E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বিচার হয় না বলেই ধর্ষকরা বেপরোয়া

২০২৪ জানুয়ারি ২৯ ১৬:০৫:৩৩
বিচার হয় না বলেই ধর্ষকরা বেপরোয়া

মীর আব্দুল আলীম


দেশে ধর্ষণ খুব বেশি হচ্ছে। অসহনীয় মাত্রায় নারীরা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। ধর্ষণের ঘটনায় সঠিক বিচার হচ্ছে না বলেই দেশে ধর্ষণ বেড়েছে। আমরা প্রতিদিন যে পরিমাণে ধর্ষণের খবর পাই তা, প্রকৃত ধর্ষণের বোধ করি অর্ধেকও না। ধর্ষিতা হয়ে প্রকাশ করে ক'জন? এ লজ্জার কথা জানায় কি করে অবলা নারী? ধর্ষণের বিচার ক'টা হয় যে মানুষ ধর্ষণ হলে থানা আদালত পর্যন্ত যাবে? ধর্ষণের পর বিচার চাইতে গিয়ে যা হয় তাতো নির্যাতন আর গণধর্ষণ!

সর্বশেষ, খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলা চেয়ারম্যান এজাজ আহমেদের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ তুলে এক তরুণী। ২৮ জানুয়ারী রাতে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান-স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি হওয়া ঐ তরুণী ও তাঁর মাকে অপহরণও করা হয়। তাদের হাসপাতাল ফটক থেকে মাইত্রেবাসে তুলে নিয়ে এমন ভয়ভীতি দেখানো হয় যে তারা পরে এ ঘটনা অস্বিকার করে। ধষর্ণের প্রায় প্রতিটি ঘটনা এমনই হয়। ভয়ে মুখ খুলতে চায় না ধর্ষিতা ও তার পরিবার। কথা না বলার চাপ মেয়েদের উপর। মুখ খুললেও ভয় দেখিয়ে থামিয়ে দেওয়া হয়। ধর্ষিত হলে শ্লিলতাহানীর শিকার হলে পরিবার থেকে বলা হয় চুপ থাকতে হবে, নইলে মান যাবে। আবার মেয়েদেরও পুলিশের উপর আস্থা থাকে না। তাই বিচারহীনসাংস্কৃতি নারীর প্রতি সহিংসতা বাড়িয়ে দিয়েছে।

ধর্ষণের অনেক তথ্য উপাত্ত প্রকাশিত আছে, কিন্তু সঠিক কোন পরিসংখ্যান বা তথ্য আমাদের নেই। এক তথ্যে জানা যায়, বাংলাদেশে কোথাও না কোথাও প্রতি ২১ মিনিটে একটি করে ধর্ষণকান্ড ঘটে। প্রকৃত সংখ্যাটা সম্ভবত এর চাইতে বহু গুণ, কেননা ৯০ শতাংশ ধর্ষণই লোকলজ্জায় কিংবা পরিবারের অমতে গোচরে আনা হয় না। এই বিপুল পরিমাণ ধর্ষণের যারা শিকার, তাদের ১৮ শতাংশই নাবালিকা, অনেকেই চার-ছয় বছরের শিশু। সর্বোপরি নথিভুক্ত ধর্ষণকান্ডগুলির ৯৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই ধর্ষকরা ধর্ষিতাদের আত্মীয়, স্বজন, নিকট প্রতিবেশী বা পূর্বপরিচিত। আর এখানেই সামাজিক ভরসা ও বিশ্বাসের সনাতন, সযত্নলালিত ধারণাগুলি ভাঙ্গে পড়ার প্রসঙ্গটি উঠে পড়ে। দেহরক্ষীর হাতে নিহত হওয়ার মধ্যে যেমন বিশ্বাসহানি রযেছে, তেমনই বিশ্বাসভঙ্গের ব্যাপার আছে আত্মজনের হাতে যৌননিগ্রহের ঘটনায়ও। যাকে রক্ষা করার কাজে নিযুক্ত, তাকেই হত্যা করা যেমন কৃতঘ্ন বিশ্বাসঘাত, আত্মীয়তা কিংবা পূর্বপরিচয়ের সূত্রে অর্জিত বিশ্বাসের সুযোগ নিয়ে ধর্ষণ করাও সমান নারকীয়তা।

