E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তাজউদ্দীন আহমদের হাতঘড়ি

২০১৫ জুলাই ২৪ ২২:০৭:২১
তাজউদ্দীন আহমদের হাতঘড়ি

।।মুহম্মদ জাফর ইকবাল।।
কিছুদিন আগে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বাসায় তাঁকে দেখতে গিয়েছিলাম। মেয়ে সিমিন হোসেন রিমির মুখে শুনেছিলাম তাঁর শরীরটা নাকি ভালো যাচ্ছিল না। আমাদের দেশে কারও শরীর খারাপ হলে হঠাৎ করে এত মানুষ এসে হাজির হয়ে যায় যে সেটা এক ধরনের বিড়ম্বনা।

যাঁর শরীর খারাপ শুভানুধ্যায়ীদের চাপে তাঁকে আরও বেশি হাঁপিয়ে পড়তে হয়। সিমিন হোসেন রিমি আমাদের অভয় দিল, বলল, আমরা যদি যাই, তাঁর ওপর আলাদা করে কোনো চাপ পড়বে না−সে জন্যই গিয়েছিলাম। কারও বাসায় গিয়ে যতটুকু সময় থাকা ভদ্রতা, তার থেকে অনেক বেশি সময় বসেছিলাম। কারণ, সেই বাসায় গেলে আমি সব সময়ই খানিকটা হতবুদ্ধি হয়ে থাকি। আমার প্রায় বিশ্বাসই হতে চায় না যে আমাদের এই দেশটিকে যুদ্ধ করে স্বাধীন করার পেছনে যে মানুষটির সবচেয়ে বেশি অবদান, সেই তাজউদ্দীন আহমদের আপনজনের কাছে আমি বসে আছি। এই ঘরের মানুষগুলো আসলে এই দেশের ইতিহাসের একটি অংশ, এই ঘরের দেয়ালে টানানো ছবিগুলো আসলে এই দেশের ইতিহাস। তাঁরা মুখে যে কথাগুলো বলেন, সেগুলো আমরা ইতিহাস বইয়ে পড়ি, ইতিহাস বইয়ে লিখি। সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সঙ্গে কথায় কথায় ২৫ মার্চের সেই রাতের কথা উঠে এল। গোলাগুলি শুরু হওয়ার পর তিনি তাঁর দুজন ছোট ছেলেমেয়েকে নিয়ে ওপর তলায় উঠে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান আর্মির একজন অফিসার তাঁদের খোঁজ করার সময় তাঁর সঙ্গেই কথা বলেছিল, তিনি তাকে নিজের পরিচয় বুঝতে দেননি। বিশুদ্ধ উর্দুতে কথা বলে সেই অফিসারকে কীভাবে বিদায় করে ছোট মেয়ে মিমি আর ছোট ছেলে সোহেলসহ নিজেকে রক্ষা করেছিলেন সেই গল্প করতে করতে এত দিন পরও তাঁর মুখে হাসি ফুটে উঠেছিল! (সেই ছোট ছেলেটি বর্তমান সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হয়েছিলেন, এখন পদত্যাগ করেছেন। মাহজাবিন মিমি খুব সুন্দর কবিতা লেখে। সেই রাতে অন্য দুই মেয়ে রিপি আর রিমি তাদের খালার বাসায় ছিল। রিপির ভালো নাম শারমিন আহমেদ। বাচ্চাদের জন্য লেখা তাঁর একটা অসাধারণ বই হূদয়ে রংধনু-এর প্রকাশনা উৎসবে আমার হাজির থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল। এই দেশে সিমিন হোসেন রিমিকে নতুন করে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। অন্য সবকিছু যদি ছেড়ে দিই, শুধু জেল হত্যায় পেছনের ভয়ঙ্কর ইতিহাসটুকু খুঁজে বের করার জন্য এই জাতি তাঁকে মনে রাখবে। প্রায় কিশোরী একটা মেয়ের জন্য সেই সত্যানুসন্ধান কী ভয়ানক কষ্টের একটি অভিজ্ঞতা ছিল, সেটি কী কেউ কল্পনা করতে পারবে?)

