E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

কৃষকের রক্ত চোষা সিন্ডিকেটের কবর রচনা করুন

২০২৩ নভেম্বর ১৬ ১৬:৩৪:১৭
কৃষকের রক্ত চোষা সিন্ডিকেটের কবর রচনা করুন

মীর আব্দুল আলীম


কৃষিপণ্য একটু নেড়ে চেড়েই চোর-বাটপারের সিন্ডিকেট আগুলফুলে কলাগাছ হচ্ছে আর কৃষক দিনদিন গরিব হচ্ছে। ফসল ফলিয়েও খাবার পাচ্ছে না কৃষক। সিন্ডিকেট প্রতিনিয়ত কৃষকের রক্ত চুষে খাচ্ছে। রক্ত চোষা সিন্ডিকেটের কবর রচনা করতে না পারলে কৃষক ভোক্তা কেউ ভালো থাকবে না। ১০ টাকার আলু কিনতে হয় ৭০ টাকায়। আলু দিয়েই শুরু করলাম। প্রতিটা কৃসিপণ্যের অতিমুনাফা চুষে খাচ্ছে সিন্ডিকেটওয়ালারা। যখন কৃষকের আলু মাঠে থাকে তখন গুটি কয়েক সিন্ডিকেট এক হয়ে নিজেরাই নিজেদের মতো করে আলুর দাম বেঁধে নেয়। কেউ এ দামের বাইরে আলু কিনে না। বাধ্য হয়েই কৃষক সে দামে আলু বিক্রি করে। কৃষকের আলু যখন শেষ হয় আলু চলে যায় কোল্ডষ্টেরে। তখন থেকেই খেলাটা শুরু হয়। ধাপে ধাপে দাম বাড়তে থাকে। সিন্ডিকেট ওয়ালাদের ইচ্ছামতো দামও বাড়ে। এবার যেমন উঠেছে ৬০/৭০ টাকা কেজি। কৃষকের বিক্রি থেকে ফাড়াকটা কত হলো। ৭০-১০=৬০ টাকা।

যারা পাইকারী কিংবা খুচরা বেঁচেন তাঁরা কিন্তু কেজিতে মুনাফা করেন মাত্র ৫ টাকা থেকে বড়জোড় ১০টাকা। মাঝখানে ৫০ টাকা সিন্ডিকেট ওয়ালাদের হাতে চলে যাচ্ছে। কৃষক রাতদিন শরিরের ঘাম ঝড়িয়ে নেয্য মূল্য পায় না; আর এসিতে ক্যালকুলেটর টিপে সিন্ডিকেটওয়ালারা হাতিয়ে নেয় কেজিতে ৫০ টাকা। পিয়াজ, মরিচ, আদা, রসুন, সব্জি প্রতিটি পণ্যের ক্ষেত্রেই এমন হচ্ছে। কৃষক লাভবান হলে বাড়তি দাম পেলে আত্তি ছিলো না কোন। এভাবেই কৃষক এবং ভোক্তার পকেটের টাকা চলে যাচ্ছে চোর-বাটপারের সিন্ডিকেটের কাছে। তারা কৃষক এবং সাধারন মানুষের কোটিকোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

দেশের কৃষিভিত্তিক পাইকারি বাজার থেকে শুরু করে শহরের পাইিকারি বাজার সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। তাঁরা গ্রামের পাইকারি বাজারে কৃষি পণ্যের দাম যেভাবে বেঁধে দেয় শহরে এসেও তাঁরা ঐ পণ্যের দাম নিজেদের মতো করে মুনাফা ধরে পাইকারী আড়ত থেকে বিক্রি করে। এতে কৃষক দাম পায় না। ভোক্তারা অধিক দামে পণ্য কিনে প্রতিদিন ঠকছে। একটু উদাহরন দেয়া যাক। যশোরের বারবাজার পাইকারি হাটের কথা বলি। বেগুন, টমেটো, সিমসহ সকল সব্জি সিন্ডিকেট ওয়ালারা আগেই (রাতে) দাম নির্ধারন করে রাখে। সিমের কথা ধরি- সিন্ডিকেট ওয়ালারা রাতে দাম বেঁধে দিলো ২০ টাকা কেজি। সিন্ডিকেটেরসব সদস্য সেদিন ২০ টাকা দরেই সেদিন সিম কিবে। এর বেশিতে নয়। সবাই যখন ঐ দামে বেশি দেতে চাইবে না কৃষক ২০ টাকা কেজিতেই সিম বিক্রি করতে বাধ্য হয়।

