E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

দারিদ্র ও আমাদের সমাজ

২০১৬ আগস্ট ০৫ ১৫:১০:৩৮
দারিদ্র ও আমাদের সমাজ

যুথিকা বড়ুয়া :


আমাদের দেশে ধনী ও প্রভাব-প্রতিপত্তিশালীদের তুলনায় নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার এবং গরীবের সংখ্যা বেশী। তারমধ্যে বেশীরভাগই হতদরিদ্র এবং অসমর্থ। বিশেষ করে জীবন ও জীবিকার তাগিদে যারা প্রতিদিন কঠোর সংগ্রামে লিপ্ত থাকে, দুঃখ-দীনতাই যাদের নিত্যদিনের সঙ্গী।

যারা আর্থিক অভাবে কখনো অর্ধাহারে, কখনো বা অভূক্ত জীবনযাপন করে। মাথা গোঁজার ছাদ থাকে তো পরনের বস্ত্র থাকে না, দু’বেলা অন্ন জোটে তো বিদ্যার্জনের সামর্থ থাকে না। যাদের নিজস্ব মাটিতে মেরুদন্ড সোজা করে দাঁড়াবার ক্ষমতা থাকে না। আত্মরক্ষা করে পাখীর বাসার মতো গাছের ছাল-বাকল আর ছেঁড়া বস্তা ঘেরা ছোট্ট ঘুপচি ঘরের কোণে, যেখানে সামান্য বর্ষণে রাজ্যের কীট-পতঙ্গ, পোকা-মাকড়, মশা-মাছি, বিষধর সাপ, কেঁচো-ব্যাঙ গিয়ে বাসা বাঁধে। আবার কারো কারো সেটুকুও জোটে না। দিবস ও রজনী অতিবাহিত করে উন্মুক্ত নীল সামিয়ানার নীচে। যারা আমাদের সুশীল সমাজে আজও নিগৃহীত, নির্যাতিত, অবহেলিত, লাঞ্ছিত এবং নিপীড়িত।

মূলতঃ এই অভাগার দল মনুষ্যকূলে জন্মগ্রহণ করেও তারা মানবাধিকার থেকে সম্পূর্ণ বঞ্চিত। ভাগ্যবিড়ম্বনায় যাদের পদে পদে অপদস্ত হতে হয়। যারা আমাদের দেশে অতি নগণ্য, দেশের নাগরিক হিসেবে কখনোই বিবেচিত হয় না। কিন্তু তারা কিভাবে জীবনযাপন করে, কিভাবে জীবিকা নির্বাহ করে, পেটের ক্ষিধে মেটায়, কেইবা রাখে তাদের খবর! যা স্বচোক্ষে না দেখলে অনুভব করা যায় না। যার দৃষ্টান্তস্বরূপ আমি নিজে। সে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা, যা কখনোও ভোলা যায় না। আজও জলছবির মতো আমার মনঃশ্চক্ষে ভেসে ওঠে, এক অসহায় আশ্রয়হীন দুর্বল নারীর ত্রাণ রক্ষা পাবার সেই করুণ আবেদন, তীব্র আর্তনাদ।

অনেক বছর আগের কথা। আমার আজও সুস্পষ্ট মনে পড়ে, তখন ঘোরতরো বর্ষাকাল। সেদিন ছিল রথযাত্রা। ঊষার প্রারম্ভেই ঘনিয়ে এসেছিল অন্ধকার। গুমোট মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। চারিদিক নীরব নিস্তব্ধ। একটুও বাতাস নেই। পশু-পাখীর কলরব নেই। ঠান্ডা আবহাওয়া। পড়ন্ত বেলায় শুরু হয় গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি। তা উপেক্ষা করে আমরা কিশোরীরা দলবেঁধে মনের উদ্যামে বেরিয়ে পড়েছিলাম রথের মেলা দেখতে। হঠাৎ শুনি, মানুষের কোন্দল, কোলাহল। চিৎকার-চেঁচামিচি। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি, এক বিশাল দালান বাড়ির প্রাঙ্গনে প্রচন্ড ভীঁড়, লোকে লোকারণ্য। খুব হৈ চৈ হচ্ছে সেখানে।

