E Paper Of Daily Bangla 71
World Vision
Technomedia Limited
Mobile Version

তিন টুকরো কাশ্মীর !

২০১৬ সেপ্টেম্বর ২০ ১৩:২৫:১৩
তিন টুকরো কাশ্মীর !

লেনিন :


ভারত-পাকিস্তান রাজনীতির এসিড টেস্ট হচ্ছে কাশ্মীর এবং বেলুচিস্তান। কাশ্মীর সমস্যা ভারত হ্যান্ডেল করে আমলাতন্ত্রের মাধ্যমে, অন্যদিকে পাকিস্তান বেলুচ সমস্যা হ্যান্ডেল করে সামরিক শক্তির মাধ্যমে।

কাশ্মীর ৩ ভাগে বিভক্ত। ভারতীয় অংশ “জম্মু-কাশ্মীর”, পাকিস্তানের অংশ “আজাদ কাশ্মীর” এবং চীনের দখলকৃত অংশ “আকসাই-চীন” নামে পরিচিত। বেশীরভাগ অধিকৃত অঞ্চলই ভারতের সাথে, প্রায় ৮৪ হাজার বর্গমাইল।

ভারতের সংবিধানের ১ নং ধারানুযায়ী কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং ৩৭০ নং ধারানুযায়ী "বিশেষ মর্যাদা" পায়। যার ফলে কাশ্মীর ভারতের বাকি ২৯ টা রাজ্যের মত নয়, এটি সরাসরি কেন্দ্র শাসিত।

সমস্যার সূত্রপাত হয় ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের সময়। তার আগে, ১৮৬৪ সালে ব্রিটিশ সরকার মাত্র ৭৫ লাখ টাকার বিনিময়ে "গলাব সিং" নামক এক হিন্দু জমিদারের নিকট কাশ্মীর বিক্রি করে দেন, "অমৃতসর চুক্তির" মাধ্যমে।

যখন ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগ হয়, তখন কাশ্মীরের শাসনকর্তা ছিলেন গলাব সিংয়ের বংশধর "হরি সিং"। হরি সিং হিন্দু রাজা হলেও তিনি প্রথমে কাশ্মীরের স্বশাসনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সহায়তায় কিছু উগ্র জঙ্গি গোষ্ঠী হিন্দু রাজার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে। তখন হরি সিং পরামর্শ নেন শেখ আবদুল্লাহর। শেখ আবদুল্লাহকে বলা হয় “শেরে কাশ্মীর শেখ আবদুল্লাহ”। শেখ আবদুল্লাহ কাশ্মীরিদের জাতীয় নেতা। শেখ আবদুল্লাহ প্রেক্ষাপট বিবেচনায় হরি সিংকে বুদ্ধি দেন পাকিস্তানের কুপ্রভাব থেকে বাঁচতে চাইলে ভারতের সাহায্য চাইতে।

হরি সিং তখন ভারতের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ভারত তখন শর্ত দেয়, কাশ্মীরকে ভারতের সাথে একীভূত করলেই কেবল ভারত সহায়তা করতে রাজি। অর্থাৎ ভারত আগে থেকেই হস্তক্ষেপ করে নি, একজন মুসলিম জাতীয়তাবাদী নেতা “শেখ আবদুল্লাহর” পরামর্শে ভারত কাশ্মীর উপাত্যকায় হস্তক্ষেপ করে।

মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা "শেখ আবদুল্লাহ" পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে চান নি, কারণ তিনি ভালো করেই জানতেন পাকিস্তানীরা শুয়োরের ঔরসজাত। তাই “শেখ আবদুল্লাহ” কাশ্মীরকে রক্ষার জন্য তাঁর বন্ধু “জহরলাল নেহরুর” সাহায্য প্রার্থনা করে ভারতের সাথে যোগ দেন।

এখনো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মীরীরা ভারতের সাথে থাকার পক্ষে। তাঁর প্রমাণ সর্বশেষ নির্বাচন। নির্বাচনে জয় পাওয়া কাশ্মীর উপত্যকার রাজনৈতিক দল “পিডিপি” জোট গঠন করে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি’র সাথে। মুখ্য মন্ত্রী হন “মেহবুবা মুফতি”। যিনি জম্মু-কাশ্মীরের ইতিহাসে প্রথম মহিলা মুখ্য মন্ত্রী। একজন নারীকে সমর্থন দেয় কট্টর হিন্দুত্ববাদী মোদীর দল বিজেপি। বর্তমান সংঘাতে “পিডিপি” কিংবা “শেখ আবদুল্লাহর” দল জড়িত না, তারা বরাবরই ভারতের সাথে থাকার পক্ষে, তবে অধিকতর স্বায়ত্তশাসনের পক্ষে।

