E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

জনসচেতনতার অভাবে পঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে 

২০২৪ মার্চ ১৫ ১৬:৪২:২৫
জনসচেতনতার অভাবে পঙ্গু রোগী বৃদ্ধি পাচ্ছে 

ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ


গত ১৫ মার্চ বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী পালিত হয় বিশ্ব পঙ্গু দিবস ২০২৪। পঙ্গু শব্দটি প্রতিটি সচেতন মানুষের মন প্রবলভাবে নাড়া দেয়। নির্বুদ্ধিতার মধ্যেও জীবন সম্বন্ধে সংশয়ের চিত্র ফুটে ওঠে। কিছুটা ভিন্নার্থে। হাজারটা বেদনামিশ্রিত এই শব্দ ইংরেজিতে-এর সমার্থক শব্দে ভেদবিভেদ থাকলেও বাংলায় এর ভাবনা মোটামুটি সঙ্গতিপূর্ণ। পঙ্গু, খোড়া, ল্যাংড়া, ল্যাংচা, দুর্বল, অচল, ব্যর্থ, রুগ্ন, বিকল, বিকলাঙ্গ, বিকৃতাঙ্গ, বাতিল, অকার্যকর, অক্ষম, স্বাস্থ্যহীন, অসম্পূর্ণ, বলহীন, হীনবল ইত্যাদি বিশেষ্য পদে ডাকা হলেও মূলত স্বাভাবিকভাবে চলার শক্তি নেই এমন অবস্থাকেই বুঝায়। এই শব্দের দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় এক প্রকার দৈহিক বিকার থাকে। পক্ষাঘাত বলেও আক্ষেপের সাথে বুঝানো হয়।

মাংসপেশী স্বাভাবিক কাজ করার বদলে দুর্বল-শিথিল-আড়ষ্ট হলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অচল হয়। কার্যকারিতা কমে যায় কিংবা একেবারে শূন্য হয়। তখনই স্পর্শ- অনুভূতিহীন হয়। এর বিভীষিকাময় ফল পঙ্গু বা পঙ্গুত্ব। স্বল্পস্থায়ী হলে কিছুটা নিরাময়ের সম্ভাবনা থাকে। দীর্ঘস্থায়ী হলেই এর ভয়াবহ রূপ পঙ্গুত্ববরণ। কিছু রোগের সাথে পঙ্গু শব্দটির গভীর সংমিশ্রণ আছে। স্ট্রোক থেকে পঙ্গু হওয়ার অন্যতম আদর্শ জায়গা।

এছাড়া কিছু রোগ যেমন পোলিও, পর্কিনন্সন্স ডিজিজ, গুলেবারে সিনড্রোম, জন্মগত সিফিলিস, মালটিপল স্পেক্লরোসিস, সোরিব্রাল পালসি ইতাদি রোগের অন্তর্গত দ্বদ্বও পেশীর দৌর্বল্য থেকে পঙ্গু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা থাকে। পেশীজনিত কিংবা স্নায়ুতন্ত্র কোনো রোগের পাকে পড়লেও পঙ্গু হয়ে যেতে পারে মানবদেহ। নিয়তির পরিহাসে জন্মগত পঙ্গু বিকলাঙ্গতা-তো ছায়ার মতো পরিবারের বেদনাবিরহের কারণ হয়। সমাজ ও সময়ে এই বিষয়টি সর্বাত্মক সংকট সৃষ্টি না করলেও বিজ্ঞানীরা গবেষণায় প্রমাণ করেছেন সাধারণের অলক্ষ্যে প্রতি ৫০ জনে ১ জন কোনো না কোনোভাবে শারীরিক বিকলাঙ্গতার শিকার।

বিকলাঙ্গ আর পঙ্গু সমার্থক শব্দ হলে আজকের বিষয় মূলত মানুষের সৃষ্ট দুর্যোগের কারণে জীবনবোধ নিঃস্বার হওয়া বা পঙ্গুত্ব বরণ করা। এখানে অবহেলাকেও আমলে আনা যায়। বিশেষত দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনার প্রকারভেদ থাকলেও প্রকারান্তরে সড়ক দুর্ঘটনার বিষয়টিতেই পঙ্গু হওয়ার করুণ চিত্র ভেসে ওঠে। প্রবহমান সাধারণ জীবনবোধকে হতাশ করে।