শারীরিক, মানসিক, পারিবারিক ও সামাজিক বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে ধর্ষণের পরিণতিই এক ও অভিন্ন হলেও এ ধরনের ধর্ষণকে ইদানীং ‘পারিবারিক হিংসা’র পর্যায়ভুক্ত করা হয়। পরিবারের ভিতরে পুরুষ আত্মীয় ও গুরুজনদের দ্বারা বা পরিবারের বাহিরে নিকট প্রতিবেশীদের দ্বারা যৌননিগ্রহের শিকার হওয়া মহিলারা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাঁদের দুর্গতির কথা মুখ ফুটে বলতে পারেন না, পুলিশের কাছে অভিযোগ করা তো দূরস্থান। কারণ পরিবারই সেই নিগ্রহ-লাঞ্ছনার কথা চেপে যায়, লাঞ্ছিতাকে পরিবারের সামাজিক মর্যাদাহানির ভয় দেকিয়ে চুপ করিয়ে রাখে, প্রায়শ তাাদের দূরে কোথাও পঠিয়ে দেয়। তাতে পরিবারের ‘মর্যাদা’ অক্ষত থাকে, ধর্ষক পুরুষ আত্মীয়ও নিষ্কলঙ্ক থাকে যায়। আর এখানেই ভিতরে ভিতরে চলতে থাকে পিতৃতন্ত্রের লীলা, নারীর প্রতি বৈষম্যের অনুশীলন। পরিবারের গন্ডির মধ্যে শুরু হওয়া এই অনুশীলনই বৃহত্তর সমাজেও ছড়িয়া পড়ে।

ধর্ষিতা ধর্ষণের স্বীকার হননা কেবল; ধর্ষিতাকে নিয়ে আজে বাজে কথাও রটনা করা হয়। ধর্ষকদের পক্ষ নেওয়া ক্ষমতাধরগণ ধর্ষিতা নারীর পোশাক-আশাক, ‘স্বভাব-চরিত্র’, একাকী, ‘অসময়ে’ পথে চলার দুঃসাহস নিয়ে কটাক্ষ করে কার্যত ধর্ষকদের অপরাধ লঘুকরতে সচেষ্ট হন। তখন তাতে ধর্ষিতা নারীর মর্যাদা ও সম্মান ভূলুণ্ঠিতই হয় বটে! পুলিশ যখন ধর্ষণকারী দুর্বৃত্তের সাথে ধর্ষিতা মহিলার ‘আগে হতেই সম্পর্ক থাকা’র অজুহাত দেয়, তখনও দুষ্কৃতী-দমন অপেক্ষা তার শিকারদের দোষ ধরার কদর্য চেষ্টা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এটা ধর্ষকদেও প্রশ্যয় দেয়ার সামিল। এ কারণেই ধর্ষণ বাড়ছে।

পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ধর্ষনণ তো বেড়েছেই। বেড়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতাও। কঠোর আইন, প্রচার ও উচ্চ আদালতের নানা নির্দেশনার পরও নারীর প্রতি সহিংসতা ও নিষ্ঠুরতা কমানো যাচ্ছে না। ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা হচ্ছে কম। যাদেও আইনের আওতায় আনা হয় তাদেও (ধর্ষণকারী) কিন্তু দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয় না। তাই কিছুতেই ঠেকানো যাচ্ছে না ধর্ষণ। অপরাধ বিশেষজ্ঞরা নারীর প্রতি সহিংসতা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিচারহীনতাকেই দায়ী করেন।
যৌন নির্যাতন করছে জনপ্রতিনিধি, কলেজ শিক্ষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক, ডাক্তার, কর্মচারি, পুলিশ, আত্মীয়, চাচা-মামা-খালু, দুলাভাই, আমলা। কেউ বাদ যাচ্ছে না। ধর্ষিত হচ্ছে ছাত্রী, শিশু, যুবতী, আয়া, বুয়া; গৃহবধূ।

রাস্তা ঘাটে, চলন্ত বাসে, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে, গৃহে ঘটছে এই পৈচাশিক ঘটনা। কোথাও আজ নারীরা নিরাপদ নয়। যৌন হয়রা! ধর্ষনের পর খুন হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে থাকছে না বয়স, স্থান, কাল, পাত্রের ভেদ। দেশব্যাপী শুরু হয়েছে ব্যভিচারের চূড়াান্ত- প্রকাশ্য ধর্ষণকামিতা। রাত-বিরাতে নয় শুধু, দিনদুপুরে প্রকাশ্য ধষর্ণের ঘটনাও ঘটছে। শুধু ধর্ষণই নয়, রীতিমতো গণধর্ষণ হচ্ছে। অপসংস্কৃতি আর ভিনদেশীসংস্কিৃতির আগ্রাসন আমাদের সমাজকে কতটা ক্ষতবিক্ষত করছে তা হালআমলের ধর্ষণের চিত্র দেখলেই বেশ টের পাওয়া যায়। বাসের ভেতরে ধর্ষিত হচ্ছে মেয়েরা, শিক্ষাঙ্গনে যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে শিক্ষার্থীরা, এমপির কথিত এপিএসর দ্বারাও এদেশে ধর্ষিত হচ্ছে যুবতী। এই হলো বাস্তবতা। তবে এটি নতুন কোন বিষয় তা নয়; বলা যায় আমাদের সমাজ বাস্তবতার এক করুন চিত্র। কছু মানুষরূপী নরপশু সভ্যতার ভাবধারাকে পাল্টে দিতে হাযেনার নখ মেলে বসেছে। অপরাধের সাজা না হলে এ জাতিয় অপরাধ বাড়ছে।