নরসিংদি, কুমিল্লা, ময়মানসিংহ, মুন্সিগঞ্জসহ দেশের যেসব জায়গায় সব্জি উৎপাদন হয় সেসব এলাকার পাইকারী বাজারও নিয়ন্ত্রণ করে দেশের এই শক্তিশালী সিন্ডিকেট। তাদের নির্ধারণ করে দেওয়া দামেই কৃষক পণ্য বেঁচতে বাধ্য হয়। এই সিন্ডিকেট খুব শক্তিশালী। কেউকেউ সরকারদলে ঘাপটি মেরে আছে। যেকোন সরকারের সময়ই এরা বদলে যায়। সরকারি শক্তিকে কাজে লাগায়। তাই তাদের টিকিটিও ছঁতে পারে না কেউ। পণ্যের দাম যখন সীমানা ছাড়ায় সরকার সে পণ্যের দাম বেঁধে দেয়। সে দামে কিন্তু বিক্রি হয় না। বরং দামবেধে দেয়ার পর দাম আরো বাড়ে। ওরা যে সরকারের চেয়ে শক্তিশালী!

জেলা উপজেলার কৃষকরা প্রতিনিয়তই পাইকারি বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। যার ফলে হাতবদলে বাড়ে সবজির দাম। কৃষকের ক্ষেত থেকে সবজি যায় পাইকারি বাজারে, পাইকারি বাজার থেকে খুচরা বাজারে সবজির দামের ব্যবধান হয় আকাশ-পাতাল। কৃষক পর্যায় থেকে পাইকারি বাজারে দাম বেড়ে যাচ্ছে দ্বিগুণ এমনকি পাচঁ সাত গুণ পর্যন্ত বাড়ে। আর খুচরা বাজার থেকে ভোক্তাদের এই বাড়তি দামেই কিনতে হচ্ছে তা। এদেকে ন্যায্যমূল্যে শাক-সবজি বিক্রি করতে না পারায় কৃষকদের লোকসান গুণতে হচ্ছে প্রতি মৌসুমেই। তবে যুগ যুগ ধরে এই অবস্থা চলে এলেও কৃষকের ভাগ্যের কোনো উন্নতি হচ্ছে না। শীত বা গ্রীষ্মকালীন আগাম সবজির ক্ষেত্রে কৃষক কিছুটা বাড়তি মূল্য পেয়ে থাকলেও খুচরা পর্যায়ে এসব পণ্যের যে দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে তার তিন ভাগের এক ভাগও পায় না কৃষকরা। এভাবে তারা কুটবুদ্ধি আর ক্ষমতা প্রদর্শন করে দাম বাজার নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা ইচ্ছা মতো প্রণ্যের দাম কমাতে পারে, আবার বাড়াতেও পারে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।

