E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

মান্না, সম্পাদক পরিষদ এবং স্বাধীনতা খর্বের গল্প

২০১৫ ফেব্রুয়ারি ২৫ ১৭:৫৯:১৫
মান্না, সম্পাদক পরিষদ এবং স্বাধীনতা খর্বের গল্প

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা : সাদেক হোসেন খোকা ও অজ্ঞাত এক ব্যক্তির সাথে মাহমুদুর রহমান মান্নার ফোনালাপ প্রকাশের পর দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজ যতটা ব্যাক ফুটে চলে গেছেন, এবার তাদের কি টেনে তুলবার শেষ চেষ্টা কি করছে সম্পাদকদের সংগঠন? সম্পাদক পরিষদ মঙ্গলবার বিবৃতিতে অভিযোগ করেছেন ‘সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে’।

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি গোলাম সারওয়ার দেশের বাইরে। তড়িঘড়ি বৈঠক করে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়েছে , ‘সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্রের ও জাতীয় প্রচার মাধ্যমের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।’

যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত বাংলা দৈনিক সমকালের সম্পাদক গোলাম সারওয়ার বলেছেন, তার সঙ্গে কোনো ধরনের আলোচনা না করেই এই বিবৃতি দেওয়া হয়েছে।

বিবৃতিতে কার সভাপতিত্বে বৈঠক? স্থান এবং কারা উপস্থিত ছিলেন সে বিষয়েও কিছু উল্লেখ না করায় বিস্ময় প্রকাশ করেন তিনি। একটি অনলাইন মাধ্যমকে তিনি বলেন, ‘পরশু দিন আমি জরুরি প্রয়োজনে আমেরিকায় চলে এসেছি। আমি সম্পাদক পরিষদের সভাপতি। বিবৃতিতে অনেক কড়া কড়া কথা আছে, যা আমার সঙ্গে আলাপ না করেই দেওয়া হয়েছে। আমি এই বিবৃতিকে ওন করি না।’ এবং ভোরের কাগজ সম্পাদক শ্যামল দত্ত বলেছেন, তিনিও এই বক্তব্যের সাথে একমত নন।

সম্পাদকরা বলছেন, নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারছেন না। এখন প্রশ্ন হলো? তারা কি নিজেরা নিরপেক্ষ? যদি বলি সুযোগ বুঝে মিথ্যার পক্ষেও অবস্থান নেন, ভুল বলা হবে? আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান দিনের পর দিন মিথ্যা সংবাদ ছেপেছেন। সাম্প্রদায়িক উস্কানি দিয়েছেন। তাকে যখন সুনির্দিষ্ট অভিযোগে গ্রেপ্তার করা করা হলো, তখন এই সম্পাদক পরিষদ বিবৃতি দিয়েছিলেন তার মুক্তির দাবিতে। মাহমুদুর রহমানের পক্ষে অবস্থান নেয়া মানে মিথ্যার পক্ষেই অবস্থান নেওয়া। এ কথা কি অস্বীকার করবেন সম্পাদক পরিষদ?

মিথ্যা বা আধা সত্যের আরেকটি নমুনা বলি। বিএনপি’র পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির একজন নেতা সাংবাদিকের পরিচয় দিয়ে নিউ ইয়র্ক-এ প্রতিদিন জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের ব্রিফিং এ উপস্থিত থাকেন এবং বাংলাদেশ নিয়ে প্রশ্ন করেন। যেহেতু দলীয় এজেন্ডা নিয়ে ব্রিফিং-এ যান, তাই প্রশ্ন করার চেয়েও দলীয় বক্তব্য সেখানে উপস্থাপন করেন। ঢাকায় একটি পত্রিকার সম্পাদক তার পত্রিকায় সেটি প্রতিদিন গুরুত্ব দিয়ে ছাপেন। সেই বিএনপি নেতা প্রশ্ন করেছে সরকার নাকি ‘রাস্তায় বিক্ষোভের ছবি’ প্রকাশ করায় ডেইলি ষ্টারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে যাচ্ছে। অথচ পত্রিকাটি ছবি ছেপেছে নিষিদ্ধ সংগঠন হিযবুত তাহরীরের। কিন্তু মহান সম্পাদক এই মিথ্যাটুকু সম্পূর্ণ এড়িয়ে গেলেন কেন? আরেকটি প্রশ্ন সেনাবাহিনীকে উস্কানি দেয়ার সর্বাত্মক চেষ্টা আছে। সেই প্রশ্নও আছে কিন্তু উত্তরটা নেই।