আমরা থমকে দাঁড়াই। লোকের কানাঘুষোয় জানলাম, শিশু অপহরণের দায়ে এক মহিলাকে আটক করে রেখেছে। ভাবলাম, এ আর নতুন কি! দিনকাল কবেইবা ভালো ছিল। অহরহই তো ঘটছে এসব। তবু স্বভাবসুলভ কারণে মহিলা চোরকে স্বচোক্ষে দেখার ইচ্ছাটা আমাদের প্রবলভাবে জেগে ওঠে। সম্বরণ করতে পারি নি। খানিকটা কৌতূহলেই দিলাম এক দৌড়। গিয়ে দেখি, অবাক কান্ড। একেবারে গল্প, নোভেলের মতো ঘটনা। এক যুবতী মহিলা, ময়লা অপরিস্কার ছেঁড়া ফাটা বস্ত্র পরিহিতা একহাত ঘোমটা টেনে, কাঁথা জড়ানো একটি ছোট্ট দুধের শিশুকে বুকে নিয়ে মাটিতে বসে আছে। ওর আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে দেখলাম, দুইহাত ভর্তি রং-বেরং-এর প্লাষ্টিকের চুড়ি। পায়ে কালো স্যাঁওলাপড়া হাওয়াই চটি। নোংরায় ভর্তি হাতে পায়ে বড় বড় নখ। পা-দুটোও ফুলে ফেটে বিন্দু বিন্দু রক্তকণায় লাল হয়ে উঠেছে। তাতে বোঝা গেল, বেশ কয়েকদিন জলের মধ্যে ডুবেছিল। আঙ্গুলের ফাঁকগুলিকেও জলে খেয়ে একেবারে ঘা করে ফেলেছে। কিন্তু মহিলাটিকে খুব অস্বাভাবিক লাগছিল। কিছু বলবার ব্যকুলতায় কেমন অস্থির হয়ে উঠছিল, ঠোঁট দুটো কাঁপছিল। চোখেমুখেও উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা। কিছু বুঝে ওঠার আগেই স্থানীয় মস্তান গোছের ছেলেরা ভীঁড় ঠেলে উত্তেজিত হয়ে এগিয়ে আসে। চোখ রাঙ্গিয়ে বলে,-“ধর চুলের মুঠি, বেটি দু-চার ঘা খেলেই মুখ দিয়ে অনায়াসে বুলি উতরে আসবে!”

কেউ বলছে,-‘কূলটা, পাপীষ্ঠা!’ আবার কেউ কেউ বলছে,-‘চোরনি, পালিয়ে যাচ্ছিস কোথায়? বল্ কোথা থেকে বাচ্চা চুরি করেছিস? কাদের বাচ্চা চুরি করেছিস? শীগ্গিরি বল, নয়তো এক্ষুণি পুলিশে ধরিয়ে দেবো!’

পুলিশের নাম শুনেই ভয়ার্ত চোখে মহিলাটি থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। ভয়ে আঁতঙ্কে আড়ষ্ঠ হয়ে বাচ্চাটাকে শক্ত হাতে বুকে চেপে ধরে। কিন্তু বিক্ষিপ্ত জনতার দল নাছোড়বান্দা। মারধর করার হুমকি দেখায়। অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করে। রীতিমতো প্রস্তুতি নিয়ে ছেলেরা তেড়ে আসতেই মহিলাটি কান্না জড়িত কন্ঠে চিৎকার করে ওঠে,-“আমি চোর নই বাবু। ও আমারই বাচ্চা। কত্ত কষ্টে নয়টামাস প্যাটে রাইখ্যা অরে আমি জনম দিছি। আমিই অর মা, বাবু।”

বাচ্চাটিকে সজোরে বাহুবেষ্টনে আলিঙ্গন করে ওর কপালে গালে একটা চুম্বন দিয়ে বলল,-“সংসারে আমাদের কেউ নাই গো বাবু, কেউ নাই। সব বন্যার জলে ভাইস্যা গ্যাছে। আমারে দয়া করেন!” বলতে বলতে মহিলাটি হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে। তারপর ধীরে ধীরে একটু একটু করে উন্মোচন হতে লাগল, ওর জীবনের করুণ কাহিনী।

