E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

কেন এই বিপর্যয়?

২০২৩ নভেম্বর ১৩ ১৭:০০:২৬
কেন এই বিপর্যয়?

মীর আব্দুল আলীম


বাংলাদেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঝড়, জলোচ্ছাস, বজ্রপাত বেড়েছে। এতো তাপমাত্রা দেখিনি কখনো। বিশ্বে বজ্রপাতে মৃত্যুর হার বাংলাদেশ নাকি এখন শীর্ষে। ঢাকা বিশ্বের অবাসযোগ্য নগরির একটি এখন। এমন কেন হচ্ছে? কেন এই প্রাকৃতিক বিপর্যয়? জনসংখ্যার আধিক্য, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়া, সুষ্ঠু নদী ব্যবস্থাপনার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মানুষের জ্ঞান ও সচেতনতার ঘাটতির কারণে এই সমস্যা সময়ের সঙ্গে প্রকট হচ্ছে । মনুষ্য সৃষ্ট ঘটনা যা পরিবেশের ভারসাম্য অবস্থার বিচ্যুতি ঘটিয়ে বাংলাদেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে সাময়িকভাবে ব্যাহত করছে। গত কয়েক দশকে জনসংখ্যার চাপ বেড়েছে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন, উন্নয়ন কার্যক্রম, নির্বিচারে বৃক্ষনিধন, বনজসম্পদ আহরণসহ নানা কারণে বাংলাদেশে জলাশয় এবং বনভূমির পরিমাণ কমে আসছে। বাংলাদেশ বন অধিদফতরের হিসাব মতে, দেশের মোট ভূমির ১৭ দশমিক ৫ শতাংশ বনভূমি হিসেবে চিহ্নিত থাকলেও প্রকৃত বন আচ্ছাদিত বনভূমির পরিমাণ আট ভাগের বেশি নয়। যা কিনা অর্ধেকেরও কম। তাহলেতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটবেই।

বাংলাদেশ একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ দেশ। দেশটির ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রভাব দিনদিন বেড়ে চলেছে । জনসংখ্যার আধিক্য, অপরিকল্পিত নগরায়ন, বনভূমি উজাড় হয়ে যাওয়া, সুষ্ঠু নদী ব্যবস্থাপনার অভাব, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং মানুষের জ্ঞান ও
সচেতনতার ঘাটতির কারণে এই সমস্যা সময়ের সঙ্গে প্রকট হচ্ছে। দেশী এবং আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে, আগামী ২০৮০ সাল নাগাদ সমুদ্রতল ৯ থেকে ৪৮ সেন্টিমিটার এবং কার্বন নির্গমনের উচ্চহারে যে বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়ছে তার ফলে সমুদ্রতল ১৬ থেকে ৬৯ সেন্টিমিটার পর্যন্ত বাড়বে। ঐযে আমরা পরিবেশকে যেভাবে খুঁচিয়ে খুচিয়ে রক্তাক্ত করছি পরিবেশতো ফুঁসে উঠবেই। পরিবেশ তার প্রতিশোধ নিতে বাধ্য। এসব কারনেই পরিবেশ বিদরা বলছেন ২০৮০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের ভূমির এক-তৃতীয়াংশ পানিতে নিমজ্জিত হবে। এর ফলে সমুদ্রের কাছাকাছি অঞ্চলগুলোর মনুষ বাস্তুভিটা হারাবে। নদ-নদীতে লোনা পানির পরিমাণ বেড়ে যাবে, বাড়বে শরণার্থীর সংখ্যা। ২০ থেকে ৩০ শতাংশ প্রজাতি বিলুপ্তির মুখে পড়বে এবং দেশে বিশুদ্ধ পানির সঙ্কট বেড়ে যাবে। পৃথিবীর তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে স্বাস্থ্য সমস্যা বাড়বে, হেপাটাইটিস-বি, সংক্রামক ব্যাধি, মেনিনজাইটির মতো গ্রীষ্মকালীন রোগ বৃদ্ধি পাবে। সেই সঙ্গে সূর্যের বিকিরণকৃত আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মিও অনুপ্রবেশ বৃদ্ধির কারণে ত্বক ক্যান্সার ও চোখের ছানি পড়া রোগ বৃদ্ধি পাবে। এমনকি খাদ্যশস্যে তেজস্ক্রিয়তা বেড়ে
যাবে। একই সঙ্গে খাদ্যাভাব দেখা দেবে। এটা শংকারই কথা। বন্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ১২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে।