তলিয়ে দেখা যাক মঙ্গলবারের বিবৃতি। নিরপেক্ষতার যে অজুহাত তারা তুলেছেন, তারা সেখানে কতটা সততার সাথে অবস্থান নিয়েছেন এবং তা মেনে চলছেন, আশা করবো এই প্রশ্ন তারা নিজেদেরই করবেন। তারা কি সত্যকে সত্য বলে তুলে ধরতে পারছেন? নাকি নিরপেক্ষতা আর গণমাধ্যমের স্বাধীনতার একটি সংজ্ঞা নিজেদের মতো করে তৈরি করেছেন?

ধরা যাক একজন সম্পাদক টক-শোতে আনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন। তিনি একটি বিশেষ দলের হয়ে কাজ করেন। অনুষ্ঠানের অতিথি তালিকায়ও সেই ঘরানার মানুষেরই প্রাধান্য। সেই টক-শো নিয়ে সেই চ্যানেল কর্তৃপক্ষের সাথে মতবিরোধ হতে পারে, তর্কের খাতিরে যদি ধরে নেই সরকার টিভি কর্তৃপক্ষকে চাপ দিয়ে এটি করেছে, তবুও সম্পাদক পরিষদ কি বলতে পারেন? কণ্ঠরোধ করা হচ্ছে? সেই সম্পাদকের কাগজের দিকে তাকালে দেখা যায় কি-না লিখছে পত্রিকাটি!

কোনো কোনো সম্পাদকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা প্রকট। গণমাধ্যম ব্যাক্তিদের, এমনকি সম্পাদকদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকতেই পারে। কিন্তু দেশ তথা জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে মিডিয়ার অবস্থানতো জনগণের পক্ষে থাকার কথা। বিবৃতিদাতারা কি জনগণের পক্ষে নিজেদের দাঁড় করাতে পেরেছেন?

প্রায় দু’মাস ধরে আগুনে পুড়িয়ে মানুষের মৃত্যুর বিরুদ্ধে একটি সাধারণ অবস্থান কি এই সম্পাদকরা নিয়েছেন? আজ একটি পত্রিকার একটি ছবি ছাপা নিয়ে সরকারের সঙ্গে কিছুটা সম্পর্ক শিথিল হতে না হতেই যেভাবে তারা একসাথে হলেন, বিবৃতি দিলেন, তাদের সেই সক্রিয়তা জনগণের পক্ষে দেখা যায়নি একবারও। সাধারণ সম্পাদকীয়তে তারা করতে পারতেন না যে ‘বন্ধ করুন মানুষ পোড়ানো? যারা মানুষ পোড়ায় সেসব রাজনৈতিক কর্মসূচি আহবানকারী দলের নেতাদের মতো দিনভর সেমিনারে, টক-শোতে, এমনকি যার যার কাগজে ব্যস্ত আছেন সংলাপ সংলাপ করে। কারা পেট্রলবোমা মারে, আগুনে পুড়িয়ে মানুষ মারে- সেটা নিয়ে তারা যদি সন্ত্রাসী অবরোধ আহবানকারী দলের নেতাদের মতো বিতর্ক করতে চান, করতে পারেন, কিন্তু মানুষ হত্যার বিরুদ্ধে যে সম্পাদকরা জোড়ালোভাবে দাঁড়ালেন না। তারাই এখন নিরপেক্ষতার কথা বলছেন। অর্থাৎ তারা স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে আগুন সন্ত্রাসীদের পক্ষে অবস্থান নিয়েছেন, কেউ কি তাদের স্বাধীনতায় বাধা দিয়েছেন? তাহলে কেন বিবৃতিতে বলা হলো, স্বাধীনতা নেই আজ।