এই কথা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনায় বহু মানুষের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নেমে আসে। বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় দেখা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষের প্রাণহানির চেয়ে পঙ্গুত্ব হওয়ার সংখ্যা দ্বিগুণের বেশি। একটিমাত্র দুর্ঘটনায় অনেকে পথের ভিখারী হয়। যে ব্যক্তি টাটকা মাছ, নির্ভেজাল দুধ আর নির্ভেজাল শাক-সবজি-ঘি খেয়ে জীবন ধারণ করেছে একটি দুর্ঘটনা তাঁর জীবন সব ওলটপালট করে দিয়েছে। আর মানবদেহের চলৎশক্তি নিয়ন্ত্রণ করে স্নায়ুতন্ত্র। এখানে সামান্যতম আঘাত পঙ্গুত্বের সাথে ‘মিতালি’ গড়তে পারে। বিপুলা এই পৃথিবীতে স্নায়ুবিক আঘাত কারো কারো মুখে ‘বিষ ঢেলে’ দেওয়ার মতো ঘটনা ঘটতে পারে। পঙ্গু, বিকলাঙ্গ, অবস শব্দটি কারো জীবনে এসে ভিড় করতে দেখা যায়। এই কারণেই যে কোনো দুর্ঘটনা যেন বিস্তৃত হতে না পারে তার জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করা হয়।

বর্তমান প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নয় কেবল- বিশ্বজুড়ে সড়ক দুর্ঘটনায় আঘাতজনিত পঙ্গু হয়ে যাওয়ার অভিজ্ঞতাকে অন্যতম বেদনার কারণ হিসাবে বিবেচনা করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরিসংখ্যান বলছে- প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ১৩ লাখ মানুষের প্রাণ কেড়ে নেয় ‘সড়ক দুর্ঘটনা’। আক্কেল গুড়ুম হওয়ার মতো তথ্যে তাঁরা দেখিয়েছে প্রতিবছর ৫ কোটির বেশি মানুষ আহত হয়। গুরুতর আহতদের অধিকাংশই পঙ্গুত্ব নামক বিষম কষ্টকর জীবন বহন করছে।

কারণ : পঙ্গুত্বের অনেক কারণ রয়েছে। এই কারণগুলোকে যদি প্রধান দুই ভাগে ভাগ করা যায় তাহলে বলা যায়, জন্মগত ত্রুটি ও মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পঙ্গুত্ব বরণ।

জন্মগত ত্রুটির কারণে পঙ্গুত্ব : বিভিন্ন ধরনের জন্মগত ত্রুটির কারণে অনেক মানুষকে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিতে হয়।

এগুলোর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে :

* সেরিব্রাল পালসি

* হাত-পায়ের ত্রুটিপূর্ণ গঠনের কারণে পঙ্গুত্ব

* পক্ষাঘাতগ্রস্ত ব্যক্তি

মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পঙ্গুত্ব

মনুষ্যসৃষ্ট কারণে পঙ্গুত্বের অন্যতম প্রধান কারণ সড়ক দুর্ঘটনা। আমাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অজস্র সড়ক দুর্ঘটনা ঘটে। এতে অনেক মানুষ আহত হয়। সামর্থ্যবানরা চিকিৎসা নিয়ে অনেক দ্রুত সেরে উঠতে পারে।আবার আর্থিক সংগতি না থাকার কারণে অনেককে ধীরে ধীরে পঙ্গুত্বকে বরণ করে নিতে হয়। বরাবর হতাশ হওয়া সড়ক দুর্ঘটনার আতঙ্ক থেকে মুক্তি পেতে সরকারের পাশাপাশি অনেক সংস্থা, সংগঠন নিরাপদ সড়ক আন্দোলন করছে। চালক ও জনসাধারণকে সচেতন করতে নানা উদ্যোগ ও কর্মসূচি চালু রয়েছে। রয়েছে নিরাপদ সড়ক পরিবহন আইন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে করা এই আইনে চালককে কঠোর শাস্তির পাশাপাশি দুর্ঘটনায় আঘাতপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত, ক্ষেত্রবিশেষ মৃত ব্যক্তির উত্তরাধিকারকে আর্থিক সহায়তার কথা বলা হয়েছে। এই ক্ষেত্রে ‘ঘন মেঘের মাঝে এক টুকরা রোদ’ দেখা যাচ্ছে। দেশের রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত সকল যানবাহনের বৈধ কাগজপত্র নবায়ন করার সময় আলাদা অনুদান আদায় শুরু হয়েছে। সিদ্ধান্ত মোতাবেক সমুদয় জমা এইসব অনুদান থেকেই ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করা হবে। তবে তা পুরোপুরিভাবে বাস্তবায়ন করতে কত সময় লাগবে কিংবা আদৌ হবে কিনা তা সময় বলে দিবে। এই ধারাটির প্রতি সাধারণ মানুষের দুর্বার ও দুরন্ত আকর্ষণ থাকলেও এর বিরোধীপক্ষের শিকড় বহু গভীরে প্রোথিত।

