E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শীতের মৌসুমে কন্ঠস্বর ভঙ্গের কারণ ও হোমিও সমাধান

২০২৩ নভেম্বর ২২ ১৭:৪০:১২
শীতের মৌসুমে কন্ঠস্বর ভঙ্গের কারণ ও হোমিও সমাধান

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


গলার স্বরের পরিবর্তন বা গলা বসে যাওয়ার সমস্যা নিয়ে প্রায় রোগী আমাদের  শরণাপন্ন হয়ে থাকেন। বিশেষ করে শীতকালে এ সমস্যা অনেকের ক্ষেত্রেই দেখা যায়। আমাদের স্বরযন্ত্রের গঠন প্রকৃতি আর কার্য প্রণালি বেশ জটিল। আমাদের গলার স্বর যে যন্ত্রের দ্বারা তৈরি হয় তাকে আমরা স্বরযন্ত্র বলে থাকি। এটা আমাদের গলার মধ্যভাগে অবস্থিত। একে এদাম অ্যাপল বলা হয়। এর একটু নিচে স্বরযন্ত্র অবস্থিত। এদাম অ্যাপল হল গলার সম্মুখ ভাগে যে উঁচু অংশ থাকে সেটি এবং এটি ঢোক গেলার সঙ্গে ওঠানামা করে।

আমরা স্বরযন্ত্র দ্বারা গলার স্বরের পিচ এবং ফ্রিকোয়েন্সি নির্ধারণ করে থাকি। স্বরযন্ত্র বা ভোকাল কর্ড দুই দিকে দুটি থাকে যা কথা বলার সময় ভাইব্রেট করে থাকে। ছেলেদের ক্ষেত্রে প্রতি সেকেন্ডে এটা ১৫০ থেকে ২০০ বার এবং মেয়েদের ২০০ থেকে ২৫০ বার ভাইব্রেট করে থাকে। এ থেকে বোঝা যায়, এটা কত সূক্ষ্ম একটা যন্ত্র।

এ ভোকাল কর্ড দুটি কিছু মাংসপেশি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। আমাদের দেহে চোখের কিছু মাংসপেশি ছাড়া এত sophisticated কোনো মাংসপেশি শরীরে আর নেই। এ মাংসপেশিগুলোর কার্যকারিতার মাধ্যমে ভোকাল কর্ডের টেনশন এবং ভাইব্রেশন নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে। যদি এ টেনশন ভাইব্রেশনের কোনো অসামঞ্জস্য হয় তা হলে দেখা যায়, ভোকাল কর্ডের ওপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। আগেই জানলাম এই যন্ত্র কতখানি সূক্ষ্ম এবং জটিল কাজ নিয়মিত করে যাচ্ছে।

আমরা কথা বলার সময় প্রতিনিয়ত এটা কাজ করছে। শ্বাস নেয়ার সময়ও প্রতি মুহূর্তে এর মুভমেন্ট হচ্ছে। কাশি দিচ্ছি বা গলা পরিষ্কার করছি তখনও এটা কাজ করছে। কথা বলার সময় গলার স্বরযন্ত্রের ওপর যে চাপ পড়ে গলা পরিষ্কার করার সময় বা কাশি দেয়ার সময় এটার ওপর অনেক বেশি চাপ পড়ে। আমরা এ কাজের ওপর সন্তুষ্ট না হয়ে গলার ওপর আরও অন্যান্য কারণে চাপ দিয়ে থাকি।

বিভিন্নভাবে কথা বলি কোনো সময় নিচু গলায় কোনো সময় উঁচু গলায়। কেউ গলা সাধনা করে গলার স্বরের পরিবর্তন ঘটাতে চেষ্টা করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গলার চর্চা চলে। কেউ উচ্চাঙ্গসঙ্গীত কেউ আধুনিক গান আবার কেউ ব্যান্ডসঙ্গীত চর্চা করে থাকেন।

এ রকম সূক্ষ্ম এবং জটিল যন্ত্র নিয়ে আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এবং কর্ম ব্যবস্থার অন্ত নেই। এ চোখের মাংসপেশি দিয়ে সাধারণ কাজের অতিরিক্ত কোনো কাজই আমরা করি না- দু-একটি ক্ষেত্রে নৃত্যশিল্পীদের চোখ নাচানো ছাড়া সাধারণ মানুষের অতিরিক্ত কোনো কাজ এ চোখের মাংসপেশি করে না। স্বরযন্ত্রের ক্ষেত্রে এটা সত্য নয়। সাধারণের অতিরিক্ত অনেক অসাধারণ এবং অনাকাঙ্ক্ষিত কাজই আমরা অনেক সময় এ স্বরযন্ত্রের মাধ্যমে করে থাকি।

