E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অনৈতিক ও অমানবিক

২০২৩ ডিসেম্বর ২১ ১৪:৫৬:৩৫
অনৈতিক ও অমানবিক

মীর আব্দুল আলীম


দেশি-আন্তর্জাতিক সব গবেষণায় দেশে খাবারের বিষক্রিয়ার বিষয়টি বারবার উঠে আসছে। ফুটপাত থেকে শুরু করে অভিজাত হোটেল-রেস্টুরেন্ট বা নামিদামি ব্র্যান্ডের পণ্য এমনকি বাসাবাড়ির খাদ্যও এখন ভেজালমুক্ত নয়। খাদ্যে ভেজাল, খাদ্যে বিষক্রিয়ার ব্যাপ্তি যে হারে বাড়ছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ভেজাল খাবার ঝুঁকির দিকে ঠেলে দিচ্ছে জীবন। উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের একটি শ্রেণি অধিক মুনাফার লোভে মনুষ্যত্ব ভুলে গিয়ে প্রচুর মাত্রায় কেমিক্যাল, ক্যালসিয়াম কার্বাইড, ফরমালিন, আর্টিফিশিয়াল রং, ইউরিয়াসহ বিষাক্ত সামগ্রী। এসব কেমিক্যাল অত্যন্ত বিষাক্ত। আর এসব বিষাক্ত খাবার খেয়ে কারো কিডনি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, ফুসফুস আক্রান্ত হচ্ছে, ক্যানসারের কিংবা অন্য কোনো জটিল রোগে ভোগছে মানুষ। মানুষের শরীরে রোগবালাই পেয়ে বসেছে। মানুষ অকালে মারা যাচ্ছে। বিষ খেলে মানুষ তো মরবেই!

গবেষণা বলছে, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে দেশে প্রতি বছর প্রায় সাড়ে তিন লাখ লোক ক্যানসারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা দেড় লাখ, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়েরশারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। এই পরিসংখ্যানটি আমাদের না ভাবিয়ে পারে না। ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে খাদ্যে ভেজাল দেওয়া এবং ভেজাল খাদ্য বিক্রির সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ ছাড়া ১৪ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। ২০১৫ সালে গঠন করা হয় ‘নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ’। নিরাপদ খাদ্যের বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে ২০১৮ সাল থেকে ফেব্রুয়ারির ২ তারিখকে ‘নিরাপদ খাদ্য দিবস’ হিসেবে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করে আসছে।

এরপরও কি আমরা নিরাপ খাদ্য পাচ্ছি? ভেজাল খাদ্য রোধে আইনের প্রয়োগই বা দেশে আছে কতটুকু? ভেজাল পণ্য ও অসাধু ব্যবসায়ীদের ঠেকাতে ব্যাপক অভিযান প্রয়োজন। অস্বীকার করা যাবে না যে, খাদ্যে ভেজাল বা দূষণ একটি বৈশ্বিক সংকট। এ সংকট তৈরি হয়েছে ভেজালবিরোধী অধিকাংশ আইন বর্তমানে অনেকটা অকার্যকর থাকায়। আইনের প্রয়োগ খুব কম। ভেজালবিরোধী অভিযান পরিচালিত হয়, তা বিচ্ছিন্নভাবে। ভেজাল খাদ্য রোধে বাজারে সার্বিক তদারকি ব্যবস্থা খুবই করুন।

সিএজির প্রতিবেদনে আমরা এমনটাই দেখেছি। ভেজাল প্রতিরোধে দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভিন্ন সরকারি সংস্থার মধ্যে সমন্বয়ের বড় অভাব রয়েছে। আমাদের দেশে পর্যাপ্ত আইনি ও কারিগরি নিরাপত্তাব্যবস্থা না থাকায় প্রায় সব ধরনের খাদ্যদ্রব্যেই অবাধে ভেজাল চলে। এমন অবাদ ভেজালের ফলে মানুষও অসুস্থ হচ্ছে দিন দিন। মানুষ মারাও যাচ্ছে। প্রশ্ন হলো- দেশ নাকি উন্নয়নের শিখরে যাচ্ছে। আমাদের জীবনযাত্রার মান বেড়েছে, রাস্তাঘাটের উন্নতি হয়েছে- না বলার সুযোগ নেই। দেশের মানুষ সুস্থই না থাকে, জীবনই যদি না বাঁচে তবে কাদের জন্য এ উন্নয়ন। ভেজাল খাদ্যে উন্নয়ন হয়েছে। এটা ভয়ংকর! দেশের সার্বিক উন্নয়নের সঙ্গে ভেজাল খাদ্য রোধে উন্নয়ন চাই। জনস্বাস্থ্য ঝুঁকিতে থাকলে, দেশের মানুষ রোগাক্রান্ত হলে উন্নয়ন কাদের জন্য? রাষ্ট্র বিষয়টি ভাববে এটা আমাদের কাম্য।

