E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে এবং দায়হীনতার দায়

২০২৪ মার্চ ১৯ ১৫:৫৯:২৬
উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে এবং দায়হীনতার দায়

মীর আব্দুল আলীম


আগুন নিভে গেছে, লাশের দাফন-কাফোনও হয়েছে। জনউত্তাপ আর প্রশাসনের হম্বিতম্বিও ফুরিয়েছে। অভিযান প্রায় শেষ। এখনসব ভুলে যাওয়ার পালা। আমরা রাজধানীর বেইল রোড়ের অগ্নিকান্ডের ঘটনার কথা বলছি। উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে চাপিয়ে ইতোমধ্যে দায় শেষ করতে যাচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। আমার প্রশ্ন আছে অনেক ট্রেডলাইসেন্স থেকে শুরু করছি। যিনি ট্রেডলাইসেন্স দিলেন তার কিন্তু লাইসেন্স দেবার আগে সব ঠিকঠাক আছে কিনা যাচাই বাছাই করবার কথা। সেটা বোধ করি করা হয়নি। রাজউকের যাচাই বাছাই তদরকি কি হয়েছিলো? হলে ভবনে অনিরাপদ ছিলো কেন? অনিরাপদ ঐ ভবন ফায়ার সাভিসের লাইন্সে পেলো কি করে? নিরাপদ সিঁড়ি নেই। এটি ভবনে এতোগুলো হোটেল রেস্তোরা; ছিলোনা অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। কি করেছে সংশ্লিষ্টরা? এটাতো তাঁদেরই দেখার কথা ছিলো। কেউ তাঁদের স্বস্ব জায়গা থেকে কাজ করেনি। পয়সা পেয়ে অফিনে বসেই সব কাগজ ঝকঝকা করে নিয়েছে। বেইলি রোড়ের আগুনে ৪৬ জন মানুষ মারা গেলো এর দায় কার ছিলো? উপরেউল্লেখিত সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো অবশ্যই দায়ি। এদের কারো বিরুদ্ধে কি মামলা হয়েছে? কেউ গ্রেফতার হয়েছেন? একজনও না। গোবেচারা ম্যানেজার আর কর্মচারিকে পিঠমোচড়া দিয়ে বেঁধে হাজতে পাঠানো হয়েছে। এদেশে এভাবে উদোর পিন্ডি বুধোর ঘাড়ে আর কত চাপানো হবে? আবারও হয়তো অপেক্ষা করছে এর চেয়েও বড় ধরনের দুর্ঘটনা। যারা প্রকৃত অপরাধী তাঁদের কঠিন সাজা আওতায় আনা হলে এজাতিয় অগ্নিকান্ডের দুর্ঘটনা কমে আসতো।

ঢাকার অনিরাপদ অবৈধ ভবনগুলো টিকে আছে কি করে? রাজধানীর অধিকাংশ ভবনেই অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই। এটা কি করে সম্ভব? বিল্ডিং কোর্ড আর নকশা না মেনেই হচ্ছে ভবন তাহলে আগুন লাগলে কিংবা ভুমিকম্প হলে মানুষতো মরবেই। আমাদের বড় একটা ব্যামো আছে। কোন কিছু ঘটে গেলে হৈ চৈ করি। আফসোস করি। কতদিন এটা নিয়ে হম্বিতম্বি হয়। তারপর শেষ। ভুলে যাই সব। রাজধানীর বেইলী রোডের রেস্তোরা থেকে আগুন লেগেছে আমরা ছুটছি সেই রেস্তোরা নিয়েই। প্রশাসন নড়ে চড়ে বসেছে। অবৈধ রেস্তোরা ভাঙ্গার কাজ চলছে রাজধানী জুড়ে। রাষ্ট্রের যারা এসব দেখার দায়িত্বে ছিলেন তাঁরা এতোদিন এসব দেখেননি; তাঁরা তাদের দায়িত্ব পালন করেননি। আর এখন সব দায় পরছে ভবন মালিক আর রেস্তোরার মালিকদের ঘাড়ে। আইনের প্রয়োগ থাকলে আর আইন মানতে বাধ্য করা হলে এসব অনিয়ম থাকতো না; মানুষও এভাবে লাশ হতো না।