আর ল্যারিংস বা স্বরযন্ত্রের মাঝ বরাবর থাকে ভোকাল কর্ড, যার আবার দুটি অংশ আছে, সে ভোকাল কর্ডের সমন্বিত নাড়াচাড়া এবং সে সঙ্গে জিহ্বা, মুখের মাংসপেশি, খাদ্যনালির অংশ বিশেষসহ আরও অনেক অঙ্গ-প্রতঙ্গের সহযোগিতায় আমরা কথা বলার কাজটি করি।এর মধ্যে ল্যারিংস আর ভোকালগলার স্বর বসে যাওয়ার বিভিন্ন কারন রয়েছে, এর মধ্যে কিছু আছে তেমন একটা ক্ষতিকর নয় আর কিছু আছে খুবই মারাত্মক। গলার স্বর বসে যাওয়ার অসংখ্য কারন রয়েছে, এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটা নিচে উল্লেখ করলাম:

১। একিউট বা ক্রনিক ল্যারিন্জাইটিস/ স্বরযন্ত্রের প্রদাহ: এটা স্বল্প বা দীর্ঘ মেয়াদ হতে পারে। এতে সাধারনত গলাব্যাথা, খুসখুসে কাশি থাকতে পারে।

২। স্বরযন্ত্রে ট্রমা বা আঘাত: এটা বাহিরের কোন কিছু দিয়ে আঘাত হতে পারে বা হঠাৎ উচ্চস্বরে আওয়াজ করার কারনে হতে পারে, যার প্রভাব সুদুরপ্রসারী হতে পারে। তবে এটা সময়ের সাথে উন্নতি হতে পারে।

৩। স্বরযন্ত্রের টিউমার : এটা বিনাইন (ভাল) বা ম্যালিগ্নেন্ট (ক্যান্সার) টিউমার হতে পারে। এতে সাধারনত বসে যাওয়া স্বর আর ভাল হয়না বরঞ্চ এটা ক্রমান্বয়ে বেড়ে যেতে থাকে। একটা পর্যায়ে গিয়ে প্রচন্ড শ্বাসকষ্ট হতে থাকে।

৪। স্বরযন্ত্রের একপাশ অবশ হয়ে যাওয়া: এটা হয় যদি রেকারেন্ট ল্যারিন্জিয়াল নার্ভ আঘাতপ্রাপ্ত হয় যা টিউমারের কারনে বা বাহ্যিক আঘাতের কারনে, এমনকি বিনাকারনে(ইডিওপ্যাথিক) ও হতে পারে।

স্বর বসে গেলে করণীয় কি?

১। এরকম স্বর বসে যাওয়া যদি ২ সপ্তাহের বেশি হয়, বয়স ৪০ এর বেশি হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকে সেক্ষেত্রে অবশ্যই FOL (Fiberoptic laryngoscopy) করে স্বরযন্ত্রের পরীক্ষা করা উচিত। এই পরীক্ষার মাধ্যমে স্বরযন্ত্রের কোন রোগ থাকলে সেটা দেখা যায়।

২। উচ্চস্বরে কথা বলা পরিহার করা উচিত।

৩। ধূমপান পরিহার করা উচিত যেহেতু ধূমপান থেকেও গলার টিউমার ( ক্যান্সার) হতে পারে।

৪। এসিড রিফ্লাক্স বা পাকস্থলির খাদ্যরস যাতে উপরে উঠতে না পারে সেজন্য যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।

৫। নাক, সাইনাস,গলা ও ফুসফুসে কোন ইনফেকশন থাকলে সেটার যথাযথ চিকিৎসা নিতে হবে।

গলা স্বর বসে যাওয়ার রোগীর ঘরোয়া পরামর্শ

১. লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করাটা সবচেয়ে সাধারণ এবং একই সঙ্গে কার্যকর পদ্ধতি। দিনে অন্তত চারবার লবণপানি দিয়ে গড়গড়া করতে হবে। গলা ভাঙা উপশমে ভালো আরেকটি পদ্ধতি হলো গরম বাষ্প টানা। ফুটন্ত পানির বাষ্প যদি দৈনিক অন্তত ১০ মিনিট মুখ ও গলা দিয়ে টানা হয়, তবে উপকার হবে।

