E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস 

ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের অবদান 

২০২৪ মার্চ ০৯ ১৬:৪০:৩১
ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় বর্তমান সরকারের অবদান 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে রবিবার (১০ মার্চ) জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস ২০২৪ পালিত হবে। ১৯৯৭ সাল থেকে মার্চের শেষ বৃহস্পতিবার সারাদেশে জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালিত হয়ে আসছে। এরপর দিবসটিকে ‘গ’ শ্রেণিভুক্ত করে ২০১২ সালের ৭ নভেম্বর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন দেওয়া হয়। এভাবে চলে আসার একপর্যায়ে মার্চের শেষ সপ্তাহের বৃহস্পতিবারে মহান স্বাধীনতা দিবস পড়ে। একই দিনে দুটি গুরুত্বপূর্ণ দিবস পড়ায় সমস্যার সৃষ্টি হয় সংশ্লিষ্টদের জন্য। এ কারণে ওই বছর মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বিশেষ সম্মতিতে ৩১ মার্চ জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদের ওই সম্মতিপত্রে সুবিধাজনক অন্য কোনো তারিখে দিবসটি পালন করার ব্যাপারে অনুশাসন দেওয়া হয়।২০১৬ সালে যাচাই-বাছাইয়ের পর জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালনের জন্য ১০ মার্চ নির্বাচন করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। কারণ এদিন জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ের কোনো দিবস নেই। ওই বছর থেকে ১০ মার্চ জাতীয় দুর্যোগ প্রস্তুতি দিবস পালিত হয়ে আসছে।

প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট দুর্যোগ সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং পাশাপাশি প্রাকৃতিক দুর্যোগে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি সহনীয় পর্যায়ে রাখতে বেসরকারি সংস্থা, সুশীল সমাজসহ সর্বস্তরের জনগণকে সচেতন করাই এই দিবসটি পালনের লক্ষ্য।আর ভৌগোলিক অবস্থানগত কারণে প্রতি বছরই বাংলাদেশে মার্চ মাস থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ হয়ে থাকে। সঠিক সময়ে যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা গেলে এসব দুর্যোগের ঝুঁকি হ্রাস করে জনগণের জানমালের ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা সম্ভব। এইজন্য সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় নানাবিধ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন।

উপকূলীয় বনায়নের মাধ্যমে ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলা, বন্যা আশ্রয়কেন্দ্র এবং মুজিব কিল্লা নির্মাণের কাজও তখন থেকে শুরু হয়েছিল। তিনি (বঙ্গবন্ধু) ১৯৭৩ সালে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচিকে (সিপিপি) সরকারের অন্যতম একটি কর্মসূচি হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন, যা আজও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসের ক্ষেত্রে বিশ্বে একটি উত্তম চর্চা হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। তাই বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই বর্তমান সরকার দুর্যোগ প্রস্তুতির ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের টেকসই কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নের গতি ত্বরান্বিত করতে এবং দুর্যোগ প্রস্তুতিমূলক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামীণ রাস্তায় সেতু-কালভার্ট নির্মাণ, গ্রমীণ মাটির রাস্তাসমূহ টেকসইকরণের লক্ষ্যে হেরিংবোন বন্ডকরণ, উপকূলীয় এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, জেলা ত্রাণ গুদাম-কাম দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা তথ্যকেন্দ্র নির্মাণ, ভূমিকম্প ও অন্যান্য দুর্যোগকালে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যন্ত্রপাতি সংগ্রহ, মুজিব কিল্লা নির্মাণ, সংস্কার ও উন্নয়নসহ বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে।

