E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

দীপমালার সজ্জা-ই দীপাবলি উৎসব

২০২৩ নভেম্বর ১০ ১৬:০৭:৫৭
দীপমালার সজ্জা-ই দীপাবলি উৎসব

গোপাল নাথ বাবুল


শক্তির দেবী কালী। তাঁর অন্য নাম শ্যামা বা আদ্যাশক্তি। সনাতন ধর্মাবলম্বী বাঙালিদের কাছে এ দেবী বিশেষভাবে পূজিত হন। তন্ত্র মতে প্রধান দশ দেবীর মধ্যে তিনি অন্যতম পূজিত দেবী। আমরা সাধারণত দেবী কালীর যে রূপের দর্শন পায় তা হল, তিনি চতুর্ভুজা অর্থাৎ তাঁর চারটি হাতযুক্ত মূর্তি দেখতে পাই। এক হাতে আছে খড়গ, আরেক হাতে আছে অসুরমুন্ড, অসুরদের কাটা হাত দিয়ে কোমরবন্ধ এবং অন্য হাত দু‘টি দিয়ে তিনি বর ও অভয় দান করেন। গলায় নরমুন্ডের মালা, প্রতিকৃতি ঘন কালো বর্ণের এবং জীভ মুখ থেকে বাইরের দিকে বেরিয়ে আছে। এছাড়াও তিনি এলোকেশী। মায়ের পায়ের নিচে দেবাদিদেব মহাদেব শুয়ে আছেন। আর জিভ বের করে দাঁড়িয়ে আছেন মহাদেবের বুকের ওপর পা তুলে। এরূপে সর্বত্র পূজিত হয়ে আসছেন মা কালী। এরূপেই দেবী মহামায়া অবতীর্ণ হয়ে তিনি দেবতাদের বরাভয় প্রদান করেন এবং অসুর নিধনে তাঁর রুদ্ররূপ ধারণ করেন। এ পূজাকে দ্বীপান্বিতা কালী পূজা বা শ্যামাপুজাও বলে থাকেন। শাস্ত্রমতে, যে কাল সর্বজনকে গ্রাস করে সেই কালকে তিনি গ্রাস করেন বলেই তিনি কালী। বাংলায় কালী শক্তিরূপে পূজিতা হলেও দক্ষিণ ভারতে ভদ্রকালী রূপে এবং উত্তর ও পশ্চিম ভারতে লক্ষ্মী ও ঐশ্বর্যের প্রতীক হিসেবে দেবী পূজিতা হন। 

কালীপূজার আগের দিন ‘ভূত চতুর্দশী’ পালন করা হয়। সনাতনী সম্প্রদায়ের বিশ্বাস মতে, এদিন ভূত-প্রেত ঘুরে বেড়ায়। তাই তাদের তাড়ানোর জন্য সেদিন সন্ধ্যেবেলা ঘরে ঘরে প্রদীপ জ্বালাতে হয়। ভুতচতুর্দশীকে ‘যম চতুর্দশী’ও বলা হয়। কারণ এদিন ১৪ জন যমের উদ্দেশ্যে তর্পণ করতে হয়। এ ১৪ জন যমরাজ হলেন- ধর্মরাজ, মৃত্যু, অন্তক, বৈবস্বত, কাল, সর্বভূতক্ষয়, যম, উড়ুম্বর, দধ্ন, নীন, পরমেষ্ঠী, বৃকোদর, চিত্র ও চিত্রগুপ্ত।

কালীপূজার আরেক নাম দীপাবলি উৎসব। এ উৎসবের উল্লেখযোগ্য দিক হল দীপমালার সজ্জা। দীপমালায় সেজে ওঠে ঘর আঙ্গন। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সনাতনী পুরাণ-শাস্ত্রগুলোর নানা কাহিনী। সনাতন ধর্মের ৫টি উপ-বিভাগ রয়েছে। এগুলো হল; শিবের উপাসক বা শৈব, বিষ্ণুর উপাসক বা বৈষ্ণব, শক্তির উপাসক বা শাক্ত, গণেশের উপাসক বা গাণপত এবং সূর্যের উপাসক বা সৌরী। এদের মধ্যে অন্যতম শাক্তদের প্রাধান্য বাংলায় বেশি। অতি প্রাচীনকাল থেকেই বাংলায় এ ধারা চলে আসছে। বাংলার উৎসব মরশুমে এ শক্তি আরাধনাই হয় দুর্গা ও কালীপূজার মধ্যে দিয়ে। এছাড়া মধ্যযুগের চৈতন্যদেব প্রবর্তিত গৌড়ীয় বৈষ্ণব ভাবধারার প্রাধান্যও লক্ষ্য করা যায় বাংলার শক্তি আরাধনার ক্ষেত্রে।