যৌন হয়রানি শুধু নারীর বিরুদ্ধে নয়, মানবতার বিরুদ্ধে চরম অপরাধ। বিশ্বের যেসব দেশে ধর্ষণ বাড়ছে এশিয়ার মধ্যে ভারত ও বাংলাদেশে ধর্ষণের অপরাধ বেশি হয়ে থাকে। খুন, ধর্ষন আজকাল এই আধুনিক পৃথিবীর নিত্যনৈমেত্তিক ঘটনা হলেও আমাদের দেশে এর মাত্রা যেন সব বিচিত্রতার সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞকদের মতে, ধর্ষণের এই ব্যাপকতার পিছনের অন্যতম একটি কারণ হচ্ছে, ইসলামী মূলবোধ মেনে না চলা এবং অপরাধীর শাস্তিনা পাওয়া। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নির্লিপ্ততা ও তাদের তৎপরতাও দায়ী। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে যথেষ্ট শক্তিশালী আইন থাকা সত্ত্বেও নির্যাতনকারীরা বিভিন্ন উপায়ে পার পেয়ে যায়।

বাংলাদেশের আইন ভারতের চেয়েও শক্তিশালী। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন ২০০০ (সংশোধিত ২০০৩)-এর ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে তবে সে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হবে। একই আইনের ৯ (২) ধারায় আছে, ‘ধর্ষণ বা ধর্ষণ পরবর্তী কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটলে ধর্ষকের মৃত্যুদন্ড বা যাবজ্জীবন কারাদন্ড হবে।’ একই সঙ্গে জরিমানার কথাও আছে। সর্বনিম্ন জরিমানা ১ লাখ টাকা। ৯(৩) ধারায় আছে, ‘যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং উক্ত ধর্ষণের ফলে কোনো নারী বা শিশু মারা যায় তাহলে প্রত্যেকের যাবজ্জীবন কারাদন্ড বা মৃত্যুদন্ড, কমপক্ষে ১ লাখ টাকা জরিমানা হবে’। ভারতে এক্ষেত্রে শুধু যাবজ্জীবনের কথা বলা আছে। মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামী খালাস পেয়ে থাকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে ‘প্রশাসনে দলীয় লোক থাকার কারণে এসব ঘটনার অপরাধীরা ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়।

রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাওয়ার আরেক কারণ। এছাড়া ফৌজদারি আইনের দুর্বলতার কারণে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি হয় না। এ বিষয়ে ‘জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই এরা শাস্তি পাবে।’ শুধুমাত্র আইন প্রয়োগের অভাবে এখানে ধর্ষণ মহামারী ব্যাপক রূপ নিয়েছে।
ধর্ষন হলো এমন প্রকার যৌন লাঞ্ছনা যার সাথে শাররীক সম্পর্ক জড়িত, যা এক বা একাধিক ব্যক্তির অপর পক্ষের সম্মতি ব্যতিরিকে শাররীক সম্পর্ক স্থাপনের ক্রিয়াা। এটি বড় ধরনের একটি অপরাধ। এই কাজে বেশিরভাগ সময় শারীরিক শক্তি, বাধ্যতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদি নিয়ামক হিসেবে কাজ করে। যৌন হয়রানির চরম ক্ষতিকর প্রভাব এবং এর ফলশ্রুতিতে অন্যন্য সমস্যা হয়রানির শিকার হওয়া নারীর সাথে সাথে পরিবার এবং সমাজেও বিরুপ পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ধর্ষণ বলেন কিংবা ছোটখাট ইভটিজিং এর কথাই বলেন; একজন নারীর জন্য তা কল্পনাতীত ভাবে অস্বস্তিকর। পুরুষ ভাইদের কাছে হাতজোড় মিনতি জানাই এ গর্হিত কাজ থেকে বিরত থাকুন। অন্যকে উত্তোক্ত করে আপনি ক্ষনিকের জন্য মজা পাবেন। আপনার সামান্য মজার বিপরীতে বোনটির কি অবস্থা হচ্ছে তা কি একটু ভাববেন? নারীকে সম্মান করার মানেই হলো মায়ের জাতকে সম্মান করা। মা জাতিকে সম্মান করা মানে হলো আপনার জন্মকে সম্মান দেখানো।

আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শান্তি প্রদান বেশ কঠিন। সব কিছুতেই আজ দলদারি চলে। আর তাতেকিছু মানুষ এ ধরণের অপরাধ করার সাহস পাচ্ছেন। যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। নারীর ওপর বলপ্রয়োগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতে পারে। কখনও দেখা যায়, সামাজিকভাবে কোনঠাসা কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার আশায় অলীক কল্পনা করতে থাকে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সমাধান না পেয়ে, বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেয়। ঘরে-বাইরে নারীর উপর আগ্রাসী যৌন আচরণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ সবই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অধনস্ততাই প্রকাশ করে নানারূপে। তাই ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন, নারীর সম্মতি ব্যতিরেকে তার উপর যে কোনো ধরনের আগ্রাসী যৌন আচরণ ক্ষমতা প্রদর্শনের, দমন-পীড়নের, কর্তৃত্ব করার কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে যার জন্ম, সচেতন চেষ্টা ছাড়া নারীবান্ধব, নারীবাদী, সে কোনোভাবেই হয়ে উঠতে পারে না। দৃষ্টিভঙ্গিটা পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীকে তারা গণ্য করে অধস্তন লৈঙ্গিক পরিচয়ের বস্তু হিসেবে যা পীড়নযোগ্য। এটা খুবই আশঙ্কার কথা যে, একজন মেয়ের জন্য সমাজের কেউ নিরাপদ নয়।

যাঁরা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপর তলার মানুষ, এই জাতীয় বিপদ তাঁদের ছুঁতে পারে কম। এদেশে ধর্ষণের শিকার হচ্ছে নির্ন্মবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশী। যাঁরা নিম্নবর্গের বাসিন্দা, তাঁরা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করেন। ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন আইন আদালত করলে তাদেও ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় কওে অপরাধিরা এভাবে পাড় পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষন বেড়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ঈমান শক্তি হারিয়েছি। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, যৗন কামনা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রেরণা আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। তাই সমাজ থেকে সুখ, শান্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠন মূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রটি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে । অনিয়ন্ত্রিত যৌন কামনার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ধর্ষণ, জেনা, পরকীয়া প্রেম ইত্যাদির প্রবণতা বাড়ছে। পাশ্ববর্তী ভারতে ধর্ষনের ঘটনা ঘটলে হৈ চৈ পরে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের জনগন একেবারেই নীরব। সচেতন কম। প্রতিবাদ হয়না হলেও খুবই সামান্য । মনে হয় ভারতেই হরে দরে ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে নয়!

অন্যায়কারী এমন জঘণ্য অন্যায় করার পরও প্রশাসন নিবর থাকে সরকারের কোন মাথা ব্যাথা নেই। ধর্ষণ বৃদ্ধি হওয়ার জন্য সরকার ও তার প্রশাসনের ব্যর্থতায় এ জন্য দায়ী। কারণ যারা এর শিকার হন তারা সবাই দরিদ্রসীমার নিচে বাস করে তাই আইনও এদের পাত্তা দেই না। তবে এর শিকার যদি প্রশাসনের কোন কর্মকর্তার মেয়ে বোন, অথবা মানোনীয় সাংসদদের মন্ত্রীদের মেয়ে বোন হত তা হলে আপরাধিরা শাস্তি পেত। তারা উচ্চ বর্গিয় তাই তাদের সন্তান বোন আর স্ত্রীরা ধর্ষিত হওয়া সুযোগ কম। তবে মেয়েদের প্রতি পদেই বিপদের মোকাবিলা করতে হয় আজকের সমাজে, শ্রেণীবিভাগ ব্যতিরেকেই। উচ্চবর্গিয়রা নিরাপত্তার ঘেরাটোপে বাস করেন বলে ঘরের মধ্যে তাদের বিপদ কিছু কম হতে পারে তবে পার্টিতে অপরিচিত বা স্বল্পপরিচিতের হাতে, আর ঘরে নিকট আত্বীয় বা পরিচিতজনদের হাতে লাঞ্ছনা জোটার সম্ভাবনাটাও উড়িয়ে দেয়া যায় না। আসল সমস্যাটা হলো কুরুচিপূর্ণ পূরুষদের দৃষ্টিভঙ্গিতে, সেটা কোনো শ্রেণীভাগ মানে বলে মনে হয় না। এমনকি শিক্ষাগত যোগ্যতাও এই মানসিকতা বদলাতে পারে না। তা নাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের মত স্থানে শিক্ষকের হাতে ছাত্রী, ডাক্তারের হাতে রোগী কিংবা ডাক্তারনী ধর্ষিত হয় কি করে ?