এসব কার্যক্রমের প্রতিটি ধাপে সম্পদের সুষ্ঠু ও টেকসই ব্যবহার নিশ্চিতকরণ এবং পরিবেশ সংরক্ষণে গুরুত্ব দিতে হবে। তাই সকলের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যথাযথ পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি গ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলা এবং দুর্যোগের ক্ষয়ক্ষতি ও ঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশ উল্লেযোগ্য ভূমিকা রাখতে সক্ষম হবে। আর দুর্যোগ হল এমন একটি গুরুতর সমস্যা যা স্বল্প বা দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘটে এবং ব্যাপক মানবিক, বস্তুগত, অর্থনৈতিক বা পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হয়ে ওঠে। দুর্যোগ বা ইংরেজিতে ডিজাস্টার শব্দটি এসেছে মুলত মধ্য ফরাসি ডিজাস্ট্রে (désastre) থেকে এবং এটি প্রাচীন ইতালীয় ডিজাস্ট্রো (disastro) থেকেও উদ্ভূত, যা ঘুরে এসেছে প্রাচীন গ্রীক অপমানজনক উপসর্গ থেকে δυσ-, (dus-) অর্থ "খারাপ" এবং ἀστήρ (aster), অর্থ "তারকা"। দুর্যোগ শব্দের মূল অর্থ দাড়ায় (গ্রীক ভাষায় "খারাপ তারকা") এটি একটি জ্যোতিষশাস্ত্রীয় অর্থ থেকে এসেছে যা গ্রহের অবস্থানের জন্য দায়ী করা হয়।

শ্রেণিবিভাগ

দুর্যোগগুলিকে সাধারণত দুই ভাগে ভাগ করা হয় প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা মানবসৃষ্ট দুর্যোগ, যদিও কিছু জটিল দুর্যোগ এর জন্য কোন মূল কারণ পাওয়া যায়না। উন্নয়নশীল দেশগুলিতে এরকম দুর্যোগ বেশি দেখা যায়। একটি নির্দিষ্ট দুর্যোগ এমন একটি গৌণ বিপর্যয়ের জন্ম দিতে পারে যা এর ক্ষতিকর প্রভাবকে বাড়িয়ে দেয়। এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ হল একটি ভূমিকম্প যা সুনামির সৃষ্টি করে, যার ফলে উপকূলীয় বন্যা হয়। কিছু উৎপাদিত বিপর্যয়কে প্রকৃতির জন্য দায়ী করা হয়েছে যেমন ধোঁয়াশা এবং অ্যাসিড বৃষ্টি।

প্রাকৃতিক বিপর্যয়

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হল এমন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া বা ঘটনা যাতে জীবনহানি, আঘাত বা অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকির প্রভাব, সম্পত্তির ক্ষতি, জীবিকা ও পরিষেবার ক্ষতি, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যাঘাত, বা পরিবেশগত ক্ষতির কারণ হতে পারে।ভূমিকম্প, ভূমিধস, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত, বন্যা, হারিকেন, টর্নেডো, তুষারঝড়, সুনামি, ঘূর্ণিঝড়, দাবানল এবং মহামারীর মতো বিভিন্ন ঘটনা হল প্রাকৃতিক বিপদ বা দুর্যোগ যার কারনে হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয় এবং কোটি কোটি টাকার আবাসস্থল ও সম্পত্তি ধ্বংস করে। যাইহোক, বিশ্বের জনসংখ্যার দ্রুত বৃদ্ধি এবং প্রায়ই বিপজ্জনক পরিবেশে এর বর্ধিত ঘনত্ব দুর্যোগের পুনরাবৃত্তির হার এবং তীব্রতা উভয়ই বাড়িয়ে দিয়েছে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় জলবায়ু এবং অস্থিতিশীল ভূমিরূপ, বন উজাড়, অপরিকল্পিত বৃদ্ধির প্রসারের সাথে, অ-প্রকৌশলী নির্মাণগুলি দুর্যোগ-প্রবণ এলাকাগুলিকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করে তোলে। দুর্যোগ প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনার জন্য অপর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দের সাথে অকার্যকর যোগাযোগের কারণে উন্নয়নশীল দেশগুলি প্রাকৃতিক দুর্যোগে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো একপ্রকারের প্রাকৃতিক ঘটনা, যাতে মানুষের আর্থ-সামাজিক ক্ষতি হয়ে থাকে। যদিও তা স্বাভাবিক প্রাকৃতিক ঘটনা হিসেবেই ঘটে থাকে, তবে অনেক ক্ষেত্রে মানুষের কাজ-কর্মের প্রভাবে প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হওয়ায় এরকম ঘটনা ঘটে থাকে। সাধারণ ভাষ্যে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ হলো স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের ব্যতিক্রম।প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে অনেক ক্ষতি হয়ে থাকে।