২. ভাঙা গলায় হালকা গরম লেবুপানি ও আদা বেশ কার্যকর। শুকনো আদায় ব্যাকটেরিয়া ধ্বংসকারী উপাদান রয়েছে, যা গলার বসে যাওয়া স্বরকে স্বাভাবিক করে তুলতে পারে।

৩. যাঁরা জোরে কথা বলেন, যাঁদের সর্বদা কণ্ঠ ব্যবহার করতে হয়, যেমন সংগীতশিল্পী, রাজনীতিবিদ—তাঁরা কিছুদিন কণ্ঠের বিশ্রাম নেবেন। এই বিশ্রামের ফলে শ্বাসনালিতে প্রদাহ কমে আসবে।

তবে এমন সব চিকিৎসা অনেক সময় কাজে দেয় না। দিনের পর দিন ধরে গলার স্বর বসে থাকে। গলা দিয়ে কথা বের হতে চায় না। স্বর বদলে যায়। ফ্যাসফেসে আওয়াজ হয়। এ ধরনের রোগীদের মধ্যে অন্তত ১০ শতাংশ আরও বিপজ্জনক কোনো রোগের সম্মুখীন হন। তাই জেনে নিতে হবে বিপদচিহ্নগুলো।

হোমিও সমাধান

রোগ নয় রোগীকে চিকিৎসা করা হয় এই জন্য একজন অভিজ্ঞ চিকিৎসক কে ডা.হানেমানের নির্দেশিত হোমিওপ্যাথিক নিয়মনীতি অনুসারে স্বর বসে যাওয়ার রোগ সহ যে কোন জটিল ও কঠিন রোগের চিকিৎসা ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য ভিওিক লক্ষণ সমষ্টি নির্ভর ও ধাতুগত ভাবে চিকিৎসা দিলে আল্লাহর রহমতে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতিতে কন্ঠস্বরের রোগীর চিকিৎসা সম্ভব।

অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকগন প্রাথমিক ভাবে যেইসব মেডিসিন লক্ষণের উপর নির্বাচন করে থাকে :-বেলাডোনা' হেপার সালফ, ফসফরাস, ল্যাকেসিস, ইগ্নাশিয়া, ব্রায়োনিয়া, ড্রসেরা, মার্ক সোল, আর্সেনিকাম অ্যালবাম, অ্যাকোনাইট, কস্টি‌কাম, আর্জেন্টাম মেটালিকাম, চামোমিলা, ব্যারিটা কার্বোনিকা, থুজা সহ আরো অনেক মেডিসিন লক্ষণের উপর আসতে পারে তাই ওষুধ নিজে নিজে ব্যবহার না করে অভিজ্ঞতা সম্পন্ন চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

পরিশেষে বলতে চাই, স্বর, অবশ্যই সৃষ্টিকর্তার অনন্য উপহার। আমি বলব, এটি হলো যোগাযোগের সবচেয়ে বড় মাধ্যম। খুব সামান্য কারণ থেকে অনেক বড় কারণেও স্বরভঙ্গ হতে পারে। দেখা গেল, ঠান্ডা লেগেছে, গলার স্বর বসে যাচ্ছে, হঠাৎ করে হয়তো আর কোনো কথাই বের হচ্ছে না—এটি স্বরভঙ্গের খুব সাধারণ একটি ঘটনা। এটি আমাদের প্রত্যেকের জীবনে কখনো না কখনো হয়ে থাকে। একে আমরা বলি একিউট ল্যারিংজাইটিস। অর্থাৎ আমাদের ভোকাল কর্ড, মানে যেখানে কথা উৎপন্ন হয়, সেখানে প্রদাহজনিত কারণে, তার কাজ সে ঠিকমতো করতে পারে না। এটি সাময়িকভাবে তার কাজকে বন্ধ করে দেয়। এতে দেখা যায় কথা বের হচ্ছে না। এখানে চিকিৎসাও খুব সামান্য। বিশ্রামটিই হলো সবচেয়ে বড় চিকিৎসা।তাই শীতের শুষ্ক আবহাওয়ায় ঠান্ডা বা ধুলাবালি থেকে বাঁচতে অবশ্যই, মাস্ক ব্যবহার করা জরুরি।

লেখক : কলাম লেখক ও গবেষক।

পাঠকের মতামত:

২৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test