মহিলাটির নাম সরলা। অজপাড়া গাঁয়ের এক অতি নিম্নবিত্ত পরিবারের কূলবধূ। জরা-জীর্ণের মতো রোগা শরীর। গায়ের রং শ্যাম বর্ণ। বয়সের তুলনায় বেশ বুড়িয়ে গেছে। চোখমুখ গর্তে ঢুকে গেলেও খুঁটিয়ে দেখলে বেশ বোঝা যাচ্ছিল, উঠতি যৌবনে সরলা কম সুন্দরী ছিল না। ভাগ্যের নিমর্ম পরিহাসে অনাদরে অবহেলায় ময়লার আবরণে ওর লাবণ্যময় সৌন্দর্য্য একেবারেই অদৃশ্য হয়ে গিয়েছে। ঘটা করে না হলেও রীতিমতো পুরোহিত ডেকে শাস্ত্রমতেই ওর বিবাহ হয়েছিল। ওদেরই পার্শ্ববর্তী গ্রামের একটা অশিক্ষিত অসমর্থ দুর্বল লুলা ল্যাংড়া তরুণ যুবক রঘুনাথের সাথে।

কথায় বলে,-‘খাঁটি সোনা বেঁকে গেলেও সোনাই থাকে। তার মূল্য কখনো কমে যায়না।’ তেমনি একজন পুরুষ মানুষ শত কালো কুৎসিৎ কিম্বা বিকলাঙ্গ হলেও তার পুরুষত্ব আমাদের সমাজে কখনো কমে যায়না। আর কমে গেলেও সরলার মতো মেয়ের কিইবা এসে যায়? বরং ওর জন্য শাপে বর হয়েছিল। আর তাছাড়া বিমাতা কতৃক অমানবিকভাবে নির্যাতিত এবং লাঞ্ছিত হয়ে অর্ধাহারে জীবনযাপন করার চেয়ে লুলা ল্যাংড়া অক্ষম স্বামীর ঘর-সংসার করা ঢের ভালো। এ তো পরম সৌভাগ্য সরলার। বিধাতার অসীম দয়া। তা না হলে ওর মতো এক অজ পাড়াগাঁয়ের ঘরকুনো, আনস্মার্ট, আন্এ্যডুকেটেড্, স্বল্প বস্ত্র পরিহিতা মহিলার পবিত্র বিবাহ-বন্ধনে আবদ্ধ হওয়া, জীবনসাথী পাওয়া কি কম সৌভাগ্যের কথা! স্বপ্নেও তো ভাবতে পারেনি কোনদিন।

রঘুনাথ ক্রাচ ছাড়া চলতে পারতো না। চলার শক্তিই ছিল না। জীবন ও জীবিকার তাগিদে শুধুমাত্র মৌলিক চাহিদাটুকু মেটাতেই ওকে হিমশিম খেতে হতো। তবু ভেঙ্গে পড়তো না। দুঃখ-দৈনতায় তাকে কখনো ঘায়েল করতে পারতো না। মনের শক্তি ছিল প্রকট। আর ছিল অসাধারণ আত্মবিশ্বাস, দৃঢ় সঙ্কল্পপ্রবণ এবং সৃজনশীল মন ও সাহসিকতা।

শারীরিক ভারসাম্যহীনতায় কখনো দুর্বল হয়ে পড়েনি। পিছুপা হয়নি। বিকলাঙ্গ শরীর নিয়ে এক হাতেই গরুরগাড়ির মতো ধিক্ ধিক্ করে ঠেলাগাড়ি টানতো। বাজারে ডাব বিক্রি করতো। বাড়িতে হাঁস-মুরগীর পোল্ট্রিও ছিল। তার দেখাশোনা করতো সরলা। তাতে যা আমদানি হোত, তা দিয়ে দুজনের সংসার কোনরকমে চলে যেতো। কোনো কোনোদিন অর্ধাহারেও কাটাতে হতো। তবু কোনও অসস্তোষ, অভিযোগ ছিল না। ছিল শুধু সুখ, শান্তি। আর ছিল সরলার অনাবিল মুখের অনিন্দ্য সুন্দর হাসি, যা কখনোও ম্লান হতো না। বাস করতো, খড়-কূটোর ছাউনি দেওয়া ছোট্ট একটি মাটির ঘরে। যেখানে প্রত্যেক বছর বন্যার জলে ধস্ নেমে গৃহহীন হয়ে পড়ে গ্রামের শত শত অসমর্থ দুর্বল মানুষ। মারাও যায় অনেকে। আর যারা না মরে অর্ধমৃত অবস্থায় বেঁচে থাকে, তারা সর্বস্ব নিঃশ্ব হয়ে এতিমের মতো অন্ন-বস্ত্র এবং আশ্রয়ের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরে বেড়ায় শহরে, পথেঘাটে, রাজ্যের অলিতে গলিতে, অখ্যাত জনপদে। যেখানে প্রতিনিয়তই প্রবঞ্চিত, লাঞ্ছিত ও নিপীড়িত হয় গৃহহীন, আশ্রয়হীন অগণিত অভূক্ত মানুষের জীবন।