বিভিন্নরকম প্রাকৃতিক দুর্যোগ

প্রাকৃতিক দুর্যোগ মূলত স্বাভাবিক প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যে ব্যতিক্রম ঘটনা বা ঘটনাবলী। সে হিসাবে, প্রাকৃতিক সাধারণ নিয়মের ব্যতয় যেকোনো ঘটনাই প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। তবে যুগ যুগ ধরে মানুষের কাছে প্রাকৃতিক দুর্যোগ হিসেবে চিহ্নিত কতিপয় ঘটনা রয়েছে, যেমন:

ঝড় : কোনো স্থানের বায়ুমণ্ডলে কোনো কারণে বায়ু গরম হয়ে গেলে তা উপরে উঠে যায়, এবং সেই শূণ্যস্থান পূরণ করতে আশেপাশের বাতাস তীব্র বেগে ছুটতে শুরু করে। সাধারণত প্রচণ্ড গরমের সময় কোনো স্থানে এরকম ঘটনা ঘটতে দেখা যায়। আর এরকম তীব্র বায়ুপ্রবাহকে ঝড় বলা হয় এবং এর ফলেই ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিভিন্ন মানববসতি। সাধারণত এরকম ঝড়ের সাথে অনুষঙ্গ হিসেবে উপস্থিত হয় স্থলঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো, কিংবা বজ্রবিদ্যুৎ। উত্তর গোলার্ধের দেশ বাংলাদেশে সাধারণত বাংলা বৈশাখ মাসে প্রচণ্ড গরমের সময় হঠাৎ করেই এজাতীয় ঝড় হতে দেখা যায়, যার স্থানীয় নাম কালবৈশাখী।

স্থল-ঘূর্ণিঝড় বা টর্নেডো: ১৫৮৪ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বাকেরগঞ্জ জেলায় ২ লাখ মানুষসহ অসংখ্য গবাদি পশু প্রাণ হরায়। ১৮২২ সালের ৬ জুন সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ে ১০হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারায়। ১৮৬৯ সালের ১৬ এপ্রিল ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৭২ সালে কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৭৬ সালের ৩১ অক্টোবর আঘাত হানে ভোলা জেলায়। এই সময় পানির উচ্চতা ছিল ৩ থেকে ১৫ মিটার। এতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১০ হাজারের মত। ১৮৯৫ সালে অক্টোবর মাসে সুন্দরবন ও বাগেরহাট জেলায় জলোচ্ছ্বাসে ও ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৮৯৭ সালে ২৪ অক্টোবর চট্টগ্রামের কতুবদিয়া দ্বীপে আঘাত আনে। প্রাণ হারায় অসংখ্য লোক। ১৮৯৮ সালে টেফনাফে ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯০১ সালে সুন্দরবনের পশ্চিমাংশে ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯০৯ সালের অক্টোবরে চট্টগ্রামে ও কক্সবাজারে ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৯৭ সালের মে মাসে সুন্দরবনে ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯১৯ সালে বরিশালে জলোচ্ছ্বাসে ও ঘূর্ণিঝড়ে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৪০ হাজার।

