E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

সাদাসিধে কথা

'কিন্তু'

২০১৪ নভেম্বর ০৭ ০৭:২৭:০০
'কিন্তু'

যতই দিন যাচ্ছে আমি ততই ‘কিন্তু’ শব্দটার উপর বিরক্ত হয়ে উঠছি। আমার মনে হয় আমাদের ভাষায় এই শব্দটা তৈরি হয়েছে প্রতারণা করার সুযোগ দেয়ার জন্যে। সোজা ভাষায় বলা যায় দুই নম্বুরী কাজ করার জন্যে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে যাবে।

আমার টেলিভিশন দেখার খুব একটা সুযোগ হয় না, কিন্তু নভেম্বরের ৩ তারিখ রাত্রিবেলা আল জাজিরায় বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ওপর একটা অনুষ্ঠান দেখার সুযোগ হয়েছিল। সেখানে অন্যদের সাথে জামায়াতে ইসলামীর আইনজীবী টবি ক্যাডম্যান বক্তব্য রাখছিল। তার কথাবার্তা খুবই চমকপ্রদ, সে বলল— ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা হয়েছিল, এখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনী নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা যুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল—এ সবই ঠিক আছে। কিন্তু টবি ক্যাডম্যান এই ‘কিন্তু’ শব্দটা উচ্চারণ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার যে কি পরিমাণ নিম্নমানের এবং কি পরিমাণ অগ্রহণযোগ্য—তার বিস্তারিত বর্ণনা দিতে শুরু করল। আমাদের ভাষায় যদি ‘কিন্তু’ শব্দটা না থাকতো তাহলে কি সে এই দুই নম্বুরী কাজটা করতে পারতো? ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আর তার পদলেহী জামায়াতে ইসলামীর রাজাকার-আলবদর বাহিনী মিলে এই দেশে কী নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে সেই কথাটুকু বলে তার বক্তব্য শেষ করে ফেলতে হতো। তাকে বলতে হতো এই দেশকে কলংকমুক্ত করতে হলে তাদের বিচার করতেই হবে। চল্লিশ বছর পরে হলেও করতে হবে। শুধু ‘কিন্তু’ শব্দটার জন্যে সারা পৃথিবীর যত প্রতারক এবং যত ভণ্ড মানুষ আছে তারা প্রথমে ভালো ভালো কথা বলে শেষে দুই নম্বুরী কথা বলতে শুরু করে। তবে টবি ক্যাডম্যানের কথা আলাদা, তাকে জামায়াতে ইসলামী টাকা দিয়ে এসব কথা বলার জন্যে ভাড়া করেছে, তাকে এই কথাগুলো বলতেই হবে। তার পরেও কথাগুলো উচ্চারণ করতে গিয়ে তার গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল- একটু পরে পরে তার পানি (কিংবা অন্য কিছু) খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিতে হচ্ছিল!

শুধু জামায়াতের ভাড়া করা সাদা চামড়ার মানুষ নয়, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার পর ইউরোপ আমেরিকার মত দেশগুলোকেও এই ‘কিন্তু’ মার্কা কথা বলতে শুনেছি। তারা প্রথমে বলে, অবশ্যই এই নৃশংস গণহত্যার বিচার করতে হবে, তারপর একটু দম নিয়ে বলে ‘কিন্তু’, তারপর ‘গরুর রচনা’ (অর্থাত্ আন্তর্জাতিক মানের বিচার হতে হবে) শুরু করে দেয়। আমাদের ষোল কোটি মানুষের দেশে কতোকিছুই তো আন্তর্জাতিক মানের নয়, লেখাপড়া আন্তর্জাতিক মানের নয় (প্রশ্ন ফাঁস হয়, দুই হাতে গোল্ডেন ফাইভ বিতরণ করা হয়), চিকিত্সা আন্তর্জাতিক মানের নয় (টাকা না দিলে চিকিত্সা শুরু হয় না, বিল শোধ না করলে মৃতদেহ আটকে রাখা হয়), ইলেক্ট্রিসিটি আন্তর্জাতিক মানের নয় (সারা দেশের গ্রীড ফেল করে দশ ঘণ্টা পুরো দেশ অন্ধকার হয়ে থাকে), নিরাপত্তা বাহিনী আন্তর্জাতিক মানের নয় (র্যাব টাকা খেয়ে সাতজনকে খুন করে ফেলে), এমনকী টয়লেট পর্যন্ত আন্তর্জাতিক মানের নয় (হাইকমোড নেই, ফ্লাশ নেই) কিন্তু ইউরোপ-আমেরিকার সেসব কিছু নিয়ে মাথাব্যথা নেই। তাদের একমাত্র মাথাব্যথা একাত্তরের কিছু নৃশংস খুনির বিচারের বেলায়? এর আগেও তো এই দেশে কতো বিচার হয়েছে, চুরি-ডাকাতি-রাহাজানি থেকে শুরু করে খুন, ধর্ষণ কিছুই তো বাদ যায়নি। তখন তো কোনো দেশকে বলতে শুনিনি এই দেশে অপরাধীদের মানবাধিকার লঙ্ঘন হয়ে যাচ্ছে, আন্তর্জাতিক মানের বিচার হচ্ছে না। আমাদের দেশের সেই একই বিচার ব্যবস্থা যখন পুরোপুরি এই দেশের আইনে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছে তখন হঠাত্ করে তাদের মনে পড়ল যে বিচার আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না?