আমি জানি দেশের কথা বলার সময় অনেকেই নানাভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন−আমি কখনোই সেটা করি না। অস্বীকার করি না যে এই দেশের ওপর দিয়ে যত দুঃখ-কষ্ট গেছে, ঝড়-ঝাপটা গেছে, আপদ-বিপদ গেছে, সে রকম আর কোথাও যায়নি। যদিও পাকিস্তানকে পরাজিত করে বাংলাদেশ হয়েছিল, তার পরও ষড়যন্ত্র করে বাংলাদেশকেই দ্বিতীয় পাকিস্তান বানানোর জন্য ছলবল আর কৌশল কম করা হয়নি। নেতৃত্বের অভাবে কিংবা ভুল নেতৃত্বের কারণে এই দেশ দীর্ঘদিন কানাগলিতে ঘুরপাক খেয়েছে, কিন্তু কেউ অস্বীকার করতে পারবে না, যখন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন ছিল তখন আমরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর তাজউদ্দীন আহমদের মতো নেতা পেয়েছিলাম। সৃষ্টিকর্তার নিশ্চয়ই এই দেশের মানুষের জন্য একটু মায়া আছে, তা না হলে কেমন করে আমরা সঠিক সময়ে সঠিক দুজনকে পেয়েছিলাম? বঙ্গবন্ধু এই দেশের মানুষকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, কিন্তু যখন স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয়, তখন তিনি ছিলেন পাকিস্তানের কারাগারে। সেই সময় স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। যদি সেই সময় তিনি সঠিক নেতৃত্ব না দিতেন, তাহলে কী হতো−চিন্তা করে এত দিন পরও আমার বুক কেঁপে ওঠে। কিছুদিন আগে আমরা সমমনা কিছু মানুষ মিলে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নামে খুব ছোট একটা বই প্রকাশ করেছি, সবার অনুরোধে সেটা লিখেছি আমি। সেখানে এক জায়গায় লেখা আছে, “এপ্রিলের ১০ তারিখ মুজিবনগর থেকে ঐতিহাসিক স্বাধীনতার সনদ ঘোষণা করা হয়।” কত সহজেই এই লাইনটি লেখা হয়েছে, কিন্তু সেই সময় সেটি যে কত জটিল একটি বিষয় ছিল, এত দিন পর কি কেউ সেটি কল্পনা করতে পারবে? সেটি সম্ভব হয়েছিল শুধু তাজউদ্দীন আহমদের মতো দূরদর্শী রাজনৈতিক নেতা আর সংগঠকের জন্য।তাঁর পুরো জীবনটাই ছিল রূপকথার মতো আশ্চর্য। ২৫ মার্চের রাতে যখন গণহত্যা শুরু হয়, তখন তিনি খুব দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন−পরিবারের আগে তাঁকে দেশের দায়িত্ব নিতে হবে। তাই ২৭ মার্চ তিনি তাঁর স্ত্রীর কাছে একটা চিঠি লিখে চলে গেলেন। চিঠির ভাষা ছিল এ রকম, “আমি চলে গেলাম। যাবার সময় বলে আসতে পারিনি মাফ করে দিও। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে মিশে যেও। কবে দেখা হবে জানি না…মুক্তির পর।” ৩০ মার্চ তিনি সীমান্ত অতিক্রম করলেন এবং সীমান্ত অতিক্রম করার আগে স্বাধীনতা ঘোষণাকারী একটা দেশের প্রতিনিধির প্রাপ্য মর্যাদাটুকু তিনি নিশ্চিত করে নিলেন। নিজের দেশের মাটিতে ফিরে আসার আগে সব সময় তিনি এভাবে তাঁর মাতৃভূমির মর্যাদা রক্ষা করেছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তিনি প্রথমেই খুব স্পষ্ট করে বলেছিলেন, এটা আমাদের যুদ্ধ। এই স্বাধীনতা সংগ্রাম একান্তভাবেই আমাদের এবং আমরাই এই যুদ্ধ করব। তারপর তাজউদ্দীন আহমদ কিছু সুনির্দিষ্ট সাহায্য চেয়েছিলেন−শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের কিছু সুযোগ-সুবিধা, কিছু অস্ত্রের সরবরাহ, বাইরের পৃথিবীতে স্বাধীনতার কথা প্রচারের জন্য সহায়তা, পাকিস্তানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য প্রচেষ্টা। কিন্তু একটিবারও দেশকে স্বাধীন করে দেওয়ার কথা বলেননি−সেটা রেখেছিলেন নিজের দেশের মানুষের জন্য।