১৯২৬ সালের মে মাসে বরিশালে ও নোয়াখাীরতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ৭ হাজার ৫ জনে মত। ১৯৫৮ সালের ২১ থেকে ২৪ অক্টোম্বর নোয়াখালী, ২০ নভেম্বর পটুয়াখালী ঘূর্ণিঝড়ে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। ১৯৬০ সালে সুন্দরবনে আঘাত হানে। এখানে মৃতে সংখ্যা দাঁড়ায় তিন হাজার। ১৯৬০ সালের ৩০ অক্টোম্বর আঘাত হানে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, নোয়াখালী, উপকূলিয় এলাকায়। ১৯৬১ সালে বেশ কয়েকবার দেশের বিভিন্ন স্থানেজলোচ্ছ্বাসে বহুলোক প্রাণ হারায়। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বৃহস্পতিবার রাতে বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, বরগুনা ও ভোলাসহ দেশের বিস্তীর্ণ উপকূলীয় এলাকার ওপর দিয়ে বয়ে যায় সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড় গোর্কি। গোর্কির আঘাতে বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছিল বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চল। দেড়শ’ মাইল বেগের গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় ও ২০ থেকে ৩০ ফুট উঁচু জলোচ্ছ্বাসে গোটা উপকূলীয় এলাকা মৃতপুরীতে পরিণত হয়। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিল চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারে ৪ থেকে ৮ মিটার উচ্চতায় জলোচ্ছ্বাসের ১৫ হাজার ব্যক্তি প্রাণ হারায়।

২০০৬ সালের ১৯ সেপ্টেম্বরে হঠাৎ টর্ণেডোয় শত শত ট্রালার, জেলে মাঝি মাল্লা প্রাণ হারায়। ২০০৭ সালে সিডরে সাতক্ষীরা ও বাগেরহাটে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছে। এ সময় মৃত গলিত লাশ ভাসতে দেখা গেছে। ২০০৯ সালের ২৫ মে। ঘণ্টায় ১১০ কিলোমিটার বেগে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় আইলা। লন্ডভন্ড করে দেয় এ অঞ্চলের হাজার হাজার বসত-ভিটা, আবাদিজমি। সরকারি হিসেবেই এতে প্রাণ যায় তিন শো ৩২ জনের। ২০১৩ সালের ১৬ মে বৃহস্পতিবার বঙ্গোপসাগরের ঘূর্ণিঝড় মহাসেন আঘাত হেনেছে বাংলাদেশের উপকূলস্থ অঞ্চলসমূহে। যেখানে ১৯৭১ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত দেশে প্রতি দুই থেকে তিন বছরে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত করত, সেখানে ২০২৩ সালে চার চারটি ঘূর্ণিঝড় বঙ্গোপসাগর হয়ে বাংলাদেশের ওপরে প্রভাব ফেলেছে।

বজ্রবিদ্যুৎসহ ঝড়-বৃষ্টি

বাংলাদেশে বর্তমানে বজ্রপাত কে দুর্যোগের তালিকায় নেয়া হয়েছে। ২০১৬ এর জানুয়ারি থেকে ১৯ জুলাই ২০১৬ পর্যন্ত ৯১ জনের মৃত্যু হয়েছে বজ্রপাতে।

কালবৈশাখী ঝড়

বাংলাদেশে সাধারণত বাংলা বৈশাখ মাসে (এপ্রিল-মে মাসে) প্রচণ্ড গরমের সময় হঠাৎ করেই এজাতীয় ঝড় হতে দেখা যায়, যার স্থানীয় নাম কালবৈশাখী। এই ঝড় শুরু হয়ে উত্তর-পশ্চিম দিকে বয়ে যায়। এই ঝড় সবসময়ই বজ্রপাত এবং বৃষ্টিসমেত সংঘটিত হয়ে থাকে। আর এই ঝড়ের সাথে শিলাবৃষ্টি ঘটে থাকে। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলে সাধারণত এই ঝড় শেষ বিকেলে হয়ে থাকে, কারণ সাধারণত ভূপৃষ্ঠ থেকে বিকিরিত তাপ বায়ুমণ্ডলে ঐসময় বেশি পরিমাণে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। একারণেই সন্ধ্যাকালে এই ঝড়ের প্রাদুর্ভাব বেশি লক্ষ্যণীয়। এই ঝড়ের গতিবেগ ঘণ্টায় ৪০-৬০ কিলোমিটার হয়ে থাকে, তবে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারও অতিক্রম করতে পারে।

