E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

অন্য এক ভাষা আন্দোলনের নাম ‘ইমার ঠার’

২০২৪ মার্চ ১৬ ১৮:০৭:১২
অন্য এক ভাষা আন্দোলনের নাম ‘ইমার ঠার’

গোপাল নাথ বাবুল


২১ ফেব্রুয়ারি, ১৬ মার্চ এবং ১৯ মে-এ তিনটি তারিখ পৃথিবীর ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তিনটি রক্তঝরা দিন। ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশে এবং ১৯ মে অসমে বাংলাভাষার মান রক্ষার্থে জীবনদানের কথা জানলেও আমরা অনেকে জানি না, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের ভাষা আন্দোলনের কথা। জানি না, বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহের জীবনদানের কথা।  

বিশ্বের নানা প্রান্তে মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে পুরুষের পাশাপাশি ভাষা ও সংস্কৃত আগ্রাসনকারীদের রুখে দাঁড়িয়েছেন অসংখ্য নারী। ৫২’র একুশেও অসংখ্য ছাত্রী ছাত্রদের হাতে হাত মিলিয়ে পাকিস্তানি রক্তচোষাদের বিরুদ্ধে মুষ্টিবদ্ধ হাত তুলে গগনবিদারী শ্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত করেছিলেন। সেবার রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রতিরোধ গড়ে তোলে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর তল্পীবাহক পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, শফিক, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা আরও অনেকে। যা আজ আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে জাতিসংঘ কর্তৃক স্বীকৃত।

মায়ের ভাষার জন্য ঢাকায় ভাষা সংগ্রামীদের আত্মত্যাগের এ ঢেউ আসামের বাঙালিদের হৃদয় স্পর্শ করেছিল। আসামের বরাক উপত্যকায় তারাও মাতৃভাষা বাংলার সম্মান রক্ষার্থে অসমিয়া সরকারের বিরুদ্ধে যথাক্রমে ১৯৬১ সালের ১৯ মে, ১৯৭২ সালের ১৭ আগস্ট এবং ১৯৮৬ সালের ২১ জুলাই আন্দোলন করে প্রাণ দিতে হয়েছে অনেক বাঙালিকে। তার মধ্যে ১৯৬১ সালের ১৯ মে বরাক উপত্যাকার শিলচরে আত্মাহুতি দিয়ে বিশ্বের প্রথম নারী ভাষা শহীদ হিসেবে ইতিহাস হয়ে আছেন ১৬ বছরের কিশোরী কমলা ভট্টাচার্য। সেদিন অসম আধা সামরিক বাহিনীর নির্বিচারে গুলিতে কমলাসহ মোট ১১ জন বাঙালি মায়ের ভাষার মর্যাদা রক্ষার্থে আত্মবলিদান দেন।

কিন্তু বাংলা ভাষা ছাড়াও অন্যান্য ভাষার জন্যেও ঝরাতে হয়েছে বেশকিছু তাজা প্রাণ। যার মধ্যে দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ হিসেবে ইতিহাসে নাম লিখিয়েছেন ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষার স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের শহীদ সুদেষ্ণা সিংহ, যার ডাক নাম বুলু। সুদেষ্ণাকে আদিবাসীদের মধ্যে সর্বপ্রথম ভাষাশহীদ হিসেবে গণ্য করা হয়। পৃথিবীতে এ যাবৎ প্রাপ্ত তথ্য অনুসারে এ ২ জন নারীই ভাষার লড়াইয়ে প্রাণ দিয়েছেন।

বিষ্ণুপ্রিয়ারা শহীদ সুদেষ্ণাকে সম্মান জানিয়ে বলেন ‘ইমা সুদেষ্ণা’ অর্থাৎ মা সুদেষ্ণা। ‘ইমা’ শব্দের অর্থ মা এবং ‘ঠার’ শব্দের অর্থ ভাষা। নিজেদের ভাষাকেও তারা ‘ইমার ঠার’ অর্থাৎ ‘মায়ের ভাষা’ বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। বর্তমানে এই প্রান্তিক জাতির বাস ভারতের পূর্ব ও উত্তর-পুর্ব এবং বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলে।

সুদেষ্ণা সিংহের জন্ম ১৯৬৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি আসামের সুরমা উপত্যকার কচুবাড়ি গ্রামের একটি অসচ্ছল পরিবারে। গ্রামবাসীরা আদর করে ডাকতেন ‘বুলু’। সহায়-সম্বলহীন সামর্থ্যকে চিরসঙ্গী করে তাঁর ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠা।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগের পর ভারতের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রের সকল ভাষাভাষীর প্রাথমিক স্তরে মাতৃভাষায় শিক্ষাগ্রহণের মৌলিক অধিকার দেওয়া হলেও আসামের বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা এ অধিকার থেকে বঞ্চিত হন। ফলে ১৯৫৫ সাল থেকে এক দীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। সেই বছর মাতৃভাষায় প্রাথমিক শিক্ষা চালুর দাবীতে ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী মহাসভা’ নামে একটি কমিটি গঠিত হয় এবং ভাষার অধিকারের দাবীতে আন্দোলন শুরু হয়। বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে ভাষিক সংখ্যালঘু বিষয়ক কমিশনসহ বিভিন্ন প্রশাসনের সঙ্গে পত্র ও স্মারকলিপিসহ নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিভিন্ন বৈঠক এবং আলোচনা হয়। কিন্তু সরকারের ঔদাসীন্যতা, ছলছাতুরী ও নেতিবাচক আচরণের কারণে বৈঠক সফল না হওয়ায় আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করে। শুধু তাই নয়, আন্দোলনকে ব্যর্থ করতে অসম সরকার বিভিন্ন প্রতারণার আশ্রয় নেয়।