খবরের কাগজের শিরোনাম- ‘হাঁস-মুরগি আর মাছের খাবারে ক্যানসারের উপাদান!’। জনমনে আতঙ্ক তৈরি হওয়ার মতোই সংবাদ। আমরা মাছে-ভাতে বাঙালি। প্রতিদিন, প্রতি বেলায় মাছ-মাংস খেতে হয় আমাদের। হাঁস-মুরগির আর মাছের খাবারে ক্যানসার সৃষ্টিকারী উপাদান ক্রোমিয়াম মাত্রাতিরিক্ত অবস্থায় আছে বলে সংবাদ ছাপা হচ্ছে তাতে আমরা ভয় পাচ্ছি। হাঁস, মুরগি ও মাছের শরীরে প্রবেশ করছে বিষ। বিভিন্ন ধাতু ও রাসায়নিকসমৃদ্ধ বিষাক্ত ট্যানারি বর্জ্য খাবার হিসেবে অধিক মুনাফার জন্য ব্যবহার খাদ্যের মাধ্যমে করছেন খামারিরা। এ ধরনের মাছ ও মাংস গ্রহণ করলে তা মানব শরীরে প্রবেশ করে। তা মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। রোগতত্ত্ব, রোগনিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের কর্মকর্তারা জানান, ট্যানারির বর্জ্য থেকে উৎপাদিত পোলট্রি ফিডে হেভিমেটালে ক্যাডমিয়াম, লেড (সিসা), মার্কারি (পারদ) ও ক্রোমিয়ামসহ বেশ কিছু বিষাক্ত পদার্থ মিলেছে।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলেন, ক্রোমিয়ামসহ এসব ধাতু ও রাসায়নিক থেকে ক্যানসার, হৃদ্রোগ, আলসার, লিভারের জটিল রোগ, কিডনির অসুখ হতে পারে। মানবদেহে অতিরিক্ত ক্রোমিয়াম প্রবেশ করলে পুরুষের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা হ্রাস, নারীদের অকাল প্রসব, বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম, অ্যাজমা, শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগও হয়ে থাকে। অবশ্য এ বিষয়ের গবেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. আবুল হোসেন জানিয়েছেন, ট্যানারি বর্জ্য ছাড়া অন্য যেসব উপাদান ব্যবহার করে দেশে যে পোলট্রি ফিড তৈরি হয়, তাতে ক্রোমিয়ামের উপাদান থাকার আশঙ্কা নেই। সে ক্ষেত্রে যেন পুরো পোলট্রি ফিডশিল্পের ব্যাপারে ভোক্তা ও উৎপাদকদের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি না হয়, তাতে সতর্ক থাকা জরুরি। অতীতে এ ধরনের আতঙ্কের কারণে আমাদের পোলট্রিশিল্প ধসের মুখোমুখি হয়েছিল। এর পুনরাবৃত্তি কোনোভাবে যেমন কাম্য নয়, আবার বিষযুক্ত মাছ-মাংসও আমাদের যেন খেতে না হয় এজন্য সরকার সংশ্লিষ্টদের সজাগ থাকতে হবে।

