E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

কাঁদো বাঙালি কাঁদো

২০১৫ আগস্ট ১৪ ১৭:২৩:৪৯
কাঁদো বাঙালি কাঁদো

চৌধুরী আ. হান্নান : কাঁদো বাঙালি কাঁদো। ১৫ আগস্ট। বঙ্গবন্ধুকে হারানোর অভিশপ্ত দিন। এ দেশীয় কিছু দুর্বৃত্ত ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের কালোরাতে নৃশংসভাবে সপরিবারে খুন করে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। যে বঙ্গবন্ধুর জন্ম না হলে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেতাম না, সেই বঙ্গবন্ধুকে খুন করেছি আমরাই ! কাঁদো বাঙালি কাঁদো !

বঙ্গবন্ধুর মত বিশাল, অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে বিশ্লেষণমূলক লেখার যোগ্যতা, জ্ঞানের গভীরতা আমার নেই। তবে তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত গুণমুগ্ধ একজন ভক্তের কিছু বলার অধিকার নিশ্চয়ই আছে।

শেখ মুজিব নিজে পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন না কিন্তু তিনি জীবনব্যাপী রাজনৈতিক জীবনে যে কীর্তি রেখে গেছেন তা অধ্যায়ন করে, গবেষণা করে যুগে যুগে বুদ্ধিজীবি, পণ্ডিত সৃষ্টির ক্ষেত্র তৈরি করেছেন। পদে পদে তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। অন্যায়, অবিচার দেখলেই তিনি ছোটবেলা থেকেই বই পুস্তক তুলে রেখে প্রতিকারে নেমে পড়েছেন। তাঁর মেধা বিকশিত হয়েছে, ব্যয় হয়েছে কেবলই অন্যায়-জুলুমের প্রতিকার, প্রতিবাদে। তাঁর রাজনৈতিক গুরুদের সাথেও তিনি দৃঢ়তার সাথে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন, লক্ষ্যে এগিয়ে গেছেন।

পাকিস্তানিরা সব সময় আমাদের ‘বাঙালি’ বলে গালি দিত। অনেকে রসিকতা করে, তামাশা করে বিদ্রুপ করতো ওরা বাঙালি হয়েছে তো কী হয়েছে ? ওরা তো মুসলমান, আবার নামাজও পড়ে।

বঙ্গবন্ধু একটি অপ্রস্তুত জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন। সত্তরের নির্বাচন স্বাধীনতা যুদ্ধের ভিত্তি মজবুত করেছিল। আওয়ামী লীগের নৌকার মিছিল কেবল শহর বন্দর প্রকম্পিত করেনি, গ্রাম-গঞ্জের মাঠ ময়দানও কেঁপে উঠেছিল তখন। নির্বাচনী প্রচারণার শেষ দিকে অভাবনীয় সব ঘটনা ঘটতে থাকে অন্য দলের মিছিল ও নৌকার মিছিলে যোগ দেয়, সব একাকার হয়ে যায়।

কচুর পাতায় নৌকার ছবি দেখা শুরু করে গ্রামের মানুষ জন। শেখ মুজিবের প্রতি ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে অলৌকিক ঘটনা বিশ্বাস করতে শুরু করে মানুষ। এর নাম নেতার ক্যারিশমা– বঙ্গবন্ধুর সম্মোহনী নেতৃত্ব। বঙ্গবন্ধুর প্রতি বাঙালির এমন ভালবাসার কারণেই আগরতলা মামলায় তাঁকে ফাঁসি দেয়ার পাকিস্তানি ষড়যন্ত্র সফল হয়নি।

৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু যেভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন তা বিশ্ব-ইতিহাসে নজিরবিহীন। বাঙালিদের বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে চিহ্নিত করার কোন অজুহাত পাকিস্তানিরা পায়নি। ব্রিটেনের বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী জ্যাক ওয়াডিস বলেছেন- চারটি ঘোষণা মানব সভ্যতার সড়ক নির্মাণের সহায়ক হয়েছে। তিনি বঙ্গবন্ধুর ৭মার্চের ভাষণকে এর অন্তর্ভূক্ত করেছেন। তিনি বলেন- ‘যদিও এই ভাষণটিতে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। আসলে এটি তাঁর সমকালীন বিশ্বে সব নিপীড়িত জাতিরই মুক্তি সংগ্রামের দিক নির্দেশনা।’

