E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর নিষিদ্ধ ছিল ৭ মার্চের ভাষণ

২০২৪ মার্চ ০৭ ১৬:৩০:৪৫
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ২১ বছর নিষিদ্ধ ছিল ৭ মার্চের ভাষণ

মানিক লাল ঘোষ


১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে ঐতিহাসিক ও গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।  মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে জয়লাভের মধ্য দিয়ে নিপীড়িত বাঙালি জাতি লাভ করে তাদের দীর্ঘদিনের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতার স্বাদ। বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে উজ্জীবিত করেছেন যে মহামানব তিনি এদেশের সব মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক, হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান স্বাধীনতার স্থপতি, নিপীড়িত মানুষের মুক্তির কন্ঠস্বর, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

১৯৭১ সালের মার্চ মাসে এক কঠিন সংকটময় পরিস্থিতিতে ৭ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্সে তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষকে চারটি শর্ত দিয়ে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণের শেষাংশে বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম, আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম।’

অগ্নিঝরা মার্চের একাত্তরের ৭ তারিখের বিকালটা ছিল অন্যরকম। পাতাঝরা বসন্তের বিকাল এভাবে বদলে দিতে পারে একটি দেশের ইতিহাসের বা্ঁক যা , বিশ্বের ইতিহাসে বিরল ঘটনা । মাত্র ১৮ মিনিটের একটি ভাষণ একটি জাতিকে স্বাধীনতার মন্ত্রে যেভাবে উজ্জীবিত করেছিল, তার তুলনা আর কোনো কিছুর সঙ্গে হতে পারে না।

পাকিস্তানী শাষক ও শোষকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অনেকটা নিরস্ত্র হাতেই বঙ্গবন্ধুর ডাকে এ দেশের সাধারণ মুক্তিকামী মানুষ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঁচা-মরার লড়াইয়ের সংগ্রামে। বজ্রকণ্ঠে সেদিন তিনি মুক্তির ডাক দিয়েছিলেন । তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) সমবেত জনতার বিশাল জনসমুদ্রের সামনে এসে বাঙালির মুক্তির মহাদূত, মহাকাব্যের মহাকবি শোনান তার অমর কবিতাখানি। তার কবিতার প্রতিটি শব্দে ছিল এক-একটি আন্দোলনের প্রেরণা, প্রতিটি লাইনে ছিল এক একটি নির্দেশনা। তিনি তার ভাষণে একদিকে তুলে ধরেছিলেন, পাকিস্তানের ২৩ বছরে শোষণ, শাসন, বঞ্চনা, নিপীড়ন ও নির্যাতনের ইতিহাস। অন্যদিকে অসহযোগের আন্দোলনের ঘোষণা দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রস্তুতিরও ঘোষণা দিয়েছিলেন।

বিশ্ব রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ রাজনৈতিক ভাষণ। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে জাতির জনকের ওই ভাষণের দিকনির্দেশনাই ছিল সে সময়ের বজ্রকঠিন জাতীয় ঐক্যের মূলমন্ত্র। স্পষ্ট করে বলেছিলেন, ‘শহীদের রক্তের ওপর পাড়া দিয়ে, আরটিসিতে শেখ মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। অ্যাসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপর বিবেচনা করে দেখব আমরা অ্যাসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে অ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।’

বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এও বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই।’

দূরদর্শী বলেই তিনি নিশ্চিত ছিলেন ৭ মার্চে তার ভাষণের পর তাকে আর ছেড়ে দিবে না পাকিস্তান জালেম সরকার। হয় মৃত্যুর দুয়ার, নয় আবারও কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠই হবে তার শেষ ঠিকানা। তাই তিনি ঘোষণা করেছিলেন, ‘আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, যার কাছে যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা করতে হবে।’ তিনি পাড়া-মহল্লা, থানা ও জেলায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার আহবান জানান। বলেছিলেন, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেবো, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বোই ইনশাল্লাহ।

‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধু এই সাহসী তেজোদীপ্ত উচ্চারণের মধ্য দিয়ে যে মহাকাব্য বঙ্গবন্ধু রচনা করেন সেদিন রেসকোর্স ময়দানে, বাঙালি জাতির মুক্তির সনদ হিসেবে আজ তা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। ইউনেস্কোর প্রামাণ্য বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ। ৭ মার্চ শুধু আজ বাঙালি কিংবা বাংলাদেশের সম্পদ নয়, পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রনায়কদের ভাষণের মধ্যে অন্যতম। মাত্র একটি ভাষণ কি ভাবে বদলে দিলো একটি মানচিত্র, জন্ম দিলো নতুন জাতিসত্ত্বা আর নতুন রাষ্ট্রের তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। এই ভাষণের মধ্যে বিশ্বের নিপীড়িত, অধিকারবঞ্চিত মানুষ আজ তার মুক্তির দিশা খুঁজে পায়।

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে, অনেক ভাষায় তার অনুবাদ হয়েছে। কিন্তু এই ভাষণ প্রচার নিয়ে ষড়যন্ত্র ও বাধা প্রদানের ঘটনাও কম ঘটেনি। ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বপরিবারে হত্যার পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলতে প্রথম বাধা আসে ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারে বাধা। এই ভাষন মাইকে প্রচার করতে গিয়ে আওয়ামী লীগের অসংখ্য নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়েছে। দিয়েছেন তাজা প্রান, শিকার হয়েছে হামলা ও মামলার। স্বাধীনতা বিরোধী খুনীচক্রের ভয় ছিল এই ভাষণে নতুন করে বঙ্গবন্ধুর চেতনায় আবারও জেগে উঠবে বাঙালি। ৭৫ পরবর্তী স্বাধীনতা বিরোধী ও তাদের পৃষ্ঠপোষকরা যখন ক্ষমতায় আসে, তারাও বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচিতে ৭ মার্চের ভাষণ প্রচারে বাধা দেয়। দীর্ঘ ২১ বছর অনেকটাই নিষিদ্ধ ছিল ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার। তাদের মূল লক্ষ্য ছিলো ইতিহাস বিকৃতি করে বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের একজন পাঠককে স্বাধীনতার ঘোষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার ষড়যন্ত্র। সেই ষড়যন্ত্রকারীরা আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত।

ইতিহাস এমনই হয়। ষড়যন্ত্র করে ক্ষণিকের জন্য ইতিহাস বিকৃতি করা যায়, কিন্তু প্রকৃত সত্যকে বেশি দিন আড়াল করা যায় না। বঙ্গবন্ধুকে যারা ধারণ করেন না, জয় বাংলা শ্লোগানে যাদের গায়ে জ্বর আসে, ৭ মার্চের ভাষণ শুনলে যাদের গায়ে কাঁটা বিঁধে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যারা বিশ্বাস করে না সেই বিএনপি জামায়াত আর স্বাধীনতা বিরোধী সকল অপশক্তির এই স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার পথ ক্রমশ সংকুচিত হয়ে আসছে।

লেখক : সহ-সভাপতি, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন ও বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির কার্যনির্বাহী সদস্য।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test