দেশে ক্যানসার রোগী বেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হলো বিষাযুক্ত এসব খাবার। খাদ্যপণ্যে ফরমালিন ও কার্বাইড ব্যবহারের ফলে স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ভেজাল নিরসনে আইনি কিছু সীমাবদ্ধতা রয়েছে, সন্দেহ নেই; কিন্তু তার চেয়েও বড় সীমাবদ্ধতা হচ্ছে আইনের প্রয়োগ খুবই সামান্য। একজন ভোক্তা হিসেবে আমাদের নিরাপদ খাদ্য পাওয়ার অধিকার রয়েছে। এ অধিকার থেকে আমরা বরাবরই বঞ্চিত। মানুষ কেন খাদ্যে ভেজাল দেয় তার কারণ পর্যালোচনা করলে ভোগী মনোবৃত্তির পরিচয় মেলে। স্বল্প সময়ে যাতে অধিক উপার্জন করা যায় সেদিকেই ভেজালকারীদের প্রধান লক্ষ্য থাকে। এতে পরিশ্রম কম হয়, কিন্তু রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠা যায়। স্বার্থান্ধ মানুষ নিজেদের স্বার্থের কথা মনে রেখে ভেজাল দিতে গিয়ে মানুষের যে চরম সর্বনাশ করে তা কখনোই তারা ভেবে দেখে না। অন্যের ভালো-মন্দ বিবেচনা করার মতো বিবেক তাদের নেই।

আইন প্রয়োগ হলে সব ঠিক হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা প্রয়োগ করার কোনো নজির নেই। খাদ্যে ভেজাল রোধে আইনের যথাযথ প্রয়োগও নিশ্চিত হবে তা আমরা আশা করব। খুব ঘৃণিত একটি বিষয়, আমরা বিভিন্ন সময়ে দেখেছি কীভাবে মাছ ও দুধে ফরমালিন, শুঁটকিতে ডিডিটি, ভাজা খাবারে তেলের বদলে পোড়া লুব্রিকেটিং, ফুডগ্রেডের বদলে টেক্সটাইলে ব্যবহৃত রং ব্যবহার করা হয়। আমরা মনে করি, নিত্যনতুন কায়দায় খাবারের সঙ্গে মানবদেহে বিষ প্রয়োগ নীরব গণহত্যারই নামান্তর। এই নীরব ঘাতককে রুখতে কেবল সরকারি সংস্থার সক্রিয়তা নয়, বেসরকারি বিভিন্ন পক্ষ বা নাগরিকদেরও সরব হওয়া জরুরি। এটা রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব। বাংলাদেশের সংবাদমাধ্যমে খাদ্যে ভেজালের সংবেদনশীল ও ভয়ানক খবরগুলো বিভিন্ন সময়ে প্রকাশ হয়ে আসছে। ভেজাল রোধে হাইকোর্টের একটি দ্বৈত বেঞ্চ নিম্নমানের ৫২ খাদ্যপণ্য প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছে। এ নিয়ে সে সময় দেশে হইচইও হয়েছে। কিন্তু তাতে কী হয়েছে?

ভেজাল নেই কোথায়? আমরা তো ভেজালের রাজ্যে রাজা হয়ে গেছি। ভেজাল দিচ্ছি; ভেজাল গ্রহণ করছি। ভেজাল বলছি; ভেজাল করছি। যেন ভেজালের রাজত্ব। কেউ কেউ বলেন এদেশে কেবল খাদ্যে নয়; বিষেও নাকি ভেজাল আছে। ভেজাল খেয়ে যা হবার নয় তাই হচ্ছে। কিডনি নষ্ট হচ্ছে, হচ্ছে হাই-প্রেসার, দুরারোগ্য ক্যানসার আর হার্ট-স্ট্রোকে অহরহ মরছে মানুষ। প্রতিটি খাবারে মেশানো হচ্ছে বিষ। আর সেই বিষ খেয়ে আমরা আর বেঁচে নেই। জীবিত থেকেও লাশ হয়ে গেছি। এ যেন জিন্দা লাশ! রোগেশোকে কয়েকটা দিন বেঁচে থাকা এই আরকি। প্রতিনিয়তই তো বিষ খাচ্ছি। কদিন আগে এক বিখ্যাত কলামিস্ট তার লেখায় লিখেছিলেন—‘আমরা প্রতি জনে; প্রতি ক্ষণে; জেনেশুনে করেছি বিষ পান।’ আরেক লেখক লিখেছেন—‘কত কিছু খাই ভস্ম আর ছাই।’ সেদিন জাতীয় দৈনিকের শিরোনাম ছিল এমন—‘মাছের বাজারে মাছি নেই!’

