E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শহীদ জননীর জন্যে ভালোবাসা

২০১৫ জুলাই ০৩ ০৯:১২:৪৩
শহীদ জননীর জন্যে ভালোবাসা

মুহম্মদ জাফর ইকবাল : ২৬ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মৃত্যুদিবস ছিল। আমার বিশ্বাস হয় না দেখতে-দেখতে একুশ বছর কেটে গেছে। মনে হয় এইতো মাত্র সেদিন নিউ ইয়র্ক, নিউ জার্সিতে সভা-সমিতি করে গাড়ি করে তার সাথে আমি ঘুরে বেড়িয়েছি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনে যিনি ইস্পাতের মতো কঠিন, সিংহীর মতো শক্তিশালী, সেই একই মানুষ ব্যক্তিগত পরিবেশে নিরিবিলি কথা বলায় সময় একেবারেই সহজ-সরল। নিজের কথা বলতে গিয়ে একটু পরে-পরে তিনি বাচ্চা মেয়ের মতো খিল-খিল করে হেসে ওঠেন। মাঝে-মাঝেই মনে হয়, আমার কত বড় সৌভাগ্য, আমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামের মতো একজন মানুষের স্নেহ পেয়েছি।

 

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যখন শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন শুরু হয়েছিল, তখন নতুন প্রজন্মের তরুণেরা সেখানে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিশাল একটি ছবি লাগিয়েছিল। আমার মনে হতো, সেই ছবির জাহানারা ইমাম এক ধরনের স্নেহ নিয়ে শাহবাগের লাখ-লাখ তরুণ-তরুণীর দিকে তাকিয়ে আছেন। মনে আছে, একদিন সন্ধ্যেবেলা মোমবাতি জ্বালানোর একটি কর্মসূচি ছিল, শাহবাগে লাখ-লাখ মোমবাতি মিটি-মিটি করে জ্বলছে এবং তার মাঝে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের বিশাল প্রতিকৃতি স্মিত হাসিতে সবার দিকে তাকিয়ে আছেন—সে রকম একটা ছবি আছে। আমি মাঝে-মাঝেই সেই ছবিটি দেখি, আমার খুব ভালো লাগে। মনে হয়, শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সত্যিই আমাদের সাথে আছেন, সত্যি-সত্যি আমার দিকে তাকিয়ে বলছেন—‘আমি বলেছিলাম না, এই দেশের মাটিতে একদিন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই হবে।’

মৃত্যুর ঠিক আগে-আগে নিউ ইয়র্ক নিউ জার্সি এলাকায় আমরা বেশ কয়েকজন সারারাত গাড়ি চালিয়ে মিশিগান স্টেটের ডেট্রয়েটের হাসপাতালে তাকে দেখতে গিয়েছিলাম। তখন তার কথা বন্ধ হয়ে গেছে, মুখে কিছু বলতে পারেন না, কিছু বলতে চাইলে কাগজে লিখে দেন। একসাথে বেশি ভিজিটর যাওয়া নিষেধ, তার ছেলে জামী আমাদের দুজন-দুজন করে নিয়ে গেছে। আমি যখন গিয়েছি তখন ধবধবে সাদা একটা বিছানায় তিনি চুপচাপ বসে আছেন। আমাদের দেখে মৃদু হাসলেন এবং তখন আমার সাথে যে ছিল, সে ভেউ ভেউ করে কাঁদতে শুরু করল। জাহানারা ইমাম কাগজে লিখলেন, ‘এখন কান্নার সময় না, এখন হাসার সময়।’

কাগজে লিখে লিখে আমাদের সাথে কথা বললেন, এক সময় আমাদের সময় শেষ হয়ে গেল, তখন আমরা বিদায় নিয়ে চলে এলাম। আমরাও জানি, তিনিও জানেন—আমাদের আর দেখা হবে না। মনে আছে তখন কাগজে লিখেছিলেন, এই দেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীর বিচার হবেই হবে। কাগজগুলো কার কাছে আছে কোথায় আছে কে জানে? তার কয়েকদিন পরই শহীদ জননী মারা গেলেন। মারা যাওয়ার আগের মাসগুলো তিনি চিকিত্সার জন্যে তার ছেলের কাছে থাকেন। তার মন ভালো করার জন্যে আমি তাকে মাঝে মাঝে ছোটখাটো উপহার পাঠাতাম। একবার আমাদের পাঠানো একটা উপহারের প্যাকেট পেয়ে তিনি খুব খুশি হয়ে আমাকে একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন। চিঠিটি আমি সযত্নে রক্ষা করেছিলাম, কিন্তু বাসার অসংখ্য কাগজপত্রের ভিড়ে সেটি হারিয়ে গিয়েছিল। সেদিন বইপত্র গোছাতে গোছাতে হঠাৎ করে সেই চিঠিটি আমি আবার খুঁজে পেলাম, সেটি পড়ে আমার বুকটা কেমন জানি টনটন করে উঠল। আমাদের কাছে লেখা একান্তই ব্যক্তিগত চিঠি, কিন্তু তারপরও আমি সেটা পাঠকদের জন্যে তুলে দিই। শহীদ জননী লিখেছেন:

স্নেহের জাফর ও ইয়াসমিন,

তোমাদের পাঠানো প্যাকেটটা এমন সময়ে আজ বিকেলে পেলাম যখন আমার মনের অবস্থা যাকে বলে all-time low সেই পর্যায়ে। কারণটা হল—প্রথম থেকে জানতাম ৬ সপ্তাহের রেডিয়েশন থেরাপি দেওয়া হবে— Five days a week—মোটমাট 30 treatments. হঠাৎ গত সপ্তাহে ডাক্তার বললেন, 25 treatments দেব। হিসেব করে দেখা গেল— ৩০ ডিসেম্বর ২৫তম রে-থেরাপি নেওয়া শেষ হবে। বাড়িসুদ্ধ সবাই খুশি। আজ হঠাৎ ডাক্তার বললেন, না, ৩০টাই নিতে হবে। যেটা শেষ হবে ৭ জানুয়ারি (ছুটিছাটা বাদে)। রাগ এবং হতাশা দুটোই প্রবল হয়েছে। এমন সময় তোমাদের পাঠানো অপূর্ব উপহার সামগ্রী এলো, যারমধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ হচ্ছে তোমাদের চিঠিটি। আসলে, জাফর— তোমার অনুভবের গভীরতাটাই আমাকে অভিভূত করেছে সবচেয়ে বেশি।

গতবারও তুমি আমাকে একটা চমত্কার বাঁধানো লেখার খাতা দিয়েছিলে। (এবং কলমও)। আসলে আমি এত কাটাকুটি করে লিখি, এত revise করি যে, এত সুন্দর বাঁধানো খাতায় লিখতে সাহস হয় না। তবু তোমার অনুভূতির প্রগাঢ় প্রকাশ হিসেবে খাতাটা আমার কাছে রইবে।

অক্টোবরে এখানে এসেই লাইব্রেরি থেকে মরিসনের বই আনতে বলেছিলাম ফ্রিডাকে। একমাত্র Tar Baby ছাড়া অন্য সব বই বাইরে। তার মানে সবাই এখন নিয়ে পড়ছে। Tar Baby’র জায়গায় জায়গায় ভাষার এমন মনোমুগ্ধকর বুনন—পড়তে পড়তে অভিভূত হয়ে গেছি। আমি ওর সব বই এখনও পড়িনি, তবু মনে হয় ওর ভাষার জাদুময়তা ওর লেখার অন্যতম asset.

সাদীর গান একপিঠ শোনা হলো—অন্য পিঠের গানের প্রথম লাইনটি এইমাত্র কানে ঠেকল—আমার পথে পথে পাথর ছড়ানো। পুরো গানটায় এখন মনোযোগ দিতে পারছি না, তবে প্রথম লাইনটাই মনে দাগ কেটে দিল—আমারও পথে পথে বাধার পাথর ছড়ানো।

বাচ্চা দুটিসহ তোমাদের দু’জনকে অনেক দোয়া ও ভালোবাসা জানিয়ে শেষ করছি।

—খালাম্মা, ২১ ডিসেম্বর ’৯৩, মিশিগান

২.
শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে একটা কথা কখনও বলা হয়নি। আমরা যখন ছোট ছিলাম তখন আমাদের পরিবারের সবার খুবই প্রিয় বই ছিল আমেরিকার লরা ইঙ্গলস ওয়াইন্ডারের লেখা বইগুলো। তখন ইংরেজি পড়া শিখিনি, তাই বাংলা অনুবাদ পড়েছি, এখনও আমার স্মৃতির মাঝে জ্বলজ্বল করে ‘ঘাসের বনে ছোট্ট কুটির’ নামের সেই বইটা। আমি জানতাম না এই বইগুলো আসলে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম অনুবাদ করেছেন। আমার খুব আফসোস হয় তাকে কখনও বলতে পারিনি তার অনুবাদ করা বইগুলো আমাদের সব ভাইবোনকে ছেলেবেলাতে কতো আনন্দ দিয়েছে।