আমরা এখন সবাই জানি ব্যাপারটা কেমন করে ঘটেছে। শুধু আমেরিকাতে জামায়াতে ইসলামী ২৫ মিলিয়ন ডলার খরচ করেছে সেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ মানুষকে নিজের দিকে টেনে নেয়ার জন্যে। পত্র-পত্রিকায় এর উপর বিশাল রিপোর্ট বের হয়েছে, পড়ে বমি করে দিতে ইচ্ছে করে। টাকা দিয়ে অনেককিছু কেনা যায় (ডলার হলে আরেকটু ভালো হয়) কিন্তু একাত্তরের নির্যাতিত মানুষের বুকের ক্ষোভকে পৃথিবীর কোনো অর্থ দিয়ে কেনা যায় না। যতদিন এই দেশের মানুষ এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শেষ করে মাতৃভূমির কলংক মোচন করতে চাইবে ততদিন বাইরের কোনো শক্তি আমাদের ব্যাপারে নাক গলাতে পারবে না। আমি সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের কাছে কৃতজ্ঞ, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে কৃতজ্ঞ এবং আমাদের তরুণ প্রজন্মের কাছে কৃতজ্ঞ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তীব্রভাবে বাঁচিয়ে রাখার জন্যে।

সবচেয়ে বেশি কৃতজ্ঞ এই সরকারের কাছে, যারা আমাদের কথা দিয়েছিল যে নির্বাচিত হলে তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে এবং তারা তাদের কথা রেখেছে।

২.
সিলেটে কৃষিকাজে ব্যবহার করার জন্যে যন্ত্রপাতি তৈরি করার একটা ফ্যাক্টরি আছে, বেশ কয়েক বছর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সেই ফ্যাক্টরি থেকে আমাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল তাদের ফ্যাক্টরিটা দেখার জন্যে। আমি বেশ আগ্রহ নিয়ে দেখতে গিয়েছিলাম, আমাদের দেশের একেবারে নিজস্ব প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি যন্ত্রপাতিগুলো দেখে আমার খুব ভালো লেগেছিল। ফ্যাক্টরির মালিক কর্মকর্তারাও আমাকে সবকিছু ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখিয়েছেন। চলে আসার আগে তারা তাদের ‘ভিজিটার্স বুক’ বের করে নিয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন তাদের উদ্দেশে কিছু একটা লিখে দিতে। আমি আমার কথাগুলো লিখে স্বাক্ষর করার আগে থমকে গেলাম, আমার ঠিক আগে বাংলাদেশের সেই সময়কার শিল্পমন্ত্রীর নিজের হাতের স্বাক্ষর, স্পষ্ট অক্ষরে তার নাম লেখা, মতিউর রহমান নিজামী।

আমি কলমটি কিছুক্ষণ ধরে রেখে আমার নিজের নামটি স্বাক্ষর করলাম। তীব্র এক ধরনের অপমান বোধ আমাকে গ্রাস করে রেখেছিল, যে মানুষটি বদরবাহিনীর প্রধান হয়ে এই দেশে পৃথিবীর ভয়াবহতম হত্যাযজ্ঞের সহযোগিতা করেছে তাকে এই দেশের মন্ত্রী করে তার গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে দেয়া হয়েছে। অথচ এই মানুষটি বাংলাদেশের জন্মলগ্নে গলা টিপে এই দেশটিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। এর চাইতে বড় দুঃখ, লজ্জা, গ্লানি, অপমান কী হতে পারে!

