E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

চাপ দিয়ে ব্যাংক একীভূতকরণের চেষ্টা দিশেহারা চিন্তার প্রতিফলন 

২০২৪ এপ্রিল ১৭ ১৬:১৩:১৬
চাপ দিয়ে ব্যাংক একীভূতকরণের চেষ্টা দিশেহারা চিন্তার প্রতিফলন 

চৌধুরী আবদুল হান্নান


স্বেচ্ছায় না এলে চাপ দিয়ে ব্যাংক একীভূত করা হবে, জানিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় একীভূত না হলে আগামী মার্চ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ভালো ব্যাংকের সঙ্গে দুর্বল ব্যাংককে মিলিয়ে দেওয়া হবে। চাপ দিতে গেলে তো ক্ষমতা বা শক্তি থাকতে হয় , বাংলাদেশ ব্যাংকের কি তা অবশিষ্ট আছে ?

যদি ক্ষমতা কিছু থেকে থাকে নিরপেক্ষভাবে তা প্রয়োগের সক্ষমতার অভাব রয়েছে — এমন বিশ্বাস ব্যাংক খাত সংশ্লিষ্টদের। দেশের অর্থনীতির হৃদপিন্ড আর্থিক খাত নিয়ে উদ্বেগ আর আলোচনা দীর্ঘদিনের।

ব্যাংকের টাকা আত্মসাতকারী ও পরাক্রমশালী অর্থ পাচারকারীদের দৌরাত্ম্য, রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস নেতৃবৃন্দের প্রভাব বাংলাদেশ ব্যাংককে অক্টোপাসের মতো আটকে রেখেছে; এখান থেকে সহসা মুক্ত হয়ে স্বাভাবিকভাবে কাজ করতে পারবে — এমন প্রত্যাশা দুরাশা।

ব্যাংক খাতের দুরবস্থা নিরসনে, শৃঙ্খলা ফেরাতে ইতিপূর্বে বা সাম্প্রতিক সময়ে যে সকল নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে, তার কিছু ছিল ব্যাংকের টাকা লুটপাটকারীদের সুযোগ আরও বাড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে অনুকূল। আমরা বুঝতে পারি, এসব নীতিমালা করার পিছনে এ সকল দুষ্টচক্রের পরোক্ষ প্রভাব রয়েছে।

আগে কোনো ব্যবসায়ী গ্রুপের যে কোনো একট প্রতিষ্ঠান ঋণ খেলাপি হলে গ্রুপভূক্ত অন্য প্রতিষ্ঠান নতুন করে ঋণ নিতে পারতো না, ফলে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানের ঋণ নিয়মিত রাখতে গ্রাহকদের ওপর আপনা আপনি একটা চাপ বিদ্যমান থাকতো। কিন্ত বর্তমানে সে শর্ত রহিত করা হয়েছে।

এ সকল সুবিধা কাদের জন্য?

এর ফলে যারা ব্যাংক থেকে টাকা বের করে নেয় কিন্ত ফেরত দেয় না, তারা উৎসাহিত হবে। এমনিতেই তারা ধুরন্ধর সুযোগ সন্ধানী, তাদের জন্য টাকা বের করার দ্বার আরও উম্মুক্ত হয়ে গেল। এমন অনেক নজির রয়েছে, গ্রুপভূক্ত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের মালিক সাজিয়ে বেনামি ঋণ ম্যানেজ করা হয়েছে। এবি ব্যাংক থেকে ৩৫০ কোটি টাকার এমন একটি ঋণ কৌশলে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয় কিন্ত ঋণ ছাড় করার আগেই আটকে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (সমকাল ২৫/০৫/২৩ ইং)।

আর একটি নীতিমালা আরও বিস্ময়কর, তবে খেলাপিদের জন্য বড়ই উৎসাহব্যাঞ্জক। এখন থেকে ৩ বছরের পরিবর্তে টানা ২ বছর মন্দ ও ক্ষতিজনক মানে শ্রেনীকৃত ঋণ অবলোপন করা যাবে। তাতে ‘সুবিধা’ অনেক, ব্যাংক খাতে অবলোপনকৃত ঋণের পরিমান বেড়ে যাবে এবং সমপরিমান খেলাপি ঋণ কম দেখানো যাবে।

বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আরও বলা হয়েছে, এ প্রক্রিয়ায় অবলোপনের মাধ্যমে এখনই ৪৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ দৃশ্যত কমানো যাবে।

এভাবে অবলোপন বাড়িয়ে খেলাপি ঋণ কমানোর মাধ্যমে ব্যাংকের স্বাস্হ্য সবল দেখানো হচ্ছে; শরীর রোগব্যাধীতে জর্জরিত কিন্ত দেখতে নাদুসনুদুস। তাই অনেক বিশেষজ্ঞ বলেন, ব্যাংকগুলোর দৃশ্যমান আর্থিক চিত্র অনেকটা সাজানো, প্রকৃত চিত্র নয়।

