E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

একুশের চেতনা ধারণ করে ‘বাংলা ভাষা’কে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে

২০২৪ ফেব্রুয়ারি ২৪ ১৫:৩৫:৩৪
একুশের চেতনা ধারণ করে ‘বাংলা ভাষা’কে সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে হবে

মোহাম্মদ ইলিয়াছ


একুশ কেবল বাংলা ভাষার লড়াই ছিল না। একুশ ছিল বাংলাদেশীদের সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম। বাংলা ভাষা ও বাঙালি সংস্কৃতির অস্তিত্ব রক্ষার সেই লড়াইয়ের সাথে ওতপ্রোথভাবে জড়িয়ে ছিল শিক্ষা, সমাজ ও অর্থনীতির লড়াইও। একুশ ছিল বাংলার মানুষের এগিয়ে যাওয়ার সংগ্রাম। আজ পৃথিবীব্যাপী এ দিনটি পালিত হচ্ছে মাতৃভাষার চর্চা ও মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার চেতনায়। একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে আমরা এক অকৃত্রিম আবেগের সৌধ নির্মাণ করেছি। যার সাথে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল ও জাতিচেতনামূলক আন্দোলনের চালিকাকেন্দ্র হয়ে আছে সর্বত্র। প্রতিটি গণ-আন্দোলনের চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছে ভাষা আন্দোলন।

যে ভাষার জন্য এত আন্দোলন, এত আত্মত্যাগ এত অহংকার সেই ভাষার মূল্য আমাদের বর্তমান প্রজন্মের কাছে কতটুকু? বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির প্রভাব তাদের জীবনে কতটুক পড়ছে আমরা কি কখনও ভেবে দেখেছি? বিষয়টি চমকে ওঠার মতোই, হ্যাঁ এই একবিংশ শতাব্দীর প্রজন্মের কাছে ভাষা দিবস হল সাদাকালো জামা পরে ছবি তুলে ঘোরাঘুরির মাস। তারা কি শুধুই ঘুরছে, ফুল দিচ্ছে নাকি আসলেই হৃদয়ে ধারণ করছে? এ মাসের ইতিহাস জানা নেই অধিকাংশের কাছে, শিশুদের মধ্যে অনেকে বাংলা বর্ণই চেনে না যা মোটেও কাম্য নয়। প্রতিবছর বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের সাক্ষাৎকার, পত্রপত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় উঠে আসে এর প্রমাণ, অনেকেই জানে না একুশে ফেব্রুয়ারিতে আসলে কী ঘটেছিল আমাদের দেশ ও জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ও দুঃখজনক একটি বিষয়।

আমাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং জীবনযাপন এখন পুরোপুরি পাশ্চাত্য অভিমুখী। খুব কম সংখ্যকই আছে যারা নিজের সংস্কৃতিকে ধারণ করে চলছে, অনেকেই পশ্চিমাদের অনুকরণ করে কথা বলতে চেষ্টা করেন। এ প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে আমাদের তরুণ প্রজন্ম ও শিশুদের মধ্যে। আমাদের ভাষা যেন আমাদের কাছেই অসহায়। বিদেশি ভাষা শিখতে গিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে এক কথায় ধ্বংস করছি। অন্য ভাষা রপ্ত করা দোষের কিছু নয় অবশ্যই তা দক্ষতা বাড়ায়। কিন্তু মাতৃভাষাকে অসম্মান করার অধিকার কোনো নাগরিকেরই নেই। অথচ কেউ কি তা মান্য করছেন? বাংলার সঙ্গে ইংরেজি মিশিয়ে একটা জগাখিচুড়ি ভাষা ব্যবহারের প্রবণতা অনেক ক্ষেত্রেই পরিলক্ষিত হচ্ছে।

বর্তমান সময়ে দেশ ও বিদেশের সংবাদ জানার জন্য আমরা অনেকাংশে নির্ভরশীল রেডিও, টেলিভিশন ও সামাজিক গণমাধ্যমগুলোর ওপর। ব্যাপক প্রচারণার জন্য এসব গণমাধ্যমের উচিত শুদ্ধ বাংলাভাষায় তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে বাংলাকে মানুষের হৃদয়ের আরও গভীরে পৌঁছে দেয়া। কিন্তু বাস্তবে যা হচ্ছে তা যথেষ্ট হতাশাব্যাঞ্জক। সরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো বাদ দিয়ে দেশের বেশিরভাগ বেসরকারি প্রচারমাধ্যমগুলো যে ভাষায় তাদের অনুষ্ঠান প্রচার করে, তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। এফএম রেডিওর জকিরা তাদের ইচ্ছামতো ভাষার ব্যবহার করেন। বাংলা এবং ইংরেজির ভাষা মিশিয়ে তারা নতুন এক ভাষার সৃষ্টি করে ফেলেন যা প্রতিনিয়ত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দেশের অগণিত মানুষের মধ্যে পৌঁছে যাচ্ছে। শুধু এফএম রেডিও চ্যানেলই নয়, আমাদের দেশের বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলগুলোও ভাষা বিকৃতির জন্য দায়ী। তাদের উপস্থাপকরা মনোমুগ্ধকর বাচনভঙ্গির মাধ্যমে বিকৃত বাংলা ভাষা জনসাধারণের কাছে উপস্থাপন করেন নাটক, সিনেমা ও বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে। যার প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের ওপর। ভাষার জন্য যে জাতির বুকের রক্ত ঝরেছে সেই জাতির কাছে এমনটা কোনোমতেই কাম্য হতে পারে না। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়াতে দেখা যায় তরুণ প্রজন্ম বাংলা দেশাত্মবোধক, লালন ও সাংস্কৃতিক গানগুলোকে বিকৃত করে তৈরি করছে নতুন এক সৃষ্টি এবং সেখানে হাজার হাজার ব্যঙ্গাত্মক বিরূপ মন্তব্য করা হয়।