জলোচ্ছ্বাস

সমুদ্রে অত্যধিক মাত্রায় বায়ুপ্রবাহের কারণে প্রচণ্ড ফুঁসে ওঠা পানি যখন নিকটবর্তী স্থলভাগে এসে আঁছড়ে পড়ে, তখন তাকে জলোচ্ছ্বাস বলে। এছাড়াও সমুদ্রে সৃষ্টি হওয়া ঘূর্ণিঝড় তার সাথে নিয়ে আসে তীব্র জলস্রোত, যা উপকূলভাগে আঁছড়ে পড়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। এরকম জলোচ্ছ্বাস ১০ ফুট পর্যন্ত উঁচু হতেও দেখা গেছে।

বন্যা

কোনো অঞ্চলে প্রবল বৃষ্টি হলে নদ-নদী বা ড্রেনেজ ব্যবস্থা নাব্যতা হারিয়ে ফেললে অতিরিক্ত পানি সমুদ্রে গিয়ে নামার আগেই নদ-নদী কিংবা ড্রেন উপচে আশেপাশের স্থলভাগ প্লাবিত করে ফেললে তাকে বন্যা বলে। তবে বন্যা কোনো সাময়িক জলাবদ্ধতা নয়, বরং একটি দীর্ঘকালীন দুর্যোগ, যা কয়েক সপ্তাহ থেকে শুরু করে কয়েক মাস পর্যন্ত স্থায়ী হতে পারে। উপকূলীয় দেশসমূহ নিজ দেশ ছাড়াও মহাদেশীয় অবস্থানের দেশগুলোর অতিবৃষ্টিপাতের কারণে নদ-নদীর জলস্থর বৃদ্ধির কারণেও বন্যায় প্লাবিত হতে পারে। বাংলাদেশ এরকমই একটি দেশ, যা ভারতের অতিবৃষ্টির প্রভাবেও বন্যায় প্লাবিত হয়।

ভূমিকম্প

ভূত্বকের নিচে টেকটনিক প্লেটের নড়াচড়ার ফলে ভূপৃষ্ঠে যে কম্পন অনুভূত হয়, তাকে ভূমিকম্প বলে। ভূমিকম্প মাপার ক্ষেত্রে সাধারণত বিশ্বব্যাপী রিখটার স্কেল ব্যবহৃত হয়, তবে সংশোধিত মার্কলি স্কেলও স্বীকৃত। রিখটার স্কেলে ১ মাত্রার ভূমিকম্প হলো সর্বনিম্ন মাত্রা, আর সর্বোচ্চ মাত্রা হলো ১০। পৃথিবীর ইতিহাসে মারাত্মক সব ভূমিকম্প নথিভুক্ত করা হয়েছে। টেকটনিক প্লেট ছাড়াও আগ্নেয়গিরির অগ্নুৎপাতেও ভূমিকম্প সংঘটিত হতে পারে। ভূমিকম্পের ফলে ভূত্বকের উপরে থাকা স্থাপনা কম্পন সহ্য করতে না পারলে ভেঙ্গে পড়ে। সমুদ্রে ভূকম্পন হলে পানিতে আলোড়ন সৃষ্টি করে, ফলে সংঘটিত হয় সুনামি।

