E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

শিরোনাম:

রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সরকার কি সত্যিই সঠিক?

২০১৬ আগস্ট ০৫ ২১:৫৩:২৬
রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনে সরকার কি সত্যিই সঠিক?

মোঃ আশিকুল ইসলাম চয়ন


আমি কোন জ্বালানী বা বিদ্যুৎ বিশেষজ্ঞ না, অতি সামান্য পড়াশোনা ও চলমান ঘটনা প্রবাহ পর্যবেক্ষণ করেই নিবন্ধটি লেখার প্রয়াস মাত্র। বাংলাদেশ একটি অপার সম্ভাবনার দেশ, যার অনেকগুলো সম্ভাবনার বাস্তবায়ন ও দেশকে উন্নত রাষ্ট্রের সন্মান অর্জন করতে হলে বিদ্যুতের উন্নতির বিকল্প নেই।

২১ শতকের মধ্যে আমাদেরকে ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার মেঃ ওয়াট বিদ্যুৎ সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য সরকার ১,০০০ মেঃ ওয়াটের দুইটি পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের জন্য রাশিয়ার সঙ্গে ও ১৩২০ মেঃ ওয়াটের জন্য রামপালে ভারতের সঙ্গে চুক্তি সাক্ষরিত করেছে। কিন্তু রামপাল নিয়ে চলছে দেশব্যাপি সমালোচনা।

কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কোন বিকল্প নেই বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীর কাছে, ভারতে ৬০%, চীনে ৭০% মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৪৫% বিদ্যুৎ উৎপাদন হয় কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে আর সেখানে বাংলাদেশ মাত্র .০২% বিদ্যুৎ উৎপাদন করে এই ক্ষেত্র থেকে,যদি রামপালে প্রকল্প বাস্তবায়ন হয় তা হলে এর পরিমাণ হবে মাত্র ৩%।

এই তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্র কেন রামপালে? এর জবাব জানাটা প্রয়োজন বোধ করি, সরকার পক্ষের জবাব- এই কয়লা ভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি হতে হবে পশ্চিম জোনে। কারন দেশের বেশিরভাগ বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র পুর্ব জোনে অবস্থিত। ন্যাশনাল গ্রিড পূর্ব থেকে দীর্ঘ পথ ট্রান্সমিশনে সিস্টেম লস হচ্ছে দীর্ঘদিন। তাই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে কোন বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র যমুনা নদীর পশ্চিম পাড়েই হবে। বড় কয়লাবাহি জাহাজ এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রে পৌছাতে দরকার চর বিহীন চালু বড় নদী, যার পাড়ে হতে হবে এই এই বিদ্যুৎ কেন্দ্র। সাথে ভারি ট্রাক চলার জন্য ন্যাশনাল হাইওয়ের কানেক্ট থাকাও জরুরি।

কাওড়াকান্দিতে করা যাবেনা কারন চর পরা নদী, চাঁদপুরের পশ্চিমে শরিয়তপুরে করা যায়, কিন্তু চওড়া হাইওয়ে নেই, গোয়ালন্দ একই অবস্থা নদীতে চর। পিরোজপুর বা বরগুনার কাছেও করা যেতে পারে, আবার এতে খটকা (পুর্ব সুন্দরবন) আক্রান্ত হবে বলে আন্দলন শুরু হয়ে যেতে পারে।মংলা বন্দরের কাছে হলেই সবচেয়ে কমখরচে অষ্ট্রেলিয়া বা দ:আফ্রিকা থেকে কয়লা এনে বিদ্যুত মুল্য কম রাখা সম্ভব বলেই হয়ত রামপালকে সিলেক্ট করা হয়েছে।

রামপাল বিদ্যুৎ প্রকল্পের জমি দরকার ২০০০ একর। বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচাইতে ঘনবসতির দেশ বাংলাদেশের ৯০% খালি জমিই তিন ফসলি জমি। সমতল ভূমি এবং উর্বরতা বিবেচনায় ২০০০ একর জমি দেশের অন্য কোথাও একযোগে অধিগ্রহন করার তেমন সুযোগ ছিল না। ঘনবসতিপূর্ণ হওয়ায় ভুমি থেকে উচ্ছেদ সবচেয়ে কঠিন কাজ ছিল, এর উদাহরন আড়িয়াল বিল। এই জবাব গ্রহণ যোগ্য তবে তা সুন্দর বন ধ্বংস করে কখনওই না।

কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কারণে ঘটে উল্লেখযোগ্য নেতিবাচক প্রভাব : ক. নির্গত কার্বন ও ছাইভস্মে আশপাশের বায়ু ও পানিপ্রবাহ দূষণ; খ. নির্গত গ্যাসে বিদ্যমান ভারী ধাতু, সালফার ও নাইট্রোজেন অক্সাইড ছড়িয়ে পড়ায় বিস্তীর্ণ এলাকার বায়ুদূষণ এবং গ, বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বর্জ্য পানি দ্বারা আশপাশের জলাশয়ের পানিদূষণ। তাই বিভিন্ন দেশে বন্য প্রাণী রক্ষিত এলাকায় বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন নিষিদ্ধ।

সরকার ভারতের সাথে চুক্তি সাক্ষর করেছে কিন্তু ভারত নিজেই ‘ওয়াইল্ড লাইফ প্রটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৭২’ অনুযায়ী, বিদ্যুৎকেন্দ্রের ১৫ কিলোমিটার ব্যাসার্ধের মধ্যে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের অনুমোদন দেয় নাই মেঘালয়ে, তাহলে রামপালে কেন?

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত টাইমস ম্যাগাজিনে ২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৫ এর অনলাইন সংস্করণে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে টেক্সাসের ফায়েটে ১৯৭৯ সালের নির্মিত একটি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে প্রতিবছর গড়ে ৩০ হাজার টন সালফার- ডাই- অক্সাইড নিঃসরণ ঘটছে, যার প্রভাবে আশ পাশের এলাকার গাছপালা মার যাচ্ছে, আর রামপাল কেন্দ্র থেকে প্রতি বছর ৫২ হাজার টন সালফার- ডাই- অক্সাইড নিঃসরণ ঘটবে। এর পাশাপাশি ১৩ হাজার টন কয়লা পুড়বে জাতে ছাই জম্বে ১ হাজার ৬০০ টন, নাইট্রাস অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, পারদ, সিসা, আর্সেনিকসহ নানা ক্ষতিকর উপাদান নির্গত হবে, যার প্রভাব কি ভয়াবহ হবে!আর এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রচুর ব্যয় সাপেক্ষ।

সরকার বলছে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যাবহার করে এই সমস্যা সমাধান করা হবে, কিন্তু বাস্তবে মাত্র ১০০ মেঃ ওয়াট বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সমস্যা মোকাবেলা করতে হিমশিম খায়, সেখানে কি করে এই বিশাল ঝুঁকি মোকাবেলা করবে তা বাস্তবসম্মত না। সুন্দরবন ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় রামসার ও ইউনেসকো উভয় কর্তৃপক্ষই ২০১২ সালে সরকারের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল।

এ উদ্বেগ আমলে নেওয়া হয়নি, এমন অভিযোগ উঠেছে। সে সময় এ প্রকল্পের ওপর প্রদত্ত মতামতে পরিবেশ অধিদপ্তর সরকারকে বলেছে, রামসার এলাকায় সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের ওপর এ প্রকল্পের সম্ভাব্য ক্ষতিকারক প্রভাবের ব্যাপারে তারা উদ্বিগ্ন। বন বিভাগও আপত্তি জানিয়ে ছিল।

২০১১ সালে প্রদত্ত পত্রে প্রধান বন সংরক্ষক সরকারকে বলেছেন, এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপিত হলে সুন্দরবনের বাঘ তথা জীববৈচিত্র্য হুমকির সম্মুখীন হবে। তাই এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার প্রস্তাব দেন। ইউনেসকো ওই প্রকল্পের ‘ইআইএ’ প্রতিবেদন খতিয়ে দেখেছে এবং বেশ কিছু ঘাটতি চিহ্নিত করেছে।