একুশে ফেব্রুয়ারি, পহেলা বৈশাখ, ছাব্বিশে মার্চ যে দিবসগুলো বাঙালি জাতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ সে দিবসগুলোয় ভাষাকে উদযাপন করার নামে চলে অনভিপ্রেত উন্মাদনা ও নোংরামি। গুটিকয়েক দেশাত্মবোধক গান দিয়ে সকাল শুরু হলেও দিন শেষ হয় হিন্দি, ইংরেজি তথাকথিত পপ গান দিয়ে। রাস্তাঘাট, গাড়ি, ট্রাকে উচ্চৈঃস্বরে বাজাতে বাজাতে চলে যায় একদল ছেলেমেয়ে। এভাবে আমাদের ভাষাকে এক ধরনের অপমান করা হচ্ছে এ বোধটি বর্তমান প্রজন্মের ভেতরে একদমই নেই। সারা বছর দেশের সম্মান প্রদর্শন নিয়ে কেউ ভাবে না অন্তত এ বিশেষ দিনগুলোয় শ্রদ্ধা প্রদর্শন করা একজন উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য।

মাতৃভাষার জন্য আমাদের ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছেন, তাদের সেই ত্যাগ আমাদের প্রজন্মকে আলোকিত করবে, সে প্রত্যাশা অমূলক নয়। বর্তমান প্রজন্ম প্রকৃত বাংলা শুদ্ধ ভাষাকে বিকৃত করে অন্য এক হাইব্রিড ভাষা সৃষ্টি করছে, যা মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। ভাষার রূপান্তর ঘটবে, পরিবর্তন প্রকৃতির নিয়ম, কিন্তু সেটা যেন হয় প্রয়োজনের তাগিদে। তবুও আশার বাণী যে এখনও দেশের বেশ কিছু তরুণ এ তথ্যপ্রযুক্তির যুগেও মাতৃভাষাকে হৃদয়ে লালন করে সাহিত্যের মননশীল চর্চা করে যাচ্ছেন।

তরুণ প্রজন্মের মাঝে বাংলাভাষার ইতিহাস-ঐতিহ্য ভালোভাবে সংক্রমিত করতে হবে। এতেই বাংলাভাষার মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পাবে। আমাদের তরুণ প্রজন্মই আমাদের দেশ ও সংস্কৃতিকে পুরো বিশ্বের কাছে উপস্থাপন করবে। একুশের চেতনা জেগে উঠুক সবার প্রাণে নতুন প্রজন্ম, যুবসমাজের মাঝে দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা থাকুক চির অটুট এতটুকুই কাম্য। শহীদ মিনারে গিয়ে শুধু ফুল দিয়েই নয়, নতুন প্রজন্মের প্রত্যেককে মনে প্রাণে একজন ভাষা সংগ্রামী মনে করতে হবে। আবেগ দ্বারা আত্মোপলব্ধি সবচেয়ে বেশি জরুরি। নিজস্ব সংস্কৃতির চেয়ে কোনো সংস্কৃতিই বড় নয় তাদের জানানো আমাদের দায়িত্ব। আবার বাংলাকে শুধু আবেগের ভাষা হিসেবে রাখলে চলবে না। এর উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং সর্বস্তরে ব্যবহারের প্রবণতা বাড়াতে হবে। আমাদের নতুন প্রজন্মের মনে একুশের চেতনা জাগিয়ে তুলতে হবে, যেন ভাষার যথার্থ মর্ম ওরা উপলব্ধি করতে পারে।

একুশের চেতনাই আমাদের সব যড়যন্ত্রের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রমের প্রেরণা। আমাদের অগ্রযাত্রার মূলমন্ত্র ২৫ কোটি মানুষের মুখের ভাষার ওপর আস্থা স্থাপন করেই বলি : ভাষা আন্দোলনের অমর একুশে ফেব্রুয়ারি এখন আর আমাদের ইতিহাসের একটি রক্ত-রঙিন দিন নয়, এদিন এখন পেয়েছে বিশ্বস্বীকৃতি। একুশ আমাদের অহঙ্কার; আমাদের জন্য গৌরব ও প্রেরণার। একুশের তাৎপর্যকে ধারণ করতে হলে ভাষা আন্দোলনের মূল চেতনা আধিপত্যবাদবিরোধী চেতনা ও শক্তির দিকে আমাদের ফিরে তাকাতেই হবে। সেখানেই আমাদের মুক্তি নিহিত। যা এ অর্জন বাংলাদেশের মানচিত্রকে উজ্জ্বল করেছে বিশ্ব মানচিত্রে।

লেখক : উপপরিচালক (অর্থ ও বাজেট) অবসর সুবিধা বোর্ড, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ঢাকা।

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test