কাশ্মীরের বাস্তববাদী রাজনৈতিক দল এবং জনগণ ভারতের সাথে থাকার পক্ষে তাঁর মূল কারণ হল -ভারতের অংশের কাশ্মীর ৩ ভাগে বিভক্ত – জম্মু, কাশ্মীর এবং লাদাখ। জম্মু হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল, কাশ্মীর মুসলিম অধ্যুষিত এবং লাদাখ বৌদ্ধ অধ্যুষিত। সমীকরণটা খুবই জটিল। আর এটাই ভারতের জন্য প্লাস পয়েন্ট।

পাকিস্তান অংশ সম্পুর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত কিন্তু ভারতীয় অংশ মুসলিম-হিন্দু-বৌদ্ধ অধ্যুষিত। মুসলমানদের অনেকেই ভারতের সাথে থাকার পক্ষে, সাথে আছে বৌদ্ধ এবং হিন্দু অধ্যুষিত লাদাখ, জম্মু। তাই ভারতীয় অংশের কাশ্মীর বিভক্তি খুবই জটিল বিষয়। যদি সেটা পাকিস্তানের মত এক তরফা মুসলিম অধ্যুষিত হতো তাহলে কাশ্মীর অনেক আগেই স্বাধীন হয়ে যেত, কিন্তু জনসংখ্যার বৈচিত্র্যের কারণে এটা কখনো আর সম্ভব হবে না। তাই যারা হ্যাশট্যাগ দিয়ে কাশ্মীরের স্বাধীনতা চাচ্ছেন তা বাস্তবতা বিবর্জিত, কাশ্মীরের সর্বোচ্চ নেতা “শেরে শেখ আবদুল্লাহ” নিজেই ভারতের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত নিছেন, ভারত জোর করে নাই।

অপরদিকে বেলুচিস্তান ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় পাকিস্তানের অংশ ছিল না। পাকিরা ১৯৪৮ সালে জোর করে বেলুচিস্তান দখল করে। তখন থেকেই বেলুচরা স্বাধীন বেলুচিস্তানের দাবিতে সংগ্রাম করে যাচ্ছে।

পাকিস্তানের মোট আয়তনের ৪৪-৪৮% হচ্ছে বেলুচিস্তান। অর্থাৎ এই মুহুর্তে কোন দেশ যদি পাকিস্তান আক্রমণ করে তাহলে ৪৮% বেলুচরাও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করবে। শুধুমাত্র এই কারণে পাকিস্তান-ভারত ৪ টা যুদ্ধে পাকিস্তান গো-হারা হারছে ভারতের কাছে।কারণ পাকিরা জাতিগত ভাবে চরমভাবে বিভক্ত। দেশের ৪৮% বেলুচ ভূখণ্ডই নিজেদের পাকিস্তানী বলে স্বীকার করে না, নিজেদের “বেলুচ জাতি” দাবি করে।

কৌশলগত কারণে বেলুচিস্তান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বেলুচিস্তানের সাথে ইরান এবং আফগানিস্তানের সীমান্ত আছে। বেলুচদের একটা অংশ ইরানের সাথেও আছে। বেলুচদের নিজস্ব সমুদ্র বন্দর আছে, আরব সাগরের পাড়ে অবস্থিত, আছে প্রচুর খনিজ সম্পদ। পাকিস্তানের ৮০ শতাংশ খনিজ সম্পদ যোগান হয় বেলুচিস্তান থেকে। বিখ্যাত সমুদ্র বন্দর “গোয়াদার” বেলুচিস্তানে অবস্থিত। গোয়াদার বন্দর দিয়ে সারা বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে সক্ষম বেলুচিস্তান।

বেলুচিস্তানের পাশেই অবস্থিত ইরান এবং আফগানিস্তান। সব চেয়ে বেশি শিয়া ধর্মাবলম্বী বাস করে ইরানে। বেলুচদের একটা অংশও শিয়া ধর্মাবলম্বী। অন্যদিকে, পাকিস্তানের সৌদি ঘেঁষা নীতির কারণে শিয়া অধ্যুষিত ইরানের সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক প্রায় তলানিতে। অপরদিকে, পাকিস্তান পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম শিয়া ধর্মাবলম্বীর দেশ, তাই পাকিস্তানও ইরানকে ক্ষ্যাপাতে চায় না। তার মূল কারণ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অনেক শিয়া ধর্মাবলম্বী অফিসার আছে, আবার ইরান চাইলে সীমান্ত দিয়ে বেলুচদের অস্ত্র দিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করাতে পারে। এতে ইরানের লাভ হচ্ছে পাকিস্তানকে সৌদি ঘেঁষা নীতি থেকে বের করে আনা, আর বেলুচদের লাভ তাঁদের দীর্ঘদিনের স্বাধীনতার দাবির পরিপূর্ণতা।