সড়ক দুর্ঘটনার প্রায় ৬০ ভাগ কারণ মোটরসাইকেল। মোট মৃত্যুর ৪০ ভাগ দায়ী এই বাহন। দেশে নিবন্ধিত ৫৫ লাখ মোটর গাড়ীর মধ্যে ৪০ লাখই মোটরসাইকেল। মোট যানবাহনের ৬৮ শতাংশ। দুর্বৃত্তদের সুবিধা দিতে অবৈধ মতাদর্শের অনিবন্ধিত মোটরসাইকেলের হিসাব এখানে অন্ধকারে। মোটরসাইকেল বিপণন কোম্পানিগুলো বছরে প্রায় ৫ লাখ নতুন মোটরসাইকেল বিক্রি করে। বিশাল বাজার। বিষম পরিকল্পনা। উঠতি বয়সি তরুণ প্রজন্মের ভোগের সংস্কৃতির শক্তিমান অংশ। সরকারও শান্ত সাহসে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দেশে সড়ক দুর্ঘটনা অর্ধেকে নামিয়ে আনার পরিকল্পনায় এগুচ্ছে। যদিও বাস্তবতা বড় কঠিন।

পরিশেষে বলতে চাই, বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে পঙ্গু দিবসটি দেশের মানুষের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কেননা জনবহুল দেশ বিবেচনায় প্রতিদিনই অনেক মানুষ সড়ক দুর্ঘটনা, অসুস্থতাসহ নানাবিধ কারণে পঙ্গুত্বের শিকার হচ্ছেন। কিন্তু এ সংক্রান্ত যথাযথ জ্ঞানের অভাব এবং অজ্ঞতার কারণে অনেক মানুষের মধ্যে পঙ্গুত্ব নিয়ে অসাড় ধারণা রয়েছে। তাই দুর্ঘটনার শেষ স্মৃতিতে ছোপ ছোপ দাগ। এই লক্ষ্য সামনে রেখে পরিবহন চালক, মোটরসাইকেল ব্যবহারকারী, পথচারিদের আরো অধিক সচেতন হতেই ‘বিশ্ব পঙ্গু দিবস’। বিশ্বব্যাপী বেশ আন্তরিকতা নিষ্ঠা ও নানাভাবে সমন্বয় গ্রহণের শিক্ষা দিয়ে পালন করলেও আমাদের সংস্কৃতিতে তা তিরোহিত। গুরুত্বহীন। দায়সারা। অথচ এশিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থোপেডিক হাসপাতাল বাংলাদেশে। তাঁরা কেবল তাঁদের নিয়েই ব্যস্ত। বাস্তবতা এমনই যে অন্যদের দিকে তাঁদের তাকানোর সময় নেই। তাঁরা যদি পঙ্গুত্বের কারণ প্রতিকার, প্রতিরোধ আর আনুসঙ্গিক বিষয় নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস চালাতেন তবে তা হতো প্রাতিষ্ঠানিক। ধীরে ধীরে অবলুপ্ত হতো দুর্ঘটনা। পঙ্গুত্বের সীমাহীন কষ্টের মাঝেও খুঁজে পেতো নতুন সূর্যোদয়ের আভা।আর পঙ্গুত্ব নিয়ে অবহেলা ও যথাযথ চিকিৎসার অভাবে অনেকের জীবনও চলে যায়। জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, দুর্ঘটনার পর সুচিকিৎসা নিশ্চিতে যথাযথ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে মানুষের গড়িমসির ফলে পঙ্গুত্বের হার দিন দিন বেড়ে চলেছে। তাই এসব বিষয়ে মানুষের আরও জানা প্রয়োজন।আর বাংলাদেশে পঙ্গুত্বের বড় কারণ হলো সড়ক দুর্ঘটনা। প্রতিদিনই সড়ক দুর্ঘটনার ফলে বহু মানুষের জীবনে পঙ্গুত্বের অভিশাপ নেমে আসছে। এসব দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্বের সংখ্যা প্রাণহানির চেয়ে দ্বিগুণ। অথবা দ্বিগুণের চেয়েও বেশি। সড়ক দুর্ঘটনা রোধ করতে পারলে বাংলাদেশের পঙ্গুত্বের হার কমে যাবে।

ঠিক কতজন মানুষ বছরে পঙ্গুত্ব বরণ করছে তার সঠিক কোনো হিসাব নেই। কারণ, দুর্ঘটনার পর অনেককেই স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তাদের মধ্যে পরে অনেকেই হয়তো স্থায়ীভাবে পঙ্গুত্ব বরণ করে নিচ্ছেন। পঙ্গুত্বের আরও একটি কারণ হলো অসুস্থতা। কার্ডিয়াক ডিজিজ, ডায়াবেটিস বা হাইপারটেনশনসহ এ জাতীয় রোগেও মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করতে পারেন। তবে দুর্ঘটনাকবলিত মানুষের পঙ্গুত্ব নিয়েই বেশি চিন্তিত। সড়কে দক্ষ চালক এবং জনগণের সচেতনতা না থাকার ফলে আমাদের দেশে দুর্ঘটনা ও পঙ্গুত্বের সংখ্যা দুটোই বাড়ছে।

লেখক : সংগঠক ও কলাম লেখক।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test