E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

আইন যখন হাতে তুলে নিতে হয়

২০১৪ মে ২০ ১৪:২৫:৪৬
আইন যখন হাতে তুলে নিতে হয়

চৌধুরী আ. হান্নান : ১৯৭১ সালে একজন বাঁশিওয়ালা এলেন। বাঁশি বাজালেন-ডাক দিলেন। যেন হেমিলিওনের বংশীবাদক। সেই বাঁশির সুর এতই মোহনীয় ও তেজস্বী যে সবাই ধ্যান ভেঙ্গে জেগে উঠলো- আইন হাতে তুলে নিল। রেডিও পাকিস্তান থেকে পাকিস্তান রক্ষার জন্য বিরতিহীন দোওয়া মাহফিলের অনুষ্ঠান প্রচারিত হচ্ছে এবং মাঝে মাঝে বুলেটিন শোনা যাচ্ছে- “কেউ আইন হাতে তুলে নিবেন না।”

কিন্তু আইন আর রাষ্ট্রের হাতে রইলো না। মানুষ আইন নিজের হাতে তুলে নিল। পাকিস্তান ভেঙ্গে গিয়ে একটি নতুন স্বাধীন দেশের জন্ম হলো-বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধুর আর্দশে দেশটাকে গড়ার স্বপ্ন ছিল কিন্তু তা হলো না।

দুর্নীতিতে দেশ বার বার সকল দেশের শীর্ষে অবস্থান করতে থাকলো। দুর্নীতি যারা দমন করবে তাদের নাকি নখ-দন্ত নেই। কীভাবে তারা ‘ইঁদুর’ ধরবে? প্রত্রিকায় প্রকাশ- নরসিংদী জেলার দায়িত্ব পালনকালে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের ভয় দেখিয়ে উৎকোচ গ্রহনের মাত্রা চরমে উঠলে দুর্নীতি দমন কমিশনের এক উপ-পরিচালককে গণপিটুনি দেয়। ‘ভদ্রলোক’ পরনের কাপড়-চোপড় ফেলে দৌড়ে নিরাপদ স্থানে ঢুকে পড়ে। কোন রকমে প্রাণটা বাঁচায়। যখন বিচার পাওয়ার আশা থাকে না তখন মানুষ নিজেই বিচার করতে চায়। চোর-ডাকাত হাতে নাতে ধরা পরলে চোখ উৎপাটন বা গণপিটুনিতে নিহত হওয়ার ঘটনা ঘটে। এভাবে জানান দেয়া হয় যে, আসলে জনগণই রাষ্ট্রের মালিক। রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যাদের দেয়া হয়েছে তারা যখন ব্যর্থ হয়, তখন জনগণের আর কী করারই বা থাকে।

নারায়ণগঞ্জের সাত অপহরণ ও হত্যার ঘটনায় মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়েছে। মূল আসামীদের ঘর-বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে আক্রোশের বহি:প্রকাশ ঘটিয়েছে। আইনজীবীরা অপহরণ ও হত্যার বিচার দাবিতে আন্দোলন করে যাচ্ছে। আন্দোলন ছাড়া তো বিচার পাওয়া যাচ্ছে না। গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন না হলে যুদ্ধ অপরাধী কাদের মোল্লার কি ফাঁসি দেয়া সম্ভব হতো? ন্যায্য পাওনা পেতেও আন্দোলন করতে হয়- সময় বিশেষে আইনকে মানুষ হাতে তুলে নিতেও দ্বিধা করে না। অন্যায়, অবিচার দেখে মানুষ এখন আর নীরব দর্শক থাকে না। গণ মানুষের চেতনার স্তর অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।

মানুষ সহিংস হলে, আইন হাতে তুলে নিলে রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ও বিচার ব্যবস্থার দুর্বলতা নির্দেশ করে। আর সরকার যখন নিজেই বিচার বহির্ভুত হত্যাকাণ্ড চালায় তখন রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে আর জন কল্যাণমূলক বলা যায় না।

আমরা গর্বের সাথে বলতে পারি আমরা স্বাধীন দেশের নাগরিক-আমরাই আমাদের শাসক। বৃটিশদের কৃতদাস নই-পাকিস্তানের গোলাম নই। সকল নাগরিকের সুখ-শান্তি ও সমৃদ্ধি কামনায় আমরা কি একটা কল্যাণ রাষ্ট্র প্রত্যাশা করতে পারি না?

গত নির্বাচনে বিরোধীদলের প্রায় ‘বিলুপ্তি’ ঘটায় নবগঠিত সরকারের চরিত্র স্বৈরাতান্ত্রিক চরিত্রে রূপান্তরের আশংকা রয়েছে। যুগে যুগে এক নায়ক বা স্বৈরশাসকের পরিনতি ভাল হয়নি- জনতার আদালতে তাদের জবাবদিহি করতে হয়েছে। ইরানের পাহলবি, রূমানিয়ার চসেস্কু, ফিলিপাইনের মার্কোস তার উদাহরণ।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কোন পথে হাঁটবেন-স্বৈরতন্ত্রের দিকে, নাকি কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে। তিনি একটি গণতান্ত্রিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী হলেও সিদ্ধান্ত মূলত একাই নিতে হয়। কারণ তার চর্তুপাশে যারা আছেন তাদের বেশির ভাগই তোষামোদকারী- তারা ‘চাকুরী’ রক্ষা করে চলেন। তাদের পরামর্শ শ্রবণ করা যায় কিন্তু সে মতে কাজ করা যায় না।

মোগল সম্রাজ্যের তৃতীয় সম্রাট আকবর ১৫৫৬ থেকে ১৬০৫ পর্যন্ত অর্ধ শতাব্দি ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। তাঁর কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না, বলতে গেলে তিনি নিরক্ষর ছিলেন। কিন্তু তাঁর রাজত্বকাল স্বর্ণযুগ ছিল। ইউরোপে তিনি ‘গ্রেট মোগল’ নামে পরিচিতি পেয়েছিলেন। তিনি তাঁর ‘নবরত্নের’ সদস্যদের পরামর্শ মনোযোগ দিয়ে শ্রবণ করতেন কিন্তু সিদ্ধান্তটা নিজে নিতেন।

জাতির পিতার রক্তের ধারা যার মধ্যে প্রবাহমান তিনি জাতিকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের দিকে নিয়ে যাবেন এ প্রত্যাশা আমরা করতেই পারি। জনতার মনের ভাষা বুঝে সঠিক পদক্ষেপ নিলে আইন কেউ আর হাতে তুলে নিবে না এবং সকলক্ষেত্রে ন্যায় বিচার নিশ্চিত করতে পারলে গন্তব্যে পৌঁছানো কঠিন নয়। ইতিহাস সাক্ষী।

লেখক: সাবেক ব্যাংকার

পাঠকের মতামত:

২৫ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test