বাংলাদেশের ভূ-প্রাকৃতিক অবস্থানের কারণে হিমালয়ের বরফগলা পানিসহ উজানের নেপাল ও ভারতের বৃষ্টিপাতের পানি, বাংলাদেশের প্রধান নদনদী হয়ে সমুদ্রে গিয়ে পড়ে। দেখা যায়, প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১০৯৪ মিলিয়ন কিউবিক মিটার পানি বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে এবং ১৫ লাখ হেক্টর চাষের জমি বন্যা ও জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে। জলবায়ু পরিবর্তন এদেশের কৃষিখাতে ব্যাপক বিরূপ প্রভাব ফেলছে। মৌসুমী বৃষ্টিপাত এবং নাতিশীতোষ্ণ তাপমাত্রার কারণে এদেশের প্রধান অর্থকারী ফসল হচ্ছে ধান। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের তীব্র প্রভাবে দিনে দিনে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে ধানচাষ। অসময়ে বন্যা, বৃষ্টি এবং প্রবল শিলাবৃষ্টির কারণেও ধানচাষ ব্যাহত হচ্ছে। বাংলাদেশের সোনালি আঁশ, পাটের উৎপাদন কমে যাওয়ায় চাষিরা পাট চাষে বিমুখ হয়ে পড়ছেন।
পাট চাষের ক্রমাবনতির জন্য বিশেষজ্ঞরা জলবায়ু পরিবর্তনকেই দায়ী করছেন। শীতকালের স্থায়িত্ব কমে যাওয়ায় রবিশস্যের জন্য প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে না। আবার শৈত্যপ্রবাহের ফলে সরিষা, মসুর, ছোলাসহ বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এর কারণ হচ্ছে, সারাবিশ্বে জলবায়ু পরিবর্তন।

জলবায়ুর পরিবর্তনটা বাংলাদেশে একটু বেমি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে মোট ৪ লাখ ১৬ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে, যার মধ্যে ১ লাখ ৫৮ হাজার ৩১ হেক্টর বনভূমি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার নামে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে এবং ২ লাখ ৬৮ হাজার ২৫৬ একর বনভূমি জবরদখল হয়েছে। ক্রমবর্ধমান ও অনিয়ন্ত্রিতভাবে বনভূমি ধ্বংসের কারণে এরই মধ্যে বন্যপ্রাণীর ৩৯টি প্রজাতি বাংলাদেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং রয়েল বেঙ্গল টাইগারসহ আরও প্রায় ৩০ প্রজাতির অস্তিত্ব মারাত্মক সংকটে রয়েছে, যা বনকেন্দ্রিক জীবনচক্র ও বাস্তুসংস্থানের জন্য অশনিসংকেত। আরো কারন অনেক আছে। আমরাতো গিনিপিক! যত পরীক্ষি নিরিক্ষা আমাদের উপর হয়। যত নোংড়া,
দুষিত, দুষনকারী শিল্প আমাদের এখানে গড়ে উন্নত বিশ্ব নিরাপদ থাকছে।

প্লাষ্টিক কারখানায়, ক্যমিক্যাল ফ্যাক্টরি এমনকি সারা বিশ্বের পুরনো জাহাজভাঙ্গার কাজটিও আমাদের দিয়ে করাচ্ছে উন্নত বিশ্ব। এসিড, প্লাষ্টিক, ব্যাটারী বহু কারখানা আমাদের দেশে গড়েছে চায়নাসহ বিভিন্ন দেশের উদ্যোগতারা। এসব কারখানাগুলো প্রতিদিন আমাদের বাতাশে বিষ ছড়িয়ে দিচ্ছে যা
পরবর্তিতে মানব দেহে যাচ্ছে। একদিকে মানুষের জীবন নাশের করন হচ্ছে অন্য দিকে পরিবেশের বারটা বাজছে। পুররেনা জাহাজ এখন আমাদের সমুদ্র পাড়ে দেদারছে কাটা হচ্ছে। একটি পুরনো জাহাজ থেকে বিষাক্ত তেলসহ প্লাষ্টি সামগ্রী সব সাগরে আর লোকালণয়ে একাকার হচ্ছে। এটা আসলে কারো দোস না আমরা গরিব বলে ক’টা পয়সার জন্য পরিবেশটা গলা টিপে হত্যা করছি আমরা।
এটাও সত্য যে, অপরিকল্পিত শিল্পায়ন (যত্রতত্র) এবং অপরিকল্পিত নগরায়নই পরিবেশ দূষণের মূল কারণ। অর্থনৈতিক উন্নয়ন হতে হবে পরিবেশসম্মত এবং সামাজিকভাবে ন্যায্য, তা না হলে উন্নয়ন টেকসই হবে না বরং জনজীবনে নেমে আসবে বিপর্যয়। বাংলাদেশের বর্তমান পরিবেশ বিপর্যয়ে বায়ূদূষণ, পানিদূষণ ও মাটি দূষণসহ প্রাকৃতিক বনসম্পদ, জলাশয় এবং কৃষিজমির ওপর অযাচিত চাপের কারণে জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।মেহেদী আহসান আরও বলেন, পরিবেশের সুরক্ষা এবং ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান আইন যথেষ্ট নয়। যেসব আইন আছে সেসবের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে পরিবেশ দূষণ মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। পরিবেশ দূষণের প্রধান দুটি কারণের মধ্যে অপরিকল্পিত শিল্পায়ন এবং অপরিকল্পিত নগরায়ন ঠেকাতে প্রয়োজন নগর, গ্রাম এবং অঞ্চল পরিকল্পনা আইন। এ ছাড়া পলিথিন ও প্লাস্টিক পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ, যা অতি দ্রুত বিকল্প
ব্যবস্থা নিয়ে বন্ধ করা প্রয়োজন।