প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে কোনো এক মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই বিষই আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কেবল হাসপাতালগুলোতে গেলেই বুঝা যায়, কত প্রকার রোগই না এখন মানবদেহে ভর করে আছে। না খেয়ে উপায়ইবা কী? তবে উপায় একটা আছে। না খেয়ে থাকলে এ থেকে যেন নিস্তার মিলবে; কিন্তু তাতো হবার নয়। তাই আমে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা আমরা কিনে নিচ্ছি। আর সেই বিষ মেশানো খাবারগুলোই সপরিবারে গিলে খাচ্ছি দিনরাত।

আসলে আমরা জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছি। না খেয়ে উপায়ই বা কী? তবে উপায় একটা আছে। না খেয়ে থাকলে এ থেকে যেন নিস্তার মিলবে। কিন্তু তাতো হওয়ার নয়। তাই আমে, মাছে, সবজিতে বিষ মেশানো আছে জেনেও তা আমরা কিনে নিচ্ছি। আর সেই বিষ মেশানো খাবারই সপরিবারে গিলে খাচ্ছি দিন-রাত। ভেজাল দেওয়া বা ভেজাল খাদ্য ও পানীয় বিক্রির কারণে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। এ আইনের ২৫ (গ) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কেউ কোনো খাদ্য বা পানীয়দ্রব্যে ভেজাল দিয়ে তা ভক্ষণ বা পান করার অযোগ্য করে ও তা খাদ্য, পানীয় হিসেবে বিক্রি করতে চায় বা তা খাদ্য বা পানীয় হিসেবে বিক্রি হবে বলে জানা সত্ত্বেও অনুরূপ ভেজাল দেয় অথবা কোনো দ্রব্য নষ্ট হয়েছে বা নষ্ট করা হয়েছে বা খাদ্য, পানীয় হিসেবে অযোগ্য হয়েছে জানা সত্ত্বেও বা তদ্রুপ বিশ্বাস করার কারণ থাকা সত্ত্বেও অনুরূপ কোনো দ্রব্য বিক্রি করে বা বিক্রির জন্য উপস্থিত করে; তবে সে ব্যক্তি মৃত্যুদণ্ড, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড অথবা ১৪ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডে এবং তদুপরি জরিমানাদণ্ডে দণ্ডনীয় হবে।

২০০৫ সালে অর্ধশত বছরের পুরোনো ১৯৫৯ সালের বিশুদ্ধ খাদ্য অধ্যাদেশে (পিএফও) বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়। মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কোনো দ্রব্য, কোনো খাদ্যপণ্যের সঙ্গে যার মিশ্রণ কোনো আইন বা বিধির অধীনে নিষিদ্ধ, এরূপ দ্রব্য মিশ্রিত কোনো পণ্য বিক্রি করা বা করতে প্রস্তাব করা ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনে ভোক্তা অধিকারবিরোধী কাজ হিসেবে স্বীকৃত। এ জন্য আইনে শাস্তির বিধান রয়েছে। বিএসটিআই অধ্যাদেশ, ১৯৮৫ এবং এর অধীনে প্রণীত বিধিমালায় খাদ্য ও কৃষিজাত পণ্যের প্রক্রিয়া ও পরীক্ষা পদ্ধতির জাতীয় মান প্রণয়ন এবং প্রণীত মানের ভিত্তিতে পণ্যসামগ্রীর গুণমান পরীক্ষা ও যাচাই করার বিধান রয়েছে। পালনীয় বিধানাবলি ভঙ্গের জন্য চার বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং ১ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার ব্যবস্থা রয়েছে। খাদ্যে ভেজাল রোধ ও ভেজালকারীদের শাস্তি দেওয়ার বিধান রয়েছে সিটি করপোরেশন অধ্যাদেশগুলোয়। দেখা যাচ্ছে, দেশে খাদ্যদ্রব্যে ভেজালবিরোধী আইনের কমতি নেই। শাস্তির বিধানও রয়েছে এসব আইনে। স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন উঠতে পারে, শাস্তির বিধানসংবলিত এসব আইন বলবৎ থাকা সত্ত্বেও খাদ্যদ্রব্যে ভেজালের এত দৌরাত্ম্য কেন? কারাদণ্ডের বিধান থাকলেও এখন পর্যন্ত তা প্রয়োগের কোনো নজির নেই। এটা আমাদের বাঙালি জাতির জন্য দুর্ভাগ্য।