বাজার নিয়ন্ত্রণে যেন দেশে কোনো অভিভাবক নেই। ইচ্ছামতো অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়াচ্ছে। লুটে নিচ্ছে মানুষের টাকা। কয়েক বছর ধরে বাজারের উচ্চমূল্য সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন ভোক্তারা। দফায় দফায় বিভিন্ন পণ্যের দাম বাড়িয়ে সুযোগ নিচ্ছে অসাধু ব্যবসায়ীরা। বাজার মনিটরিং না থাকার কারণে এমন অবস্থার জন্য দায়ী করছে মানুষ। বাজারে অসাধু ব্যবসায়ীদের কারসাজি নতুন নয়। সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে সব ধরনের নিত্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে গেছে। চলমান পরিস্থিতিতে স্বল্প আয়ের মানুষের নিত্যদিনের চাহিদায় কাটছাঁট করতে হচ্ছে। সবমিলে নিত্যপণ্যের বাড়তি দাম মেটাতে ভোক্তার হাঁসফাঁস অবস্থা। তারা বলছেন, সব কিছুর দাম বাড়ায় সংসার খরচ বেড়ে গেছে। যে কারণে আয়ের সিংহভাগ চলে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের পেছনে। চাহিদার সঙ্গে দাম যাতে না বাড়ে, সেজন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল সংস্থাগুলো দৃশ্যত কিছু বিশেষ ব্যবস্থাও নিয়ে থাকে। তবে আমাদের অভিজ্ঞতায় আছে, এসব ব্যবস্থা বাজার নিয়ন্ত্রণে ইতিবাচক তেমন প্রভাব ফেলতে পারে না। দেশের মানুষের ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধির কষ্ট শুরু হয়েছিল মূলত ২০২০ সালে মহামারি করোনা শুরুর পর থেকে। তখন লকডাউনে সবকিছু থমকে গেলেও মানুষের পেটে খাবার দেওয়া তো আর বন্ধ ছিল না। অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকলেও ভোগ্যপণ্যের ব্যবসা চলেছে রমরমা। সেই শুরু, তার পর থেকে দেশে ভোগ্যপণ্যের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানগুলো প্রতি মাসে এবং প্রতি বছরে পণ্য বিক্রি করে অস্বাভাবিক মুনাফা করছে। গত বছর থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ব বাজারে পণ্যমূল্য বেড়ে যায়।

এটিকে দেশের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়ানোর হাতিয়ার হিসেবে নিয়েছে। বিগত এক-দেড় বছরে ভোগ্যপণ্যের বাজারে বেশি সিন্ডিকেট হয়েছে। কখনো হয়েছে দেশের মানুষের প্রধান খাদ্যপণ্য চালের বাজারে, কখনো আটা-ময়দায় সিন্ডিকেট হয়েছে। এর পর কখনো সিন্ডিকেট হয়েছে মুরগির বাজারে, কখনো ডিমের বাজারে, কখনো হয়েছে পেঁয়াজে সিন্ডিকেট, আবার কখনো হয়েছে চিনিতে বা ভোজ্য তেলে। গরুর মাংসের বাজারেও সিন্ডিকেট। দফায় দফায় ৫০/১০০ টাকা কেজিতে বাড়িয়ে ৬ শ’ টাকার গরুর মাংসের দাম অল্প ব্যবধানে উঠেছে ৮শ’ টাকাতে। আবার বিশ্ব বাজারে দাম বৃদ্ধির দোহাই দিয়ে খাদ্য বহির্ভূত পণ্য যেমন- সবানা, পাউডার, টুথপেস্টের দামও সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে প্রায় দ্বিগুণ করা হয়েছে। গরম মসলার বাজারও সিন্ডিকেটের দখলে।

এদিকে চিনি নিয়ে যে সিন্ডিকেট তৈরি হয়েছিল, তা এখনও ভাঙা যায়নি। ব্যবসায়ীদের খোলা চিনি ১৪০ ও প্যাকেটজাত চিনির কেজি ১৫০ টাকা করার প্রস্তাবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সায় না দিলেও চিনি সিন্ডিকেট কিন্তু বাজারে বিক্রি করছে ওই দামেই। মাছ-মাংস ছেড়ে সবজি দিয়ে যে ভাত-রুটি খাবে সাধারণ মানুষ, সেটিও দুরূহ হয়ে পড়েছে। কারণ ৫০-৬০ টাকার নিচে মিলছে না কোনো সবজি। বৃষ্টির দোহাই দিয়ে সব ধরনের সবজির দাম বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

করপোরেট কোম্পানিগুলোর দৌরাত্ম্যে চালের দাম আর কমল না। এখনও চিকন চাল ৭০-৭৫ টাকা এবং মোটা চাল বিক্রি হচ্ছে ৫৪ থেকে ৫৮ টাকা কেজিতে। বিশ্ব বাজারের দোহাই দিয়ে দেশের বাজারে আটা-ময়দার দাম দুই-তিনগুণ বাড়িয়েছিল ব্যবসায়ীরা। বিশ্ববাজারে এখন গমের দাম অর্ধেকে নেমেছে, কিন্তু দেশের বাজারে আটা-ময়দার দাম আর না কমিয়ে ক্রেতার পকেট কাটছে ব্যবসায়ীরা। এভাবে একেক সময় একেক পণ্যে সিন্ডিকেট করে দাম বাড়িয়ে দেশের মানুষের পকেট কাটা হলেও মিলছে না কোনো প্রতিকার। দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বাজারে কর্তৃপক্ষের কোনো নিয়ন্ত্রণ বা নজরদারি নেই। সাধারণত পণ্যের সংকট থাকলে দাম বাড়ে। কিন্তু দেশে খাদ্যপণ্যের কোনো সংকট নেই। চালের উৎপাদন, বিপণন, মজুত ও আমদানি-সবকিছুতেই এবার রেকর্ড হয়েছে। তবুও চালের দাম এতো বেশি কেন?