ভয়ের কথা হলো জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, গত ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রাকৃতিক বিপর্যয়বহির্ভূত কারণে পরিবেশ বিপর্যয় ৪৩% বৃদ্ধি পেয়েছে। এ তথ্যই বলে দিচ্ছে আমরা কতটা অনিরাপদ ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং স্বাস্থ্যগত উন্নয়নের পথে একটি বড় বাধা। দীর্ঘদিন যাবৎ এদেশের প্রথিতযশা পরিবেশবিদগণ এবং পরিবেশবাদী বেশ কয়েকটি সংগঠন এই অপরিকল্পিত নগরায়ণের বিরুদ্ধে বেশ সোচ্চার ভূমিকা পালন করে আসছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের ভালো কিছু কাজ এখনো আমাদের চোখে পরে না। তবে দুষনকারী শিল্প প্রতিষ্ঠান, নদীদুষণকারী এবং নদী হন্তারকদের সাথে যে তাতের বেশ সখ্যতা তা বেশ চোখে পরে। পত্রিকায় ওসব প্রতিষ্ঠানের সাথে সম্পর্ক ভালো থাকার কারন হিসাবে মাসোহারার কথা শুনি আমরা। বেড়ায় যদি ক্ষেত খায় তাহলে ফসল রক্ষা করবে কে? আমাদের দেশের পরিবেশ অধিদপ্তরের কাজে খুশি হওয়ার কোন কিছুই নেই। এ প্রতিষ্ঠানটি স্বাধীন এবয় স্ততার সাথে কাজ করলে আমাদের পরিবেশের বারোটা বাজতো না।

আল্লাহর সৃষ্টি পশু-পাখি, গাছপালা, নদী-নালা, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, বনজঙ্গল, আগুন, পানি ও বায়ু এর সবই মানুষের উপকারী ও পরিবেশবান্ধব। আর মানুষই এসব ধ্বংশ করছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষাকারী এসব নিয়ামতের অপব্যবহার ও অবাঞ্ছিত পরিবর্তনের মাধ্যমে মানুষ সীমা লঙ্ঘন করে প্রতিনিয়ত পরিবেশকে দূষিত করে চলেছে। মনুষ্য সৃষ্ট পরিবেশদূষণের কারণের মধ্যে পানিদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, বৃক্ষনিধন, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস অন্যতম প্রধান। যুগ যুগ ধরে মানুষ নিজের ব্যক্তিস্বার্থে মজে ও জীবনের উন্নয়নের জন্য পরিবেশের ওপর নির্মম অত্যাচার চালিয়েছে। মানুষের অপতৎপরতা, বিশেষ করে বিজ্ঞানের উন্নতির পর থেকে দ্রুতগতিতে বিস্তার লাভ অজস্র ছোট-বড় প্রাণী, গাছগাছালি ও প্রাকৃতিক সম্পদের বিনাশ সাধন করেছে। এসবের অবশ্যম্ভাবী ক্ষতির প্রভাব পড়তে শুরু করেছে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে। এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার যে, জলবায়ু আমাদের অস্তিত্ব সংকটের কারণ হয়ে উঠছে। আমাদের আগামী প্রজন্ম একটা সুন্দর পৃথিবী পাক, সেজন্য আমাদের এখনই ভাবতে হবে। আমরা যখন পরিবেশ নিয়ে ভাবনায় পরে গেছি ঠিক তখনই কার্বন-ডাই-অক্সাইডের খনি তৈরি হচ্ছে বাগেরহাটের রামপালে। নির্মাণাধীন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রটি বলে দিচ্ছে পরিবেশ নিয়ে কতটা সচেতন আমরা। ২০১২ সালের ২৯ জনুয়ারি এ বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ নিয়ে দেশে যথেষ্ট হৈ চৈ হয়েছে। কে শোনে কার কথা।