আসলের খবর নেই রেস্তোরা নিয়ে টানাটানি চলছে সব জায়গায়। 'ঢাকায় ২৬০০ ভবনে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি' খোদ বিবিসির অনলাই ভার্সণের অতিত নিকেটের এমন সংবাদে আমরা আতংকিত হই বৈকি! আমাদের শীর্ষ জাতীয় দৈনিক গুলোও এমন সংবাদ প্রকাশ করেছে। ফায়ার সার্ভিসের উদৃতি দিয়ে বলা হয় যে, ঝুঁকিতে থাকা প্রায় অর্ধেক ভবন হলো বিপণিবিতান বাকিটা আবাসিক। তবে নগরবিদের অভিমত রাজধানীতে বসবাসরত ৯০ ভাগ মানুষ অগ্নি ঝুঁকিতে বসবাস করছেন। এসব আবাসিক ভবনে নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা। নেই বিকল্প সিঁড়ি। ভবন মালিক কিংবা বসবাসকারীরা ব্যায় কমাতে অগ্নিনির্বাপন সামগ্রী ভবনে রাখেন না। তাতে মাথা ব্যথাও নেই কারো। আমাদের ফায়ার সার্ভিসতো ঠুটো জগন্নাথ। কেবল আগুন লাগলে ফায়ার সার্ভিস ঘটনাস্থলে যায়। যাবার আগেই সব পুঁড়ে শেষ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অগুন নেভানোর প্রাথমিক ব্যবস্থা থাকলে, ভবনের বসবাসকারীদের হাতেকলমে টেনিং দিলে অনেক আগুনই প্রাথমিক পর্যায়ে নিয়ন্ত্রনে আনা যেতো। কে করবে সেই কাজ? আমরা মাঝে মাঝে দায় সড়া ফায়ার সার্ভিসের মহড়া দেখি। মহড়ার নামে কোটিকোটি টাকা জলেও যাচ্ছে।

আবাসিক ভবনে মহড়া কয়টা হয়! আগুন নেভানোই যেন ফায়ার সার্ভিসের একমাত্র কাজ না হয়। এই সংস্থাটি যেন তাদের দায়-দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করে সেদিকে সংশ্লিষ্টদের নজর দেওয়া দরকার।
জাতীয় একটি দৈনিকের খবরে বলা হয়েছে, পুরোনো ঢাকার পর রাজধানীর বনশ্রীতে আগুনের ঝুঁকি সবচাইতে বেশি। সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে- বনশ্রী ডি ব্লকের ৮ নাম্বার রোডের রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচুড়ায় কন্ডেমিনিয়ামে রয়েছে তিনটি ১০তলা ভবন। এসব ভবনে ৯০টি পরিবারের প্রায় সারে ৮শ মানুষ বসবাস করেন। এই ভবনের মুল ফটকে বিশাল ক্যামিকেল গোডাউন। সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ করেও তারা কোন সরাহা পায়নি এভবনে বসবাসকারীরা। বাসিন্দাদের আরো অভিযোগ ভবনটি প্রতিষ্ঠার পর ফায়ার সার্ভিসের কোন ব্যক্তি এখানে অসেননি। এই হচ্ছে আমাদের আবাসিক ভবনগুলোর অবস্থা। নুন্যতম নিরাপত্বা নোই কোথাও। এমন ভবন গুলোতে আগুন লাগলে কি হবে? শততশত মানুষ লাশ হবে; আর আমরা আহ্ উহ্ করবো। এতোটুকুই!

সরকার যদি বাজধানীবাসিকে নিরাপদ করতে চায় ফায়ার সার্ভিসকে গতিশীল করতে হবে। আগুন লাগলে ছুঁটে যাবে এমনটা যেন না হয়। প্রতিটি ভবনে অগ্নিনিরাপ্তা আছে কিনা তা যেন তল্লাশী করা হয়। প্রতিটা ভবনে কিংবা কয়েকটা ভবন মিলে যেন বাসিন্দাদের আগুন লাগলে তাৎক্ষনিক কি করতে হবে তাঁর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের (অপারেশনস ও মেইনটেন্যান্স) লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম জাতীয় একটি দৈনিকে বলেন, “আমরা ভবনের মালিককে নোটিশ দিতে পারি। এ ছাড়া আর কিছু করার নেই। আমাদের আইনের মধ্যে যা যা করা সম্ভব, তা-ই করছি।” লেখাটা পড়ে হতভম্ব হয়েছি। এমন দায়িত্বশীল ব্যক্তি কি করে এমন বক্তব্য দিতে পারেন। কেউ আইন না মানলে তাঁেক আইন মানতে বাধ্য করতে হবে। এটা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। এ ব্যাপারে নগর পরিকল্পনাবিদেরা বলছেন যে নোটিশ দেওয়ার পরেও কাজ না হলে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এইসব ভবনগুলোর একটির বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে বাকিগুলো এমনিতেই ঠিক হয়ে যাবে। তবে এজন্য ফায়ার সার্ভিস, রাজউক ও সিটি কর্পোরেশনকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।