যৌন-ব্যভিচার সর্বযুগে, সর্বধর্মমতে নিন্দনীয় নিকৃষ্ট পাপাচার। ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার চূড়ান্ত শাস্তিবিধান মৃত্যুদন্ড। অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করা হলে এবং সাক্ষ্য-প্রমাণে নিশ্চিত হলে হত্যাকারীর শাস্তিও মৃত্যুদণ্ড। কিন্তু আমাদেও দেশে এ যাবৎ যতগুলো ধর্ষণ ও ধর্ষণজনিত হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে, তার যথাযথ বিচার সম্পন্ন হযয়েছে এরূপ নজির কমই আছে। হয় চুড়ান্ত রিপোর্টে ঘপলা নয়তো স্বাক্ষপ্রমানে প্রভাবিত করে অপরাধি পার পেয়ে যাচ্ছে ঠিকই। উপরন্তু এর বিচার চাইতে গিয়ে বিচারপ্রার্থীরা নির্বিচারে পাল্টা হত্যার হুমকি কখনো কখনো হত্যার শ্বিকার ও হয়রানির শিকার হন। এ অবস্থা থেকে আমাদের অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে। ১৯৯৫ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ বিশেষ বিধান আইন করা হয়। পর্যায়ক্রমে ২০০০ সালে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন করা হয়। ২০০৩ সালে এ আইন আবার সংশোধন করা হয়।

ধর্ষণের শাস্তি কত ভয়ানক, তা অনেকেই জানেন না। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের ৯ ধারায় ধর্ষণের বিচার হয়। এ আইনে ধর্ষণের সর্বনিম্ন শাস্তি পাঁচ বছরের কারাদন্ড এবং সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদ করা হয়েছে। আইনের ৯(১) ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো পুরুষ কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে, তাহলে সে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া অর্থদন্ডে দন্ডিত হবে। ৯(২) উপধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি কর্তৃক ধর্ষণ বা ওই ধর্ষণ-পরবর্তী তার অন্যবিধ কার্যকলাপের ফলে ধর্ষিত নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে, তাহলে ওই ব্যক্তি মৃত্যুদে বা যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। অতিরিক্ত এক লাখ টাকা অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত হবে। উপধারা ৯ (৩)-এ বলা হয়েছে, যদি একাধিক ব্যক্তি দলবদ্ধভাবে কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে এবং ধর্ষণের ফলে ওই নারী বা শিশুর মৃত্যু ঘটে বা তিনি আহত হন, তাহলে ওই দলের প্রত্যেক ব্যক্তি মৃত্যু দন্ডেদন্ডীত হবে, যদি কোনো ব্যক্তি কোনো নারী বা শিশুকে ধর্ষণ করে মৃত্যু ঘটানোর বা আহত করার চেষ্টা করে, তাহলে ওই ব্যক্তি যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ডে দন্ডিত হবে ও এর অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হবে। ধর্ষণের চেষ্টা করলে ওই ব্যক্তি সর্বোচ্চ ১০ বছর ও সর্বনিম্ন পাঁচ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হবে। এ ছাড়া অতিরিক্ত অর্থদণ্ড দণ্ডিত হবে।

এদেশে ধর্ষণের পাকাপোক্ত আইন আছে ঠিকই কিন্তু আইনেকে কাজে লাগানো যাচ্ছে না। আইনের যারা প্রয়োগ করবেন তারা ঐ আইনের পথে হাটেন না। কখনো অর্থের লোভ কখনোবা হুমকি ধমকিতে শুরুতেই গলদ দেখা দেয়। মামলার চার্যশিট গঠনের সময় ফাক ফোকর থেকে যায়। তাই শেষে রায়ে ধর্ষিত কিংবা নির্যাতনের শিকার লোকজন সঠিক বিচার থেকে বঞ্চিত হন। ধর্ষণ যেহেতুক মস্ত অপরাধ এসব মামলাগুলোর ক্ষেত্রে চার্যশিট গঠনের সময় কোন মেজি্েট্রটে অথবা পুলিশের কোন পদস্থ কর্মকর্তার নজরদারিতে করা যেতে পারে। এ ক্ষেত্রে চুড়ান্ত রিপোর্টেও সময় ভিক্টিমের স্বাক্ষাত গ্রহন করা যেতে পারে। তাতে করে গোপনে চার্যশীট দাখিলের ফলে যে জটিলতা তৈরি হয় তা কমে আসবে।

কি আছে ধর্ষণ আইনে?

ধর্ষণ আইনে ধর্ষণের সংজ্ঞা নিয়ে অনেকেই, বিশেষকরে নারী সংস্থাগুলি আদৌ সন্তুষ্ট নয়। এই আইনে পুরুষাঙ্গ স্ত্রী-যৌনাঙ্গের ভেতরে প্রবেশ না করলে সেটি ধর্ষণ বলে গণ্য করা হবে না। অথচ বহু ভাবেই পুরুষ নারীর ওপর যৌন-অত্যাচার (sexual assault) করতে পরে - দুর্ভাগ্যবশতঃ ধর্ষণ আইনের আওতায় সেগুলি পড়বে না। ধর্ষণ আইনে একজন পুরুষ তখনই একটি নারীকে ধর্ষণ করেছে বলে ধরা হবে, যখন দুজনের যৌন-সংসর্গ ঘটছে: (১) সেই নারীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে (২) সেই নারীর সন্মতি ছাড়া (৩) সেই নারীর সন্মতি নিয়ে, কিন্তু সেই সন্মতি আদায় করা হয়েছে তাকে বা তার প্রিয়জনকে হত্যা বা আঘাত করা হবে বলে ভয় দেখিয়ে। (৪) নারীটি সন্মতি দিয়েছে এই বিশ্বাসে যে পুরুষটি তার স্বামী, যদিও পুরুষটি জানে যে সে তার স্বামী নয়, (৫) নারীটি যখন সন্মতি দিয়েছে তখন সে প্রকৃতিস্থ ছিলো না, অথবা পুরুষটি বা অন্য কারো দেওয়া হতবুদ্ধিকর বা বাজে কোনো বস্তু খেয়ে নেশাগ্রস্থ অবস্থায় ছিলো - যার ফলে এই সন্মতির দানের পরিণাম বোঝার ক্ষমতা তার ছিলো না, (৬) নারীটির সন্মতি থাকুক বা না থাকুক - তার বয়স ১৬ বছরের কম।