উল্লেখ্য, বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে সরকার একটি আইন করেছে। এ আইনের প্রয়োগ নেই। অসাধু সিন্ডিকেটের কারসাজিতে প্রতি সপ্তাহে কোনো না কোনো পণ্যের দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের ঠকাচ্ছে। সরবরাহ স্বাভাবিক থাকলেও দাম বাড়িয়ে ভোক্তাকে নাজেহাল করা হচ্ছে। আমরা জানি, এসব পরিস্থিতি থেকে ভোক্তাকে রক্ষা করতে সরকারের একাধিক বাজার তদারকি সংস্থা কাজ করছে। এর মধ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তদারকি সেল, মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, কৃষি মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন কৃষি বিপণন অধিদপ্তর, বিএসটিআই, খাদ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন নিরাপদ খাদ্য অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন, জেলা প্রশাসন, র‌্যাবসহ সরকারের অন্যসব আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। এছাড়া এসব সংস্থা নিজস্ব আইনে বাজার তদারকি করছে। তারপরও বাজারে কোনো ধরনের শৃঙ্খলা আনা সম্ভব হয়নি কেন? হয়তে এই উত্তর কারো কাছে নেই। গোড়ায় গলদ? এদেশের সিন্ডিকেটওয়ালারা বড়ই প্রভাবশালী।

সরকারের লোকজনেরসাথে তাঁদের সখ্যতা অনেক। তাই হয়তো তাঁদের রোধ করা যায় না কিংব রোধ করা হয় না। এদেশের অসাধু ব্যবসায়ীরা চাইলে ভোগ্যপণ্যের বাজারে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করতে পারে বা পণ্যের সরবরাহ কমাতে পারে। কৌশল করে তারা দাম কমাতে পারে, আবার বাড়াতেও পারে। এখানে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ীর কারসাজিতে বছরের পর বছর ভোক্তারা ঠকছেন। সংস্থাগুলো জানে কে বা কারা পণ্যের দাম নিয়ে কারসাজি করছে। একাধিক বার তারা সেটা চিহ্নিত করেছে। কিন্তু অসাধুদের বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিতে পারছে না। পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণসহ বাজারে সঠিক পণ্যটি সঠিক দামে বিক্রি হচ্ছে কি না তা দেখতে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। ভেজাল খাদ্য রোধে মনিটরিং করতে হবে।

নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে গত ৫ বছরে জাতীয় পর্যায়ে পারিবারিক আয় বেড়েছে ৫৯ শতাংশ, আর খরচ বেড়েছে ৮৪.৫ শতাংশ। পারিবারিক ভোগ-ব্যয়ের অর্ধেকেরও বেশি প্রায় ৫৫ শতাংশ জুড়ে রয়েছে খাদ্য। সবচেয়ে কম আয়ের পরিবারে খাদ্যের পেছনে খরচ হয় ৭২ শতাংশ, সবচেয়ে বেশি আয়ের পরিবারে খাদ্যবহির্ভূত খাতে খরচ ৫৯ শতাংশ। যেসব পরিবারের আয় মাঝামাঝি পর্যায়ে, খাদ্যের পেছনে মোট সংসার খরচের ৬১ থেকে ৬৫ শতাংশ ব্যয় হয় তাদের। সবচেয়ে বেশি দরিদ্র পরিবারের সঙ্গে সমাজের উঁচু স্তররের মানুষের আয়ের বৈষম্য বেড়েছে। তবে পাঁচ বছরে দরিদ্র্র পরিবারের আয় খানিকটা বাড়লেও ধনীদের আয় কমেছে বলে এক জরিপে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্যবসায়ীরা নানা ফন্দি ফিকিরসহ ডলারের দাম বাড়ার অজুহাতে পণ্যমূল্য বাড়িয়ে তাঁর মুনাফা ঠিক রাখতে পারেন।