প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি সব সময়ই নিজের দেশের মর্যাদা রক্ষা করেছেন। যখনই বিদেশ থেকে কোনো সাংবাদিক বা কোনো কূটনীতিক তাঁর সঙ্গে দেখা করতে আসতন, তিনি তাঁদের সঙ্গে দেখা করতেন বাংলাদেশের সীমানার ভেতরে কোনো মুক্তাঞ্চলে। ব্যাপারটি ছিল খুব ঝঁুকিপূর্ণ; কখনো কখনো সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ শুরু হয়ে যেত, তার পরও তিনি দেশের মুক্তিযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানের জন্য এই কষ্টটুকু করে গিয়েছেন।প্রবাসী সরকারের দায়িত্ব পালন করার সময় তাঁর যে ভূমিকাটি ছিল, সেটি এখন আমাদের সবার কাছে কিংবদন্তির মতো। প্রথমেই সবাই প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে যত দিন দেশ শত্রুমুক্ত না হবে, তারা কেউ পরিবারের সঙ্গে থাকবেন না এবং তাজউদ্দীন আহমদ সেটি অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলেছিলেন। যুদ্ধের নয় মাস তিনি কখনো তাঁর পরিবারের কাছে যাননি। অফিসের পাশে একটা ঘরে তিনি ঘুমাতেন। এপ্রিল মাসের ভেতরেই বাংলাদেশের ভেতর থেকে তাঁর স্ত্রী ছেলেমেয়েদের নিয়ে ভারতে চলে এসেছিলেন, তাঁরা থাকতেন মাত্র তিন-চার মাইল দূরে। ইচ্ছে করলেই তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যেতে পারতেন, কিন্তু তিনি যাননি। এমনকি একবার সেই বিল্ডিংয়ে গিয়েছেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে দেখা করতে, কিন্তু তবু তিনি তাঁর পরিবারের কারও সঙ্গে দেখা করেননি। তিনি এসেছেন খবর পেয়ে স্ত্রী, ছেলেমেয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলেন, তাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের দিকে তাকিয়ে একটুখানি হেসে লিফটের দিকে এগিয়ে গিয়েছিলেন! এর পরেরবার যখন সেই বিল্ডিংয়ে গিয়েছিলেন, তখন গিয়েছিলেন আরও গোপনে, যেন তাঁর পরিবারের লোকজন দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে তাঁর মনকে দুর্বল করে দিতে না পারে। তাজউদ্দীন আহমদ জানতেন, খুব বড় কিছু পেতে হলে খুব বড় আত্মত্যাগ করতে হয়। তিনি অনায়াসে সেই আত্মত্যাগ করেছিলেন। আমাদের নতুন প্রজন্ন কতটুকু জানে আমি জানি না, কিন্তু তাঁর সেই আত্মত্যাগের কথা এখনো আমাদের মাঝে একধরনের উদ্দীপনার জন্ন দেয়। সারা দিন তিনি মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমাতেন এ রকম একটা জনশ্রুতি চালু আছে−একজন মানুষ দিনে মাত্র দুই ঘণ্টা ঘুমিয়ে বেঁচে থাকতে পারে কি না আমার জানা