আমাদের সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের কথা বলছেন, কিন্তু কীভাবে বছরের পর বছর ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায়, নিয়মবহির্ভূতভাবে এসব ভবন টিকে আছে? রাজউক এবং ফায়ার সার্ভিসের যেসব আইন রয়েছে সেগুলো যথাযথভাবে মানা হচ্ছে না বলে এসব ভবন এখনও টিকে আছে। ব্রিগেডের যে আইন আছে সেখানে মামলা করার বিধান আছে, এবং ভবন ঝুঁকিপূর্ণ হলে তারা সেটাকে সিল করে দিতে পারে যাতে কেউ ওই ভবন ব্যবহার করতে না পারে। কিন্তু সেরকম কিছু দেখা যাচ্ছে না, শুধু দুর্ঘটনা ঘটলে তারা সেসব ভবন থেকে লোকজন উদ্ধার করে। সরকার থেকে রাজউককে সেই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে কেউ নিয়মের বাইরে কিছু করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারবে। রাজউক সেই কাজটা করছে কি? প্রথমে নোটিস দেয়া হয়, তারপর মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে জরিমানা করা তারপর উচ্ছেদের মাধ্যমেও তাদের দায়িত্ব পালন করার কথা। তাঁরা যদি সঠিক দায়িত্ব পালন করতো রাজধানীতে ঝুঁকির্পর্ণ ভবন কমে যেত। অন্যদিকে ফায়ার সার্ভিসও তাদের যথাযথ দায়িত্ব পালন করছে না। ঢাকা শহরে ঝুঁকিপূর্ণ বা নিয়মবহির্ভূত কতগুলো ভবন রয়েছে তার হিসেবও বোধ করি রাজউকের কাছে নেই। থাকলেও বিশেষ কারণে হয়তো চুপ থাকে সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আফসানা হকের পত্রিকায় দেওয়া একটি বক্তব্য বেশ ভালো লেগেছে। তিনি বলেছেন- প্রাথমিক অগ্নিনির্বাপনের প্রস্তুতিটা স্কুল পর্যায় থেকে চালু করতে হবে। আজকে যদি ফায়ার ড্রিলের কথা বলা হয়, ফায়ার সার্ভিস বা ডিফেন্স যদি সেই ব্যবস্থা নেয় , তাহলে ক'জন এর জন্যে মানসিকভাবে প্রস্তুত? এই কাজটা করা আমাদের জন্য জরুরী। এই মানসিক প্রস্তুতিটাও আমাদের মধ্যে নেই। আমার মনে হয় একটা ছোট বাচ্চা যখন স্কুলে যায় তার লেখাপড়া বা দৈনন্দিন চর্চার মধ্যে এই বিষয়টাও নিয়ে আসা উচিত। স্কুল থেকে অগ্নিনির্বাপনের বিষয়টি ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে আনা হলে অগ্নিকান্ডের ব্যাপারে অভিভাবকরা সচেতন হবেন।

শুধু রাজধানী ঢাকা নয় অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে দেশের ৩৭ দশমিক ৮৭ শতাংশ ভবন। এর মধ্যে আবাসিক, বাণিজ্যিক, শিল্প, হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রয়েছে। তাছাড়া দেশের দুই গুরুত্বপূর্ণ শহর ঢাকা ও চট্টগ্রামের ৫৪ শতাংশ ভবন অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এটা ফায়ার সার্ভিসের তথ্য তবে বেসরকারী তথ্য মতে দেমে ঝুকির্পর্ণ ভবনের পরিমান হয়তো দ্বিগুন হবে।

‘খরচ বাঁচাতে অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম কিনতে অনীহা’র বিষয়টি খুব বেশি সামনে আসছে। এফবিসিসিআই এর চেয়ারম্যান মো. নিয়াজ আলী চিশতির দেওয়ার পত্রিকার বক্তব্যে জানা যায়, “প্রয়োজনীয় এসব সরঞ্জামের শতকরা ৯৫ ভাগ আমদানি করতে দিতে হয় উচ্চ কর। দাম বাড়ার কারণে মেয়াদ শেষ হওয়ার পর অনেকেই এসব পণ্য নতুন করে কিনতে উদাসীনতা দেখাচ্ছে। যার ফলে অগ্নিনির্বাপনের ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে। আবার, অনেকেই মনে করেন অগ্নিনির্বাপক সরঞ্জাম লাগানো নেহাতই অপচয়। যার ফলাফল হিসাবে আমরা দেখতে পাই বেইলি রোডের মত ভয়াবহ আগুনের ঘটনা।” তাঁর মতে, কার্বন ডাই অক্সাইড, ফোম, ড্রাই পাউডারসহ অন্যান্য আগুন প্রতিরোধী গ্যাস ও রাসায়নিক আমদানিতে আলাদা অনুমতির দরকার হয়। যে কারণে এসব পণ্য আমদানিকারকদের অযথা হয়রানির শিকার হতে হয় অনেককেই। এসকল ঝামেলা থেকে বাঁচতে তারা ভবনে অগ্নিনির্বাপক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন না। ফলে দিনদিন এ ধরনের অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বেড়েই যাচ্ছে। এ বিষয়টি সরকার সংশ্লিষ্টদের ভাবতে হবে।

