E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আমরা পাকিস্তান ও মালদ্বীপ থেকে শিক্ষা নিতে পারি

২০২৪ মার্চ ৩০ ১৬:১৯:১৭
আমরা পাকিস্তান ও মালদ্বীপ থেকে শিক্ষা নিতে পারি

গোপাল নাথ বাবুল


সম্প্রতি রাজধানী ঢাকার নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে বিএনপি’র পূর্ব ঘোষিত ‘ইন্ডিয়া আউট’ কর্মসূচিতে বিএনপি’র মুখপাত্র এবং সিনিয়র যুগ্ন মহাসচিব রহুল কবির রিজভী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে চলমান ভারতীয় পণ্য বয়কট বা ‘ইন্ডিয়া আউট’ প্রচারাভিযানকে সমর্থন জানিয়ে নিজের পরনের পুরানো গায়ের শাল আগুনে পুড়িয়ে সারাদেশের নেতাকর্মীদের ভারতীয় সকল জিনিসপত্র ও পণ্য বয়কট করার আহবান জানান। তবে পাকিস্তানি কায়দায় বিএনপি’র নেতারা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিলেও ভারতীয় কূটনীতিকদের নিয়ে ইফতার পার্টি করতে কিন্তু একেবারেই ভুলেননি দলটি। এছাড়া বিএনপি-জামাতের ক্ষমতাকালে দেখেছি, বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের বাজারে পরিণত হতে। আসলে আমাদের রাজনীতিবিদরা নিজেদের সকল অপকর্ম জনগণের নামে চালিয়ে দিয়ে দীর্ঘদিন যাবত এক ধরনের ধোঁকাবাজি ও ঠকবাকি করে আসছে। বিএনপি’র ‘ইন্ডিয়া আউট’ তারই একটা অংশ। কিন্তু তারা একবারও কী ভেবে দেখেছেন, এসব ধোঁকাবাজি করে জনগণকে আর ঠকানো যায় না ? কারণ, প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে জনগণ এখন রাজনৈতিকভাবে খুবই পরিপক্ক। যা গ্রাম-গঞ্জের চা স্টলগুলোতে বসলে বোঝা যায়।

বিএনপি’র ভারত বিরোধীতা নতুন কোনও বিষয় নয়। মূলত দলটি জন্মলগ্ন থেকেই আওয়ামীলীগ ও ভারত বিরোধী। তাই পাকিস্তান মুসলিমলীগের কার্বনকপি বলেও অভিহিত করা হয় বিএনপিকে। দলটির সংবিধানও প্রায় মুসলিমলীগের অনুকরণে লিখিত। দলটির মূল চরিত্র হলো আওয়ামীলীগ বিরোধীতা, হিন্দু বিরোধীতা ও ভারত বিরোধীতা। এর অন্যতম কারণ হলো, বিএনপি ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের শতভাগ বেনিফিশিয়ারি। সে হিসেবে বিএনপি’র আওয়ামী লীগ ও ভারত বিরোধীতা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। ৪৭-এ দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর থেকেই বিএনপি’র পূর্বসুরী মুসলিমলীগ তথা পাকিস্তান ভারতবিরোধী ছিল। এজন্য ৫২-এর ভাষা আন্দোলনকেও ‘ভারতের ষড়যন্ত্র’ বলা হয়েছিল। ৬৬-এর ৬ দফা ঘোষণার পর বঙ্গবন্ধুসহ ৩৫ জনকে আসামি করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা করা হয়েছিল। ৬৯-এর গণঅভ্যূত্থানের পর মনিং নিউজ পত্রিকা লিখেছিল, পাঞ্জাবী-পায়জামা পরে ভারতীয়রাই এ অভ্যূত্থানে যোগ দিয়েছিল। রাগে আর ক্ষোভে আন্দোলনকারীরা ওই পত্রিকা অফিস পুড়িয়ে দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সে ধারা এখনো পর্যন্ত অব্যাহত রেখেছে বিএনপি।

দীর্ঘ ৬ বছর ভারতে নির্বাসিত জীবন কাটিয়ে সামরিক শাসক জিয়াউর রহমানের রক্তচক্ষু ও নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে ১৯৮১ সালের ১৭ মে বর্তমান মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন সেদিন রাজধানী ঢাকা মিছিলের নগরীতে পরিণত হয় এবং গগনবিদারী স্লোগানে আকাশ-বাতাস প্রকম্পিত হয়। সেদিন ‘তালপট্টি দ্বীপ’ সংক্রান্ত পাকিস্তানি পুরানো বিবাদ উস্কে দিয়ে শেখ হাসিনাকে ভারতের সেবাদাস হিসেবে পরিচিত করতে উঠে-পড়ে লাগে জেনারেল জিয়াউর রহমান। তিনি জনগণকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের অভ্যান্তরীন শক্তির সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিদেশি শক্তিবর্গ দেশের ভিতর বিশৃঙ্খলা ও অশান্তি সৃষ্টির জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।’