তাকে আরও একটা কথা কখনও বলা হয়নি, সেটি হচ্ছে তার ছেলে রুমী আর আমি ঢাকা কলেজে সহপাঠী ছিলাম! রুমীর কথা সবাই জানে, বাংলাদেশে ‘একাত্তরের দিনগুলো’ বইটি পড়েনি এ রকম মানুষ আর কতজন আছে? আমিও রুমীর কথা জানি, রুমীর মা বলে আমরা সবাই তাকে শহীদ জননী বলি! অথচ আমি কখনও রুমীর ছবি ভালো করে দেখিনি, কিছুদিন আগে রুমীর ভালো একটা ছবি দেখে আমি চমকে উঠেছিলাম, কারণ ঢাকা কলেজে আমরা একসাথে পড়েছি। আমি ছিলাম মফস্বল থেকে আসা হাবাগোবা একজন ছাত্র, রুমী ছিল প্রাণশক্তিতে ভরপুর তেজস্বী একজন ছেলে! তখন ঊনসত্তুরের গণ-আন্দোলন চলছে, কলেজে লেখাপড়া সে রকম হয়নি, যখন হয়েছে তখনও আমি পাবলিক লাইব্রেরিতে বসে, গল্প-বই পড়ে সময় কাটিয়েছি। ঢাকা কলেজের সহপাঠীদের সাথে বন্ধুত্ব হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে, কিন্তু রুমীর আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া হয়নি। একাত্তরে সে শহীদ হয়েছিল। রুমী আর আমি সহপাঠী জেনে একটি মেয়ে কয়দিন আগে আমাকে লিখেছে, রুমী বেঁচে থাকলে সে আমাকে যেরকম জাফর স্যার বলে ডাকে রুমীকেও নিশ্চয়ই সেভাবে রুমী স্যার বলে ডাকত। কিন্তু এখন রুমী তাদের কাছে রুমী স্যার নয়, সে কমবয়সী একজন তরুণ, আজীবন সে কমবয়সী তরুণীদের বুকের দীর্ঘশ্বাস হয়ে রুমী হিসেবে বেঁচে থাকবে। আমি শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে এই কথাগুলো বলতে পারিনি।

৩.
শহীদ জননী জাহানারা ইমামের দ্বিতীয় ছেলে জামীর সাথে আমার পরিচয় হয়েছিল মিশিগানে। বছর তিনেক আগে সে আমার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ করেছিল জাহানারা ইমামের আত্মজৈবনিক বই ‘অন্যজীবন’ বইটি চারুলিপি প্রকাশনী থেকে নতুন করে প্রকাশিত হবে, আমি কি তার ভূমিকা লিখে দিতে পারব? কী আশ্চর্য একটি অনুরোধ, শহীদ জননী জাহানারা ইমামের লেখা একটা বইয়ের ভূমিকা লিখব আমি? আমার মতো একজন মানুষ?

আমি বইটির ভূমিকা লিখেছিলাম। আমরা সংগ্রামী তেজস্বী জাহানারা ইমামকে চিনি তার তীব্র গণ-আন্দোলনের নেতৃত্বের ইতিহাস থেকে। কিন্তু কেউ কি জানে তিনি একসময় যখন ছোট একটা বালিকা ছিলেন তখন কী ভাবতেন, যখন কিশোরী ছিলেন তখন কী করতেন? ‘অন্যজীবন’ বইটিতে সেই বালিকা, কিশোরী আর তরুণী জাহানারা ইমামের ছবিটুকু আঁকা আছে। আমি আমার মতো করে তার সেই বইয়ের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলাম। তার মৃত্যুদিবসে আমার বারবার তার কথা মনে পড়ছে। আমার কেন জানি ইচ্ছে করছে সেই বইটির ভূমিকাটি পাঠকদের সাথে একটু ভাগাভাগি করে নিই!