নীতিমালাগুলো ব্যাংক ব্যবস্থার যতটা না সুশাসনের জন্য, তার চেয়ে বেশি ঋণখেলাপিদের সুবিধার জন্য — এমন বিশ্বাস জনমনে।

ব্যাংক লুটেরা আর অর্থ পাচারকারীদের প্রতারণার কলাকৌশল এতটাই তীক্ষ্ণ যে ব্যাংক ব্যবস্থার সুশাসনের জন্য নেওয়া উদ্যোগ সেখানে বরাবরই মার খাচ্ছে। বিনা পরিশ্রমে হাতে আসা টাকা, অবৈধ অর্থের ক্ষমতার দাপট অপ্রতিরোধ্য, তারা জয়ী হতে সব কিছু করবে। তাদের প্রত্যক্ষ, পরোক্ষ শক্তির প্রভাবমুক্ত হওয়া সহজ নয়।

তাই বলা হচ্ছে, ন্যাংড়া দুর্বল ব্যাংকগুলো ভালো ব্যাংকের ঘাড়ে চাপানোর উদ্যোগ কার স্বার্থে? যাদের কারণে একটি ব্যাংকে মাত্রাতিরিক্ত খেলাপি ঋণ সৃষ্টি হয়েছে, ব্যাংকটিকে রুগ্ন করে দিয়েছে, তাদের স্বার্থ এর পিছনে কাজ করছে — এমন ভাবনাকে কি অযৌক্তিক বলা যায়?

উদ্যোক্ততা, কর্মকর্তগণের বহুবিদ প্রতিকূলতা পার করে, মেধা, যোগ্যতা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে একটি ব্যাংক ভালো অবস্থায় উন্নীত হয়েছে এবং টিকে আছে; তার প্রতি দুষ্ট লোকের কুদৃষ্টি পড়েছে।একটি খেয়ে শেষ করেছে, এখন ভালো ব্যাংককেও খাবে। যাদের কেবল খাওয়ার অভ্যাস, তারা অন্যদের নিঃস্ব করে খেয়েই যাবে।

নিজের লাভ ছাড়া কেউ কাজ করে না, একটি পচে যাওয়া ব্যাংককে সঙ্গে নিয়ে ভালো ব্যাংকটির কী লাভ ? একটি ভালো ব্যাংক স্বেচ্ছায় একটি খারাপ ব্যাংকের দায় নিতে পারে না আর জোর করে চাপানো হলে তার ফল শুভ হতে পারে না। অনেকেই মনে করেন, ঋণখেলাপি, অর্থ পাচারকারীদের সুবিধা দেওয়ার জন্য ভালো ব্যাংকের সাথে খারাপ ব্যাংক একীভূত করতে তড়িঘড়ি করা হচ্ছে।

ব্যাংক একীভুতকরণের পিছনে লাভ ও লোভ দুই ই ক্রিয়াশীল এবং অনেক হিসাব নিকাশ রয়েছে যেখানে শুভশক্তির জয় হবে তা নিশ্চিত করে বলা যায় না।

দেশে ব্যাংকের সংখ্যা কমিয়ে আনার চিন্তা ভাবনা হচ্ছে, সেক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত বেশি দুর্বল ব্যাংকের আমানতকারীদের টাকা বিশেষ ব্যবস্থায় (বাংলাদেশ ব্যাংক তো এমন ব্যবস্হা মাঝে মাঝে করেই থাকে) ফেরত দিয়ে দুর্বল ব্যাংক অবসায়নের উদ্যোগ নেওয়ার পক্ষে অনেকেই মতামত রাখছেন।

যে সকল পরিচালকের দুর্নীতির কারণে ব্যাংক আজ ডুবন্ত, সেই ব্যাংককে যদি একটি সবল ব্যাংকের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়, তা হলে ওই পরিচালকেরাই অবশেষে লাভবান হবেন — এমন ভাবার যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে।

রাজনৈতিক হস্তক্ষেপসহ অযাচিত প্রভাবমুক্ত হয়ে একটি স্বাধীন স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা হিসেবে কাজ করার সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে বড় সমস্যায় হাত না দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ছোট কাজগুলো করুক; ব্যাংকগুলো ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে এসেছে যারা জনগণের কাছে তাদের অন্তত চিহ্নিত করে দিক। এমনও তো হতে পারে, একদিন জনগণই তাদের বিচার করবে — বিচারহীনতার যুগের ভাবনা।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত ডিজিএম, সোনালী ব্যাংক।

পাঠকের মতামত:

৩০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test