এ প্রকল্পের ব্যাপারে পরিবেশ অধিদপ্তর উদ্বেগ প্রকাশ করলেও পরিশেষে ৫৯টি আরোপিত শর্ত প্রতিপালন সাপেক্ষে ‘ইআইএ’ অনুমোদন করেছে। কিন্তু এই ৫৯ টি আরোপিত শর্ত কতোটুকু বাস্তবায়িত হবে তা নিয়ে বিরাট সংশয় ও উদ্বিগ্ন কাজ করছে জন মনে। ভারতের সাথে করা এই চুক্তি নিয়েও আছে অনেক প্রশ্ন, এই প্রকল্পের মোট ব্যয়ের ৭০% আসবে বিদেশী ঋণ থেকে, ১৫% দিবে বাংলাদেশ, ১৫% দিবে ভারত। অর্থাৎ মাত্র ১৫% ব্যয় নির্বাহ করে ভারতের ৫০% মালিকানার দাবী করা কতটা যুক্তি সাপেক্ষ।

সার্বিক পর্যালোচনায় প্রতীয়মান যে রামপালের বিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য বিরাট হুমকির এবং সরকারের অবস্থান সত্য সাপেক্ষ না। কিন্তু আমাদের দেশের বিকাশের জন্য বিদ্যুৎ দরকার, তাহলে কিভাবে আসবে এই বিদ্যুৎ? কোথায় হবে এই কেন্দ্র? আর তা হবেইবা কিভাবে? এই প্রশ্ন গুলো সমাধান খুঁজতে হবে সবাইকে নিয়ে। সরকার জনগণ কে প্রতিপক্ষ না ভেবে মিত্র পক্ষ ভাবতে হবে, বিশ্বাস রাখতে হবে শত মতের সংঘাতে শত পুষ্পের জন্ম ঘোটতেই পারে। আলোচনার শুরু সরকারকেই করতে হবে। অন্যথায় দেশের সকল জনগণ আন্দোলনে সম্পৃক্ত হতে হবে, দেশের ৩৫ লক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকেদের কে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে কিছুটা বেড় হয়ে আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া উচিৎ।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এর মতো অকার্যকর বিরোধী দল গোটা পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া যাবে কিনা, তা আমার জানা নাই। সিঙ্গুর আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মমতার তৃণমূল কংগ্রেস পশ্চিম বঙ্গের ৩৪ বছরের বাম সকারের পতন ঘটাতে পারলে, বিএনপি কেন জনগণের দাবি নিয়ে আন্দোলন করে না, নেত্রীর বাড়ি উদ্ধার, নেতার মামলা প্রত্যাহারের জন্য যদি হরতাল হতে পারে, আন্দোলনের কর্মসূচি আসতে পারে, থাহলে রামপালের মতো অধিক জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে উদাসীনতা একটি রাজনৈতিক দলের কাছে কখনওই কাম্য হতে পারে না।


সুন্দরবন শুধু দেশের না গোটা পৃথিবীর সম্পদ। আর এর রক্ষার দায়িত্ব আমাদের সবার, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পৃথিবী আমাদেরকেই বিনির্মাণ করতে হবে। আর মাননীয় প্রধান মন্ত্রী যেমন সমুদ্র জয় ও এম ডি জি লক্ষ্য পূরণের জন্য বিশ্ববাসীর কাছে প্রশংসিত হয়েছেন, তেমনি সুন্দরবন কে যদি রক্ষা করতে ব্যর্থ হন তাহলে পৃথিবীবাসীর ধিক্কার কুড়োতে হবে। যা বাংলাদেশের জনগণ কখনওই প্রত্যাশা করে না, কারণ তারা যেমন সুন্দরবন আর বাংলাদেশকে ভালোবাসে তেমনি তাঁদের প্রধানমন্ত্রীকেও ভালোবাসে। তাই আমাদের বিশ্বাস মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রামপাল তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়টিকে রাজনৈতিক ভাবে নয়, বরং মানবিক গুরুত্বের বিবেচনা করে অতি দ্রুত সমস্যার সমাধান করবেন।

লেখক : গ্রাজুয়েট রিসার্চ সহকারী, উহান টেক্সটাইল ইউনিভার্সিটি,হুবেই, চায়না ও কলামিস্ট।

পাঠকের মতামত:

২৭ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test