দেবীপক্ষের শেষ দিন অর্থাৎ আশ্বিনের শুক্লপক্ষের পূর্ণিমায় হয় কোজাগরী লক্ষ্মীপূজা। তার ঠিক পনের দিন পরে কার্তিক অমাবস্যায় দীপাবলির দিন হয় কালীপূজা। সনাতন ধর্মের পুরাণ-শাস্ত্র অনুসারে দেবী কালিকা দুর্গারই আরেক রূপ। শক্তির উপাসকরা দীপাবলির দিন কালীপূজা করেন আর সেদিন বাংলাসহ ভারতীয় উপমহাদেশের বিষ্ণুর উপাসকরা আরাধনা করেন মহালক্ষ্মীর। কারণ প্রচলিত বিশ্বাস, কার্তিক মাসের কৃষ্ণপক্ষের ত্রয়োদশী তিথিতেই সহস্র ফণার ছত্র মাথায় নিয়ে সমুদ্র থেকে ওঠে এসেছিলেন ধন্বন্তরি দেবী লক্ষ্মী। তাই এ তিথির নাম ধন্বন্তরি ত্রয়োদশী বা সহজ কথায় ধনতেরাস। সেদিন দেবী লক্ষ্মীকে স্বর্গে বরণ করে নেওয়ার জন্য স্বর্গকে সাজিয়ে তোলা হয়েছিল আলোকমালায়। ‘ধনতেরাস উৎসব’ দিয়ে শুরু হয় পাঁচ দিনের দীপাবলি উৎসব এবং শেষ হয় ‘ভাই দুজ’ অর্থাৎ আমাদের বাঙালিদের ‘ভ্রাতৃ দ্বিতীয়া’ উৎসব বা ‘ভাই ফোঁটা’ উৎসবের মাধ্যমে। এ পাঁচ দিন যাবৎ দেওয়ালি বা দীপাবলি উৎসব মহা আড়ম্বরে পালিত হয়।

মৎস্যপুরাণ মতে, স্বয়ং বামনরূপী বিষ্ণু কার্তিকী অমাবস্যার রাতেই বলিরাজকে পরাজিত করেন। কালীপূজার রাতে দীপান্বিতায় অলক্ষ্মীর বিদায় ও মহালক্ষ্মীর পূজা দিয়ে সূচনা হয় বাংলার কার্তিক, পৌষ, চৈত্র ও ভাদ্র মাসের লক্ষ্মীপূজার। বাংলায় এটা কালীপূজার সঙ্গে জড়িয়ে আছে। চৈতন্যদেবের সমসাময়িক শক্তি সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লৌকিক দেব-দেবীদের একত্রিত করে দেবী কালিকার এক সুসংহত রূপ প্রদান করেছিলেন এবং সে দেবীকেই গ্রহণ করা হল রাত্রি (অন্ধকার) ও মৃত্যুর অধিদেবতা রূপে। কারণ, মৃত্যুকে জয় করার বাসনায় মত্ত ভক্তরা তাঁকে তুষ্ট রাখার জন্য দীপ জ্বালিয়ে মৃত্যুদেবতার আরাধনা অর্থাৎ দীপাবলি উদযাপন করেন।

ঠিক একই উদ্দেশ্যে চীন ও জাপানেও দীপাবলি উৎসব পালন করা হয়। জাপানে এ উৎসব চলার সময় তিনদিন পর্যন্ত ঘর ঝাট্ দেন না। তাঁদের বিশ্বাস-এ তিনদিন ঘর ঝাট্ দিলে লক্ষ্মী বিদায় নেবেন এবং এ সময় তাঁদের পূর্বপুরুষদের আত্মা বাড়িতে অতিথি হয়ে আসে। কার্তিকী অমাবস্যার দিন চীনে অশুভ আত্মারা যাতে বাড়িতে প্রবেশ করতে না পারে সেজন্য তাঁরা ওইদিন লাল রঙের মানুষ বানিয়ে বাড়ির সামনে দাঁড় করিয়ে দেন এবং তাঁদের পূর্বপুরুষ ও দেবতাদের উদ্দেশ্যে পূজা দেন। কয়েক সপ্তাহ ধরে এ উৎসব চলে চীনে।