সুনামি

কোনো বিশাল জলক্ষেত্রে, বিশেষ করে সমুদ্রে, ভূমিকম্প সংঘটিত হলে সেখানটায় ভুত্বকে যে আলোড়ন সৃষ্টি হয়, তার প্রভাবে উপরস্থিত জলক্ষেত্র ফুঁসে উঠে বিপুল ঢেউয়ের সৃষ্টি করে। এই ঢেউ প্রবল বিক্রমে স্থলভাগের দিকে এগিয়ে আসে এবং স্থলভাগে আছড়ে পড়ে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়। সাধারণত ভূমিকম্পের পরে সুনামি ঘটে থাকে। তবে ভূমিকম্পের পর যে সুনামি হবেই এমন নিশ্চয়তা দেয়া যায় না বলেই উপকূলীয় এলাকায় ভূমিকম্প সংঘটিত হলেই উপকূলীয় জনসাধারণ এ ব্যাপারে সর্বদা প্রস্তুত থাকতে পারে না। আর ভূমিকম্প সংঘটিত হলেই তারা নিজেদের আবাস ত্যাগ করতেও পারে না। ফলে উচ্চমাত্রার ভূকম্পনের পরে হওয়া সুনামিতে সাধারণত জনক্ষয় রোধ করা যায়, কিন্তু কোনো সুনামিতেই স্থলভাগের স্থাপনার ক্ষয়ক্ষতি রোধ করা যায় না।

ভূমিধ্বস

পাহাড়কাটা, পাহাড়ের বৃক্ষনিধন এবং তার সাথে অতিবৃষ্টি যোগ হলে সাধারণত ভূমিধ্বস হতে পারে। তবে পাহাড় কাটা বা বনভূমি ধ্বংস না হলেও পাহাড়ের মাটি বৃষ্টির কারণে আলগা হয়েও যেকোনো সময় এমন ভূমিধ্বস সৃষ্টি করতে পারে। ভূমিধ্বসে সাধারণত উঁচু কোনো স্থান, যেমন পাহাড়, থেকে গাছপালা, স্থাপনাসহ বিপুল পরিমাণ মাটি কিংবা পাথর অকস্যাৎ হড়কে নিচের দিকে নেমে আসে। কখনও পাহাড়ের মাটি পানির সাথে মিশে ঘন মিশ্রণের সৃষ্টি করে, যা অনেক সময়ই জীবিতদের আটকে রাখার মতো আঠালো হয়ে থাকে এবং প্রাণঘাতি হয়। তাছাড়া অকস্যাৎ পাহাড়ধ্বসে পাহাড়ের পাদদেশে থাকা মনুষ্যবসতিতে বিপুল প্রাণনাশ হয়ে থাকে। সাধারণত বৃষ্টিপাতের কারণে ভূমিধ্বস হয়। বাংলাদেশে চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, বান্দরবান, সিলেট, নেত্রকোণা ইত্যাদি জেলায় প্রায়ই ভূমিধ্বস হয়ে মানুষের প্রাণহানি ও বাড়িঘর নষ্ট হয়।

নদী ভাঙন

বাংলাদেশে আজকাল নদী ভাঙন প্রচুর দেখা যায়। বিশেষকরে পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, তিস্তা ও আড়িয়াল খাঁ নদীর ভাঙনে কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জামালপুর, লালমনিরহাট, সিরাজগঞ্জ, পাবনা, টাঙ্গাইল, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরসহ দেশের বিভিন্ন জেলার মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন।

আর্সেনিক দূষণ

ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশের মানুষের স্বাস্থ্য ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের দক্ষিণ -পূর্বাঞ্চল বিশেষ করে কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর,চাঁদপুর, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুরও নারায়ণগঞ্জ জেলার অধিবাসীরা ভয়াবহ আর্সেনিক দূষণের শিকার।