নেই। যারা তাঁর খুব কাছের মানুষ, তাদের কাছে শুনেছি, তিনি কাজের চাপে আক্ষরিক অর্থে নাওয়া-খাওয়া, ঘুমের সময় পেতেন না। ব্যক্তিগত আরাম-আয়েশ বা বিলাসের তাঁর কোনো সময় বা প্রয়োজন ছিল না। অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, শুরুতে তাঁর মাত্র একপ্রস্থ কাপড় ছিল। একজন দেশের প্রধানমন্ত্রীর মাত্র একপ্রস্থ কাপড় থাকবে, সেটা কেমন দেখায়? তাই তাঁর পরিচিত একজন তাঁকে আরও একপ্রস্থ কাপড় কিনে দিয়েছিল। তিনি সেই কাপড় পরে থাকতেন। নিজের কাপড় নিজে ধুয়ে দিয়েছেন! কাপড় ধুতে ধুতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম করে ফেলতেন, দাপ্তরিক কাজকর্ম শেষ করতেন। অফিসের পাশে যে ঘরটিতে থাকতেন, সেখানে ছিল একটা চৌকি, মাদুর, কাঁথা-বালিশ, চাদর আর সাড়ে তিন টাকা দামের একটা মশারি। যুদ্ধের সেই নয় মাস তাঁর ছিল শুধু কাজ, কাজ আর কাজ। দাপ্তরিক কাজের সঙ্গে সঙ্গে তিনি রণাঙ্গন থেকে রণাঙ্গনে ঘুরে বেড়িয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস দিয়েছেন, অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। বিদেশি সাংবাদিক, কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলেছেন, বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করার জন্য নিরলসভাবে চেষ্টা করেছেন।

তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই, যার অর্থ ১৯৭১ সালে তাঁর বয়স ছিল মাত্র ৪৫ বছর! আমি মাঝেমধ্যে আমার নিজের সঙ্গে তুলনা করি−আমার বয়স যখন ৪৫ বছর, তখন আমি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভাগীয় প্রধান−আমার ওপর কয়েক শ ছাত্রছাত্রীর দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালন করতে গিয়েই আমি হিমশিম খেয়ে গেছি, অথচ সেই বয়সে তিনি সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার মতো দায়িত্ব পালন করেছিলেন। আমরা এখন জানি সেই যুদ্ধটা চলেছে মাত্র নয় মাস, কিন্তু তখন কেউ সেটা জানত না, তখন যারা মুক্তিযুদ্ধের সেই অনিশ্চিত জগতে পা দিয়েছিল, তারা কিন্তু তাদের পুরো জীবনটাকেই সেখানে উৎসর্গ করেছিল। যুদ্ধের নয় মাস তাজউদ্দীন আহমদকে রণক্ষেত্রের শত্রুর পাশাপাশি সম্পূর্ণ ভিন্ন একধরনের শত্রুকে মোকাবিলা করতে হয়েছিল, সেই শত্রু ছিল তাঁর দলের ভেতর! সে রকম একজন মানুষ ছিল খন্দকার মোশতাক আহমদ−তাঁকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এত বড় একটা দায়িত্ব নিয়ে খন্দকার মোশতাক আহমদ কিন্তু পুরো মুক্তিযুদ্ধের গতিধারাটুকুই পাল্টে ফেলতে চেষ্টা করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার ছিল পাকিস্তানের পক্ষে, খন্দকার মোশতাক আহমদ সেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আর পাকিস্তানের সঙ্গে যোগাযোগ করে জাতিসংঘের একটা অধিবেশনে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিটুকুই পাল্টে ফেলার ষড়যন্ত্র করেছিলেন। এ খবরটুকু জানার পর শেষ মুহূর্তে