লন্ডন থেকে প্রকাশিত জ্যাকর এফ ফিল্ড কর্তৃক সংকলিত ও সম্পাদিত ‘The speeches that inspired history’ নামক বইতে বিগত প্রায় আড়াই হাজার বছরের ইতিহাসের অগ্রযাত্রার সহায়ক ঘোষণাগুলোর মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘোষণাও স্থান পেয়েছে (লন্ডন প্রবাসী বিখ্যাত সাংবাদিক আবদুল গফফার চৌধুরীর এক লেখা থেকে)।

তিনি একাত্তরের বংশীবাদক, যেন যাদু-মন্ত্রে দেশটা স্বাধীন করে দিলেন। কিন্তু একটি সদ্য স্বাধীন দেশকে পুনর্গঠনের জন্য গুছিয়ে ওঠার আগেই পরাজিত ঘাতকেরা সপরিবারে জাতির পিতাকে হত্যা করলো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বাঙালির আজন্ম কান্নার দিন, হৃদয়ে রক্তক্ষরণের দিন। প্রায় দুই দশকের ও অধিক সময় ধওে হিংস্র দানবেরা সদ্য স্বাধীন দেশটাকে তছনছ করলো, অপবিত্র করলো। দেশের অগ্রযাত্রার দিক পরিবর্তন করে উল্টোযাত্রা করলো। ২১ বছর কান্না চেঁপে রেখেছিল বাঙালি। নির্মলেন্দু গুণের সেই কবিতা অনন্তকাল বাঙালির হৃদয় ছুঁয়ে যাবে- ‘একুশ বছর তুমি কাঁদতে পারোনি। আজ কাঁদো। আজ প্রাণ ভরে কাঁদো, এসেছে কান্নার দিন, দীর্ঘ দুই দশকের জমানো শোকের ঋণ আজ শেষ করো অনন্ত ক্রন্দনে’।

ইতিহাসের এ ঘৃণ্য ও নৃশংস হত্যাকাণ্ডের দুর্বিসহ স্মৃতি অনন্তকাল বয়ে বেড়াব আমরা। আরও একদিন কেঁদেছিল বাঙালি। সেদিন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে নিজ দেশে পদার্পণ করে জাতির উদ্দেশে প্রথম ভাষণ দিয়েছিলেন তিনি। সে কান্না ছিল স্বাধীন দেশে বঙ্গবন্ধুকে ফিরে পাওয়ার আনন্দে। তিনি এখন আর আওয়ামী লীগের দলীয় বৃত্তে আবদ্ধ নেই, বঙ্গবন্ধু এখন সর্বজনীন।

বাঙালি জাতির এক সৌভাগ্য বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাধা করার দায়িত্ব এসে পড়েছে তাঁরই কন্যা শেখ হাসিনার ওপর। আগস্ট-ট্রাজেডিতে দৈবক্রমে বেঁচে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সব হরানোর বেদনা নিরন্তর বয়ে চলেছেন। হাসিনা সরকারের কাছে আমাদের অনেক রাড়তি প্রত্যাশা। যাঁর হারানোর কিছু নেই, লোভ লালসা নেই, অপরকে দেয়ার জন্য বিধাতা তাঁকে অসীম ক্ষমতা দেন। তিনি এখন বিশ্বসভায় একজন সফল, বিচক্ষণ, রাষ্ট্রনায়কের আসনে আসীন।

বাংলাদেশ এখন অগ্রযাত্রার, উন্নয়নের মহাসড়কে ওঠে গেছে। মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছানো এখন কেবল সময়ের ব্যাপার। বঙ্গবন্ধু বাঙালি আজ পৃথিবীর বুকে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। তিনি বেঁচে থাকলে আবারও তাঁর তর্জনী উঁচু করে বিশ্ববাসীকে জানান দিতেন- তোমরা দেখ, আজ আমার বাঙালি মানুষ হয়েছে।

সেই বঙ্গবন্ধু আজ নেই ! কাঁদো বাঙালি কাঁদো !

লেখক : সাবেক ব্যাংকার

পাঠকের মতামত:

০২ মে ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test