সেবার প্রবল বর্ষণ ও ঝড়-তুফানে সরলার স্বামীসহ ঘর-সংসার, হাঁস-মুরগী সব বন্যার জলে ভাসিয়ে নিয়ে যায় অনিশ্চিত মোহনার দিকে। তারা জীবিত না মৃত সরলার জানা নেই। কথায় বলে, ‘চাচা, আপন পরাণ বাঁচা।’

বন্যার জলে বিপদগ্রস্ত সরলার ভালোবাসার মাটির প্রাসাদখানি যখন টলমল অবস্থা, তখন সে মানসিক ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ে। দ্বিগ্বিদিক জ্ঞান হারিয়ে বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। সুনিশ্চিতভাবে গন্তব্য নির্ণয় করা, ন্যায়-অন্যায়, ভাল-মন্দ বিচার বিবেচনা করার মতো কোনো শক্তিই তখন ওর ছিল না। যখন আসন্ন বিপর্যয়ের সম্মুখে পালায়নই ছিল সরলার একমাত্র বাঁচবার পথ। নয়তো মা ও নবজাত শিশু দু’জনেরই মৃত্যু অবধারিত।

অবলীলায় সদ্য নবজাত শিশুকে বুকে আলগে একটি কাপড়ের পোটলা সাথে নিয়ে, স্বামী ঘর-সংসার ও বৈবাহিক জীবনের বিশ্বাস-ভালোবাসার সকল বন্ধন ছিন্ন করে সরলা নৈঃশব্দে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীতে। যে ঘরে জন্ম নিয়েছিল ওর প্রথম প্রেম, ভালোবাসা। কত আশা বুকে নিয়ে সাজিয়ে ছিল নতুন ঘর সংসার। গড়ে তুলেছিল স্বর্গসুখ। কতনা স্বপ্নীল আশা আকাক্সক্ষা সঞ্চিত করে রেখেছিল মনের মণিকোঠায়। যা ভাগ্যবিড়ম্বণায় অবাঞ্ছিত, অর্থহীণ মনে হতেই হারিয়ে গেল ওর মনের শক্তি। যেদিন জীবনের নিষ্ঠুর পরিণতির পূর্বাভাষে বুঝতে পেরেছিল, প্রকৃতির নিমর্মতায় বন্যার জলে ভেসে যাবে ওর সুখের নীড়। ভেসে যাবে ওর দেবতূল্য স্বামী রঘুনাথ। যার ছুটে পালাবার ক্ষমতা নেই। হয়তো আজই ওর শেষ দেখা। জলের ¯্রােতে বিকলাঙ্গ স্বামী রঘুনাথকে কোথায় যে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে, কোনো পাত্তাই পাওয়া যাবেনা। হয়তো লেপটে পড়ে থাকবে গাছের লতাপাতার সাথে। হয়তো বা দম আঁটকে সেখানেই মরে পড়ে থাকবে। যাকে শনাক্ত করা কিম্বা জীবিত না মৃত তা অনুসন্ধান করার মতো কেউ থাকবে না। হয়তো কোনদিনও আর দেখা হবে না রঘুনাথের সাথে। জবাবদিহীও আর করতে হবে না।

অনেক আশা করেছিল, শহরে এসে কূল-কিনারা একটা নিশ্চয়ই খুঁজে পাবে। মাথা গোঁজার মতো একটুখানি আশ্রয় কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই জুটে যাবে। কোলের সন্তানই আজ ওর একমাত্র সম্বল। বেঁচে থাকার সাহারা। যার মুখ চেয়ে জীবনের সব দুঃখ যন্ত্রণা ভুলে যাবে সরলা। ভুলে যাবে ওর অতীত। ভুলে যাবে বিকলাঙ্গ স্বামী রঘুনাথকেও। দুঃখ যার নিত্যসঙ্গী, প্রতিদিনকার খোরাক, লোকের বাড়িতে ঝি-কাজ করে অনিশ্চিত জীবনের বাকী দিনগুলি সে অনায়াসে কাটিয়ে দিতে পারবে। কিন্তু ভাবতে যত সহজ, বাস্তবায়ীত করা ততই কঠিন।