রামায়ণের এক কাহিনী মতে, ভগবান রামচন্দ্র বিষ্ণুর সপ্তম অবতার হিসেবে স্বীকৃত। তাই ভগবান রামচন্দ্রের লীলাসঙ্গিনী সীতার পরিচিতি লক্ষ্মী হিসেবে। লঙ্কা বিজয়ের পর যেদিন সীতা ও লক্ষ্মণকে নিয়ে ভগবান রামচন্দ্র অযোধ্যায় ফিরেছিলেন, সেদিন তিথি ছিল কার্তিক অমাবস্যা। সেদিন সীতারূপী লক্ষ্মীদেবীকে বরণ করে নেওয়ার জন্য অযোধ্যাবাসী অযোধ্যা নগরীকে অগণিত দীপমালায় সাজানো হয়েছিল। সেদিনটিকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য দীপাবলি উৎসব উদযাপন করা হয় বলে অনেকের বিশ্বাস। আবার মহাভারতের এক কাহিনী মতে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ দেবতাদের অনুরোধে অত্যাচারী নরকাসুরকে বধ করে নরকাসুরের কারাগার থেকে ১৬ হাজার গোপিনীদের মুক্ত করেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের ভক্ত-অনুগামীদের কাছে ওই গোপিনীদের মুক্তির স্মরণ উৎসবই দীপাবলি। দক্ষিণ ভারতের কেরালা ও তামিলনাড়–তে দীপাবলি উৎসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে নরকাসুর বধের গল্প।

মহারাষ্ট্রবাসী আবার কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীর দিন ‘গো-মাতা’র পূজা করেন। মারাঠিদের প্রাচীন আখ্যান মতে, পুরাকালে ভিনা নামের একজন খুবই অত্যাচারী শাসক ছিলেন। তিনি প্রজাদের ওপর খুবই অত্যাচার করতেন। ফলে পৃথিবী ক্রমশ নিষ্ফলা হয়ে পড়েছিল। ফলে রাজা ভিনার পুত্র পৃথু এ পৃথিবীকে দেবতাজ্ঞানে পূজা করতে লাগলেন। পৃথিবী তখন গাভীর রূপ ধারণ করে অনর্গল দুগ্ধদানে রাজ্যকে আবার সুফলা-সুজলা-শস্য-শ্যামলা করে তোলেন। এরপর থেকেই মারাঠি সম্প্রদায়ের লোকজন কৃষ্ণপক্ষের দ্বাদশীর দিন ‘গো-মাতা’ পূজা করেন।

পাঞ্জাবে দীপাবলি পালিত হয় শিখ গুরু গোবিন্দ সিংহের মুক্তির দিনটিকে স্মরণ করে। বাদশা আওরঙ্গজেবের কারাগার থেকে যেদিন তিনি মুক্তি পান সেদিন রাজ্যের জনগণ প্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেন। সেদিন থেকে পাঞ্জাবে এদিন জাঁকজমক সহকারে দীপাবলি পালিত হয়।

জৈন ধর্মাম্বলীরা মনে করেন, মহাবীরের মৃত্যুতে জ্ঞানের উজ্জ্বল শিখা নিভে গিয়েছিল। তাই তারা তার অভাব মেটাতেই এবং মহাবীরের মৃত্যুর দিনটিকে স্মরণ করে দীপাবলি উৎসব পালন করেন। তাছাড়া, দিনটি ছিল রাজা বিক্রমাদিত্যের জন্মদিন এবং বিক্রমাব্দের শুরু। এদিন তাদের নতুন বছর শুরু হয়।
নেপালের লোকজন দীপাবলি উৎসবকে বন্ধুত্বের অনুষ্ঠান হিসেবে দেখেন। তারা বিশ্বাস করেন, বন্ধুত্ব শুধু মানুষের সঙ্গে হয়না, অন্যান্য প্রাণীদের সঙ্গেও হয়। তাই তারা দীপাবলির প্রথমদিন কাক, দ্বিতীয়দিন কুকুর, তৃতীয়দিন গরু, চতুর্থদিন অন্যান্য প্রাণী এবং শেষ দিনে একে-অপরের হাতে রাখি পরিয়ে মৈত্রীর বন্ধন আরও দৃঢ় করেন।

পরিশেষে বলা যায়, দুর্গা পূজার মত কালীপূজাও বর্তমানে সর্বজনীন রূপ পেয়েছে। আর বাণিজ্যিকরণের হাত ধরে বেড়েছে সেসব পূজার জৌলুষ ও জাঁকজমক আয়োজন। ভক্তি আরাধনার থেকেও এগুলোতে বাড়ছে থিমের লড়াই ও হৈ-হুল্লোড়। তবে এ ঘরোয়া রূপটিও সমানভাবে বেড়েছে, বেড়েছে উপলক্ষ্য বিশেষে গৃহস্থের ঘরে মায়ের পূজা। অশুভ শক্তির বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ কালীমায়ের কাছে প্রার্থনা করেন শ্রীবৃদ্ধি ও ঐশ্বর্য লাভের।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test