আমরা আত্মঘাতী? এতকিছুর পরও সচেতন হই না, রাষ্ট্র সজাগ হয় না। তাই জীবন পোড়ে অবহেলায়। রাজধানীর বেইলি রোডতো প্রিয়জনদের নিয়ে অবসর আর আনন্দে কাটানোর জায়গা। সন্তান কিংবা প্রিয়জনদেনর নিয়ে যদি লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হয় এর চেয়ে বেদনার আর কি হতে পারে। দিবারাত্র প্রাণচঞ্চল প্রাণোচ্ছল বেইলি রোডের এক ভবনে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। ভবনটিতে ছিলো শপিংমল আর খাবারের দোকান। মজাদার খাবার খেতে আর শপিং করতে সবাই যখন ব্যস্ত তখন ঘটে অগ্নিকান্ডের ঘটনা। ভবনের নিচ তলায় একটি ভবনে আগুন লাগলে অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকায় তাৎক্ষণিক আগুন নিয়ন্ত্রনে আনতে না পারায় পুরো ভবনটিতে আগুন ছড়িয়ে পরে। সর্বশেষ পাওয়া তথ্যে প্রাণ হারিয়েছেন ৪৪ জন। আহত হয়েছেন অনেকে।

এমন দুঃসংবাদ শুনতে আর ভালো লাগে না। মানুষের জীবন এতটা তুচ্ছ! এসব হতাহতের দায় কে নেবেন? খোদ ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার ড. খ. মহিদ উদ্দিন গণমাধ্যমকে বলেছেন, ভবনটিতে অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল না বললেই চলে। তাহলে এ দায় কি ভবন মালিক নেবেন? সরকার সংশ্লিষ্ট বিভাগের দায়িত্ব হয়তো নেই। থাকলে ফিবছর রাজধানীতে মানুষ আঙ্গার হতো না। ভবনটিতে যারা ব্যবসা করেন তারা কি এ দায় এড়াতে পানের। নিজেদেরওতো পর্যাপÍ অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা রাখা জরুরী ছিলো। এমন ঘটনা সবসময়ই ঘছে এদেশে। এসববের কেউ দায়ি-দায়িত্বব নিতে চায় না। প্রতিটা ঘটনারই তদন্ত কমিটি হয়। কারো সাজা হতে তেমন শোনা যায় কি?। প্রতিটি ঘটনায় তদন্ত কমিটি হয় কিন্তু কারো উপর দায় চাপে না। তাই রাজধানী ঢাকার বাসিন্দাদের অগ্নিকুন্ডলিতেই বসবাস করতে হয়। আর গুটি কয়েকজনকে লাশ হতে হবে এটাই স্বাভাবিক!

অগ্নিকাণ্ডের আগের ঘটনাগুলো থেকে শিক্ষা নিলে হয়তো অঙ্গার হওয়া লাশ আর দেখতে হতো না। প্রতিটা ঘটনার পর বিল্ডিং ত্রুটি আর অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা না থাকার কথা শুনি। তদন্ত কমিটির কথা শুনি। সরকারও নড়েচড়ে বসে। কিন্তু ক'দিন পরই সবাই সব বেমালুম ভুলে যায়। তাই অবহেলা-উদাসীনতা-দায়িত্বহীনতার আগুনে পুড়ছে মানুষ। যদি জীবনের দাবিই প্রাধান্য পেত তাহলে রাজধানীর বিল্ডিংগুলোতে বিকল্প সিড়ি আছে কিনা আর অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতো সরকার সংশ্লিষ্টরা।
অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে, মানুষ মরছে কিন্তু কেন হচ্ছে এমন পুনঃপুন। আমাদের সক্ষমতার অভাব, না সচেতনতার অভাব? নগর পরিকল্পনায় ঘাটতি? বাংলাদেশের ক্ষেত্রে সবগুলোই কারণ। বলা যেতে পারে, ঢাকার ঘিঞ্জি পরিবেশ এবং সরু রাস্তা। এখানে অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটলে ভয়াবহতা তাড়াতাড়ি বিস্তৃতি লাভ করে। ফলে ব্যাপক হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতির ঘটনা ঘটে। ২৯ ফেব্রুয়ারির বেইলি রোড়ের অগ্নিকান্ড বা ট্র্যাজেডি কিন্তু আমাদের আবারও সতর্ক বার্তা দিয়ে গেল ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মাধ্যমে। আমরা যদি সচেতন না হই বা সুষ্ঠু পরিকল্পনা গ্রহণ না করি ভবিষ্যতে আরো ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে।