এ ব্যাপারে দুটি ব্যতিক্রম আছে: (ক) স্বামী ও স্ত্রীর যৌন-মিলনকে কোনো ক্ষেত্রেই ধর্ষণ বলে ধরা হবে না, যদি না স্ত্রীর বয়স ১৫ বছরের কম হয়, অথবা আদালতের নির্দেশে স্বামী স্ত্রী আলাদা ভাবে থাকে। (খ) নারীর উপর অশালীন আক্রমণ (Indecent assaul) ধর্ষণের চেষ্টা বলে ধরা হবে না, যদি না আদালত মনে করে যে অভিযুক্ত পুরুষটি সব রকম বাধা পাওয়া সত্বেও সর্বক্ষণই নিজের কাম-চরিতার্থ করার জন্য সচেষ্ট ছিলো। আইন যাই থাকুক না কেন আমাদের সমাজের অতি-রক্ষণশীলতা এবং পারিবারিক সমস্যাকে গোপন রাখার চেষ্টা ধর্ষণকারীদের শাস্তি দেবার ক্ষেত্রে বিরাট অন্তরায়। যৌন নির্যাতন তথা ব্যভিচার সর্বযুগে সর্বধর্মমতে নিকৃষ্টতম পাপাচার। তন্মধ্যে মুসলিম ধর্মগ্রন্থ আল-কুরআনের বিভিন্ন সূরার বিভিন্ন আয়াতে মহান আল্লাহ ব্যভিচার সম্পর্কিত পাপের ভয়াবহতা ও এর কঠিন পরিণতিসম্পর্কে সুস্পষ্টভাবে মানবজাতিকে সাবধান হতে বলেছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘তোমরা ব্যভিচারের ধারেকাছেও যেও না, কারণ এটা একটা অশ্লীল এবং জঘন্য পন্থা।’ এ অপরাধ কোন দেশে কোন যুগেই বন্ধ ছিল না। এখনো নেই। কোন অপরাধ কখনই নিঃশেষ করা যায় না কিন্তু নিয়ন্ত্রন করা যায়। যে কোন মূল্যে নিয়ন্ত্র করতে হবে। আমরা পুরুষরা (সবাই নন) নারীকে মানুষের মর্যাদা দেইনি কখনই। নারীকে বানিয়েছি ভোগের বস্তু। এ মানুষিকতা দুর করতে হবে।

ধর্ষণ রোধের উপায় কি?