একটি কাগজ, দিনের পর দিন, প্রথম পাতায় মন্তব্য প্রতিবেদন ছেপেছে, ‘ছাত্রলীগকে থামান’ শিরোনামে। ছাত্রলীগের অপকর্মের কথা অবশ্যই লিখতে হবে। কিন্তু নিরেপক্ষতার স্বার্থে তো অন্তত; একটি লেখা আশা করা যায় যে তিনি অবরোধকারী দলের উদ্দেশ্যে লিখবেন, ‘পেট্রল বোমা থামান’। এই পত্রিকা কদিন আগে সংবাদ ছেপেছে, বোমা বানাতে গিয়ে যুবক আহত। এই রিপোর্টের শেষ ভাগে লেখা হয়েছে, তিনি যুবদল করতেন। আমি নিশ্চিত, যুবলীগ বা ছাত্রলীগ হলে তার শিরোনামেই এই তথ্যটি থাকতো।

টেলিভিশন টক-শো নিয়ে তাদের উদ্বেগ বোধগম্য নয়। টেলিভিশনে আলাদা সম্পাদকীয় প্রতিষ্ঠান আছে। সেসব সম্পাদকরা কি এ নিয়ে কিছু বলেছেন? তারা কেন আগ বাড়িয়ে এ নিয়ে বললেন? আর যদি বলেনই, তখন পুরোটা বললেন না কেন? টক শো যে কোন কোন ক্ষেত্রে মিথ্যাচার আর অপপ্রচারের নির্ভরযোগ্য প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে সেটা কি তাদের পর্যবেক্ষণে ধরা পড়েছে? এমনকি যে ফোনালাপ প্রকাশিত হয়েছে, সেখানে দেখা যায় মান্না বলেছেন, তিনি এবং তারা কিছু মানুষকে গ্র“মিং করছেন এবং বিভিন্ন চ্যানেলে পাঠাচ্ছেন তাদের রাজনৈতিক বক্তব্য প্রকাশ করার জন্য। নাকি মিথ্যাচার করার স্বাধীনতাই গণমাধ্যম স্বাধীনতার মানদন্ড?

কোনো কোনো সম্পাদক ঘোষণা দিয়ে হরতাল অবরোধের বিরুদ্ধে তাদের অবস্থান জানান দিয়েছিলেন। তখন আওয়ামীলীগ বিরোধী দলে ছিল। সেই সম্পাদকদের পত্রিকা দেখলে দেখা যায়, এখন একটি নির্বাচনের জন্য হরতাল অবরোধের প্রমোটার হিসেবে কাজ করেছেন; এবং এটাও তারা কিন্তু করছেন তাদের স্বাধীন ইচ্ছাতেই। সময় এসেছে গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতা, নিরপেক্ষতার পরিধি নিয়ে আসলে খোলামেলা আলোচনা করার। কারা কি উদ্দেশ্যে গণমাধ্যমকে তাদের রাজনীতি, কোন দল বা ব্যক্তির প্রতি তাদের বিদ্বেষ আর হিংসা চরিতার্থ করার কাজে ব্যবহার করে, আবার তাকেই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা বলে সবকিছু নিজেদের পকেটে সংরক্ষণ করতে চাচ্ছেন, তা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনার এখনই সময়।

যে সম্পাদক পরিষদ আজ পর্যন্ত গণমাধ্যমের জন্য একটি কমন আচরণবিধি করতে পারেনি, তারা কেন ব্যস্ত রাজনৈতিক বিষয়ে? এই বিষয়ে আলোচনায় উঠে আসার দাবি রাখে।

লেখক : বার্তা পরিচালক, একাত্তর টেলিভিশন


সৌজন্যে : আমাদের সময় ডট কম

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test