তাঁকে সরিয়ে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জাতিসংঘের সেই অধিবেশনে পাঠানো হয়েছিল। খন্দকার মোশতাক আহমদ সে জন্য কখনো তাজউদ্দীন আহমদ আর তাঁর সহকর্মীদের ক্ষমা করেননি, প্রতিশোধ নিয়েছিলেন পঁচাত্তরের নভেম্বরে ঠান্ডা মাথায় জেলখানায় তাঁদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। সেদিন আমি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে গিয়েছিলাম, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সরকারের মন্ত্রিপরিষদের ছবি রয়েছে সেখানে। সেখান থেকে খিমচে খিমচে কেউ একজন খন্দকার মোশতাক আহমদের ছবিটা তুলে ফেলেছে। কিন্তু জাদুঘরে খিমচে খিমচে ছবি তুলে ফেলাটাই কি এই মানুষের যোগ্য শাস্তি? বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় এই বিশ্বাসঘাতককে কি এই দেশের ইতিহাসের আস্তাকুরে আমরা ঠিকভাবে নিক্ষেপ করেছি? যে তীব্র ঘৃণা নিয়ে আমরা মীর জাফরের নাম উচ্চারণ করি, তার থেকেও বেশি ঘৃণা নিয়ে কি এই মানুষটির নাম উচ্চারণ করার কথা নয়?

একাত্তরের ২৩ নভেম্বর তাজউদ্দীন আহমদ রেডিওতে একটা ভাষণ দিয়ে ঘোষণা করেছিলেন, বাংলাদেশের মাটিতে মুক্তিযোদ্ধারা এখন যেকোনো জায়গায় পাকিস্তানি বাহিনীকে আঘাত করার ক্ষমতা অর্জন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে পরাজিত হওয়ার গ্লানি থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তারা এখন ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটা আন্তর্জাতিক সংকট তৈরি করার চেষ্টা করবে।দুই সপ্তাহের মধ্যে তাঁর ভবিষ্যদ্বাণী সত্য প্রমাণিত হয়, সত্যি সত্যি পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করে বসে। যুদ্ধের কারণে ভারতের সেনাবাহিনীর যদি বাংলাদেশে প্রবেশ করতে হয়, সেটাও যেন সঠিকভাবে করা হয়, তাজউদ্দীন আহমদ সেটা নিশ্চিত করেছিলেন। বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি দিয়ে দুই দেশের যৌথ সামরিক কমান্ড তৈরি করে তারপর তারা বাংলাদেশের মাটিতে প্রবেশ করেছিল। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি এক মুহূর্তের জন্যও তাঁর প্রিয় দেশটির মর্যাদাকে ভূ-লুণ্ঠিত হতে দেননি।বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হয় ১৬ ডিসেম্বর, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে ফিরে আসেন ১০ জানুয়ারি। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ তার যাত্রা শুরু করে, সেই মন্ত্রিপরিষদে তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন প্রথম অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী। বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের কাজে লেগে গেলেন অনেক উৎসাহ নিয়ে। তিনি কল্পনা করেছিলেন এমন একটি বাংলাদেশের, যেটি মোটেও পরনির্ভর হবে না, নিজের পায়ের ওপর দাঁড়াবে আত্মমর্যাদা নিয়ে। দেশের মর্যাদা তাঁর কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে সে ব্যাপারে কাউকে তোয়াক্কা করতেন না। মুক্তিযুদ্ধের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ছিল পাকিস্তানের বিপক্ষে, সেটি তিনি কখনো ভুলতে পারতেন না। তাই ওয়াল্র্ড ব্যাংকের প্রধান হয়ে রবার্ট ম্যাকনামারা যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন, তাঁকে তিনি এয়ারপোর্টে প্রটোকল দিতে পর্যন্ত রাজি হননি। সপ্তাহ কয়েক আগে এই রবার্ট ম্যাকনামারা মারা গেছেন। পৃথিবীর মানুষের নতুন করে তাঁর কথা মনে পড়েছে। কারণ, তিনি ছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধের “স্থপতি”! মিথ্যে তথ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র যেভাবে ইরাকে যুদ্ধ করতে গেছে, ঠিক সে রকম মিথ্যে তথ্য দিয়ে তারা ভিয়েতনাম যুদ্ধেও জড়িয়ে পড়েছিল এবং এই রবার্ট ম্যাকনামারা ছিলেন সেই কুটিল ষড়যন্ত্রকারী। বলা যেতে পারে, ভিয়েতনাম যুদ্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যে অসংখ্য তরুণ মারা গিয়েছিল, তাদের রক্তের দাগ এই রবার্ট ম্যাকনামারার হাতে রয়ে গেছে। পৃথিবীর কোনো কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে তার বিচার করা যায়নি, সেটি পৃথিবীর অনেক বিবেকবান মানুষকে এখনো পীড়া দেয়। আমাদের সান্ত্বনা সদ্য স্বাধীন হওয়া ছোট্ট একটি দেশের অর্থমন্ত্রী হয়েও তাজউদ্দীন আহমদ রবার্ট ম্যাকনামারার মতো মানুষকে তাঁর প্রাপ্যটুকু বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে দেখা হওয়ার পর ম্যাকনামারা জিজ্ঞেস করেছিলেন, “বাংলাদেশের কোথায় কোন ধরনের সাহায্যের দরকার?”সেই আলোচনায় আমরা উপস্থিত ছিলাম না, তাই ঠিক কীভাবে কথাগুলো বলেছিলেন আমরা জানি না, তবে অনুমান করতে পারি। ম্যাকনামারার প্রশ্ন শুনে জনাব তাজউদ্দীন বলেছিলেন, “আমাদের যেটা দরকার, আপনারা সেটা আমাদের দিতে পারবেন না।”ম্যাকনামারা অবাক হয়ে বললেন, “কেন?”তাজউদ্দীন আহমদ সরল মুখে বললেন, “আমার দরকার গরুই!”ম্যাকনামারা চোখ কপালে তুলে বললেন, “গরু?”তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, “হ্যাঁ। কৃষকদের চাষ করার জন্য লাগে গরু। যুদ্ধের সময় পাকিস্তানিরা গরু খেয়ে ফেলেছে। ভয়ের চোটে পালিয়েও গেছে অনেক গরু। এখন চাষ করার জন্য গরু খঁুজে পাওয়া যাচ্ছে না!”ম্যাকনামারা অবাক হয়ে তাজউদ্দীন আহমদের দিকে তাকিয়ে রইলেন। তখন তাজউদ্দীন আহমদ বললেন, “ও, হ্যাঁ। আমাদের আরও একটা জিনিস দরকার।”ম্যাকনামারা একটু আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “কী?””গরুগুলো বেঁধে রাখার জন্য দড়ি!”ম্যাকনামারা নির্বোধ মানুষ ছিলেন না, তাই তাজউদ্দীন আহমদের টিটকারিটুকু বুঝতে দেরি হলো না। তিনি চুপ করে গেলেন। পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশের এককালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওয়াল্র্ড ব্যাংকের প্রধানের সঙ্গে কেউ এভাবে কথা বলতে পারে, সেটি তিনি স্বপ্নেও চিন্তা করেননি!