ভেজালকারবারিরা ইতোমধ্যে ২ কোটি মানুষকে কেবল কিডনি রোগে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে অবলীলায়। এর মধ্যে প্রায় ৫০-৬০ হাজার লোক ডায়ালাইসিস-এর মাধ্যমে জীবন ধারণ করছে। ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৫০ হাজার। এ ছাড়া অন্তঃসত্ত্বা মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা প্রায় ১৫ লাখ। ক্যান্সারসহ কোন না কোনো রোগে আক্রান্ত আরো আরো ২ কোটি মানুষ। প্রতিনিয়ত ভেজাল দ্রব্য খেয়ে কঠিন রোগে আক্রান্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে বাকি ১৪ কোটি মানুষ। এসব তথ্য জনমনে আতংক তৈরি করে বৈকি! কেবল ক্যান্সারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত ২৭৩ জনের মৃত্যু হয় বলে খোদ তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী এক সেমিনারে বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত। প্রতি বছর আরো প্রায় এক থেকে দেড় লাখ মানুষ এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে এই তালিকায়। মৃত্যুও হয় লাখের কাছে। রোজ মারা যায় ২৭৩ জন। ক্যান্সার সম্পর্কিত গ্লোবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে ৯১ হাজারের অধিক মানুষই মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক বলছেন প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের উদ্ধৃতি বাংলাদেশে ৬০ ভাগ ক্যান্সার রোগী প্রায় ৫ বছরের মধ্যে মারা যায়। দেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার বর্তমানে প্রায় ৮ ভাগ এবং এই সংখ্যা ২০৩০ সালে এটি ১৩ ভাগে দাঁড়াতে পারে।

দেশের উন্নয়নের কথা শুনছি, হচ্ছেও। জঙ্গি দমন করেছে সরকার, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে, স্বপ্নের পদ্মায় সেতু হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলা, বিভাগীয় শহর এমনকি উপজেলা পর্যায়েও ফ্লাইওভার হয়েছে, দেশের বিভিন্ন নদী পথের ফেরি বদলে সেতু হয়েছে, রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে মানব উন্নয়নও। বলতেই হয় বহিঃবিশে^ও দেশের মর্যাদা বেড়েছে। এতসব কাদের জন্য? এদেশের মানুষের জন্যইতো? দেশের মানুষ সুস্থ না থাকলে, বেঁচে না থাকলে এসবে ফায়দা কি? মানুষকে সুস্থ রাখতে সরকার কঠোর হচ্ছে না কেন? এ ব্যাপারেতো রাষ্ট্রের কোনো দুর্বলতা থাকার কথা নয়। তাহলে এ জায়গাটাতে সরকারের এতো কার্পণ্য কেন?

আমরা প্রতিনিয়ত যে খাবার খাচ্ছি তাতে একটু একটু করে দেহে বিষ জমা হচ্ছে। এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা। খাদ্য ভেজালের বিষক্রিয়া দেহের ভিতর দীর্ঘদিন জমা থাকে কখনও নিঃশেষ হয় না। ফলে দেহে থাকা বিষ বংশানুক্রমে স্থানান্তর হয়। যা থেকে নানা রোগের জন্ম দেয়। খাদ্যে কেমিকেল এবং ভেজাল মিশিয়ে সমগ্র জাতিকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ভেজালকারবারি। এসব ভেজাল খাদ্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে ওরা নামান্তে শিশু হত্যা করছে, এদেশের বুদ্ধিজীবী, জ্ঞানী-গুণী তথা দেশের আমজনতাকে হত্যা করছে। তাই খাদ্যে ভেজাল গণহত্যার সামিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল মিশ্রিত খাদ্যের কারণে কিডনি রোগ, ক্যান্সার, হাঁপানী, অন্ত্রে ব্যথা, পেটের পীড়া, গর্ভপাত, বন্ধ্যাত্ব, শ্বাসকষ্ট, যকৃত, প্লিহা, স্নায়ুর ক্ষতি, ফুসফুসের রোগ, ডায়াবেটিস, প্রজনন অক্ষমতা, মাংসপেশীর সংকোচন, ববি বমি ভাব, মুখে অতিরিক্ত লালা ঝরা, চোখে পানি পড়া, মাথা ব্যথা, চোখের মণি ছোট হয়ে আসা, ঝাপসা দেখা, দুর্বলতা, তলপেটে ব্যথা, খিঁচুনি রোগ হতে পারে। খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে সমগ্র জাতিকে তিল তিল করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে এক শ্রেণীর অসাধু ব্যবসায়ী। ভেজাল খেয়ে মানুষ মারা যাচ্ছে, নানারোগে ভুগছে মানুষ।

