্যান্য বিষয় নিয়ে ঝগড়ায় লিপ্ত হয়। সে ঝগড়ায় অতীষ্ট হয়ে তিনি মনের দুঃখে বনে এসেছেন আত্মহত্যার উদ্দেশ্যে। সব শুনে মা লক্ষ¥ী তাঁকে আত্মহত্যা না করে বাড়ি গিয়ে লক্ষ্মীব্রত করার উপদেশ দিলে বৃদ্ধা বাড়ি ফিরে গিয়ে তাঁর পুত্রবধুদের শ্রী শ্রী লক্ষ্মীর কথা বর্ণনা করলেন। এতে বৃদ্ধার পুত্রবধুরা লক্ষ্মীব্রত করলেন এবং ধীরে ধীরে তাঁদের সব দুঃখ মোচন হলো। ফলে লক্ষ্মীব্রতের কথা অবন্তীনগরে ছড়িয়ে পড়লো।

একদিন অবন্তীনগরের সধবারা মিলে লক্ষ্মীব্রত করছিলেন। এমন সময় শ্রীনগরের এক যুবক বণিক এসে লক্ষ্মীপূজাকে ব্যঙ্গ করলেন। তাঁর পাঁচ ভাই ও অনেক ধন-সম্পদ। যুবক বললেন, যাদের ধন-সম্পদ নেই তারাই এ পূজা করে। আমারতো সবই আছে। আমি কেন লক্ষ্মীপূজা করবো ? এতে মা লক্ষ্মী কুপিত হলেন। যুবক বণিক সবকিছু হারিয়ে অবন্তীনগরে ভিক্ষা করতে লাগলেন।

একদিন যুবক সধবাদের লক্ষ্মীপূজা করতে দেখে অনুতপ্ত হলেন এবং তাঁর অহংকারের জন্য মা লক্ষ্মীর কাছে ক্ষমা চাইলেন। মা লক্ষ্মী যুবককে ক্ষমা করে দিয়ে তাঁর সবকিছু ফিরিয়ে দিলেন। এভাবে পৃথিবীতে লক্ষ্মীব্রতের প্রচলন হয়।

আমরা সবাই জানি, মা লক্ষ্মীর বাহন হলো পেঁচক বা প্যাঁচা। পাখি জগতের সবচেয়ে তীক্ষ্ণ শ্রবণ শক্তির অধিকারী আমাদের চির পরিচিত এ লক্ষ্মীপ্যাঁচা। ধন-সম্পত্তি হোক বা টাকাকড়ি হোক অথবা সাধনধনই হোক, সদাজাগ্রত থেকে তা রক্ষা করতে হয়। আমরা যখন রাতে নিদ্রা যাই, তখন প্যাঁচা রাত জেগে এ সম্পদ পাহারা দেয়। ধান, চাল, অন্ন, খাদ্যশস্য বা ধানের গোলা হলো লক্ষ্মীর প্রতীক। মা লক্ষ্মীর দেওয়া ধন যারা অপব্যয় করে, তাদের প্রতি তিনি অসন্তুষ্ট হন। ধান ক্ষেত ও গোলাঘরের চারদিকেই বাস করে ইঁদুর। ইঁদুর এসব খেয়ে ফেলে এবং অধিকাংশই নষ্ট করে। প্যাঁচার আহার হলো ইঁদুর। তাই প্যাঁচা ইঁদুর খেয়ে ধান, খাদ্যশস্য রক্ষা করে। এজন্য লক্ষ্মীর বাহন প্যাঁচা।

পরিশেষে বলা যায়, আসলে লক্ষ্মী লৌকিক দেবী। দেবী লক্ষ্মীর শুভদৃষ্টি বা কৃপাদৃষ্টি যাদের উপর পড়েছে তারাই চিরকাল থেকেছেন সুখে-সমৃদ্ধিতে। অর্থের অভাব বা কোনো রকম বিপদ তাদের জীবনে কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। তাই কমবেশি সবাই মা লক্ষ্মীকে মানেন এবং তাঁর বন্দনায় ব্রতী হন।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test