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হবার পর অনেকদিন পার হয়ে গেছে, সবাই যেরকম দ্রুত একটা বিচার দেখতে চাইছিল ঠিক সেভাবে বিচার হচ্ছিল না বলে অনেকের ভেতর এক ধরনের হতাশার জন্ম হচ্ছিল। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে অনেকের ধারণা আমি বুঝি অনেক ভেতরের খবর জানি, তাই আমার সাথে দেখা হলেই অনেকে জানতে চাইতো কী হচ্ছে? আসলেই কি যুদ্ধাপরাধীর বিচার শেষ হবে?—ইত্যাদি ইত্যাদি। আমি তখন তাদের পাল্টা প্রশ্ন করতাম, তাদের কি জামায়াত-বিএনপি আমলের সেই জোট সরকারের কথা মনে আছে যখন দু’দু’জন কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী সেই সরকারের মন্ত্রী ছিল! যারা তাদের গাড়িতে এই দেশের পতাকা উড়িয়ে ঘুরে বেড়াতো? যারা প্রশ্ন করেন তারা সবাই মাথা নেড়ে স্বীকার করেন যে, হ্যাঁ তাদের সবারই সেই অবিশ্বাস্য দিনগুলোর কথা মনে আছে। তখন আমি তাদের জিজ্ঞেস করি তারা কি তখন কল্পনা করেছিলেন যে একদিন সব যুদ্ধাপরাধী গ্রেপ্তার হয়ে জেলে বসে থাকবে, একজন একজন করে তাদের বিচার করা হবে? (মনে আছে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ঘোষণা দিয়েছিল তাকে স্পর্শ করা হলেই সমগ্র চট্টগ্রামে আগুন লেগে যাবে। কোথায় সেই আগুন?), গোলাম আযমকে যখন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেয়া হয়েছিল তখন সবাই মন খারাপ করেছিল। এখন কি আমরা বলতে পারি না এই দেশের নাগরিকত্ব নিয়ে এই দেশে থেকে যাওয়ার জন্যেই তাকে ধরে জেলখানায় রাখা সম্ভব হয়েছিল? যুদ্ধাপরাধীর শাস্তি পেয়ে তাকে জেলখানায় মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, বাংলাদেশের ইতিহাসে এই কলঙ্কমোচনের কাহিনী আজীবনের জন্যে লেখা হয়ে গেল!

যারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারের সদিচ্ছার ওপর সন্দেহ প্রকাশ করেন তারা সবাই কিন্তু স্বীকার করতে বাধ্য হন জামায়াত-বিএনপির জোট সরকারের আমলে তারা কেউ কল্পনা করেননি সত্যি সত্যি এই দেশের মাটিতে আমাদের জীবদ্দশায় তাদের বিচার শুরু হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে যাদের মনে হতাশা সন্দেহ এবং অবিশ্বাস ছিল গত কয়েকদিনের বিচারের রায় দেখে তাদের সেই হতাশা, সন্দেহ এবং অবিশ্বাস অনেকটুকুই কেটে গেছে। আমরা এখন নিশ্চিতভাবে জানি আর কখনোই আমাদের সেই অন্ধকার দিনগুলোতে ফিরে যেতে হবে না।

৩.
একটা সময় ছিল যখন দেশদ্রোহী যুদ্ধাপরাধীরা এই দেশে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতো। একজন আমাকে বলেছেন যে সেই সময়ে নাকি কিছু রাজাকার একাত্তরে তাদের বকেয়া বেতনের জন্যে সরকারের কাছে আবেদন করেছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পর খালেদা জিয়া বেশ অনেকবার সেটাকে রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র বলে যুদ্ধাপরাধীদের মুক্তি চেয়েছেন।
ইদানীং সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও শিক্ষক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট.

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test