পরেব ইতিহাসটুকু আসলে একটুখানি দুঃখের ইতিহাস। ধীরে ধীরে বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের ভেতরে একটা দূরত্বের সৃষ্টি হলো। তাজউদ্দীন আহমদের ভেতরে খুব সংগত কারণে খানিকটা অভিমান ছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস তিনি অবিশ্বাস্য একধরনের কঠিন সময়ের ভেতরে থেকেও আশ্চর্য দক্ষতায় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, কিন্তু বঙ্গবন্ধু কখনো সেই ইতিহাসটুকু তাজউদ্দীন আহমদের কাছ থেকে শুনতে চাননি। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতা করেছিল, তারাই আবার ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে লাগল। দেশের স্বার্থ ছাপিয়ে দলাদলি অগ্রাধিকার পেতে শুরু করল। তাজউদ্দীন আহমদ বাকশাল তৈরি করে একদলীয় শাসন শুরু করার ঘোরতর বিরুদ্ধে ছিলেন। ক্ষুব্ধ কণ্ঠে তিনি একদিন বঙ্গবন্ধুকে ইংরেজিতে বলেছিলেন, “বাই টেকিং দিস স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য ডোরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইওর পজিশন।” (এই পদক্ষেপ নিয়ে আপনি শান্তিপূর্ণ উপায়ে আপনাকে সরানোর সব পথ বন্ধ করে দিলেন!)তাজউদ্দীন আহমদের সেই কথাগুলো ছিল প্রায় দৈববাণীর মতো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট পৃথিবীর নৃশংসতম হত্যাকাণ্ডে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হলো। হত্যাকারী সেনাবাহিনীর অফিসাররা রাষ্ট্রপতি হিসেবে বেছে নিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদকে। খন্দকার মোশতাক আহমদ আওয়ামী লীগের নেতাদের নিয়ে তাঁর সরকারের একটা বৈধ রূপ দেওয়ার চেষ্টা করলেন। কেউ এগিয়ে এল না। খুব দ্রুত বুঝতে পারলেন তাঁর পায়ের নিচে মাটি নেই। ক্যু পাল্টা ক্যু হতে থাকে−মুক্তিযুদ্ধের নেতারা যেন আবার ক্ষমতায় চলে আসতে না পারে, সেটি নিশ্চিত করার জন্য জেলখানায় হত্যা করা হয় চার নেতাকে। বাংলাদেশকে ঠেলে দেওয়া হয় একটি অন্ধকার গহ্বরে।বহুদিন পর আমরা সেই অন্ধকার গহ্বর থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করছি।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সময়ের পার্থক্য ছিল ৩০ মিনিট। বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ভারতের মাটিতে থেকে কাজ করত, চলত ভারতের সময়ে। কিন্তু তাজউদ্দীন আহমদ কোনো দিন তাঁর হাতঘড়ির সময় পরিবর্তন করেননি, সেটি চলত বাংলাদেশের সময়ে।মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি দানবেরা এই দেশের মাটিতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছিল। তখন আকাশে শকুন উড়ত, নদীর পানিতে ভেসে বেড়াত ক্ষতবিক্ষত মৃতদেহ, শুকনো মাটিতে দাউ দাউ করে জ্বলত আগুনের লেলিহান শিখা, বাতাস ভারী হয়ে থাকত স্বজনহারা মানুষের কান্নায়। শুধু বাংলাদেশের সময়টুকু তারা কেড়ে নিতে পারেনি। তাজউদ্দীন আহমদ পরম মমতায় সেই সময়টুকুকে তাঁর হাতঘড়িতে ধরে রেখেছিলেন।ঘাতকের বুলেট তাজউদ্দীন আহমদের হৎস্পন্দনকে চিরদিনের জন্য থামিয়ে দিয়েছে, কিন্তু তাঁর হাতের ঘড়িতে ধরে রাখা বাংলাদেশের সময়টিকে কোনো দিন থামাতে পারবে না।যত দিন বাংলাদেশ থাকবে, তত দিন তাজউদ্দীন আহমদের ঘড়ি আমাদের হূদয়ে টিকটিক করে চলতে থাকবে। চলতেই থাকবে।

লেখক : অধ্যাপক, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

(ওএস/অ/জুলাই ২৪, ২০১৫)

পাঠকের মতামত:

২০ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test