দেশে এত ধর্ষণ হচ্ছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তরে অনেকেই বলেন- ভাল মেয়েরা ধর্ষণের শিকার হয় না ; পোশাকের সমস্যার কারনে মেয়েরা ধর্ষিত হয়। অনেকে আবার বলেন বেহায়াপনা করে স্বল্প কাপড়ে রাস্তায় ঘুরে বেড়ালে ধর্ষণ হবে না তো কি হবে? আর কোন আলেম বলবেন- ‘পর্দা প্রথায় ফিরে আসলে ধর্ষণ আর হবে না।’ আবার অনেকে বলবেন- ‘কঠোর শাস্তি দিলে ধর্ষন কমবে।’ আমি এসব কোনটার পক্ষেই নই। সেই মক্কা-মদিনায়র আরব দেশে পর্দা মানা হয় সেখানেও তো ভুরি ভুরি ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে। তাদের শাস্তি প্রকাশ্য শিরচ্ছেদ। কৈ সেখানেও তো ধর্ষণ বন্ধ হচ্ছে না। আমাদের দেশ থেকে যেসব অসহায় নারী আরব দেশে যান তাদের আনেকেইতো দেশে সুরক্ষিত ফিরে আসতে পারেন না। তারা কোননা কোন ভাবে নারী নির্যাতনের শিকার হনই। আমাদেও দেশের নারী শ্রমিকরা আরব দেশে গিয়ে পর্দায় থেকেও কেন যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন? যৌন নির্যাতন বন্ধে আগে মানুষিকতা বদলাতে হবে। নারী দেখলেই কেন ধর্ষণ করতে হবে? সব দোষ নারীর? সব দোষ পাশাকের ? এমন মানোষিকতা কেন আমাদের। ধর্মে নারীকে পর্দা করতে বললেও পুরুষদেরও চোখ অবনত রাখতে বলা বয়েছে। তবে শুধু নারীর দোষ কেন? নারীর রুপ যৌবন পুরুষকে মোহিত করবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই বলে তার উপর পশুর মতো ঝাপিয়ে হতে হবে কেন? ধর্ষণ কমাতে হলে আগে পুরুষের মাঝে মানুবিক গুণাবলী জাগ্রত করতে হবে। ধর্ষণ রোধে আমাদের সচেতন হতে হবে। অবাধ মেশামেশার সুযোগ, লোভ-লালসা-নেশা, উচ্চাভিলাষ, পর্নো সংস্কৃতির নামে অশ্লীল নাচ-গান, যৌন সুড়সুড়িমূলক বই-ম্যাগাজিন, অশ্লির নাটক-সিনেমা ইত্যাদি কামোত্তেজনা মানুষকে প্রবলভাবে ব্যভিচারে প্ররোচিত কওে তা বর্জন করতে হবে। নিজেকে নিয়ন্ত্রন করতে হবে। সময় মত বিয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। ধর্মীয় শিক্ষা ও যৌন শিক্ষার গ্রহন করতে হবে। বাজে সঙ্গ ও নেশা বর্জন করতে হবে। পাশাপাশি নারীকেও শালিন হতে হবে। যৌন উত্তেজক পোষাক বর্জন করতে হবে। প্রবল কামোত্তেজনা মানুষকে পশুতুল্য করে ফেলে। ব্যাপকভাবে কামোত্তেজনা সৃষ্টিকারী উপকরণগুলোর কাছাকাছি চলে গেলে নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের আর কোনো উপায়ই থাকে না।

যেহেতু এ দেশে ধর্ষর্ণের বিচার হয় খুব কম তাই ধর্ষক আপনাদের বলছি- মনের ভেতরতো ক্ষেপা কুকুর বাস করে। মনের কুকুটাকে কি কোরবানি দেয়া যায় না? কুরুচিশীল নিষ্ঠুর মানুষই ধর্ষণ করে। ধর্ষকরা আবার খুনিও হয়। অমানুষগুলোইতো ধর্ষণ আর ধর্ষণের পর খুনের মতো ঘটনা ঘটাতে পারে। ধর্ষকদের প্রকাশ্যে বিচারের আওতায় আনা হউক। এটাও বোধ করি এ দেশে অসম্ভব! যারা আইনের কাজ করেন তারা অনেকেই ঘুষঘাস খান। তাহলেতো বিচার হয়েছেই! ধর্ষক বেঁচে যাবে; সাজা হবে ধর্ষিতা, ধর্ষিতার পিতা কিংবা ভাইয়ের! অবাক হলেও এটাই হয় এ দেশে। ধর্ষণ মামলা করে ধর্ষিতার ভাই, পিতা খুন কিংবা ডাকাতির মিথ্যা মামলায় ঝোলে। এর ঢের প্রমাণ আছে এ দেশে। জানি উচিত কথায় মুর্শিদগণ বেজার হন। পাঠক আপনারাই বলুন, আমি কি খুব ভুল বললাম? ভুল হলে ক্ষমা চাই। সব কিছুর পর ধর্ষণ রোধের উপায় চাই; সব ধর্ষণের বিচার চাই।

মহিলা আইনজীবী সমিতির এক জরিপে জানা যায়, নানা কারণে ধর্ষণ মামলার ৯০ শতাংশ আসামি খালাস পেয়ে থাকে। অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসনে অযোগ্য লোক থাকায় অপরাধীরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় পার পেয়ে যাওয়াও এর আরেক কারণ। এ ছাড়া ফৌজদারি আইনের দুর্বলতার কারণে অপরাধীর উপযুক্ত শাস্তি হয় না। এ বিষয়ে জনগণের প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই এরা শাস্তি পাবে। শুধু আইন প্রয়োগের অভাবে এখানে নারী নির্যাতন ও ধর্ষণ মহামারী রূপ নিয়েছে। আমাদের প্রচলিত ব্যবস্থায় অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান বেশ কঠিন। সব কিছুতেই আজ দলবাজি চলে। তাতে কিছু মানুষ এ ধরনের অপরাধ করার সাহস পাচ্ছে। যৌন নির্যাতনের সঙ্গে ক্ষমতার সম্পর্ক আছে। নারীর ওপর বলপ্রয়োগের বহিঃপ্রকাশ হিসেবেও যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটতে পারে। কখনও দেখা যায়, সামাজিকভাবে কোণঠাসা কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো ব্যক্তির সঙ্গে স্বাভাবিক সম্পর্ক গড়ার আশায় অলীক কল্পনা করতে থাকে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত সমাধান না পেয়ে, বলপ্রয়োগের পথ বেছে নেয়। ঘরে-বাইরে নারীর ওপর আগ্রাসী যৌন আচরণ, যৌন হয়রানি, যৌন নিপীড়ন, ধর্ষণ সবই পুরুষতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামোতে নারীর অধঃস্তনতাই প্রকাশ করে নানারূপে। তাই ধর্ষণ, যৌন হয়রানি বা নিপীড়ন, নারীর সম্মতি ছাড়া তার ওপর যে কোনো ধরনের আগ্রাসী যৌন আচরণ ক্ষমতা প্রদর্শনের, দমন-পীড়নের, কর্তৃত্ব করার কুৎসিত বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছুই নয়।