অন্যজীবন।। জাহানারা ইমাম।। ভূমিকা

অনেকদিন আগের কথা। নিউ ইয়র্কের একটি অনুষ্ঠানে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম এসেছেন। আমার খুব ইচ্ছে তাঁর সাথে একটু পরিচিত হই। যখন তাঁর আশেপাশে কেউ নেই তখন কুণ্ঠিতভাবে তাঁর কাছে গিয়ে নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, আপনি আমাকে চিনবেন না। আমার বড়ভাই হচ্ছে হুমায়ূন আহমেদ। জাহানারা ইমাম আমাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তোমাকেও চিনি। আমি তোমার বইও পড়েছি। তারপর তিনি আমার বই নিয়ে খুব দয়ার্দ্র কিছু কথা বললেন। শহীদ জননীর কথাগুলো আমার জীবনে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছিল। আমি তখন তখনই ঠিক করেছিলাম আমার লেখা কেউ পড়ুক আর নাই পড়ুক আমি এখন থেকে নিয়মিত লিখে যাব। তারপর আমি খুব একটা সাহসের কাজ করে ফেললাম, মুক্তিযুদ্ধের ওপর লেখা আমার কয়েকটি গল্পের একটা পাণ্ডুলিপি তাঁর হাতে দিয়ে তাঁকে অনুরোধ করলাম কিছু একটা লিখে দিতে। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আমার বইটির জন্যে খুব সুন্দর কয়টি কথা লিখে দিয়েছিলেন। তার সেই কথাগুলো পিছনের মলাটে লিখে যখন বইটি প্রকাশিত হল, তখন আমার মনে হল সেই লেখাটি আমার জন্যে অনেক বড় সম্মান, সেই বইটি আমার জীবনের খুব বড় একটি সম্পদ।

আজ আমি শহীদ জননীর ‘অন্যজীবন’ বইটির ভূমিকা লিখতে বসেছি। আমি কি কাউকে বোঝাতে পারব এটি আমার জন্যে কত বড় সম্মান? তিনি যদি আজ বেঁচে থাকতেন তাহলে কি আমার এই দুঃসাহস দেখে ফিক করে হেসে দিতেন না?

বইটির নাম ‘অন্যজীবন’, জাহানারা ইমাম শুরুতেই বলে দিয়েছেন পরিণত জীবনে তিনি যখন তাঁর জীবনের প্রথম দশকের দিকে তাকান তখন তাঁর বিশ্বাসই হতে চায় না সেটি তাঁর নিজের জীবন। আমরা যখন পড়ি তখন পাঠক হিসেবেও কিন্তু বিষয়টা টের পেতে শুরু করি। আত্মজৈবনিক বই, কিন্তু শুরুতে উত্তম পুরুষে লেখা হয়নি। জাহানারা ইমাম জুড়ু নামে একটা বালিকার কথা বলে গেছেন, যে খুব ধীরে ধীরে আমি হয়ে উঠেছে। নিজেকে বাইরে থেকে দেখার এই পদ্ধতিটি আমার কাছে অভিনব মনে হয়েছে। অন্যজীবন-এ নিজের চরিত্রটি যে অন্যের জীবন সেটি এভাবেই যেন অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

বইটির আজ থেকে সত্তুর কিংবা আশি বছর আগের জীবনের একটা ছবি উঠে এসেছে। সেই ছবি কখনো একটি শিশু বা বালিকার চোখে দেখা কখনো বা পরিণত জাহানারা ইমামের চোখে দেখা। লেখার মাঝে অনেক বিষয় উঠে এসেছে, তবে নিঃসন্দেহে আলাদাভাবে যে বিষয়টি চোখে পড়বে সেটি হচ্ছে ত্রিশ এবং চল্লিশ দশকের মেয়েদের বেড়ে ওঠা।

ছোট ছোট অসংখ্য ঘটনা দিয়ে একটি অপূর্ব কাহিনি গেঁথে তোলা হয়েছে, যার ভেতরে বৈচিত্র্যের ছড়াছড়ি। মাকে বাবা বাংলা লেখাপড়া শেখানোর চেষ্টা করেছেন সেই বিষয়টিই কেউ মানতে রাজি নন। আবার রক্ষণশীল সেই পরিবারের মায়ের হাতে পিস্তল, রাতের অন্ধকারে চোরকে প্রতিহত করতে গুলি ছুঁড়তে দ্বিধা করছেন না। কঠিন পর্দার কারণে মহিলাদের গরুর গাড়িতে আটকে রেখে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে নদী পারাপার করছে। সেই মহিলারাই বিয়ের অনুষ্ঠানে কোমর দুলিয়ে নেচে চলছে। গায়ে হলুদ অনুষ্ঠানে উন্মত্তের মতো কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, রং ছোঁড়াছুঁড়ি করছে।