প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ে কর্তৃপক্ষের অবহেলা, অব্যবস্থাপনা ও প্রস্তুতিহীনতার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কোনো স্থাপনায় আগুন বড় আকারে জ্বলে উঠলে সর্বোচ্চ মানের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থায়ও সেখানে অবস্থানকারী ব্যক্তিদের মৃত্যু ও আহত হওয়া এড়ানো দুরূহ হয়ে ওঠে। বিশেষজ্ঞদের দ্বারা স্থাপনার পূর্ণাঙ্গ অগ্নিনিরাপত্তার ব্যবস্থার নকশা করা ও তা যথাযথ পরিপালন করা এবং সেটা নিয়মিত পরীক্ষা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে সেই স্থাপনা ব্যবহারকারীদের জীবন ও সম্পদের অগ্নিনিরাপত্তা বিধান করা সম্ভব। সবার এ বিষয়টির গুরুত্ব উপলব্ধি করা অত্যন্ত প্রয়োজন। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধে পরিকল্পিত নগরায়ণ ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা হোক।

গ্যাসের চুলা, খোলা চুলা, শর্টসার্কিট, সিগারেটের আগুন, গ্যাসলাইনের ছিদ্র, নিম্নমানের বৈদ্যুতিক স্থাপনা বা যন্ত্রাংশ ইত্যাদি কারণে অহরহ অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটছে রাজধানীতে। আবাসিক এলাকায় কেমিক্যালের দোকান বা সামগ্রী, ঘিঞ্জি পরিবেশ, দুর্বল ব্যবস্থাপনা, সরু রাস্তা দিয়ে উদ্ধারসামগ্রী পৌঁছাতে কষ্টসাধ্য, অগ্নি প্রতিরোধের ব্যবস্থা বিল্ডিংয়ে না থাকা বা মেয়াদোত্তীর্ণ ব্যবস্থা, ঢাকার আশপাশে বা মধ্যের নদী-খালের পানিশূন্যতার কারণে উদ্ধার কার্যক্রম অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। ফলে সংঘটিত অগ্নিকান্ড থেকে প্রচুর ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটু সচেতনতা হলেই অনেক দুর্ঘটনা থেকে রেহাই পাওয়া যেত বা ক্ষতির হার কমে যেত। অগ্নি প্রতিরোধ সামগ্রীর মূল্য খুব বেশি নয়। অনেক সময় গড়িমসি করে পুরনো সামগ্রী বদলানো হয় না। আবার ভালো মানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করলেও দুর্ঘটনা অনেক কমে যেত। কিছু অর্থ কম করার জন্য আমরা অনেক সময় নিম্নমানের বৈদ্যুতিক সামগ্রী ব্যবহার করি। কিন্তু একটু সচেতন হলেই দুর্ঘটনার হার বা ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমানো যেত।

ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা এখানে প্রশ্নবিদ্ধ হয়। একই সঙ্গে পর্যাপ্ত ফায়ার সার্ভিসের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১১ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ঢাকা শহরে প্রতি ৭ লাখ ৪২ হাজার ১৭০ অধিবাসীর জন্য মাত্র একটি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। অর্থাৎ ফায়ার সার্ভিসের সংখ্যা যেমন কম, তাদের জনবল ও প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতিরও অপ্রতুলতা রয়েছে। অনেক কর্মীও উদ্ধারকাজের সময় মারা যান নিরাপত্তার কারণে। পাশাপাশি পরবর্তী সময়ে হাসপাতালে প্রেরণ ও যথাযথ চিকিৎসা দিতে হিমশিম খেতে হয় স্বাস্থ্য খাতকে। তাছাড়া বাংলাদেশের শহরগুলোয় অগ্নিকাণ্ডে আহতদের চিকিৎসা দেয়ার মতো ঢাকার তুলনায় লোকবল ও সুযোগ-সুবিধাও অপ্রতুল। পুরো দেশজুড়েই অপরিকল্পত নগরায়ণের চিত্রটি সামনে আসে অগ্নিদুর্ঘটনার সময়ে। এছাড়া নীতিমালা লঙ্ঘন, জবাবদিহির শিথিলতা, অসাবধানতা এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে উঠেছে, যা কমবেশি সবাইকে ঝুঁকিতে ফেলছে।