তখন থেকেই নতুনভাবে শুরু ভারতবিরোধীতা। স্বাধীন বাংলাদেশে জিয়াউর রহমান কর্তৃক শুরু করা এ ধারা এরশাদ হয়ে খালেদা জিয়াও নিয়মিত জারি রেখেছিলেন। পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পূর্বে খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ফেনী পর্যন্ত বাংলাদেশ ভারতের অংশ হয়ে যাবে। আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় এলে মসজিদে উলুধ্বনি শোনা যাবে, আজান শোনা যাবে না। আওয়ামীলীগ যে গঙ্গার পানি চুক্তি করেছে সে পানিতে ওযু করা ইসলাম সম্মত নয়। আওয়ামীলীগ ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে। বাংলাদেশে মুসলমানরা দাড়ি-টুপি নিয়ে রাস্তায় বের হতে পারবে না। বাংলাদেশ পুরোপুরি রামরাজ্য হয়ে যাবে।
কিন্তু পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তি চুক্তির পর দেখা গেল, ১৯৯৬ এর পর থেকে মাননীয় শেখ হাসিনা ৫ বার ক্ষমতায় এলেও কোনও মসজিদেই আযানের পরিবর্তে উলুধ্বনী শোনা যায়নি। বরং ৫৬০ টি মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কুতিক কেন্দ্র নির্মাণ-সহ অবহেলিত মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়নের ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে সাধারণ শিক্ষার সমমানে উন্নীত করা হয়েছে। বাংলাদেশের কোনও অংশ ভারত হয়ে যায়নি। বরং ভারত থেকে গঙ্গার পানি হিস্যা আদায়, সিটমহল সমস্যার সমাধান, আন্তর্জাতিক আদালতে ভারতের বিরুদ্ধে মামলা করে বিশাল সমুদ্রসীমা জয়-সহ দু’দেশের মধ্যে বিশাল বাণিজ্য ঘাটতির ভারসাম্য ফিরিয়ে আনতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

১৯৭২ সালের ১৯ মার্চ স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী চুক্তিটিকে স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি-সহ বিএনপি-জামাত ‘গোলামির চুক্তি’ বলে অভিহিত করতো। কিন্তু সে চুক্তিটি ৭৫ এর পরের কোনও সরকারই বাতিল করেনি। এছাড়াও বর্তমান সরকারের সঙ্গে সবচেয়ে বেশি সুসম্পর্ক রয়েছে চীনের সঙ্গে। কিন্তু চীনের বিরুদ্ধে বিএনপিসহ ভারতবিরোধী দলগুলো কোনও কথা বলেনা।

এখন বিএনপি’র একটা অংশ ভারতের সব ধরনের পণ্য বয়কট করার জন্য জনগণকে আহ্বান জানিয়েছে। যেখানে শুধুমাত্র পেঁয়াজ না এলে আবার এরাই নয়াপল্টনে চিৎকার শুরু করে দেন। এ বিষয়ে আওয়ামীলীগের যুগ্ন-সাধারণ সম্পাদক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ যুৎসই একটা কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘ভারতের পেঁয়াজ দিয়ে পেঁয়াজু খায়, ভারতের গরুর মাংস দিয়ে সেহরি খায়, ভারতের শাড়ি পরে স্ত্রীরা সাজে, কিন্তু বয়কটের ডাক দেয়! তারা ভারতীয় পণ্য বয়কটের নামে মানুষের সাথে তামাশা করছে। বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তারা চেষ্টা করছে।’

আমরা এখনও সবকিছুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারিনি। অনেক পণ্য আমাদের আমদানি করে দেশ ও জনগণের চাহিদা মিটাতে হয়। অবশ্য তা আমরা অন্যান্য দেশ থেকেও আনতে পারি। কিন্তু ভারত আমাদের প্রতিবেশি দেশ হওয়ায় কোনও পণ্যের অর্ডার দিলে পরেরদিন তা আমরা পেয়ে যায়। এতে যানভাড়াও অনেক কম হয়। ফলে ন্যায্য মূল্যে আমরা সেসব পণ্য ভোগ করতে পারি। যা অন্যান্য দেশ থেকে আনলে পণ্যমূল্য দ্বিগুণও হতে পারে। আজ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আছে বলেই সহজে সবকিছু আমরা পাচ্ছি। ফলে অভাব বুঝতে পারছি না। পাকিস্তানের মতো ৩৫০ টাকা কেজি আটা খেতে হলে আমরা বর্তমান সরকারের কদর বুঝতাম।