বলতে বলতে গহীন বেদনায় বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে সরলার। অসহায় বিকলাঙ্গ স্বামী রঘুনাথের করুণ মুখখানা চোখের পর্দায় ভেসে উঠতেই হঠাৎ শোকে বিহ্বলে দু’হাতে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বিলাপ করে ওঠে,-‘আমি তারে একলা ছাইড়া আইছি। আমি পারি নাই রক্ষা করতে। তারে বাঁচাইতে। আমি যে বচন দিছিলাম, সারাজীবন তার পাশে থাকুম। আপদে বিপদে তারে দেখুম, রক্ষা কুরুম। পারি নাই তারে বাঁচাইতে। আমি বড়ই নিষ্ঠুর, স্বার্থঃপর। আমারে ক্ষমা করো প্রভু। আমার বাচ্চাটারে বাঁচাও। অরে দয়া করো। আমারে পথ দেখাও।’

কিন্তু সঠিক পথ সরলাকে দেখাবে কে? সেদিনকার মতো সাময়িক আশ্রয় পেলেও রাতের গভীর নিশী পোহায়ে দিগন্তের প্রান্তরে উষার প্রথম সূর্য্যরে স্নিগ্ধ কোমল আলো ফুটে ওঠার আগেই হতাশ হয়ে শূন্য হাতে সরলাকে ফিরে যেতে হয়েছিল। কেউ এগিয়ে আসেনি। সাহায্য সহানুভূতি, নিরাপদ আশ্রয় কেউ দেয়নি। বিপন্ন জীবন নদীর স্রোাতের টানে ও যে কোন্ মোহনায় গিয়ে আঁটকে আছে, কিভাবে জীবন ও জীবিকা নির্বাহ করছে, তা কেউ জানে না।
তার কারণ আমাদের সমাজ বড়ই কঠোর, নিষ্ঠুর, অস্থিতিশীল। সন্দেহের প্রকোষ্ঠে কারাবন্দী। ক্রমান্বয়ে ছলে-বলে সুকৌশলে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ধূর্ত প্রতারকের প্রতারণায় প্রতারিত হতে হতে সাধারণ দিনমজুর খেটে খাওয়া মানুষের প্রতি বিশ্বাস-ভরসা, দয়া-মায়া-মমতা-ভালোবাসা একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। কোনভাবেই বিগলিত হয় না। কোন প্রকার অনুদান কিম্বা আর্থিক সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে আমাদের সমাজ কুণ্ঠিতবোধ করে, পিছুপা হয়। মাথাকূটে কেঁদে মরে গেলেও তাদের অনুনয় বিনয় আর্তচিৎকার কখনোই কর্ণপাত হয় না।

উপরন্তু ভ্রষ্ঠাচারে লিপ্ততার অভিযোগে প্রতারক, কূলটা, পাপীষ্ঠা বলে অহেতুক মিথ্যে অপবাদ দিয়ে সম্বলহীন অসহায়কে কলঙ্কিত করে সুশীলসমাজ থেকে চ্যুত, বিতাড়িত ও বহিঃস্কার করতে এতটুকু বাঁধেনা। যার ফলে সরলার মতো শত শত গৃহহীণ আশ্রয়হীন সম্বলহীন সহজ সরল অবলা অসহায় নারী আমাদের সমাজে আজও নিগৃহীত, নিপীড়িত। যারা প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে নিমর্মভাবে জীবন পাত করে চলেছে। পেটের দায়ে শহরের অলিতে গলিতে বসে ভিক্ষে করছে। কেউ লোকের এঁঠো বাসন-পত্র ধুয়ে মেজে অন্ন যোগাচ্ছে, দু’বেলা পেট ভরছে। কেউ কূলি বিত্তি করে পাখীর ছানার মতো নিজের সন্তানের মুখে আহার তুলে দিচ্ছে। আর কেউ কেউ অর্থের বিনিময়ে নিজেকেই বেঁচে দিচ্ছে দয়া-মায়াহীন, নিষ্ঠুর অত্যাচারী পাষন্ডের হাতে। কি হবে এদের ভবিষ্যৎ? কে দেবে এদের সাহারা? কে নেবে এদের দায়িত্ব? কি হবে এদের পরিণাম? যার কোনও নিশ্চয়তা নেই।

লেখক : কানাডার টরন্টো প্রবাসী গল্পকার, গীতিকার, সুরকার ও সঙ্গীত শিল্পী

পাঠকের মতামত:

১৮ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test