এ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে কয়লা ব্যবহার করা হবে। এজন্য বছরে ৪ মিলিয়ন টন কয়লা আমদানি করতে হবে। বিদ্যুৎ আমাদের দরকার সন্দেহ নেই। কিন্তু কয়লা পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে, তাতে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে। এ বিষয়টি আমরা মোটেও বিবেচনায় নিচ্ছি না। ভারতীয় ন্যাশনাল থার্মাল পাওয়ারের সঙ্গে একটি চুক্তি হয়েছে। কিন্তু নিয়মনুসারে পরিবেশের প্রভাব নিরূপণের জন্য ইআইএ সমীক্ষা তা কি করা হয়েছে? হয়নি। রামপালের গৌরম্ভর কৈকরদশকাঠি ও সাতমারী মৌজায় ১ হাজার ৮৪৭ একর জমিতে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি নির্মিত হবে, যা সুন্দরবন থেকে মাত্র ১৬ কিলোমিটার দূরে। কয়লা পোড়ানো হলে কার্বন-ডাই-অক্সাইড, সালফার, নাইট্রিক এসিড বায়ুমন্ডলে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। এতে এসিড বৃষ্টি হবে। কি পরিমাণ পরিবেশ বিপর্যয় ঘটবে, তা এখনি ভেবে দেখা দরকার। গাছপালা মরে যাবে। সুন্দরবন উজাড় হবে। পশু-পাখির প্রজনন বাধাগ্রস্ত হবে। ধ্বংস হয়ে যাবে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আজ যেখানে বিশ্ববাসীকে ভাবিয়ে তুলছে সেখানে আমরা এমন অসচেতন হই কি করে?

পরিবেশ দূষণে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে পৃথিবীর বহু দেশে সৃষ্টি হচ্ছে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তবে শতকরা বিশ থেকে পঁিচশ ভাগ জলবায়ু পরিবর্তন প্রাকৃতিক কারণে হয়তাে হতে পারে। তবে বেশিরভাগ পরিবর্তন হচ্ছে মনুষ্য সৃষ্ট। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী শিল্পোন্নত দেশগুলো। এদের অতি ভোগবিলাসিতা ও যন্ত্রনির্ভরশীলতার জন্য পৃথিবীতে গ্রিন হাউস গ্যাসের পরিমাণ বেড়ে যাচ্ছে। এসব দেশের কলকারখানা ও গাড়ি থেকে অতিমাত্রায় কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের ফলে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তর ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। সেই সঙ্গে বাড়ছে তাপমাত্রা। তাতে মেরু অঞ্চল ও বিভিন্ন পর্বতে জমে থাকা বরফ গলে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। সমুদ্র ও নদীর কম্পন বাড়ছে। ফলে নদী ও সমুদ্রের উপকূলে ভাঙনের হারও বেড়ে যাচ্ছে।

বাংলাদেশসহ বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে । জলবায়ু পরিবর্তন ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের কারণে দেশের বেশিরভাগ নদী শুকিয়ে যাচ্ছে । পলি জমে বেশকিছু নদী দেশের মানচিত্র থেকে হারিয়ে গেছে। দেশের প্রধান নদীগুলো বিভিন্ন স্থানে এসে ভরাট হয়ে যাচ্ছে। পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও যমুনার মাধ্যমে হিমালয় থেকে ভারত হয়ে বাংলাদেশের নদীগুলোতে পানি এলেও এগুলোর স্রোতধারা অনেকটা কমে গেছে । ব্রহ্মপুত্রের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। পদ্মার বুকেও বিভিন্ন স্থানে চর পড়ে নদী ভরাট হয়ে যাচ্ছে। ফারাক্কার প্রভাবে গত তিন দশকে বাংলাদেশের আশিটি নদীর ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়েছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদী হিসেবে পরিচিত দেশের সতেরটি নদী মরা নদীতে পরিণত হয়েছে। আরও আটটি নদী মৃতপ্রায়। এসব নদী ড্রেজিং করে সচল করারও কোনাে ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। ফলে বর্ষাকালে নদীর উপচে পড়া পানি প্লাবিত করে ফসলের মাঠ, জনবসতি। প্রতি বছরই বন্যা এদেশের নিয়তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। বন উজাড় করাও প্রাকৃতিক দুর্যোগের আরেকটি কারণ। প্রত্যেক দেশের মোট আয়তনের পঁচিশ ভাগ বনাঞ্চল থাকা যেখানে প্রয়োজন সেখানে বাংলাদেশে সরকারি হিসাবে মাত্র ষোল ভাগ বনাঞ্চল রয়েছে।