যারা ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছে, তাদের কাছে প্রশ্ন-মুক্তবাজার অর্থনীতির যুগে কী কোনও দেশকে বয়কট করা যায় ? আমাদের তিনদিক ঘিরে রয়েছে ভারত। পূর্বদিকে সামান্য কিছু মায়ানমারের সীমানা রয়েছে। আর দক্ষিণ দিকে বঙ্গোপসাগর। এখন ভারতের সবকিছু বয়কট করলে তাদের আকাশপথও বযকট করতে হবে। তাহলে আমাদের প্রবাসি ভাই-বোনেরা যাবেন কোনদিক দিয়ে ? হয়তো কলম্বো থেকে পাকিস্তান হয়ে যাওয়া যাবে। কিন্তু তাতে যাতায়াত ভাড়া পড়বে বর্তমানের দ্বিগুণেরও বেশি। আশা করি বয়কটকারীদের মনে আছে, মুক্তিযুদ্ধকালে ভারত তাদের আকাশপথ বন্ধ রাখায় পাকিস্তানকে গোলা-বারুদ কলম্বো হয়ে আনতে হতো। ফলে তাদের খরচ অতিরিক্ত হতো। এটাও মুক্তিযুদ্ধে তাড়াতাড়ি পাকিস্তানের পরাজয়ের একটা কারণ।

২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর খালেদা জিয়া পাকিস্তানের আইএসআই, আসামের উলফা-সহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ৭টি রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে ঢাকায় অফিস খুলতে সহায়তা করে। ভারতের সাতবোন নামে পরিচিত রাজ্যগুলোকে অস্থিতিশীল করতে আইএসআই-এর সহযোগীতায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোকে বিভিন্ন ভয়াবহ অস্ত্রে সজ্জিত করে তোলে। যার প্রমাণ- ১ এপ্রিল, ২০০৪ সালে উলফা-সহ বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলোর জন্য আনা দশ ট্রাক অস্ত্রের চালান।
২০১৩ সালে খালেদা জিয়া পাকিস্তানের আইএসআই-এর পরামর্শে জামাতের ডাকা হরতালের দোহাই দিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে দেখা না করে তাকে মারাত্মকভাবে অপমানিত করেন এবং রাজনৈতিকভাবে অজ্ঞানতার পরিচয় দেন। তাদের রাষ্ট্রপতিকে এমন অপমান করার পর ভারত কেন মেনে নেবে বিএনপিকে? অথচ বিএনপি’র আবেদনের প্রেক্ষিতেই প্রণব মুখার্জির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। সুতরাং অতিথিকে এক প্রকার নিমন্ত্রণ করে এনে অপমান করার শামিল বলে অভিহিত করা যায় উক্ত ঘটনাকে। তাই ভারতের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকির সম্ভাবনাকারী দলকে ভারত কোনোদিন সমর্থন দেবে না, এটাই স্বাভাবিক। শুধু ভারত কেন, যে কোনো দেশ এমন ভূমিকা-ই নেবে।

এ ব্যাপারে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (এমইএ) বাংলাদেশ, মিয়ানমার বিভাগের জ্যৈষ্ঠ কর্মকর্তা স্মিতা প্যান্ট বলেন, ভারতের ভবিষ্যৎ, বিশেষ করে এর নিরাপত্তা বাংলাদেশের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে অনেককিছু অর্জন করতে পারে, বিশেষ করে নবায়নযোগ্য জ¦ালানি এবং সুন্দরবনের ব-দ্বীপ সুরক্ষায়। (দি ডেইলি স্টার, ১৬ আগস্ট, ২০২৩)। স্মিতা প্যান্টের এ কথাগুলো আমাদের অনেককিছু বুঝিয়ে দেয়।