দৃষ্টিভঙ্গি পুরুষতান্ত্রিক বলেই নারীকে তারা গণ্য করে অধঃস্তন লৈঙ্গিক পরিচয়ের বস্তু হিসেবে, যা পীড়নযোগ্য। এটা খুবই আশঙ্কার কথা যে, সমাজে বেশিরভাগ নারীই নিরাপদ নয়। যারা উচ্চবিত্ত, সমাজের ওপরতলার মানুষ, এ জাতীয় বিপদ তাদের ছুঁঁতে পারে কম। এ দেশে নিপীড়নের শিকার হচ্ছে নিম্নবিত্ত আর মধ্যবিত্তরাই বেশি। যারা নিম্নবর্ণের বাসিন্দা, তারা সম্ভবত এখনও ধর্ষণকে স্বাভাবিক জ্ঞান করেন। ভয়ে চুপ থাকেন। ইজ্জত হারিয়েও মুখ খোলেন না। তারা জানেন, আইন-আদালত করলে তাদের ভাগ্যে উল্টো বিপত্তি ঘটবে। অন্যায় করে অপরাধীরা এভাবে পার পেয়ে যাচ্ছে বলেই দেশে ধর্ষণ বেড়ে গেছে। বর্তমানে আমরা ইমানি শক্তি হারিয়েছি। দেশপ্রেম, সততা, নৈতিক মূল্যবোধ, যৌন কামনা ইত্যাদি নেতিবাচক প্রেরণা আমাদের অন্ধ করে ফেলেছে। তাই সমাজ থেকে সুখ, শাস্তি বা আনন্দ হারিয়ে যাচ্ছে। নিঃশর্ত ভালোবাসা বা ভক্তি কমে যাওয়ার কারণে আমাদের গঠনমূলক মনোভাব বা সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হচ্ছে। এ কারণে বিপরীত লিঙ্গের প্রতি শ্রদ্ধার পরিবর্তে আমাদের ভোগের মনোভাব সৃষ্টি হচ্ছে। অনিয়ন্ত্রিত যৌন কামনার প্রভাবে আমাদের মধ্যে ধর্ষণ, জেনা, পরকীয়া ইত্যাদির প্রবণতা বাড়ছে। পার্শ্ববর্তী ভারতে ধর্ষণের ঘটনা ঘটলে হৈচৈ পড়ে যায়। এ ব্যাপারে আমাদের দেশের জনগণ একেবারেই নীরব। সচেতন কম। প্রতিবাদ হয় না, হলেও খুবই সামান্য।

ধর্ষণের ভয়াবহতা থেকে বাঁচতে হলে কেবল আইনের কঠোর প্রয়োগও কোনো কাজ হবে না। এর জন্য প্রয়োজন জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে যার যার পারিবারিক বলয়ে ধর্মানুশীলনে একনিষ্ঠতা, পোশাকের শালীনতা, অশ্লীল সংস্কৃতিচর্চার পরিবর্তে শিক্ষণীয় বিনোদনমূলক ও শালীন সংস্কৃতি চর্চার প্রচলন নিশ্চিতকরণ। আর এটা করতে হলে কেবল রাজনৈতিক বক্তৃতা, আইনের শাসন প্রয়োগ বা ফতোয়া দিলেই চলবে না, সমাজের সর্বস্তরের মানুষ যার যার অবস্থানে থেকে স্কুল-কলেজ মাদরাাসা-মক্তব-মসজিদ-মন্দির-গির্জা-প্যাগোডার নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সমাজের অন্য বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের সমন্বয়ে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সর্ব্বোপরি কঠোর শাস্তির বিধান ও প্রয়োগ নিশ্চত করতে হবে। নারীকে মর্যাদার আসনে বসাতে হবে। পর নারীকে কখনো মা, কখনো বোন, কখনোবা মেয়ে ভাবতে হবে। তাদের উপর লুলুপ দৃষ্টি নয়; মায়ামমতার দৃষ্টি দিতে হবে। তবেই ধর্ষন কমে আসবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

০৫ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test