রিকশাওয়ালারা চালের দাম বাড়ার অজুহাত দেখিয়ে ভাড়া বাড়িয়ে নিতে পারেন। কিন্তু চাকরিজীবী আইজউদ্দিনরা তাঁদের বেতন চাইলেই বাড়াতে পারেন না। একটি পদের পেছনে যেখানে হাজার হাজার আবেদনপত্র পড়ে, সেখানে এক চাকরি ছেড়ে অন্য চাকরিতে ঢোকার সুযোগও নেই। ফলে একটু ভালো করে বাঁচার আশাটি আর তাঁদের পূরণ হচ্ছে না। ঢাকা মহানগরীতে সীমিত আয়ের মানুষের বসবাসের অর্থ দাঁড়িয়েছে ‘শুধু বেঁচে থাকার জন্য বেঁচে থাকা।’

যত কথাই বলা হোক, যত ভালো কথা, যত দামি কথা, সবকিছুই নিরর্থক, ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী গদ্যময়। এক কথায় বললে বলতে হয়, নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষের জীবনের চাকাই একরকম অচল হয়ে পড়ছে। এই অবস্থাকে কোনোমতেই দেশের ও সমাজের সুলক্ষণ বলা যায় না। যেমন করেই হোক, সর্বপ্রথমে সর্বাগ্রে মানুষের হাতে কাজ দিতে হবে। কর্মসংস্থান অর্থাৎ কাজে সুযোগ সৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। গত ৩৮ বছরে দেশে কর্মসংস্থানের পরিধি যতটা বাড়া উচিত ছিল তারা সামান্যতই মাত্র বেড়েছে। এর একটা বড় কারণ সরকার নিয়ন্ত্রিত শিল্প ও বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানে ক্রমাগত বিপর্যয়।

সব কিছুর দাম বাড়ছে অন্যদিকে মানুষের পকেটের টাকা কমছে। দেশে মাছ, মাংস, ডাল, চাল, চিনি, তেল, পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়তি। এতো বেশি দামে পণ্য কিনে সাধারন মানুষ কি করে খাবে? গ্যাস, বিদ্যুৎ, বাস ভাড়া বাড়ে। বাড়ি ভাড়া, শিক্ষা, চিকিৎসা খরচ সবকিছুর দামই বাড়ে, কিন্তু আয় বাড়ে না; কমছে দিনদিন। টাকার মান কমে যাওয়া, ডলারের উর্দ্ধগতি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, করোনা পরিস্থিতি আর মন্দ ব্যবসায় চাকরি চলে যাওয়া, বেতন কমে যাওয়ার ধাক্কা পড়েছে মধ্যবিত্ত আর গরিবের উপর। সবকিছুর দামই এখন আকাশ ছোঁয়া। তাহলে গরিবের জীবন চলবে কী করে? সামনে বিশ্ব মন্দার কথা শুনছি। দেখছি চাহিদার চেয়ে পণ্যের সর্বরাহ কমে যাচ্ছে দিনদিন। সব কিছুর দাম যখন হুহু করে বাড়ছে তখন সামনের দিন কেমন যাবে বেশ টের পাওয়া যাচ্ছে। উন্নত বিশ্বের মন্দার হোঁচটতো আমাদের মতো নির্ন্ম আয়ের (কথিত মধ্য আয়ের) দেশে একটু বেশিই পরবে মনে হয়।