ইচ্ছে করলে বয়কটকারীরা তাদের মুরব্বী দেশ পাকিস্তান থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন। ভারত সরকার কর্তৃক কাশ্মীরের ৩৭০ ধারা বাতিলের পর রাগে ও ক্ষোভে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের সঙ্গে সকল প্রকার বাণিজ্য কার্যক্রম স্থগিত করেন। এরপর হু হু করে পাকিস্তানে পণ্যমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকে। আবার তিনি রাশিয়া সফরে গিয়ে আমেরিকাকে রাগিয়ে দেয়। যেহেতু পাকিস্তান চালায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। আর সেনাবাহিনী চালায় আমেরিকা। ফলে যা হওয়ার তাই হলো। যথেষ্ট জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও ক্ষমতা থেকে ছিটকে পড়েন ইমরান খান। অথচ ইমরান খান নিজেও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা করার পক্ষে মত দিয়েছিলেন। দৈনিক যুগান্তর-এ প্রকাশ- ১৬ জানুয়ারি, ২০২২-এ তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতের সঙ্গে আগামী ১০০ বছরেও আমরা যুদ্ধে জড়াবো না। বাণিজ্যকেই প্রাধান্য দিব।’

তিনি আরও বলেছিলেন, দিল্লীকে বাদ দিয়ে কুটনৈতিকভাবে ইসলামাবাদ কোনও মতেই এগিয়ে যেতে পারে না। আমরা কোনঠাসা হয়ে গেছি। আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে একা হয়ে গেছি। এজন্য ভারতের বিষয়ে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতির আমূল পরিবর্তনের জন্য তিনি ৫ বছরের পরিকল্পনা করেছিলেন।
এখন পাকিস্তান আবার ভারতের সঙ্গে স্ব-উদ্যোগে ব্যবসায়িক সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। যদিও ভারতের দিক থেকে এখনও সে ব্যাপারে কোনও মতামত দেয়া হয়েছে কিনা অথবা ভারত তা সমর্থন করবে কিনা জানিনা। আজকে পাকিস্তানের যে অর্থনৈতিক দুর্দশা কিংবা তাদের খাদ্যমূল্য বৃদ্ধি হওয়ার জন্য দায়ী ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের বাণিজ্য কার্যক্রম স্থগিত করা। আর সুচারুরূপে এ কাজটি করেছিলেন পাকিস্তানের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি ভাবতেই পারেননি, রাগের বশে এবং নিজের অজান্তেই তিনি পাকিস্তানের সর্বনাশটা করে বসেছেন।

সুতরাং যারা এখন ভারতীয় পণ্য বয়কটের ডাক দিয়েছেন তাদের উচিত, পাকিস্তান থেকে শিক্ষা নেওয়া। পাকিস্তান এখন তাদের পররাষ্ট্রনীতি ঢেলে সাজানোর জন্য পাঁচ বছর মেয়াদী পরিকল্পনা হাতে নিতে যাচ্ছে, কীভাবে ভারত-সহ প্রতিবেশি দেশগুলোর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক সুন্দর, সাবলীল ও শান্তিপূর্ণ রাখা যায়। তারা বুঝে গেছে, ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ করে পাকিস্তানের বিপদ আরও বেড়ে যাবে। তার ওপর বেলুচিস্তানের স্বাধীনতাকামীদের নিয়ে এমনিতে একটা ঝামেলা রয়েছে। তারা যখন-তখন আত্মঘাতি হামলাসহ বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা চালাচ্ছে।

১৮ জানুয়ারি, ২০২৩ ইংরেজি ডয়চে ভেলে পত্রিকাকে তখনকার সরকার প্রধান শাহবাজ শরীফ বলেন, ‘দিল্লীর সঙ্গে তিনটি যুদ্ধ করতে গিয়ে পাকিস্তান শিক্ষা পেয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আরব-আমিরাতের সঙ্গে পাকিস্তানের ভাতৃপ্রতীম দেশ ভারতের একটা ভালো সম্পর্ক আছে। তাই তারা দু’দেশকে আলোচনার টেবিলে বসাতে পারে। আমি কথা দিচ্ছি, আমি অন্তত এ বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে অর্থবহ আলোচনা করব। আমরা ভারতের সঙ্গে তিনটি যুদ্ধ করেছি। তার ফলে মানুষের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে, মানুষ আরও গরীব হয়েছে, আরও বেকার হয়েছে।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভারত আমাদের প্রতিবেশি দেশ। এমন নয় যে, আমরা আমাদের পছন্দমতো প্রতিবেশি হয়েছি। কিন্তু ঘটনা হলো, আমাদের প্রতিবেশি হিসেবে থাকতে হবে। আমরা শান্তিতে থাকবো নাকি ঝগড়া করবো তা আমাদের বিষয়। আমরা গোলা-বারুদের খরচ আর বাড়াতে চাইনা। আমাদের হাতে যা বোমা আছে, যুদ্ধ হলে আমরা কেউ বাঁচবো না।’

ভারত এ বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। কারণ তারা পাকিস্তানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। তবে ভারতের প্রতিরক্ষা বিশেষজ্ঞ প্রফুল্ল চাকী এএনআইকে বলেন, এর আগেও ইমরান খান এমন কথা বলেছিলেন। তারপরও কিছুই হয়নি।

