E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আসন্ন!

২০১৫ জুলাই ০৩ ২০:০৬:৩৪
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ কি আসন্ন!

আনিস আলমগীর : রাশিয়া ও চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ভূমিকার কারণে বিশ্বে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধে যেতে পারে বলে আশংকা ব্যক্ত করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অনুসন্ধানী সাংবাদিক ওয়েন মেডসেন। সব বিষয়ে আমেরিকার নাক গলানো স্বভাব বিশ্ব ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করেছে সুতরাং বিশ্ব ব্যবস্থার (ওয়ার্ল্ড ওর্ডার) বিশৃঙ্খলার মাঝে কোনো অশুভ কিছু হবে না তা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে অনেকটা নিশ্চিত করে বলা যায়- তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের চেয়েও দ্বিতীয় স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার সম্বাবনাই বেশি। সম্ভবতো আরেকটা স্নায়ুযুদ্ধ আরম্ভ হলে সেটা হবে মানব ইতিহাসের একটা ঐতিহাসিক ট্রাজেডি।

 

স্নায়ুযুদ্ধ একটি অশুভ বিষয়। আমেরিকা শক্তিধর হয়েই পরাশক্তি হয়েছে। তবে তার পরিকল্পনা ও কার্যক্রমে বিচক্ষনতা ও দূরদৃষ্টি- দু’টিরই অভাব। লিবিয়ায় গাদ্দাফিকে উৎখাত করা হয়ত আমেরিকার দৃষ্টিতে দরকার ছিল -সুতরাং লিবিয়ায় তার বোমা বর্ষণের যৌক্তিকতা হয়তবা মেনে নিলাম কিন্তু গাদ্দাফির শূণ্যস্থান পূরণ করার কোনো যথাযত ব্যবস্থাই আমেরিকা করেনি। ফলে লিবিয়া আজ সরকারবিহীন অবস্থায় রয়েছে। সুদীর্ঘকালব্যাপী একটা শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে লিবিয়া বিরাজমান ছিল। তার অর্থ, অস্ত্র সব কিছুই ছিল। আজ বিশৃঙ্খালার মাঝে সব কিছুই নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। একটা সমৃদ্ধ জনপদের এই অবস্থার জন্য মার্কিনিরাই দায়ী। চূড়ান্ত ফলাফলের কথা চিন্তা না করে কোনো ঘটনার মাঝপথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলাটা আমেরিকার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।

সিরিয়ায় বোমা ফেলার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করল আমেরিকা অথচ আমেরিকা নিশ্চয়ই অবগত ছিল যে বহিঃবিশ্বে রাশিয়ার একমাত্র নৌঘাটি রয়েছে সিরিয়ায়। সিরিয়া সর্ম্পকে কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে রাশিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা বলা উচিৎ ছিল তার। আমেরিকার্ কোনো সমস্যা নিয়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলোর সঙ্গে আলাপ আলোচনার সংস্কৃতিতে আমেরিকা অভ্যস্ত নয়। ইউক্রেনের সমস্যা উদ্ভাবনের পর আমেরিকার নৌশক্তির একটা ক্ষদ্র অংশ ন্যাটোর ছত্রছায়ায় কৃষ্ণসাগরে অবস্থান নিয়েছে। ন্যাটোর কমান্ডার জেনারেল ফিলিপ ব্রিডলাভ আর তার ওয়াশিংটনের মুরব্বীরা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিল কে জানে। কয়েকদিন আগে মার্কিন রণতরী ইউ.এস.এস রস আগ্রাসী ভঙ্গিতে কৃষ্ণসাগরে রাশিয়ার জলসীমানা অতিক্রম করে রাশিয়ার উপকূলে যেতে উদ্যত হয়েছিল। প্রথমে রাশিয়ার নৌবাহিনী সতর্ক সংকেত প্রদান করে কিন্তু রাশিয়ার নৌবাহিনীর সতর্ক সংকেত উপেক্ষা করে যখন রণতরীটি অগ্রসর হচ্ছিল তখন রাশিয়ার যুদ্ধ বিমান এসে উপস্থিত হওয়ায় আমেরিকার রণতরী পিছু হটে যায়।