এ যাবত অগ্নিকান্ডে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু ঘটেছে ২০১১ সালে ৩৬৫ জন। গত ২৩ বছরে বহু অগ্লিকান্ডের ঘটনা ঘটেছে এই রাজধানীতে। আমাদের নিশ্চয় মনে আছে ২০১০ সালের ৩ জুন নিমতলীর ৪৩/১ নবাবকাটরায় পাঁচতলা বাড়িতে স্মরণকালের অন্যতম ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় হারাতে হয় ১২৩ জনকে। আহত হয় কয়েকশ মানুষ। এক দশকে কেবল পুরান ঢাকায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন ১৪৯৩ জন। তবে এক দশকে আগুনে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৪ হাজার ২৮৬ কোটি ৮৬ লাখ ৬২ হাজার ৭৯৪ টাকা। ২০১৯’এর ২৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর পুরান ঢাকার চকবাজারে ফের আগুন লাগে। ফাগুনের আগুনে শতাধিক মানুষ পুড়ে ছাই হয়। ঘনবসতিপূর্ণ রাজধানীর চকবাজার এলাকা। ক্যামিক্যালের গোডাউনে ঠাসা পুর এলাকা। আগুন লাগলে তো মানুষ মরবেই। আগুনে মানুষ মরে কিন্তু সংশ্লিষ্ট বিভাগের টনক নড়েনা। আপনজন হারিয়ে নিঃস্ব হতে হয় অনেক পরিবারকে। মূলত কেমিক্যাল গোডাউনের আগুনেই সব স্বপ্ন ধূলিসাৎ হয়।

গোডাউনের অতি দাহ্য রাসায়নিক পদার্থের কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। সম্পদের সঙ্গে মানুষও আঙ্গার হয়। ক্যামিক্যাল গোডাউন ঘনবসতীপূর্ণ এলাকায় যেখানে সেখানে হলে মানুষতো পুড়ে মরবেই। এতো প্রাণ যাবার পরও প্রশ্ন হলো রাজধানীর ঘনবসতীপূণ এলাকা থেকে কি ক্যামিক্যাল গোডাউন সরানো হয়েছে আদৌ! সেদিন বনশ্রীর ডি ব্লকের এক বাসিন্দা লিখেছেন- রেডিয়েন্ট কৃষ্ণচুড়া কন্ডেমিনিয়ামে বসবাস করেন ৯০টি পরিবারে প্রায় সহস্রাধিক মানুষ। ঠিক এর মুল ফটকে আছে ক্যামিকেল গোডাউন। তারা বারবার সংশ্লিষ্ট বিভাগকে জানালেও ক্যামিকেল গোডানটি আছে বহাল তবিয়তে। এমন অসংখ্য ক্যামিকেল গোডাউন রয়েছে পুরান ঢাকাসহ রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক ভবনে। প্রতি বছর আগুনে পুড়ে মানুষ মরলেও কেমিক্যাল গোডাউনগুলো সেখানে রয়ে গেছে সংশ্লিষ্টদের পয়সা দিয়ে যথাস্থানেই। তাহলে তো মানুষ মরবেই। কোনোভাবেই আগুনের অভিশাপ থেকে মুক্তি মিলছে না পুরান ঢাকাবাসীর। অহরহ ঘটছে প্রাণঘাতী আগুন।

রাজধানী ঢাকায় ভবন নির্মাণে আইন মানা হয় না, অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা থাকে না। থাকে না বিকল্প সিঁড়িও। আগুন লাগলে নিয়ন্ত্রণের জন্য আধুনিক যন্ত্রপাতিরও অভাব আছে। সবখানেই সমস্যা! তাহলে বাঁচার উপায় কি? আগে অসভ্যতার আগুন নেভাতে হবে। অসভ্যতার আগুন নেভায় সাধ্য কার? সরকারকে এ বিষয়ে কঠোর হতেই হবে নইলে ফি বছর আমরা এভাবে আগুনে পোড়া লাশ দেখতেই থাকবো। ২৯ ফেব্রুয়ারী বেইলি রোডের ব যে বহুতল ভবনে আগুন লেগেছে সেখানে অগ্নিনির্বাপণের তেন কোনো ব্যবস্থা ছিল না, ছিল না বিকল্প সিঁড়িও। তাহলে মানুষ পুড়ে আঙ্গারতো হবেই। সবখানেই অসভ্যতার ছোঁয়া তাহলে আগুনে পুঁড়ে মানুষতো মরবেই! পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় প্রায় চার হাজার কেমিক্যাল গোডাউন, কারখানা রয়েছে। এসব গোডাউন ও কারখানায় বিস্ফোরক ও দাহ্য পদার্থ থাকায় আবাসিক এলাকার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। এগুলো সরনোর কথা। উচ্চ আদালতেরও নির্দেশ ছিল। কে সরাবেন? কে শোনে কার কথা? যারা ক্যামিক্যাল গোডাউনগুলো সরানোর কাজ করবেন তারা তো নগদ নারায়ণ পেয়ে বিলাসী গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। তাই যা হবার তাই হয়। এমন হওয়াটাই তো স্বাভাবিক।