শহীদ জননী জাহানারা ইমামের কর্মজীবন ছিল শিক্ষাবিদের জীবন, সেদিক দিয়ে বিবেচনা করলে তাঁর শিক্ষাজীবনের শুরুটি ছিল যথেষ্ট চিত্তাকর্ষক। ক্লাস সিক্স শেষ করে আর লেখাপড়া করবেন না বলে মনস্থির করে ফেলেছেন। কেউ যখন তাঁকে লেখাপড়া করাতে রাজি করতে পারছেন না তখন হঠাৎ করে নিজে থেকেই আবার লেখাপড়ায় আগ্রহ ফিরে পেলেন। কারণটি বিচিত্র। তিনি খবরের কাগজে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের ছবি দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলেন। মুগ্ধতা যতটুকু না বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের বিদ্যাবুদ্ধি আর পাণ্ডিত্যে, তার থেকে বেশি তাঁর হাতকাটা ব্লাউজ আর ববছাঁটা চুলে।

ভারতবর্ষের মানুষ বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতকে কতোটুকু স্মরণ রেখেছে কিংবা ভবিষ্যতে কতোটুকু স্মরণ রাখবে আমরা জানি না, কিন্তু নিঃসন্দেহে নিশ্চিতভাবেই বলতে পারি, বাংলাদেশের মানুষ শহীদ জননীর কথা কখনোই ভুলে যাবে না। আজ থেকে সত্তুর বছর আগের সেই কিশোরী বালিকাটি কী কখনো সেটা কল্পনা করেছিল?

‘অন্যজীবন’ বইয়ের যে অংশটুকু আমাকে সবচেয়ে বেশি আলোড়িত করেছে সেটি হচ্ছে কৈশোরে তাঁর বই পড়ার তীব্র আগ্রহ। স্কুল শেষ করেই রবীন্দ্র রচনাবলিতে ডুবে গেছেন, বিছানার নিচে লুকিয়ে বঙ্কিমের কপালকুণ্ডলা পড়ছেন। ছোট বয়সে বড়দের নভেল পড়ার কারণে নিগৃহীত হচ্ছেন, তবু কোনোমতে নিজেকে থামাতে পারছেন না। বইয়ের জন্যে তীব্র আকর্ষণের কাছে সব যুক্তি, সব বাধা-নিষেধ তুচ্ছ হয়ে যাচ্ছে।

আমরা দেখি ছটফটে একটা কিশোরী সাইকেলে করে শহর চষে ফেলছে, তাঁর আনন্দ আমাদের স্পর্শ করে। আবার দেখতে পাই হঠাত্ করে বড় হয়ে যাওয়ার অপরাধে তাঁকে শাড়ি পরিয়ে ঘরের ভেতর বন্দি করে ফেলা হয়েছে, সেই যাতনাটুকুও সমানভাবে আমাদের ব্যথিত করে।

‘অন্যজীবন’ বইয়ের শেষ অংশে জাহানারা ইমাম তরুণী হয়ে উঠেছেন। তাঁর জীবনে প্রায় একই সাথে রাজনীতি আর প্রেম এসে দেখা দিয়েছে। আমরা আবিষ্কার করি, প্রেমকে সম্মান দেখাতে গিয়ে তিনি রাজনীতিকে বিসর্জন দিয়েছেন, সেজন্য তাঁর ভেতরে অস্পষ্ট বেদনাবোধ। এই বইয়ে উল্লেখ নেই। কিন্তু আমরা জানি শেষ জীবনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য তাঁর নেতৃত্বে সারা দেশে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে উঠেছিল। আমরা জানি না, তরুণ বয়সে রাজনীতিকে বিসর্জন দেওয়ার সেই অতৃপ্তিটুকু শেষবয়সে পূর্ণ হয়েছিল কি না। কিন্তু আমরা অন্তত এটুকু জানি তাঁর এই ভূমিকাটির জন্যে এই দেশের মানুষ তাঁকে বুকের ভেতরে ঠাঁই দিয়েছে।

‘অন্যজীবন’ বইটিতে এই অসাধারণ মানুষটিকে আমরা ছটফটে শিশু, প্রাণোচ্ছল কিশোরী আর মায়াবতী তরুণী হিসেবে দেখতে পাই। মানুষটি নেই, কিন্তু এই ছটফটে শিশু, প্রাণোচ্ছল কিশোরী আর মায়াবতী তরুণীটি তো আমাদের চোখের সামনে আছেন। সত্যিমানুষ থেকেও বেশি সত্যি এই শিশু এই কিশোরী, আর এই তরুণীকে আমরা কেমন করে ভুলব?

১০ জানুয়ারি ২০১২
লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

(ওএস/এএস/জুলাই ০৩, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test