কৃষ্ণসাগরের ক্রাইমিয়া দ্বীপে রাশিয়ার নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর। দীর্ঘ সময়ব্যাপী ইউক্রেন রাশিয়ার অংশ ছিল। পূর্ব ইউক্রেনে রাশিয়ার বংশউদ্ভূত লোকের বসতি। তাদের প্রতি ইউক্রেন সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কোনো অন্যায় করলে রাশিয়া তো আর উপেক্ষা করতে পারে না। ইউক্রেন আর রাশিয়া যখন এক ছিল তখন শাসন কাজের সুবিধার জন্য ক্রাইমিয়া দ্বীপটির শাসনের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল ইউক্রেনকে এবং ক্রাইমিয়া দ্বীপেই রাশিয়ার নৌ-বাহিনীর সদর দপ্তর ছিল। রাশিয়ার নৌবাহিনীর সদর দপ্তরতো আর ইউক্রেনের অধীনে রাখা যায় না। আমেরিকা ইউক্রেনের সঙ্গে মিলে দীর্ঘদিন পূর্ব ইউরোপে যে ঘোলাটে পরিস্থিতির সৃষ্টি করে রেখেছিল, রাশিয়ার উপর অবরোধ বসিয়েছিল- তা কখনো কাঙ্খিত ছিল না । রাশিয়া বরং ক্রাইমিয়া দখল করে পা বাড়ায়নি বা এটা জামার্নীর হিটলারের চেকোস্লাভিয়া যাওয়া নয়। ইউক্রেনের ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক সর্ম্পক থেকে শুরু করে কিয়েভ শহরের বিক্ষোভের মতো ঘটনাবলির প্রভাব কি হতে পারে তা নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকার চিন্তা ভাবনা বাস্তব সম্মত ছিল না। তাদের উচিৎ ছিল পুরো বিষয়টা নিয়ে রাশিয়ার সঙ্গে বসে সমাধানের পথ খোঁজা।

অষ্টাদশ শতাব্দিতে ক্রাইমিয়া দ্বীপ নিয়ে আরেকটা যুদ্ধ হয়েছিল রাশিয়ার সঙ্গে তুরস্কের। তখন ক্রাইমিয়া দ্বীপ ওসমানীয়া খেলাফতের অংশ। রাশিয়ার অবস্থান তখন শীর্ষে কারণ তারই কিছু দিন আগে নেপোলিয়নকে পরাজিত করেছিল্ রাশিয়া। ফ্রান্স ও বৃটেন তখন রাশিয়ার মর্য়াদাকে ক্ষুন্ন করতে একটা সুযোগের সন্ধানে ছিল। তুরস্ককে রক্ষা করার জন্য নয়, রাশিয়াকে হতমান করার জন্য ফ্রান্স ও বৃটেন এই যুদ্ধে তুরস্কের পক্ষ অবলম্বন করেছিল। ইউক্রেনকে নিয়ে যে বাড়াবাড়িতে আমেরিকা, ফ্রান্স, বৃটেন জড়িয়ে পড়েছিল, মনে হয়েছিল অষ্টাদশ শতাব্দির মতো তারা রাশিয়াকে হতমান করার জন্য হয়তোবা আর একটা যুদ্ধের সূচনা করতে পারে। কিন্তু রাশিয়ার প্রতি চীনের সমর্থন এবং আমেরিকা, ফ্রান্স, বৃটেনের বিরাজমান আর্থিক মন্দাদশাই সম্ভবত যুদ্ধের সে ইচ্ছেটাকে অবদমিত করে ফেলেছে।

চীনের উত্থানে আমেরিকা উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছে। বর্তমানে বিশ্ব ব্যবস্থায় আমেরিকা আধিপত্য বিস্তার করে আছে। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থায় একচেটিয়া আধিপত্য নিয়ে বিরাজ করছে। আর এ দুই আর্থিক সংস্থার নিয়ন্ত্রণে আমেরিকা সর্বেসর্বা। বিশ্বব্যাংক মিশরে আসোয়ান বাধ নির্মানে অর্থ সাহায্যের অনুমোদন দিয়েছিল। অর্থ প্রদানের আগেই নানা ছলছাতুরী করে অর্থ প্রদানে এমন একটা জটিলতা সৃষ্টি করে যে শেষ পর্যন্ত খরচ সময় অপচয়ের কারণে দেড়গুণ বেড়ে যায়। তখন মিশর বিশ্বব্যাংকের ঋণ গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের (রাশিয়া) সাহায্যে আসোয়ান বাধ নির্মানে উদ্যোগ গ্রহণ করে। সফলতার সঙ্গে ৪ বছরে তারা বাধ নির্মাণ করে ফেলে। বাংলাদেশের পদ্মা সেতুর অর্থায়নেও তারা নানাহ জটিলতার সৃষ্টি করেছিল আর শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ঋণ প্রত্যাখান করে নিজ খরচে সেতু নির্মানে তাদের দৃঢ় প্রত্যয়ের কথা ঘোষণা করে। বর্তমানে সেতুটির কাজে বিশ্বব্যাংকের সহায়তা ছাড়াই এগিয়ে চলছে।