সিঙ্কহোল

মূলত সিঙ্কহোল হলো চুনাপাথর অঞ্চলে সৃষ্ট বড়ো বড়ো গর্ত।যখন প্রাকৃতিক ক্ষয় বা মানব খনির উপর ভিত্তি করে নির্মিত কাঠামো সমর্থন খুব দুর্বল স্থল তোলে, মাটি একটি সঙ্কুচিত পতন এবং সিঙ্কহোল উৎপাদন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ২০১১ সালের গুয়াতেমালার সিটি সিঙ্হোলে ১৫ জন মানুষকে মেরে ফেলা হয়েছিল, যখন ট্রপিক্যাল স্টর্ম অ্যাগাথা থেকে ভারী বৃষ্টির ফলে পাম্পের পানিতে ডুবে যাওয়ার ফলে একটি ফ্যামিলি বিল্ডিংয়ের নিচে মাটির আকস্মিক পতন ঘটে।

তুষারঝড়

তুষারঝড় হলো ভারী তুষারপাত এবং ভারী বায়ু দ্বারা চিহ্নিত চরম শীতল ঝড় যখন উচ্চ বায়ুগুলি ইতোমধ্যে ভেঙে পড়েছে তুষারপাত শুরু হয়, তখন এটি একটি স্থল তুষারঝড় হিসেবে পরিচিত। তুষারঝড় স্থানীয় অর্থনৈতিক কার্যক্রম প্রভাবিত করতে পারে, বিশেষত এমন অঞ্চলে যেখানে তুষারপাত বিরল হয়। ১৮৮৮ সালের গ্রেট ব্লিজার্ড মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছিল, যখন অনেক টন গম ফসল নষ্ট হয়ে যায়, এবং এশিয়ার ২০০৮ সালে আফগানিস্তান তুষারঝড় এবং ১৯৭২ সালে ইরানের তুষারঝড়ও ছিল গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৯৩ সালের সুপারস্টট মেক্সিকো উপসাগরে জন্মগ্রহণ করে এবং উত্তর ভ্রমণ করে, ২৬ টি রাজ্যের পাশাপাশি কানাডায় ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং ৩০০ জনের বেশি মৃত্যুর মুখোমুখি হয়।

খরা

খরা দীর্ঘ সময় ধরে গড় মাত্রার নিচে বৃষ্টিপাতের মাত্রা দ্বারা সৃষ্ট মাটির অস্বাভাবিক শুষ্কতা। গরম শুষ্ক বায়ু, জল ঘাটতি, স্থায়ী তাপমাত্রা এবং স্থল থেকে আর্দ্রতা এর ফলে বাষ্পীভবন।খরার ফলে জল ঘাটতি থেকে পশুর পানীয় যোগ্য জলের অভাব ফসলহানী ঘটতে পারে।

সুপরিচিত ঐতিহাসিক খরাগুলির মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে ১৯৯৭-২০০৯ অস্ট্রেলিয়ার মিল্নেয়াম খরা যাতে অনেক দেশের মধ্যে পানি সরবরাহের সঙ্কটের সৃষ্টি হয়।

পরিশেষে বলতে চাই, ঘুর্ণিঝড় মোকাবিলায় আমরা সার্বিকভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের রোল মডেল। এর ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনার সক্ষমতা আমাদের কাছে। তবে ভূমিকম্প বাংলাদেশের জন্য নতুন এক দুর্যোগ। এটাকে আমরা কমাতে পারবো যদি আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি থাকে। ভূমিকম্প মানুষ মারে না। বিল্ডিং ধসের মাধ্যমে মানুষ বেশি মারা যায়। তাই আমাদের বিল্ডিং করার সময় ভালোভাবে ডিজাইন করে করতে হবে। ভূমিকম্পের সোর্সগুলো নিয়ে আমাদের বেশি করে গবেষণা করতে হবে।ভূমিকম্পের সোর্স কত দূরে সেই ক্যালকুলেশন করে বিল্ডিং। যদিও বাংলাদেশ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকা থেকে অনেক দূরে। তারপরও এ বিষয়ে অনেক সতর্ক থাকতে হবে। তাহলে ক্ষয়ক্ষতির হার কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।

লেখক : কলাম লেখক ও সংগঠক, প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি।

পাঠকের মতামত:

০৬ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test