প্রশ্ন হলো অগ্নি নিরাপত্তা নিয়ে এতো উদাসীনতা কেন? বাংলাদেশ ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগ মানুষের নিরাপত্তার দিকটি বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ভবনে অগ্নি নিরাপত্তার কিছু বিধিমালা নির্ধারণ করে দিলেও তার কেন প্রয়োগ নেই ভবনগুলোতে। ঢাকার বেশিরভাগ বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নি নির্বাপক ব্যবস্থা না থাকায় যেকোনো মুহূর্তে ভয়াবহ দুর্যোগের আশঙ্কায় থাকে নগরবাসী। ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বিভাগের সাম্প্রতিক জরিপে ঢাকার জনবহুল ভবন বিশেষ করে হাসপাতাল, শপিং মল ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ দুই হাজার ৬১২টি ভবনের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা খতিয়ে দেখে। সেখানে মাত্র ৭৪টি ভবন ছাড়া বাকি সব ভবন, অর্থাৎ দুই হাজার ৫৩৮টি ভবন ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে বলে জরিপে উঠে আসে।

অগ্নি দুর্ঘটনার হাত থেকে নিরাপদ ও কার্যকর ব্যবস্থার নাম ফায়ার হাইড্রেন্ট। বিশ্বের প্রায় সব শহরে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে এই ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। কিন্তু অপরিকল্পিত এই ঢাকা নগরীতে আজও ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবস্থা গড়ে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়া হয়নি। নিমতলী এবং চকবাজারের ঘটনায় দেখা গেছে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সরু অলিগলি পেরিয়ে দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছতে পারলেও প্রয়োজনীয় পানি সরবরাহের অভাবে দ্রুত সময়ের মধ্যে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে পারেননি। ফলে আগুনের ব্যাপ্তি আর ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ বেশি হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ফায়ার হাইড্রেন্ট হচ্ছে পানির একটি সংযোগ উৎস। যা পানির প্রধান উৎসের সঙ্গে যুক্ত থাকে। যে কোনো জরুরি প্রয়োজনে এই উৎস থেকে পানি ব্যবহার করা যায়। এর সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো এর সঙ্গে লম্বা পাইপ যুক্ত করে ইচ্ছে মতো যে কোনো দূরত্বে পানি সরবরাহ করা যায়। তারা বলেন, আগুন নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বহু আগে থেকেই ফায়ার হাইড্রেন্ট ব্যবহার হয়ে আসছে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই। এটি মূলত রাস্তার ধারে স্থাপন করা এক ধরনের পানির কল। যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। যতদূর জানি, ঢাকার মানুষের জন্য প্রথম সাপ্লাই পানির ব্যবস্থা করে ঢাকার নবাব পবিবার। তখন পুরান ঢাকার বিভিন্ন স্থানে ফায়ার হাইড্রেন্টের ব্যবস্থা রাখা হয়েছিল। সেই ফায়ার হাইড্রেন্টে অগ্নি দুর্ঘটনা রোধে ব্যবহার না হলেও সাধারণ মানুষ গোসল খাওয়া দাওয়াসহ বিভিন্ন কাজেই সেই ফায়ার হাইড্রেন্ট থেকে পানি ব্যবহার করত। পরবর্তীকালে এসব পানির উৎস বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অথচ এগুলো আজ চালু থাকলে প্রয়োজনীয় পানি পেতে বেগ পেতে হতো না। শুধু ফায়ার হাইড্রেন্ট নয়, ঢাকায় এক সময় প্রচুর পরিমাণে পুকুর ডোবাসহ নানা ধরনের জলায়শও ছিল। এসব থেকে অগ্নি দুর্ঘটনারোধে সহজেই পানি পাওয়া যেত। কিন্তু কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির কারণে এগুলো ভরাট, দখল হয়ে গেছে। আজ উদ্ধারের কোনো ব্যবস্থা নেই। উন্মুক্ত এসব জলাশয় বন্ধ করে দেয়ার কারণে আগুনের হাত থেকে রেহাই পেতে বা দ্রুত আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে প্রয়োজনীয় পানি পাওয়া যায় না। দূর থেকে গাড়ি ভরে পানি এনে আগুন নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হয়ে পড়ে। এ কারণে আগুন দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।