সম্ভবতো ২০১৮ সাল নাগাদ সেতুটির নির্মানের কাজ শেষ হবে। পদ্মা সেতু সর্ম্পকে বিশ্ব ব্যাংকের আজগবি অভিযোগ ছিল দুর্নীতি। অথচ সেতুর কাজও আরম্ভ হয়নি আর বিশ্বব্যাংক ঋণের কোনো কিস্তিই প্রদান করেনি। এভাবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলো বিশ্ব অর্থ ব্যবস্থার দুই জায়েন্ট সংস্থার দ্বারা তেমন কোনো উপকার লাভ করতে পারছিল না। ঋণ প্রদানের আগে সংস্কারের যে সব প্রস্তাব দেওয়া হয় তা বাস্তবায়ন করতেই সরকারের মাথা খারাপ হওয়ার উপক্রম হয়। আর বিভিন্ন কলসালটেন্সির নামে ঋণের বিরাট একটা অংশ কাগজ কলমে খরচ হয়ে যায়। তৃতীয় বিশ্বের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রগুলোর এমত অবস্থা বিবেচনা করে চীন, রাশিয়া, ভারত, দক্ষিণ আফ্রিকা, ব্রাজিল ‘ব্রিক ব্যাংক’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে। চীন তার বিরাট উদ্বৃত্ত বিদেশী মুদ্রা এশিয়ান ইনফাস্টাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক গঠন করে বিনিযোগ করার উদ্যোগ নিয়েছে। চীনের এমত উদ্যেগ পশ্চিমা বিশ্বকে চিন্তিত করে তুলেছে। চীন এখন সব সূচক অতিক্রম করে বিশ্বের এক নাম্বার ধনী রাষ্ট্র হিসেবে নিজের অবস্থান পাকা করেছে।

চীনের দ্রুত অগ্রগতি দেখে আমেরিকা সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার নৌশক্তির ৬০ শতাংশ আটলান্টিক থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে স্থানান্তর করবে এবং তারা ২০২০ সালের মাঝে এই কাজ সমাপ্ত করবে। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী অ্যাশটন কার্টার বলেছেন এই খাতের অর্থ তারা পেন্টাগনকে সরবরাহ করে রেখেছে। চীনের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেছেন ২০৪৯ সালের মধ্যে প্রশান্ত মহাসাগরে তারা প্রধান সামরিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করবে। প্রশান্ত মহাসাগরে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতির কারণে চীনের সঙ্গে আমেরিকার স্নায়ুযুদ্ধের রিহার্সেল শুরু হয়ে গেছে। দক্ষিণ চীন সাগর নিয়ে সমস্যার শুরু । চীন দাবী করছে দক্ষিণ চীন সাগর একান্তই তার। চীন সাগরে নাকি ৭ বিলিয়ন ব্যারেল তেল আর ৯০০ বিলিয়ন ঘনফুট প্রকৃতিক গ্যাস রয়েছ্ এ অফুরন্ত সম্পদের লোভ কেউই সামাল দিতে পারছে না।

চীন সাগরের বিরোধ আঞ্চলিক বিরোধ। আমেরিকা সরাসরি এই বিরোধে জড়িত হতে পারছে না। সুতারাং সে এখন দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার বন্ধু দেশগুলোর সঙ্গে সর্ম্পক দৃঢ় করার উদ্যোগ নিয়েছে যেন অদুর ভবিষ্যতে চীনকে মোকাবেলায় তাদের সহযোগিতা পাওয়া যায়। আর চীন সাগরের বিরোধকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবে চীনের বিরুদ্ধে। দক্ষিণ চীন সাগরে চীন কৃত্রিম দ্বীপ নির্মাণ করেছে এরই প্রেক্ষিতে আমেরিকা প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কার্টার দ্বীপ নির্মাণের কাজ বন্ধ রাখার আর আঞ্চলিক বিরোধ মিটানোর দাবি জানান। চীনকে বাড়াবাড়িতে জড়িত না হবার হুশিযারী জানান। চীন অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের এই অনধিকার চর্চাকে কান্ডজ্ঞানহীন আচরণ বলে অবিহিত করেছে। দক্ষিণ চীন সাগরে জনমানবশূণ্য দুই একটা দ্বীপের অধিকার নিয়ে জাপানের সঙ্গে চীনের বিরোধ চলছে। জাপানকে আমেরিকা সমরাস্ত্র ও সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়েছে।

সব মিলিয়ে দেখা যাচ্ছে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে আমেরিকা ধীরে ধীরে বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। তবে এই বিরোধ এখনই যুদ্ধের রূপ নেবে বলে মনে হয়না। কারণ আমেরিকার আর্থিক অবস্থা ভাল নয় আর চীন তার সামরিক প্রস্তুতির মাঝ পথে।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test