পাকিস্তানের রাজনৈতিক বিশ্লেষক শাহবাজ চৌধুরী এক্সপ্রেস ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ভারত বিশ্বের কাছে গুরুত্বপূর্ণ একটি দেশ। আমেরিকা ও রাশিয়া, দু’টি দেশই তাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রাখতে চাইছে। কৃষি ব্যবস্থাপনায় তারা বিশ্বের সেরা।’

পাকিস্তানের বাণিজ্যমন্ত্রী মাকদুম আমিন বলেছেন, ভারতকে বাণিজ্য সুবিধা দিতে যাচ্ছে পাকিস্তান। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিবেশি ভারত এত কাছে থাকতে আমরা সিঙ্গাপুর ও দুবাই থেকে খাবার কিনে আনি, যা ভারতেরই খাবার এবং যথেষ্ট ব্যয়সাপেক্ষ।

এ বিষয়ে পাক বিশেষজ্ঞরাও জানিয়েছেন, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নতি করতে হলে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য শুরু করা প্রয়োজন। ভারত থেকে সস্তায় পণ্য কেনা যায়। সেইসঙ্গে ভারত একটি বড় বাজার অথচ পাকিস্তান প্রতিবেশি দেশ হয়েও তার সুবিধা নিতে পারছে না।

গত ২৩ মার্চ বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে নিউক্লিয়ার এনার্জি সামিটে অংশগ্রহণের পর লন্ডনে এক সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার একই ইঙ্গিত দেন। ওই সম্মেলনে ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক কার্যক্রম পুনরায় শুরু করার জন্য পাকিস্তানের ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের আগ্রহের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমরা ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যের বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করব।’ এ সময় তিনি দেশকে অর্থনৈতিক অগ্রগতির পথে ফিরিয়ে আনতে এবং সাধারণ মানুষের অর্থনৈতিক অসুবিধা ও মুদ্রাস্ফীতি কমাতে একটি ৫ বছরের রোড ম্যাপ বাস্তবায়ন করার কথাও উল্লেখ করেন।

উল্লেখ্য, ভারতের সঙ্গে পাকিস্তান বাণিজ্য কার্যক্রম স্থগিত করে সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে সেদেশের ব্যবসায়ীদের। কারণ, এতে ভারতের মতো বড় বাজারের সুবিধা নিতে পারছেন না তারা। মোটামুটি ভারতের অর্থনৈতিক উত্থান পাকিস্তানি ব্যবসায়ীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। যা আগে কখনও হয়নি। পাকিস্তানের প্রধান রপ্তানি টেক্সটাইল পণ্য আর ভারতে রয়েছে তার বড় বাজার। তাই কম খরচে টেক্সটাইলের বাজার ধরতে ভারতে অ্যাক্সেসের সুবিধা চাইছেন পাকিস্তানি ব্যবসায়ীরা। এজন্য তারা সরকারের ওপরও চাপ সৃষ্টি করছেন।

এছাড়া মালদ্বীপে চীনপন্থী মইজ্জু সরকার ক্ষমতায় আসার পর ভারতের সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হন। ফলে পর্যটকের ওপর নির্ভরশীল মালদ্বীপে পর্যটকের সংখ্যা অর্ধেকে পরিণত হয় এবং মালদ্বীপ অর্থনৈতিক চাপে পড়ে যায়। এর ওপর মালদ্বীপের কাছে ভারতের পাওনা বিপুল পরিমাণে ঋণ রয়েছে। এতদিন শত্রু ভাবা ভারতকে জানালেন, ভারত তাদের ঘনিষ্ট বন্ধু। তাই মইজ্জু ভারতের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন, মালদ্বীপের কাছে পাওনা প্রায় ৪০০.৯ মিলিয়ন ডলার ঋণ যেন ভারত মাফ করে দেয়। আমাদের দেশের ভারত বয়কটকারীরা মালদ্বীপ থেকেও শিক্ষা নিতে পারেন।

সুতরাং বিএনপি ও তাদের সমমনা দলগুলোর প্রতি বিনীত আবেদন-অন্তত দেশ ও দেশের জনগণের কথা ভেবে নিজেদের স্বার্থের জন্য ও কোনও বিদেশি রাষ্ট্রকে খুশি করতে ভারতীয় পণ্য এবং ভারত বয়কটের ডাক দিয়ে দেশের বাজার অস্থিতিশীল করা থেকে বিরত থাকবেন, এমনটাই কামনা করছি।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

০৩ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test