এদিক থেকে বেলুচিস্তান এবং কাশ্মীরের বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। কাশ্মীরের জনগণ সজ্ঞানে ভারতের সংবিধানের বিশেষ সুবিধা ভোগ করে, বিজেপির সাথে জোট করে ক্ষমতা ভোগ করে, চাকরি বাকরিতে সুবিধা পায়, দেশের মূলধারার রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত। অপরদিকে, পাকিরা বেলুচদের শোষণ করে, গ্যাস, তেল লুট করে। “গোয়াদার” সমুদ্র বন্দর অন্য দেশের হাতে তুলে দেয়। শিক্ষা দীক্ষা চাকরি বাকরি থেকে বঞ্চিত রাখে। নারীদের গাড়িতে তুলে নিয়ে যায় তারপর ক্যান্টনমেন্টে পাকি শুয়োরের বাচ্ছারা ধর্ষণ করে।

কাশ্মীর সমস্যার সহজ সমাধান ভারতের হাতে আছে, সেটা হচ্ছে অধিকতর স্বায়ত্তশাসন। কিন্তু বেলুচ সমস্যার সমাধান পাকিস্তানের হাত নেই। তাঁর মূল কারণ ভারতে গণতান্ত্রিক সরকার বিদ্যমান, অপরদিকে পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর কথাই শেষ কথা। একটা গণতান্ত্রিক সরকারের এপ্রোচ এবং সামরিক সরকারের এপ্রোচ কখনো এক হবে না। পাকিরা ৭১ সালে বাঙালিদের উপর গণহত্যা চালায় তার ফলাফল আজকে স্বাধীন বাংলাদেশ। ইতিহাস থেকে এখনো শিক্ষা নেওয়া তো দূরের কথা, উল্টো দিনের পর দিন বেলুচদের উপর পাকিদের অত্যাচার বেড়েই চলছে। তাই বেলুচদের এই আন্দোলন দশকের পর দশক জ্বলবে।

আবার, ভৌগলিকভাবে কাশ্মীরের অবস্থান খুবই দুর্গম। পুরোটাই "ল্যান্ড লকড" বা ভূমি বেষ্টিত, বের হওয়ার কোন জায়গা নেই! ব্যবসা-বাণিজ্য, আমদানি-রফতানি, খাওয়া-দাওয়া সব কিছুর জন্য আল্টিমেটলি সেই ভারতের উপরই নির্ভরশীল থাকতে হবে। কিন্তু বেলুচিস্তান "ল্যান্ড লকড" বা ভূমি বেষ্টিত না। বেলুচিস্তান আরব সাগরের তীরে অবস্থিত, সমুদ্র বন্দরের সুবিধা আছে, কোন দেশের উপর নির্ভরশীল হওয়ার প্রয়োজন নেই।নিজেরাই স্বাধীনভাবে সকল কর্মকান্ড চালিয়ে নিতে পারবে...

বেলুচদের আন্দোলন হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের আন্দোলন যারা মারখোর পাকিদের কাছ থেকে আলাদা হতে চায়, অন্যদিকে কাশ্মীর আন্দোলন হচ্ছে তাদের আন্দোলন যারা ৭১ সালে ধর্মের মিল থাকার পরেও বাঙালি নারীদের ধর্ষণ করেছে, খুন করেছে তাদের আন্দোলন। সংখ্যায় তারা গুটিকয়েক।বিশ্বাস হচ্ছে না?

আসুন নিজে করি, তাহলে বিশ্বাস হবে!

বেলুচিস্তান মুসলিম অধ্যুষিত হওয়ার পরেও কেন মুসলিম দেশ পাকিস্তানের সাথে থাকতে চাচ্ছে না? অন্যদিকে, কাশ্মীরের ৫৩% মুসলমান(বাকিরা হিন্দু এবং বৌদ্ধ) এবং তাঁদের জাতীয়তাবাদী নেতা “শেখ আবদুল্লাহ” ভারতের সাথে থাকার সিদ্ধান্ত কেন নিয়েছিলেন? এই দুই প্রশ্নের সমাধান করতে পারলেই বুঝতে পারবেন “কাশ্মীর” এবং “বেলুচ” সমস্যা এক না

লেখক : মুক্তচিন্তক।

(ওএস/অ/সেপ্টেম্বর ২০, ২০১৬)

পাঠকের মতামত:

১৯ এপ্রিল ২০২৪

এ পাতার আরও সংবাদ

উপরে
Website Security Test