ফলমূল, আমে, জামে, মাছে, ভাতে কোথায় নেই বিষ? প্রতিটি খাবারেই এখন বিষ মিশানো হচ্ছে। প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাচ্ছি তাতে কোনো এক মাত্রায় বিষ মেশানো আছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আর এই বিষই আমাদের তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে নিচ্ছে। কেবল হাসপাতালগুলোতে গেলেই বুঝা যায় কত প্রকার রোগই না এখন মানব দেহে ভর করে আছে। আসলে আমরা জেনে শুনেই বিষ খাচ্ছি। ভেজাল আমাদের জীবনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তেল, মসলা, লবণ, মুড়ি, চিনি, মাছ, দুধ, ফলমূল, সবজি, গুঁড়াদুধ, কেশতেল, কসমেটিকস সর্বত্রই ভেজাল। ফলের জুস, কোমল পানীয় এসবের বেশির ভাগই কৃত্রিম কেমিক্যাল দিয়ে তৈরি, যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। ফল প্রথমে ক্যালসিয়াম কার্বাইড দিয়ে পাকানো হয়, পরে ফরমালিন দিয়ে প্রিজারভ করা হয়। দু’টোই স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।

অসাধু ভেজাল ব্যবসায়ীরা কিনা করছে? খাবারের সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্য বিরিয়ানি, জিলাপি, জুস, মিষ্টিসহ বিভিন্ন খাবারে সস্তা দামের টেক্সটাইল গ্রেড বিষাক্ত রং ব্যবহার করে থাকে, যা শরীরের জন্য খুবই ক্ষতিকর। খাবারে কৃত্রিম রং এবং জুসে ব্যবহৃত প্রিজারভেটিভ ক্যান্সার সৃষ্টিতে সহায়তা করে। এমনকি আমাদের জীবন রক্ষাকারী ওষুধও ভেজাল থেকে শতভাগ মুক্ত নয়। খেতে ফলানো চালে, ডালেও ভেজাল। ক্রোমিয়াম নামক বিষ পাওয়া যাচ্ছে ওসবে। ক্যালসিয়াম কার্বাইড এবং ইথোফেন ব্যবহার করে আম, কলা, পেঁপে, আনারস, বেদানা, ডালিম, আপেলসহ এমন কোনো ফল নেই যা পাকানো না হয়। আবার ১০০/২০০ মি. গ্রা. বোতলজাত প্রভিট (ইথোফেন) বাজারজাত করা হয়- যা সবজির সজীবতা রক্ষা করে। এই প্রকারের কেমিক্যালটি ব্যবহার করে তরিতরকারিকে দীর্ঘস্থায়ী করা হয়- যা বাজারের সবজির মূল্য বৃদ্ধির অন্যতম কারণ। শুধু ফলমূল, মাছ আর সবজিতেই নয়- মিষ্টির দোকান হতে শুরু করে মুদি দোকানের নিত্যপণ্য আর মনোহারি প্রসাধনীর এমন কোনো বস্তু নেই যাতে কেমিক্যালের সংশ্রব নেই। মাংসও ভেজাল মুক্ত নয়। অধিকাংশই খামারের গরুকে খাওয়ানো হচ্ছে মাত্রাতিরিক্ত ইউরিয়া সার ও খাবার সোডা। এতে গরু দ্রুত মোটাতাজা হলেও এর মাংস মানুষের শরীরের জন্য ক্ষতিকর। এসব গরুর মাংস খেলে তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না দিলেও মানুষের লিভার ও কিডনি ধীরে ধীরে নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে বলে চিকিৎসকরা জানিয়েছেন।