পরবর্তীতে এই আন্দোলনকে জোরালো করার উদ্দেশ্যে ১৯৯২ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর রবিশংকর সিংহ, কুলচন্দ্র সিংহ প্রমুখের নেতৃত্বে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী গণসংগ্রাম পরিষদ’ গঠিত হয়। এ সংগঠনের নেতৃত্বে ২৪ ঘন্টা থেকে শুরু করে ৪৮ ঘন্টা এমনকি ১০১ ঘন্টার গণঅনশন, বিক্ষোভ কর্মসূচী চলতে থাকে। আন্দোলনের ব্যাপকতায় বাধ্য হয়ে ত্রিপুরা সরকার ১৯৯৫ সালের ২৬ মে প্রাথমিক স্তরে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষা চালু করলে অসম সরকার এ দাবী মানা থেকে বিরত থাকে। ফলে ১৯৯৬ সালের ১৬ মার্চ, শনিবার ‘গণসংগ্রাম পরিষদ’ ও ‘নিখিল বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী স্টুডেন্টস্ ইউনিয়ন’ মিলে সবচেয়ে দীর্ঘ ৫০১ ঘন্টার রেলপথ-রাজপথ অবরোধ কর্মসূচী ঘোষণা করে এবং অন্যান্য বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সঙ্গে মাতৃভাষার মান রক্ষার্থে উক্ত কর্মসূচীতে অংশ নেওয়ার উদ্দেশ্যে সুদেষ্ণা সিংহ মায়ের কাছ থেকে বিদায় নেন। সুদেষ্ণা ঘর থেকে বের হওয়ার সময় মায়ের কাছে কিছু টাকার আবদার করেছিলেন। কিন্তু চরম দারিদ্রতার মধ্যে বাস করা মা সুদেষ্ণার এ আবদার মিটাতে ব্যর্থ হলে বিলবাড়ি গ্রামের বন্ধু প্রমোদিনীর কাছে তিনি ২টি টাকা চেয়ে নেন। টাকার প্রয়োজন কেন ? এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি প্রমোদিনীকে বলেন, ‘খেয়াপারের জন্য’। উল্লেখ্য, মৃত্যুর পর খেয়াপারের মাধ্যমে অন্য জগতে পদার্পন করতে হয় বলে বৈষ্ণব ধর্মের মণিপুরীরা বিশ্বাস করেন।

এদিনই আসে বরাক উপত্যকায় বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীদের সুদীর্ঘ ভাষা আন্দোলনের বিস্তৃত ইতিহাসে এক গগনবিদারী রক্তক্ষয়ী দিন। আসামের পাথারকান্দিও কলকলিঘাট রেলস্টেশনে আন্দোকারীদের একটি মিছিলে কোনো রকম পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই অসম পুলিশ বাহিনী গুলি বর্ষণ করলে বেলা ১২.১০ টায় ঘটনাস্থলে প্রাণ হারান ইতিহাসের দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ এবং আহত হন শতাধিক। পরে হাসপাতালে নিহত হন আরেকজন বিপ্লবী সলিল সিংহ এবং অরুণ সিংহ, প্রমোদিনী সিংহ, কমলাকান্ত সিংহ, দীপঙ্কর সিংহ, প্রতাপ সিংহ, নমিতা সিংহ, রতœা সিংহ, বিকাশ সিংহ, শ্যামল সিংহ সহ অনেকে গুরুতর আহত হন। সুদেষ্ণার মৃত্যু সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে আন্দোলন তীব্র থেকে তীব্রতর আকার ধারণ করে।

অবশেষে আন্দোলনের ব্যাপকতায় এক প্রকার বাধ্য হয়েই অসম সরকার ২০০১ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বরাক উপত্যকার ১৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী ভাষায় শিক্ষাদান চালু করে এবং ২০০৬ সালের ৮ মার্চ ভারতের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিমকোর্ট এক যুগান্তকারী রায়ের মাধ্যমে ‘বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরী’ ভাষাকে ভারতের একটি স্বতন্ত্র ভাষার স্বীকৃতি দেয়।

পরিশেষে বলা যায়, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯ মে ও ১৬ মার্চ তিনটি ভিন্ন ভিন্ন তারিখ হলেও ইতিহাস জুড়েই রয়েছে মাতৃভাষার প্রতি ভালোবাসা, সম্মান ও নিজ ভাষায় কথা বলার অধিকার। ১৬ মার্চ বিষ্ণপ্রিয়া মণিপুরীদের জন্য একটি বিশেষ দিন। সেদিনই ৩২ বছরের এক ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহ তাঁর জীবনের বিনিময়ে মৃতপ্রায় এক ভাষা রক্ষা করেছেন। তাই বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরীরা ‘ইমা সুদেষ্ণা’ নামে দিনটি পালন করে সুদেষ্ণা সিংহের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। সুতরাং এদিনে বিশ্বের দ্বিতীয় নারী ভাষাশহীদ সুদেষ্ণা সিংহের আত্মার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test