রাজধানী ঢাকার অধিকাংশ বহুতল ভবনে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নেই ঠিকঠাক জরুরি নির্গমন ব্যবস্থাও। সংশ্লিষ্ট আইন ও নীতিমালা অনুসরণ না করে তৈরি হওয়া ভবনগুলো পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে! ফায়ার সার্ভিস বিভিন্ন সময়ে এ নিয়ে ভবন মালিকদের নোটিশ দিলেও ব্যবস্থা গ্রহণ করেন না ভবন মালিকরা। এমনকি নোটিশের জবাবও দেন না। ভবন নির্মাণ ও সম্প্রসারণে নিয়ম না মানা এবং অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা না মানার ফলে বারবার মানুষের জীবন বিপন্ন হচ্ছে। অগ্নিকাণ্ডের ফলে প্রাণহানি, আহত হওয়ার ঘটনা ও সম্পদের ক্ষতি বেড়েই চলেছে। বছরে কয়েকশ মানুষের প্রাণ যাচ্ছে অগ্নিকাণ্ডে। অগ্নিকাণ্ড প্রতিরোধ ও প্রতিকারে ভবন থেকে বেরিয়ে আসার পথ এবং আগুন নেভানোর ব্যবস্থাপনা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অর্থাৎ আগুন লাগলে মানুষ যাতে বেরিয়ে আসতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রশস্ত সিঁড়ি এবং এক ভবন থেকে আরেক ভবনের প্রয়োজনীয় দূরত্ব রক্ষা করা জরুরি।

অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা বলতে লোকজন সাধারণত বোঝে ভবনে ফায়ার এক্সটিংগুইশার থাকা। কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। বহুতল ভবনে আগুন নির্বাপণ ও জরুরি নির্গমনে কয়েকটি বিষয় মেনে চলা জরুরি। এগুলো হলো-রাইজার স্থাপন, স্বয়ংক্রিয় স্প্রিং কলার, আন্ডারগ্রাউন্ড পানির রিজার্ভ, ফায়ার ফাইটিং পাম্প হাউজ, স্মোক ও হিট ডিটেকশন সিস্টেম স্থাপন ও ফায়ার লিফট নির্মাণ। কিন্তু দুঃখজনক হলেও আমাদের অল্প কিছু ভবনেই এ নিয়ম মানা হয়। ফলে নিয়মিত বিরতিতেই অগ্নিকাণ্ডে হতাহত ও সম্পদের ক্ষতি হচ্ছে।

অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ সংক্রান্ত আইন ও বিধিমালা থাকলেও তা মানছেন না সিংহভাগ ভবন মালিক। নগরীতে বেশিরভাগ আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে নেই অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। অগ্নিনির্বাপণ আইনের তোয়াক্কা না করে নগরীতে ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে শত শত আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবন। অগ্নিনির্বাপণ আইনে পরিষ্কার বলা আছে– ছয়তলার উপরে ভবনের ক্ষেত্রে তিন স্তরের নিজস্ব স্থায়ী অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এছাড়া বাণিজ্যিক ভবনের ক্ষেত্রে প্রথম তলা থেকে তিন স্তরের এই নিরাপত্তা ব্যবস্থা রাখার বিধান রয়েছে। বেশিরভাগ আবাসিক ভবনেই তিন স্তরের অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা নেই। নিজস্ব অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা দূরে থাক, অনেক এলাকার সড়ক এত সরু, কোনো ভবনে দুর্ঘটনা ঘটলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি প্রবেশেরও সুযোগ নেই। ফলে প্রতিবছর অগ্নিকাণ্ডে প্রচুর পরিমাণ সম্পদহানি হচ্ছে। আইন লঙ্ঘনকারীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মেয়াদে কারা ও অর্থদণ্ডসহ প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স বাতিলের মতো শাস্তির বিধানও রয়েছে। মোবাইল কোর্টের মাধ্যমেও এ আইন প্রয়োগের নিয়ম আছে। কিন্তু ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সীমাবদ্ধতাসহ নানা কারণে এসব আইনের প্রয়োগ নেই।

নামমাত্র অনুমোদন নিয়ে বা না নিয়েই গড়ে উঠছে বহুতল ভবন, মার্কেটসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। অনিয়মিত মোবাইল কোর্ট পরিচালনার কারণে নিয়ম না মানা ভবন মালিকদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। ফলে একদিকে অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি বাড়ছে, অন্যদিকে অগ্নিকাণ্ডের পর নির্বাপণ ব্যবস্থা ও ভবন থেকে জরুরি নির্গমন ব্যবস্থা আরও অকার্যকর হয়ে পড়েছে। এসব অসঙ্গতি দূর করে জনগণের জানমালের নিরাপত্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে।

লেখক : সাংবাদিক, সমাজ গবেষক, মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test