পরিবেশ বিজ্ঞানীদের মতে, কোন দেশের মোট আয়তনের ২৫ শতাংশ বনভূমি প্রয়োজন। অথচ আমাদের দেশে সরকারী হিসাব মতে মাত্র ১৯ শতাংশ বনভূমি রয়েছে। আর বেসরকারী হিসেবে এর পরিমাণ ৯ শতাংশের বেশি নেই। বাসগৃহ ও আসবাবপত্র তৈরিতে এবং জ্বালানির চাহিদা মেটাতে সংগ্রহ করা হয় কাঠ। এ জন্যে ব্যাপকহারে বন উজাড় করা হচ্ছে। পৃথিবীকে বাঁচিয়ে রাখতে বৃক্ষের অপরিহার্যতা অসামান্য। বৃক্ষ প্রতিনিয়ত বাতাস থেকে কার্বনডাই অক্সাইড গ্রহণ করে এবং অক্সিজেন ত্যাগ করে পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে। অর্থাৎ গাছের মূল থেকে সংগৃহীত পানি ও কার্বন-ডাই-অক্সাইড সূর্যের আলোর উপস্থিতিতে বিক্রিয়া করে অক্সিজেন ও গ্লুকোজ উৎপন্ন করে। গাছের আর একটি বিশেষ গুণ হল নিজের খাদ্য নিজে প্রস্তুত করতে পারে। প্রাণী তা পারে না। বরং উদ্ভিদের উপর নির্ভরশীল হয়ে বেঁচে আছে। পরিতাপের বিষয় যে, মনুষ এই কল্যাণময় পরিবেশ ও বনভূমির উপর অত্যাচার করে চলেছে। নির্বিচারে উজাড় করা হচ্ছে বৃক্ষরাজি। ২০০০ সালে জাতিসংঘের বনজ সম্পদ নিয়ে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছিল যে, ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে আমাদের দেশের সবচেয়ে উন্নত বনাঞ্চলের পরিমাণ ৪৫০ হেক্টর থেকে ২০০ হাজার হেক্টরে এসে দাঁড়িয়েছে। এভাবে বৃক্ষ নিধন চলতে থাকলে পরিবেশের অবস্থা খুবই ভয়াবহরূপ ধারণ করবে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্যহীনতা এবং এ কারণে অতিমাত্রায় অনাবৃষ্টি ও খরার কবলে পড়তে হচ্ছে। আরও একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলোর অযাচিত ও অনিয়ন্ত্রিত কার্যক্রমের ফলে জলবায়ু পরিবর্তনের মাত্রা বেড়েছে আরও প্রকটভাবে।

পুঁজিবাদী স্বার্থান্বেষী শিল্পোন্নত রাষ্ট্রগুলো করপোরেট সমাজের স্বার্থের কাছে পরাজিত হয়ে জলবায়ু পরিবর্তন ও দূষণ প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ব্যর্থ হচ্ছে। আর এর কুফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে বাংলাদেশ বিশ্বে শীর্ষ অবস্থানে আছে এমন আভাস আমরা অনেক আগেই পেয়েছি। জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কায় মারাত্মকভাবে ভুগবে বাংলাদেশসহ এশিয়া অঞ্চলের দেশগুলো। অনাবৃষ্টি ও অতিবৃষ্টির কারণে সৃষ্ট বন্যায় ভোগান্তির শিকার হবে এসব অঞ্চলের দুই বিলিয়ন মনুষ। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে দক্ষিণ এশিয়া ও পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো সবচেয়ে খারাপ মৌসুমী আবহাওয়ার মধ্যে পড়বে। ইতিমধ্যে এ অঞ্চলের দেশগুলোয় অতিবৃষ্টি ও অনাবৃষ্টি লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অদূরভবিষ্যতে এর প্রভাব দৈনন্দিন জীবন থেকে শুরু থেকে কৃষিসহ সব ক্ষেত্রে পড়তে শুরু করবে। জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর ‘বিজনেস অ্যাজ ইউজুয়াল’ পটভূমিতে হিসাব করে দেখিয়েছে যে, ২১০০ সালের মধ্যে পৃথিবীর উষ্ণতা ৪.২ ডিগ্রি বাড়বে। জলবায়ুর পরিবর্তন এর নেতিবাচক দিক ভেবে মানবসভ্যতা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত।