সামনের দুর্দিনের ভাবনাটা এখনই ভাবতে হবে হয়তো। আগত মন্দা অবস্থা থেকে আমাদের পরিত্রাণের প্রধান উপায় হলো কৃষিজাত খাদ্যপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধি। এক্ষেত্রে কৃষি উৎপাদন বাড়ানের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে হবে। সেগুলো মোকাবিলায় উদ্যোগ নিতে হবে। অনাবাদী জমি চাষের আওতায় আনাতে হবে। বিশ্ব মন্দা শুরু হলে বাংলাদেশের জনগনের বাঁচার একটাই পথ কৃষি খাত আরও শক্তিশালী করা। মোট কথায় খাদ্যে নির্ভরতা বাড়ানো। যতই মন্দা আসুক তখন কৃষি খাতই আমাদের বাঁচিয়ে রাখের মুল পথ তৈরি করতে পারে হয়তো।

বিশ্বমন্দা শুরু হলে আরো অনেকেই চাকরি হারাবেন, পাশাপাশি বিদেশ থেকেও চলে আসতে হবে অনেক প্রবাসীদের। ঝুঁকির কথা ভেবে বুদ্ধিমান অনেকেই এখন শহর ছেড়ে গ্রামে ফিরছেন। এদেও কেউ পৈত্রিক অনাবাদী জমি কৃষির আওতায় আনছেন, পুকুরে মাছ চাষ করছেনর কেউ আবার হাস-মুরগীর খামার গড়ছেন। মানুষের কর্মসংস্থান করতে না পারলে গ্রামীণসহ সকল অর্থনীতি ঝুঁকিতে পড়তে পারে। ভবিষ্যতে দারিদ্র্য বিমোচন ও সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে নিরাপদ ও পুষ্টিকর খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি নির্দিষ্ট হারে খাদ্য সরবরাহ একান্ত প্রয়োজন। কৃষি ব্যবসা ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পই গ্রামীণ কর্মসংস্থানের মূল উৎসে পরিণত হবে। মাছ, দুগ্ধ, শস্য, পোলট্রি ও প্রাণিসম্পদ খাতের মাধ্যমেই চাকরি বা উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে এখনই। এ ব্যাপারে সরকারকে অনেক বেশি ভাবতে হবে। প্রচার প্রচারনাসহ জনগনকে উদ্বোদ্ধ করার কাজ করতে হবে।

কৃষিখাতে কর্মসংস্থান ক্রমাগত কমছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের আকাশছোঁয়া দাম, দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ না হওয়া প্রভৃতি কারণে অর্থনীতিতে এক ধরনের অনিশ্চয়তা চলছে। দেশের শ্রমজীবী মানুষ তারই শিকার। বেকার সমস্যা কম-বেশি সবসময়ই ছিল। এখন দিনে দিনে তা আরও ভয়াবহ ও প্রকট হয়ে উঠছে। সরকারি একটি বিভাগে ৪০৭ শূন্যপদে দরখাস্ত পড়েছিল ১১ লাখ। অন্য একটি বিভাগে ৩টি পদের জন্য আবেদনপত্র জমা পড়েছিল ১৫ হাজার। বোধ হয় দৃষ্টান্ত আর বাড়ানোর দরকার নেই। এসব থেকেই বোঝা যায়, দেশে বেকার সমস্যা অর্থাৎ কাজের অভাব কী তীব্র ও ভয়াবহ। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আকাশ ছোঁয়া মূল্যবৃদ্ধি।

এদিকে বাজারে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বমুখী দামের প্রভাব পড়েছে দেশের মূল্যস্ফীতির হিসাবে। বেড়েছে খাদ্য মূল্যস্ফীতি। জুন মাসে এই হার দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৭৩ শতাংশে, যা প্রায় দুই অঙ্ক ছুঁই ছুঁই। এর আগে গত বছরের আগস্টে এ হার দাঁড়িয়েছিল ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে। এরপর কমতে থাকে খাদ্য মূল্যস্ফীতির হার। এখন আবার বাড়তে শুরু করেছে। এর আগে মে মাসে মূল্যস্ফীতির এ হার ছিল ৯ দশমিক ২৪ শতাংশ এবং এপ্রিলে ছিল ৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ। তারও আগে ২০২২ সালের জুন মাসে খাদ্যে মূল্যস্ফীতি ছিল ৮ দশমিক ৩৭ শতাংশ। জাতীয় পর্যায়ে যেমন খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে গ্রাম ও শহর সর্বত্রই। পুরোপুরি সিন্ডিকেটের কব্জায় চলে গেছে দেশের ভোজ্যতেল, চাল, পিয়াজসহ নিত্য পণ্যের বাজার। ব্যবসায়ীরা একে অপরের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে কৃত্রিম সঙ্কট তৈরি করে বাজার থেকে অতিরিক্ত মুনাফা তুলে নিচ্ছেন। চেষ্টা করলেও কিছুতেই তা সরকার নিয়ন্ত্রনে আনতে পারছে না। সরকার সংশ্লিষ্টদের হম্বিতম্বি কোনই কাজে আসছে না। শুধু চাল তেল নয় মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, পিয়াজ সব কিছুর দাম এখন উর্দ্ধে। তাতে উচ্চবিত্তদের কোন সমস্যা নেই। মধ্যবিত্ত আর গরিবের হয়েছে যত জ্বালা।

কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বাড়তি ব্যায় সামাল দিতে পাছেনা সাধারন আয়ের মানুষ। বাজার করতে গেলে বাড়ি ভাড়া থাকে না, সন্তানের শিক্ষার ব্যায় মিটাতে পারেনা। অনেকে বাধ্য হয়ে উচ্চ সুতে ঋণ নিয়ে তা শোধ করতে পারছেন না। দরিদ্র মানুষের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রসারিত হয়েছে, কম দামের সরকারি চাল ও আটা কিনতে পারছেন নিম্ন আয়ের মানুষ। সরকারি চাকরিজীবীদের অনেকে রেশন পাচ্ছেন। কিন্তু কোনো রকম সুবিধাহীন ঢাকার মধ্য আয়ের মানুষের কষ্ট শুধুই বেড়েছে। গ্রামে ফিরে যাওয়ার কোনো উপায় না থাকায় যানজট, পানিহীনতা, জলাবদ্ধতা, গ্যাস সংকট, লোডশেডিং, ভেজাল খাবারসহ নানা কষ্টের মধ্যেও ঢাকায় পড়ে আছেন তাঁরা। প্রথম শ্রেণীর সরকারি গেজেটেড কর্মকর্তার চাকরি যে বেকারদের কাছে ব্যাপক আকর্ষণীয় তা পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু বেতনটা মোটেও আকর্ষণীয় নয়। কারণ, বর্তমান আক্রার বাজারে মাসশেষে বেতনের ১৬ হাজার টাকায় অন্তত ঢাকায় সংসার চালানো সম্ভব নয়। তার ওপর বছরশেষে যেখানে বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি হয় মাত্র সাড়ে সাত শ টাকার মতো। শতকরা হিসাব করলে দেখা যায়, বছর শেষে প্রথম শ্রেণীর সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন পাঁচ শতাংশেরও কম বাড়ে। কিন্তু কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) হিসাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়েছে ১১ দশমিক ৯৬ শতাংশ। বাড়তি ব্যায় সামাল দিতে পাছেনা সাধারন আয়ের মানুষ।

শেষে বলতেই হয, নিম্ন আয়ের মানুষ ভালো নেই। আয় কমলেও উচ্চ আয়ের মানুষদের সমস্যা হচ্ছে কম। বেশী বিপদে রয়েছেন শুধু সনাতনি মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ, যাদের জীবনবোধ ভিন্ন। তাদের মাসিক আয়ের ৬০ ভাগ চলে যায় বাড়িভাড়া, আর ২০ ভাগ খাবারে। দুই বাচ্চার পড়াশোনা আর স্কুলে যাতায়াতে খরচ হয় আয়ের ১০-১৫ ভাগ। তারপর রয়েছে চিকিৎসা। মানুষের একদিকে বাসস্থান সমস্যা প্রকট, অন্যদিকে পারিবারিক ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাওয়ায় মহা সংকটে পরেছে। জনগনের কথা মাথায় রেখে যে কোন মূল্যে পণ্য মূল্যসহ অন্যান্য ব্যয় যাতে কমে সেদিকে সরকারের নজরদারীর বিকল্প নেই। সরকারের কার্যকর পদক্ষেপই পারে এ ক্ষেত্রে সফলতা এনে দিতে। বাজার তদারকিসহ সকল ক্ষেত্রে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগ গুলো সদাই সজাগ থাকতে হবে।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অফ বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test