কেবল ক্যান্সারের কারণে বাংলাদেশে প্রতিদিন অন্তত ২৭৩ জনের মৃত্যু হয় বলে খোদ তথ্য দিয়েছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক। মন্ত্রী এক সেমিনারে বলেন, বাংলাদেশে এখন প্রায় ২০ লাখ মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত। প্রতি বছর আরও প্রায় এক থেকে দেড় লাখ মানুষ এর সঙ্গে যোগ হচ্ছে এই তালিকায়। মৃত্যুও হয় লাখের কাছে। রোজ মারা যায় ২৭৩ জন। ক্যান্সার সম্পর্কিত গ্লোাবোক্যানের তথ্য অনুযায়ী, দেশে প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। যার মধ্যে ৯১ হাজারের অধিক মানুষই মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল পরিচালক বলছেন প্রকৃত সংখ্যা তার চেয়েও বেশি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যের উদ্ধৃতি বাংলাদেশে ৬০ ভাগ ক্যান্সার রোগী প্রায় ৫ বছরের মধ্যে মারা যায়। দেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার বর্তমানে প্রায় ৮ ভাগ এবং এই সংখ্যা ২০৩০ সালে এটি ১৩ ভাগে উন্নীত হবে। দেশের উন্নয়নের কথা শুনছি, হচ্ছেও। জঙ্গি দমন করেছে সরকার, শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন এনেছে, স্বপ্নের পদ্মায় সেতু হয়েছে, দেশের বিভিন্ন জেলা, বিভাগীয় শহর এমনকি উপজেলা পর্যায়েও ফ্লাইওভার হয়েছে, দেশের বিভিন্ন নদী পথের ফেরি বদলে সেতু হয়েছে, রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন ঘটেছে। ঘটেছে মানব উন্নয়নও। বলতেই হয় বহি:বিশ্বেও দেশের মর্যাদা বেড়েছে। এতসব কাদের জন্য? এদেশের মানুষের জন্যইতো? দেশের মানুষ সুস্থ্য না থাকলে, বেঁচে না থাকলে এসবে ফায়দা কি? মানুষকে সুস্থ্য রাখতে সরকার কঠোর হচ্ছে না কেন? এ ব্যাপারেতো রাষ্ট্রের কোন দুর্বলতা থাকার কথা নয়। তাহলে এ জায়গাটাতে সরকারের এতো কার্পণ্যতা কেন?

আমরা উদ্বেগের সঙ্গে দেখেছি, হাইকোর্টের হস্তক্ষেপের পরও সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে পরিস্থিতির তেমন হেরফের ঘটেনি। অথচ সরকারি সংস্থার দ্বারা ভেজাল চিহ্নিত হওয়ার পরই উপযুক্ত সরকারি সংস্থা দায়ী প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে, সেটাই ছিল দেশের মানুষের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু কিছুই হয়নি। থেমে গেছে সব কার্যক্রম। এর ফলে ভোক্তাদের মধ্যে হতাশা, এমনকি অসহায়ত্ববোধ আরো তীব্র হয়েছে। খাদ্য মানুষের অন্যতম প্রধান মৌলিক অধিকার। খাদ্যগ্রহণ ছাড়া মানুষসহ কোনো প্রাণীই বেঁচে থাকতে পারে না। তবে সে খাবার অবশ্যই হতে হয় বিশুদ্ধ। আমরা আশা করব, ভেজাল খাদ্যপণ্য কার্যকরভাবে প্রত্যাহার করে এবং দোষী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যথাযথ পদক্ষেপ নিয়ে সরকার একটি অনুসরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে।

সর্বোপরি ভেজাল প্রতিরোধে জনসচেতনতা একান্ত দরকার। গ্রামেগঞ্জে, শহরে-নগরে এ ব্যাপারে প্রয়োজনে গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এক যোগে আওয়াজ তুলতে হবে- 'আমরা আর ভেজাল খাবো না; ফরমালিনমুক্ত খাবার চাই।' মানুষ তো বাঁচার জন্য খায়, মরার জন্য নয়। আর খাদ্য যদি মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়, তাহলে তা কতটা দুঃখজনক। বিষয়টি নিশ্চয়ই সরকার এবং সংশ্লিষ্টরা ভাববেন। সুস্বাস্থ্যের জন্য স্বাস্থ্যসম্মত নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। আমরা নিরাপদ খাদ্য চাই; আমরা সুস্থ থাকতে চাই। আর তা রাষ্ট্র নিশ্চিত করবে- এটাই আমাদের প্রত্যাশা।

লেখক : সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৪ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test