আইপিসিসি’র দাবি অনুসারে, বর্তমান সময়টি হলো গত ১০০০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণ। উন্নত বিশ্বের জীবাশ্ম জ্বালানির ফলে বায়ুদূষণ প্রতিক্রিয়ার ফলে ২০৬০ সালের পরে নন মেলানোমা স্কিন ক্যান্সারের ঘটনা সংখ্যা শতকরা ৬ থেকে ৩৫ ভাগ বৃদ্ধি পাবে। সমুদ্র উচ্চতা বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে বৃহৎ শহর ও উপকূলের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত করে লাখ লাখ জনসাধারণকে স্থানান্তরিত হতে বাধ্য করবে। এটি তৈরি করবে খাদ্য ঘাটতি এবং তার প্রেক্ষিতে কিছু কিছু অঞ্চলে দুর্ভিক্ষও দেখা দিতে পারে। অপেক্ষাকৃত উষ্ণ ও আর্দ্র অবস্থা, অন্যান্য বিষাক্ত উৎপাদক, যেমন ফাঙ্গাস থেকে নিঃসৃত বিষাক্ত পদার্থ বৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করতে পারে। তার ফলে খাদ্য নষ্ট হওয়ার পরিমাণ সম্ভবত বৃদ্ধি পাবে। অতিরিক্ত তাপমাত্রার কারণে চাষাবাদের সময়কাল সঙ্কুচিত হতে পারে এবং উৎপাদনশীলতা কমে যেতে পারে। পৃথিবীর উষ্ণতা বাড়ার নেতিবাচক প্রভাব বনাঞ্চলে পড়লে প্রাকৃতিক ভারসাম্যে পরিবর্তন আসতে পারে। প্রাণিকূল, ভূমি, পানি ইত্যাদির ওপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে উপকূলীয় নিম্নাঞ্চলে বসবাসরত প্রায় দুই কোটি মনুষ বাস্তুহারা হবে। খরা, বন্যা ও লবণাক্ততার ফলে ফসলের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পাবে।

পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। জলবায়ুর পরিবর্তনে বাংলাদেশের দক্ষিণের বিরাট অংশ তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর মে-জুন এবং অক্টোবর-নভেম্বর মাসে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানছে। এ দুর্যোগ থেকে আমাদের পরিত্রাণের উপায় কি? পরিবেশ দূষণ নিজেদের মুক্ত রাখা, বিপন্ন পরিবেশের ব্যাপারে আওয়াজ তোলা, বিশ্ব বিবেককে জাগ্রত করা। বিগত দিনে আমরা দেখেছি, বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো উল্লিখিত বিষয়ে অনেক প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবতা হচ্ছে, এসব প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে শিল্পোন্নত দেশগুলো তেমন আন্তরিক নয়। কোনো কোনো প্রতিশ্রুতি অনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকার বিষয়টি উদ্বেগজনক। এবারও বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে নানা প্রতিশ্রুতির বাণী দেয়া হয়েছে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সম্মেলনে বাংলাদেশের বিপন্ন পরিবেশ নিয়ে জোরাল বক্তব্য দিয়েছেন। বিশ্ব নেতারা এ ব্যাপারে কতটুকু নজর দেবেন, এটাই এখন দেখার বিষয়।

পরিবেশ সচেতন হওয়ার সময় এখনই। আমাদেরকে পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগ নিতে হবে।
জলবায়ু ও দেশে পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে আরো বেশি সচেষ্ট হতে হবে। কেবল
সরকারের পক্ষেই পরিবেশ রক্ষা সম্ভব নয়; জনগণকেও এ বিষয়ে সচেতন হয়ে পরিবেশ
রক্ষায় ভূমিকা রাখতে হবে।

লেখক : চেয়ারপার্সন (পরিবেশ), লায়ন্স ক্লাব ইন্টারন্যাশনাল, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test